তুমি কেন, ভাই, বিমুখ এমন—
নয়নে কঠোর হাসি।
দূর হতে যেন ফুঁষিছ সবেগে
উপেক্ষা রাশি রাশি—
কঠিন বচন ঝরিছে অধরে
উপহাস হলাহলে,
লেখনীর মুখে করিতে দগ্ধ
ঘৃণার অনল জ্বলে।
ভালোবেসে যাহা ফুটেছে পরানে,
সবার লাগিবে ভালো,
যে জ্যোতি হরিছে আমার আঁধার
সবারে দিবে সে আলো—
অন্তরমাঝে সবাই সমান,
বাহিরে প্রভেদ ভবে,
একের বেদনা করুণাপ্রবাহে
সান্ত্বনা দিবে সবে।
এই মনে করে ভালোবেসে আমি
দিয়েছিনু উপহার—
ভালো নাহি লাগে ফেলে যাবে চলে,
কিসের ভাবনা তার!
তোমার দেবার যদি কিছু থাকে
তুমিও দাও-না এনে।
প্রেম দিলে সবে নিকটে আসিবে
তোমারে আপন জেনে।
কিন্তু জানিয়ো আলোক কখনো
থাকে না তো ছায়া বিনা,
ঘৃণার টানেও কেহ বা আসিবে,
তুমি করিয়ো না ঘৃণা!
এতই কোমল মানবের মন
এমনি পরের বশ,
নিষ্ঠুর বাণে সে প্রাণ ব্যথিতে
কিছুই নাহিক যশ।
তীক্ষ্ম হাসিতে বাহিরে শোণিত,
বচনে অশ্রু উঠে,
নয়নকোণের চাহনি-ছুরিতে
মর্মতন্তু টুটে।
সান্ত্বনা দেওয়া নহে তো সহজ,
দিতে হয় সারা প্রাণ,
মানবমনের অনল নিভাতে
আপনারে বলিদান।
ঘৃণা জ্বলে মরে আপনার বিষে,
রহে না সে চিরদিন—
অমর হইতে চাহ যদি, জেনো
প্রেম সে মরণহীন।
তুমিও রবে না, আমিও রবনা,
দু দিনের দেখা ভবে—
প্রাণ খুলে প্রেম দিতে পারো যদি
তাহা চিরদিন রবে।
দুর্বল মোরা, কত ভুল করি,
অপূর্ণ সব কাজ।
নেহারি আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতা
আপনি যে পাই লাজ।
তা বলে যা পারি তাও করিব না?
নিষ্ফল হব ভবে?
প্রেমফুল ফোটে, ছোটো হল বলে
দিব না কি তাহা সবে?
হয়তো এ ফুল সুন্দর নয়,
ধরেছি সবার আগে—
চলিতে চলিতে আঁখির পলকে
ভুলে কারো ভালো লাগে।
যদি ভুল হয় ক’দিনের ভুল!
দু’ দিনে ভাঙিবে তবে।
তোমার এমন শাণিত বচন
সেই কি অমর হবে?
নিভৃত আশ্রম
সন্ধ্যায় একেলা বসি বিজন ভবনে
অনুপম জ্যোতির্ময়ী মাধুরীমুরতি
স্থাপনা করিব যত্নে হৃদয়-আসনে।
প্রেমের প্রদীপ লয়ে করিব আরতি।
রাখিব দুয়ার রুধি আপনার মনে,
তাহার আলোকে রব আপন ছায়ায়—
পাছে কেহ কুতূহলে কৌতুকনয়নে
হৃদয়দুয়ারে এসে দেখে হেসে যায়।
ভ্রমর যেমন থাকে কমলশয়নে,
সৌরভসদনে, কারো পথ নাহি চায়,
পদশব্দ নাহি গণে, কথা নাহি শোনে,
তেমনি হইব মগ্ন পবিত্র মায়ায়।
লোকালয়-মাঝে থাকি রব তপোবনে,
একেলা থেকেও তবু রব সাথি-সনে।
নিষ্ঠুর সৃষ্টি
মনে হয় সৃষ্টি বুঝি বাঁধা নাই নিয়মনিগড়ে,
আনাগোনা মেলামেশা সবই অন্ধ দৈবের ঘটনা।
এই ভাঙে, এই গড়ে,
এই উঠে, এই পড়ে—
কেহ নাহি চেয়ে দেখে কার কোথা বাজিছে বেদনা।
মনে হয়, যেন ওই অবারিত শূন্যতলপথে
অকস্মাৎ আসিয়াছে সৃজনের বন্যা ভয়ানক—
অজ্ঞাত শিখর হতে
সহসা প্রচণ্ড স্রোতে
ছুটে আসে সূর্য চন্দ্র, ধেয়ে আসে লক্ষ কোটি লোক।
