- বইয়ের নামঃ কণিকা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অকর্মার বিভ্রাট
লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খসে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব’সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চালা করে ধরাইব আখা।
হল্ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে—
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।
অকৃতজ্ঞ
ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে,
ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।
অচেতন মাহাত্ম্য
হে জলদ, এত জল ধরে আছ বুকে
তবু লঘুবেগে ধাও বাতাসের মুখে।
পোষণ করিছ শত ভীষণ বিজুলি
তবু স্নিগ্ধ নীল রূপে নেত্র যায় ভুলি।
এ অসাধ্য সাধিতেছ অতি অনায়াসে
কী করিয়া, সে রহস্য কহি দাও দাসে।
গুরুগুরু গরজনে মেঘ কহে বাণী,
আশ্চর্য কী আছে ইথে আমি নাহি জানি।
অদৃশ্য কারণ
রজনী গোপনে বনে ডালপালা ভ’রে
কুঁড়িগুলি ফুটাইয়া নিজে যায় স’রে।
ফুল জাগি বলে, মোরা প্রভাতের ফুল—
মুখর প্রভাত বলে, নাহি তাহে ভুল।
অধিকার বেশি কার বনের উপর
সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর।
বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল,
গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল।
পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া,
বর্ণে আমি দিগ্বিদিক রেখেছি কাড়িয়া।
গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব,
গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব।
কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে,
হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে।
মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর,
প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।
অনাবশ্যকের আবশ্যকতা
কী জন্যে রয়েছ, সিন্ধু তৃণশস্যহীন—
অর্ধেক জগৎ জুড়ি নাচো নিশিদিন।
সিন্ধু কহে, অকর্মণ্য না রহিত যদি
ধরণীর স্তন হতে কে টানিত নদী?
অনুরাগ ও বৈরাগ্য
প্রেম কহে, হে বৈরাগ্য, তব ধর্ম মিছে।
প্রেম, তুমি মহামোহ—বৈরাগ্য কহিছে—
আমি কহি, ছাড়্ স্বার্থ, মুক্তিপথ দেখ্।
প্রেম কহে, তা হলে তো তুমি আমি এক।
অপরিবর্তনীয়
এক যদি আর হয় কী ঘটিবে তবে?
এখনো যা হয়ে থাকে, তখনো তা হবে।
তখন সকল দুঃখ ঘোচে যদি ভাই,
এখন যা সুখ আছে দুঃখ হবে তাই।
অপরিহরণীয়
মৃত্যু কহে, পুত্র নিব; চোর কহে ধন।
ভাগ্য কহে, সব নিব যা তোর আপন।
নিন্দুক কহিল, লব তব যশোভার।
কবি কহে, কে লইবে আনন্দ আমার?
অযোগ্যের উপহাস
নক্ষত্র খসিল দেখি দীপ মরে হেসে।
বলে, এত ধুমধাম, এই হল শেষে!
রাত্রি বলে, হেসে নাও, বলে নাও সুখে,
যতক্ষণ তেলটুকু নাহি যায় চুকে।
অল্প জানা ও বেশি জানা
তৃষিত গর্দভ গেল সরোবরতীরে,
‘ছিছি কালো জল!’ বলি চলি এল ফিরে।
কহে জল, জল কালো জানে সব গাধা,
যে জন অধিক জানে বলে জল সাদা।
অসম্পূর্ণ সংবাদ
চকোরী ফুকারি কাঁদে, ওগো পূর্ণ চাঁদ,
পণ্ডিতের কথা শুনি গনি পরমাদ!
তুমি নাকি একদিন রবে না ত্রিদিবে,
মহাপ্রলয়ের কালে যাবে নাকি নিবে!
হায় হায় সুধাকর, হায় নিশাপতি,
তা হইলে আমাদের কী হইবে গতি!
চাঁদ কহে, পণ্ডিতের ঘরে যাও প্রিয়া,
তোমার কতটা আয়ু এসো শুধাইয়া।
অসম্ভব ভালো
যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,
কোন্ স্বর্গপুরী তুমি ক’রে থাকো আলো।
আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়,
অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।
অসাধ্য চেষ্টা
শক্তি যার নাই নিজে বড়ো হইবারে
বড়োকে করিতে ছোটো তাই সে কি পারে?
অস্ফুট ও পরিস্ফুট
ঘটিজল বলে, ওগো মহাপারাবার,
আমি স্বচ্ছ সমুজ্জ্বল, তুমি অন্ধকার।
ক্ষুদ্র সত্য বলে, মোর পরিষ্কার কথা,
মহাসত্য তোমার মহান্ নীরবতা।
আকাঙ্ক্ষা
আম্র, তোর কী হইতে ইচ্ছা যায় বল্।
সে কহে, হইতে ইক্ষু সুমিষ্ট সরল।—
ইক্ষু, তোর কী হইতে মনে আছে সাধ?
