প্রার্থনাতীত দান
শিখের পক্ষে বেণীচ্ছেদন ধর্মপরিত্যাগের ন্যায় দূষণীয়
পাঠানেরা যবে বাঁধিয়া আনিল
বন্দী শিখের দল —
সুহিদ্গঞ্জ রক্তবরন
হইল ধরণীতল ।
নবাব কহিল , ‘ শুন তরুসিং ,
তোমারে ক্ষমিতে চাই ।’
তরুসিং কহে , ‘ মোরে কেন তব
এত অবহেলা ভাই ? ‘
নবাব কহিল , ‘ মহাবীর তুমি ,
তোমারে না করি ক্রোধ —
বেণীটি কাটিয়া দিয়ে যাও মোরে
এই শুধু অনুরোধ ।’
তরুসিং কহে , ‘ করুণা তোমার
হৃদয়ে রহিল গাঁথা —
যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব ,
বেণীর সঙ্গ মাথা ।
বন্দী বীর
পঞ্চনদীর তীরে
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে
জাগিয়া উঠেছে শিখ
নির্মম নির্ভীক ।
হাজার কণ্ঠে গুরুজির জয়
ধ্বনিয়া তুলেছে দিক্ ।
নূতন জাগিয়া শিখ
নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিখ ।
‘ অলখ নিরঞ্জন ‘
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
করে ভয়ভঞ্জন ।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
অসি বাজে ঝন্ঝন্ ।
পঞ্জাব আজি গরজি উঠিল ,
‘ অলখ নিরঞ্জন ! ‘
এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে
না রাখে কাহারো ঋণ ।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য ,
চিত্ত ভাবনাহীন ।
পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর
এসেছে সে এক দিন ।
দিল্লিপ্রাসাদকূটে
হোথা বারবার বাদশাজাদার
তন্দ্রা যেতেছে ছুটে ।
কাদের কণ্ঠে গগন মন্থ ,
নিবিড় নিশীথ টুটে —
কাদের মশালে আকাশের ভালে
আগুন উঠেছে ফুটে !
পঞ্চনদীর তীরে
ভক্তদেহের রক্তলহরী
মুক্ত হইল কি রে !
লক্ষ বক্ষ চিরে
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ পক্ষীসমান
ছুটে যেন নিজনীড়ে ।
বীরগণ জননীরে
রক্ততিলক ললাটে পরালো
পঞ্চনদীর তীরে ।
মোগল – শিখর রণে
মরণ – আলিঙ্গনে
কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি
দুইজনা দুইজনে ।
দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ
যুঝে ভুজঙ্গ – সনে ।
সেদিন কঠিন রণে
‘ জয় গুরুজির’ হাঁকে শিখ বীর
সুগভীর নি : স্বনে ।
মত্ত মোগল রক্তপাগল
‘ দীন্ দীন্’ গরজনে ।
গুরুদাসপুর গড়ে
বন্দা যখন বন্দী হইল
তুরানি সেনার করে ,
সিংহের মতো শৃঙ্খল গত
বাঁধি লয়ে গেল ধরে
দিল্লিনগর – ‘ পরে ।
বন্দা সমরে বন্দী হইল
গুরুদাসপুর গড়ে ।
সম্মুখে চলে মোগল – সৈন্য
উড়ায়ে পথের ধূলি ,
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া
বর্শাফলকে তুলি ।
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে ,
বাজে শৃঙ্খলগুলি ।
রাজপথ – ‘ পরে লোক নাহি ধরে ,
বাতায়ন যায় খুলি ।
শিখ গরজয় , ‘ গুরুজির জয় ‘
পরানের ভয় ভুলি ।
মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে
দিল্লিপথের ধূলি ।
পড়ি গেল কাড়াকাড়ি ,
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান
তারি লাগি তাড়াতাড়ি ।
দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে
বন্দীরা সারি সারি
‘ জয় গুরুজির’ কহি শত বীর
শত শির দেয় ডারি ।
সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ
নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি
বন্দার এক ছেলে ।
কহিল , ‘ ইহারে বধিতে হইবে
নিজহাতে অবহেলে ।’
দিল তার কোলে ফেলে
