সখি রে, পিরীত বুঝবে কে
সখি রে, পিরীত বুঝবে কে!
আঁধার হৃদয়ক দুঃখকাহিনী বোলব, শুনবে কে।
রাধিকার অতি অন্তরবেদন কে বুঝবে অযি সজনি।
কে বুঝবে, সখি, রোয়ত রাধা কোন দুখে দিনরজনী।
কলঙ্ক রাটায়ব জনি, সখি, রটাও— কলঙ্ক নাহিক মানি,
সকল তয়গব লভিতে শ্যামক একঠো আদরবাণী।
মিনতি করি লো সখি, শত শত বার, তু শ্যামকো না দিহ গারি—
শীল মান কুল অপনি, সজনি, হম চরণে দেযনু ডারি।
সখি লো, বৃন্দাবনকো দুরুজন মানুখ পিরীত নাহিক জানে,
বৃথাই নিন্দা কাহ রটায়ত হমার শ্যামক নামে।
কলঙ্কিনি হম রাধা, সখি লো, ঘৃণা করহ জনি মনমে।
ন আসিও তব্ কবহুঁ, সজনি লো, হমার অঁধা ভবনমে।
কহে ভানু অব, বুঝবে না, সখি কোহি মরমকো বাত—
বিরলে শ্যামক কহিও বেদন বক্ষে রাখৈ মাথ॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব
সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব মথুরাপুর যব যায়
করল বিষম পণ মানিনী রাধা রোয়বে না সো, না দিবে বাধা,
কঠিন‐হিয়া সই হাসয়ি হাসয়ি শ্যামক করব বিদায়।
মৃদু মৃদু গমনে আওল মাধা, বয়ন‐পান তছু চাহল রাধা,
চাহয়ি রহল স চাহয়ি রহল— দণ্ড দণ্ড, সখি, চাহয়ি রহল—
মন্দ মন্দ, সখি— নয়নে বহল বিন্দু বিন্দু জলধার।
মৃদু মৃদু হাসে বৈঠল পাশে, কহল শ্যাম কত মৃদু মধু ভাষে।
টুটয়ি গইল পণ, টুটইল মান, গদগদ আকুল ব্যাকুল প্রাণ,
ফুকরয়ি উছসয়ি কাঁদিল রাধা— গদগদ ভাষ নিকাশল আধা—
শ্যামক চরণে বাহু পসারি কহল, শ্যাম রে, শ্যাম হমারি,
রহ তুঁহু, রহ তুঁহু, বঁধু গো রহ তুঁহু, অনুখন সাথ সাথ রে রহ পঁহু—
তুঁহু বিনে মাধব, বল্লভ, বান্ধব, আছয় কোন হমার!
পড়ল ভূমি‐’পর শ্যামচরণ ধরি, রাখল মুখ তছু শ্যামচরণ‐’পরি,
উছসি উছসি কত কাঁদয়ি কাঁদয়ি রজনি করল প্রভাত।
মাধব বৈসল, মৃদু মধু হাসল
কত অশোয়াস‐বচন মিঠ ভাষল, ধরইল বালিক হাত।
সখি লো, সখি লো, বোল ত সখি লো, যত দুখ পাওল রাধা,
নিঠুর শ্যাম কিয়ে আপন মনমে পাওল তছু কছু আধা।
হাসয়ি হাসয়ি নিকটে আসয়ি বহুত স প্রবোধ দেল,
হাসয়ি হাসয়ি পলটয়ি চাহয়ি দূর দূর চলি গেল।
অব সো মথুরাপুরক পন্থমে ইঁহ যব রোয়ত রাধা।
মরমে কি লাগল তিলভর বেদন, চরণে কি তিলভর বাধা।
বরখি আঁখিজল ভানু কহে, অতি দুখের জীবন ভাই।
হাসিবার তর সঙ্গ মিলে বহু কাঁদিবার কো নাই।।
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
সজনি সজনি রাধিকা লো
সজনি সজনি রাধিকা লো, দেখ অবহুঁ চাহিয়া
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে মৃদুল গান গাহিয়া॥
পিনহ ঝটিত কুসুমহার, পিনহ নীল আঙিয়া।
সুন্দর সিন্দুর দেকে সীঁথি করহ রাঙিয়া॥
সহচরি সব নাচ নাচ মিলনগীত গাও রে,
চঞ্চল মঞ্জরীরাব কুঞ্জগগনে ছাও রে।
সজনি, অব উজার’ মঁদির কনকদীপ জ্বালিয়া,
সুরভি করহ কুঞ্জভবন গন্ধসলিল ঢালিয়া॥
মল্লিকা চমেলি বেলি কুসুম তুলহ বালিকা,
গাঁথ যূথি, গাঁথ জাতি, গাঁথ বকুলমালিক;
তৃষিতনয়ন ভানুসিংহ কুঞ্জপথ চাহিয়া—
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে মৃদুল গান গাহিয়া॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
সতিমির রজনি, সচকিত সজনী
সতিমির রজনি, সচকিত সজনী, শূন্য নিকুঞ্জ‐অরণ্য।
কলয়িত মলয়ে, সুবিজন নিলয়ে বালা বিরহবিষণ্ণ॥
নীল আকাশে তারক ভাসে, যমুনা গাওত গান।
পাদপ‐মরমর, নির্ঝর‐ঝরঝর, কুসুমিত বল্লিবিতান।
তৃষিত নয়ানে বনপথপানে নিরখে ব্যাকুল বালা—
দেখ ন পাওয়ে, আঁখ ফিরাওয়ে, গাঁথে বনফুলমালা!
