হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে
হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে, কণ্ঠে শুখাওল মালা।
বিরহবিষে দহি বহি গল রয়নী, নহি নহি আওল কালা॥
বুঝনু বুঝনু, সখি, বিফল বিফল সব, বিফল এ পীরিতি লেহা।
বিফল রে অ মঝু জীবন যৌবন, বিফল রে এ মঝু দেহা॥
চল সখি, গৃহ চল, মুঞ্চ নয়নজল— চল সখি চল গৃহকাজে।
মলতিমাল রাখহ বালা— ছি ছি সখি, মরু মরু লাজে।
সখি লো, দারুণ আধিভরাতুর এ তরুন যৌবন মোর।
সখি লো, দারুণ প্রণয়হলাহল জীবন করল অঘোর॥
তৃষিত প্রাণ মম দিবসযামিনী শ্যামক দরশন আশে।
আকুল জীবন থেহ ন মানে, অহরহ জ্বলত হুতাশে।
সজনি, সত্য কহি তোয়,
খোয়ব কব হম শ্যামক প্রেম সদা ডর লাগে মোয়॥
হিয়ে হিয়ে অব রাখত মাধব, সো দিন আসব সখি রে—
বাত ন বোলবে, বদন ন হেরবে! মরিব হলাহল ভখি রে।
ঐস বৃথা ভয় না কর বালা ভানু নিবেদয় চরণে—
সুজনক পীরিতি নৌতন নিতি নিতি, নাহি টুটে জীবনমরণে॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
০১. উৎসর্গ ও সূচনা (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী)
উৎসর্গ
ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার
অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই।
আজ ছাপাইছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।
সূচনা
অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় পর্যায়ক্রমে বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশের কাজে যখন নিযুক্ত হয়েছিলেন আমার বয়স তখন যথেষ্ট অল্প। সময়নির্ণয় সম্বন্ধে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা তখনো ছিল, এখনো আছে। সেই কারণে চিঠিতে আমার তারিখকে যাঁরা ঐতিহাসিক বলে ধরে নেন তাঁরা প্রায়ই ঠকেন। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের কাল অনুমান করা অনেকটা সহজ। বোম্বাইয়ে মেজদাদার কাছে যখন গিয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোলোর কাছাকাছি, বিলাতে যখন গিয়াছি তখন আমার বয়স সতেরো। নূতন-প্রকাশিত পদাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, সে আরো কিছুকাল পূর্বের কথা। ধরে নেওযা যাক, তখন আমি চোদ্দয় পা দিয়েছি। খন্ড খন্ড পদাবলীর প্রকাশ্যে ভোগ করবার যোগ্যতা আমার তখন ছিল না। অথচ আমাদের বাড়িতে আমিই একমাত্র তার পাঠক ছিলুম। দাদাদের ডেস্ক্ থেকে যখন সেগুলি অন্তর্ধান করত তখন তারা তা লক্ষ্য করতেন না। পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হোত আমার কৌতুহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে। শব্দতত্ত্বে আমার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক। টীকায় যে শব্দার্থ দেওয়া হয়েছিল তা আমি নির্বিচারে ধরে নিই নি। এক শব্দ যতবার পেয়েছি তার সমুচ্চয় তৈরি করে যাচ্ছিলুম। একটি ভালো বাঁধানো খাতা শব্দে ভরে উঠেছিল। তুলনা করে আমি অর্থ নির্ণয় করেছি। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ যখন বিদ্যাপতির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হলেন তখন আমার খাতা তিনি সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই খাতা তাঁর ও তাঁর উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারি নি। যদি ফিরে পেতুম তা হলে দেখাতে পারতুম কোথাও কোথাও যেখানে তিনি নিজের ইচ্ছামত মানে করেছেন ভুল করেছেন। এটা আমার নিজের মত। তার পরের সোপানে ওঠা গেল পদাবলীর জালিয়াতিতে। অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলুম বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প। তাঁকে নকল করার লোভ হয়েছিল। এ কথা মনেই ছিল না যে, ঠিকমত নকল করতে হলেও শুধু ভাষায় নয়, ভাবে খাঁটি হওয়া চাই। নইলে কথার গাঁথনিটা ঠিক হলেও সুরে তার ফাঁকি ধরা পরে। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণবচিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই। এইজন্যে ভানুসিংহের পদাবলী বহুকাল সংকোচের সাথে বহন করে এসেছি। একে সাহিত্যের একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত বলেই গণ্য করি। প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা স্লেটের উপরে, অন্তপুরের কোণের ঘরে––
গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে।
মনে বিশ্বাস হল চ্যাটার্টনের চেয়ে পিছিয়ে থাকব না। এ কথা বলে রাখি ভানুসিংহের পদাবলী ছোটো বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড়ো বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা। তাদের মধ্যে ভালোমন্দ সমান দরের নয়।
শান্তিনিকেতন
১১|৭|৪০