কিশোর কুমার , বাঁধা বাহু তার ,
বন্দার এক ছেলে ।
কিছু না কহিল বাণী ,
বন্দা সুধীরে ছোটো ছেলেটিরে
লইল বক্ষে টানি ।
ক্ষণকালতরে মাথার উপরে
রাখে দক্ষিণ পাণি ,
শুধু একবার চুম্বিল তার
রাঙা উষ্ণীষখানি ।
তার পরে ধীরে কটিবাস হতে
ছুরিকা খসায়ে আনি
বালকের মুখ চাহি
‘ গুরুজির জয়’ কানে কানে কয় ,
‘ রে পুত্র , ভয় নাহি ।’
নবীন বদনে অভয় কিরণ
জ্বলি উঠি উৎসাহি –
কিশোর কণ্ঠে কাঁপে সভাতল
বালক উঠিল গাহি
‘ গুরুজির জয় ! কিছু নাহি ভয় ‘
বন্দার মুখ চাহি ।
বন্দা তখন বামবাহুপাশ
জড়াইল তার গলে ,
দক্ষিণ করে ছেলের বক্ষে
ছুরি বসাইল বলে –
‘ গুরুজির জয়’ কহিয়া বালক
লুটালো ধরণীতলে ।
সভা হল নিস্তব্ধ
বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক
সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ ।
স্থির হয়ে বীর মরিল , না করি ‘
একটি কাতর শব্দ ।
দর্শনজন মুদিল নয়ন ,
সভা হল নিস্তব্ধ ।
বিচারক
পন্ডিত শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন-প্রণীত চরিতমালা হইতে গৃহীত।
অ্যাকওয়ার্থ সাহেব-প্রণীত Ballads of the Marathas নামক
গ্রন্থ রঘুনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র নারায়ণ রাওয়ের হত্যা সম্বন্ধে প্রচলিত
মারাঠি গাথার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে।
পুণ্য নগরে রঘুনাথ রাও
পেশোয়া – নৃপতি – বংশ
রাজাসনে উঠি কহিলেন বীর ,
‘ হরণ করিব ভার পৃথিবীর –
মৈসুরপতি হৈদরালির
দর্প করিব ধ্বংস ।’
দেখিতে দেখিতে পুরিয়া উঠিল
সেনানী আশি সহস্র ।
নানা দিকে দিকে নানা পথে পথে
মারাঠার যত গিরিদরি হতে
বীরগণ যেন শ্রাবণের স্রোতে
ছুটিয়া আসে অজস্র ।
উড়িল গগনে বিজয়পতাকা ,
ধ্বনিল শতেক শঙ্খ ।
হুলুরব করে অঙ্গনা সবে ,
মারাঠা – নগরী কাঁপিল গরবে ,
রহিয়া রহিয়া প্রলয় – আরবে
বাজে ভৈরব ডঙ্ক ।
ধুলার আড়ালে ধ্বজ – অরণ্যে
লুকালো প্রভাতসূর্য ।
রক্ত অশ্বে রঘুনাথ চলে ,
আকাশ বধির জয়কোলাহলে —
সহসা যেন কী মন্ত্রের বলে
থেমে গেল রণতূর্য !
সহসা কাহার চরণে ভূপতি
জানালো পরম দৈন্য ?
সমরোন্মাদে ছুটিতে ছুটিতে
সহসা নিমেষে কার ইঙ্গিতে
সিংহদুয়ার থামিল চকিতে
আশি সহস্র সৈন্য ?
ব্রাহ্মণ আসি দাঁড়ালো সমুখে
ন্যায়াধীশ রামশাস্ত্রী ।
দুই বাহু তাঁর তুলিয়া উধাও
কহিলেন ডাকি , ‘ রঘুনাথ রাও ,
নগর ছাড়িয়া কোথা চলে যাও ,
না লয়ে পাপের শাস্তি ? ‘
নীরব হইল জয়কোলাহল ,
নীরব সমরবাদ্য ।
‘ প্রভু , কেন আজি’ কহে রঘুনাথ ,
‘ অসময়ে পথ রুধিলে হঠাৎ !
চলেছি করিতে যবননিপাত ,
জোগাতে যমের খাদ্য ।’
কহিলা শাস্ত্রী , ‘ বধিয়াছ তুমি
আপন ভ্রাতার পুত্রে ।
বিচার তাহার না হয় যজ্ঞদিন
ততকাল তুমি নহ তো স্বাধীন ,
বন্দী রয়েছ অমোঘ কঠিন
ন্যায়ের বিধানসূত্রে ।’
রুষিয়া উঠিলা রঘুনাথ রাও ,
কহিলা করিয়া হাস্য ,
‘ নৃপতি কাহারো বাঁধন না মানে —
চলেছি দীপ্ত মুক্ত কৃপাণে ,
শুনিতে আসি নি পথমাঝখানে
ন্যায়বিধানের ভাষ্য ।’
কহিলা শাস্ত্রী , ‘ রঘুনাথ রাও ,
যাও করো গিয়ে যুদ্ধ !
আমিও দণ্ড ছাড়িনু এবার ,
ফিরিয়া চলিনু গ্রামে আপনার ,
বিচারশালার খেলাঘরে আর
না রহিব অবরুদ্ধ ।’
বাজিল শঙ্খ , বাজিল ডঙ্ক ,
সেনানী ধাইল ক্ষিপ্র ।
ছাড়ি দিয়া গেলা গৌরবপদ ,
দূরে ফেলি দিলা সব সম্পদ ,
গ্রামের কুটিরে চলি গেলা ফিরে
দীন দরিদ্র বিপ্র ।