সহসা রাধা চাহল সচকিত, দূরে খেপল মালা—
কহল, সজনি, শুন বাঁশরি বাজে, কুঞ্জে আওল কালা।
চমকি গহন নিশি দূর দূর দিশি বাজত বাঁশি সুতানে—
কণ্ঠ মিলাওল ঢলঢল যমুনা কলকল কল্লোলগানে।
ভনে ভানু— অব শুন গো কানু, পিয়াসিত গোপিনিপ্রাণ
তোঁহার পীরিত বিমল অমৃতরস হরষে করবে পান॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
হম যব না রব, সজনী
হম যব না রব, সজনী,
নিভৃত বসন্তনিকুঞ্জবিতানে আসবে নির্মল রজনী—
মিলনপিপাসিত আসবে যব, সখি, শ্যাম হমারি আশে,
ফুকারবে যব ‘রাধা রাধা’ মুরলি ঊরধ শ্বাসে,
যব সব গোপিনী আসবে ছুটই যব হম আওব না,
যব সব গোপিনী জাগবে চমকই যব হম জাগব না,
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে হেরবে আকুল শ্যাম।
বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে ‘রাধা রাধা’ নাম।
না যমুনা, সো এক শ্যাম মম, শ্যামক শত শত নারী—
হম যব যাওব শত শত রাধা চরণে রহবে তারি।
তব্ সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে, কাহে তয়াগব দে।
হমারি লাগি এ বৃন্দাবনমে কহ, সখি, রোয়ব কে।
ভানু কহে চুপি, মানভরে রহে, আও বনে ব্রজনারী—
মিলবে শ্যামক থরথর আদর, ঝরঝর লোচনবারি॥
১২৮৮ শ্রাবণ– আনুমানিক ১২৯২
হম, সখি, দারিদ নারী
হম, সখি, দারিদ নারী।
জনম অবধি হম পীরিতি করনু, মোচনু লোচনবারি।
রূপ নাহি মম, কছুই নাহি গুণ, দুখিনী আহির জাতি—
নাহি জানি কছু বিলাস‐ভঙ্গিম যৌবনগরবে মাতি—
অবলা রমণী, ক্ষুদ্র হৃদয় ভরি পীরিত করনে জানি।
এক নিমিখ পল নিরখি শ্যাম জনি, সোই বহুত করি মানি।
কুঞ্জপথে যব নিরখি সজনি হম শ্যামক চরণক চীনা
শত শত বেরি ধূলি চুম্বি সখি, রতন পাই জনু দীনা
নিঠুর বিধাতা, এ দুখজনমে, মাঙব কি তুয়া‐পাশ।
জনম‐অভাগী উপেখিতা হম বহুত নাহি করি আশ—
দূর থাকি হম রূপ হেরইব, দূরে শুনইব বাঁশি,
দূর দূর রহি সুখে নিরখিব শ্যামক মোহন হাসি।
শ্যামপ্রেয়সি রাধা! সখি লো! থাক’ সুখে চিরদিন—
তুয় সুখে হম রোয়ব না সখি, অভাগিনী গুণহীন।
আপন দুখে, সখি, হম রোয়ব লো, নিভৃতে মুছৈব বারি।
কোহি ন জানব, কোন বিষাদে, তন‐মন দহে হমারি।
ভানুসিংহ ভনয়ে, শুন কালা,
দুখিনি অবলা বালা—
উপেখার অতি ভিখিনি বাণে না দিহ না দিহ জ্বালা
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২