কোথাও পড়েছে আলো, কোথাও বা অন্ধকার নিশি,
কোথাও সফেন শুভ্র, কোথাও বা আবর্ত আবিল,
সৃজনে প্রলয়ে মিশি
আক্রমিছে দশ দিশি—
অনন্ত প্রশান্ত শূন্য তরঙ্গিয়া করিছে ফেনিল।
মোরা শুধু খড়কুটো স্রোতোমুখে চলিয়াছি ছুটি,
অর্ধ পলকের তরে কোথাও দাঁড়াতে নাহি ঠাঁই।
এই ডুবি, এই উঠি,
ঘুরে ঘুরে পড়ি লুটি—
এই যারা কাছে আসে এই তারা কাছাকাছি নাই।
সৃষ্টিস্রোত-কোলাহলে বিলাপ শুনিবে কে বা কার,
আপন গর্জনে বিশ্ব আপনারে করেছে বধির।
শতকোটি হাহাকার
কলধ্বনি রচে তার—
পিছু ফিরে চাহিবার কাল নাই, চলেছে অধীর।
হায় স্নেহ, হায় প্রেম, হায় তুই মানবহৃদয়,
খসিয়া পড়িলি কোন্ নন্দনের তটতরু হতে?
যার লাগি সদা ভয়,
পরশ নাহিক সয়,
কে তারে ভাসালে হেন জড়ময় সৃজনের স্রোতে?
তুমি কি শুনিছ বসি হে বিধাতা, হে অনাদি কবি,
ক্ষুদ্র এ মানবশিশু রচিতেছে প্রলাপজল্পনা?
সত্য আছে স্তব্ধ ছবি
যেমন উষার রবি,
নিম্নে তারি ভাঙে গড়ে মিথ্যা যত কুহককল্পনা।
নিষ্ফল কামনা
বৃথা এ ক্রন্দন!
বৃথা এ অনল-ভরা দুরন্ত বাসনা!
রবি অস্ত যায়।
অরণ্যেতে অন্ধকার আকাশেতে আলো।
সন্ধ্যা নত-আঁখি
ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে।
বহে কি না বহে
বিদায়বিষাদশ্রান্ত সন্ধ্যার বাতাস।
দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে
চেয়ে আছি দুটি আঁখি-মাঝে।
খুঁজিতেছি, কোথা তুমি,
কোথা তুমি।
যে অমৃত লুকানো তোমায়
সে কোথায়।
অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে
বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন
স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম,
ওই নয়নের
নিবিড় তিমির তলে, কাঁপিছে তেমনি
আত্মার রহস্য-শিখা।
তাই চেয়ে আছি।
প্রাণ মন সব লয়ে তাই ডুবিতেছি
অতল আকাঙ্ক্ষা-পারাবারে।
তোমার আঁখির মাঝে,
হাসির আড়ালে,
বচনের সুধাস্রোতে,
তোমার বদনব্যাপী
করুণ শান্তির তলে
তোমারে কোথায় পাব—
তাই এ ক্রন্দন।
বৃথা এ ক্রন্দন।
হায় রে দুরাশা,
এ রহস্য এ আনন্দ তোর তরে নয়।
যাহা পাস তাই ভালো,
হাসিটুকু, কথাটুকু,
নয়নের দৃষ্টিটুকু,
প্রেমের আভাস।
সমগ্র মানব তুই পেতে চাস,
এ কী দুঃসাহস!
কী আছে বা তোর,
কী পারিবি দিতে!
আছে কি অনন্ত প্রেম?
পারিবি মিটাতে
জীবনের অনন্ত অভাব?
মহাকাশ-ভরা
এ অসীম জগৎ-জনতা,
এ নিবিড় আলো অন্ধকার,
কোটি ছায়াপথ, মায়াপথ,
দুর্গম উদয়-অস্তাচল,
এরই মাঝে পথ করি
পারিবি কি নিয়ে যেতে
চিরসহচরে
চিররাত্রিদিন
একা অসহায়?
যে জন আপনি ভীত, কাতর, দুর্বল,
ম্লান, ক্ষুধাতৃষাতুর, অন্ধ, দিশাহারা,
আপন হৃদয়ভারে পীড়িত জর্জর,
সে কাহারে পেতে চায় চিরদিন-তরে?