সে কহে, হইতে আম্র সুগন্ধ সুস্বাদ।
আত্মশত্রুতা
খোঁপা আর এলোচুলে বিবাদ হামাশা,
পাড়ার লোকেরা জোটে দেখিতে তামাশা।
খোঁপা কয় এলোচুল, কী তোমার ছিরি!
এলো কয়, খোঁপা তুমি রাখো বাবুগিরি।
খোঁপা কহে, টাক ধরে হই তবে খুশি।
তুমি যেন কাটা পড়ো, এলো কয় রুষি।
কবি মাঝে পড়ি বলে, মনে ভেবে দেখ্
দুজনেই এক তোরা, দুজনেই এক।
খোঁপা গেলে চুল যায়, চুলে যদি টাক—
খোঁপা, তবে কোথা রবে তব জয়ঢাক।
আদিরহস্য
বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব,
কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব।
ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি—
যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।
আরম্ভ ও শেষ
শেষ কহে, একদিন সব শেষ হবে,
হে আরম্ভ, বৃথা তব অহংকার তবে।
আরম্ভ কহিল ভাই, যেথা শেষ হয়
সেইখানে পুনরায় আরম্ভ-উদয়।
ঈর্ষার সন্দেহ
লেজ নড়ে, ছায়া তারি নড়িছে মুকুরে
কোনোমতে সেটা সহ্য করে না কুকুরে।
দাস যবে মনিবেরে দোলায় চামর
কুকুর চটিয়া ভাবে, এ কোন্ পামর?
গাছ যদি নড়ে ওঠে, জলে ওঠে ঢেউ,
কুকুর বিষম রাগে করে ঘেউ-ঘেউ।
সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে
ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারি প্রভু-কোলে।
মনিবের পাতে ঝোল খাবে চুকুচুকু,
বিশ্বে শুধু নড়িবেক তারি লেজটুকু।
উচ্চের প্রয়োজন
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল,
হাট ভ’রে দিই আমি কত শস্য ফল।
পর্বত দাঁড়ায়ে রন কী জানি কী কাজ,
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ।
বিধাতার অবিচার, কেন উঁচুনিচু
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে, সব হলে সমভূমি-পারা
নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গলধারা?
উদারচরিতানাম্
প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।
ধিক্ ধিক্ করে তারে কাননে সবাই—
সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?
উপলক্ষ
কাল বলে,আমি সৃষ্টি করি এই ভব।
ঘড়ি বলে, তা হলে আমিও স্রষ্টা তব।
এক পরিণাম
শেফালি কহিল, আমি ঝরিলাম, তারা!
তারা কহে, আমারো তো হল কাজ সারা—
ভরিলাম রজনীর বিদায়ের ডালি
আকাশের তারা আর বনের শেফালি।
এক-তরফা হিসাব
সাতাশ, হলে না কেন এক-শো সাতাশ,
থলিটি ভরিত, হাড়ে লাগিত বাতাস।
সাতাশ কহিল, তাহে টাকা হত মেলা,
কিন্তু কী করিতে বাপু বয়সের বেলা?
একই পথ
দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি।
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?
কর্তব্যগ্রহণ
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
কলঙ্কব্যবসায়ী
ধুলা, করো কলঙ্কিত সবার শুভ্রতা
সেটা কি তোমারি নয় কলঙ্কর কথা?
কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ
দেহটা যেমনি ক’রে ঘোরাও যেখানে
বাম হাত বামে থাকে, ডান হাত ডানে।
কীটের বিচার
মহাভারতের মধ্যে ঢুকেছেন কীট,
কেটেকুটে ফুঁড়েছেন এপিঠ-ওপিঠ।
পণ্ডিত খুলিয়া দেখি হস্ত হানে শিরে;
বলে, ওরে কীট, তুই এ কী করিলি রে!
তোর দন্তে শান দেয়, তোর পেট ভরে,
হেন খাদ্য কত আছে ধূলির উপরে।
কীট বলে, হয়েছে কী, কেন এত রাগ,
ওর মধ্যে ছিল কী বা, শুধু কালো দাগ!
আমি যেটা নাহি বুঝি সেটা জানি ছার,
আগাগোড়া কেটেকুটে করি ছারখার।
কুটুম্বিতা-বিচার
কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা—
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!
কুয়াশার আক্ষেপ
‘কুয়াশা, নিকটে থাকি, তাই হেলা মোরে—
মেঘ ভায়া দূরে রন, থাকেন গুমরে!’
কবি কুয়াশারে কয়, শুধু তাই না কি?
মেঘ দেয় বৃষ্টিধারা, তুমি দাও ফাঁকি।
কৃতীর প্রমাদ
টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি,
হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি।
হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল,
কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।
ক্ষুদ্রের দম্ভ
শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।
খেলেনা
ভাবে শিশু, বড়ো হলে শুধু যাবে কেনা
বাজার উজাড় করি সমস্ত খেলেনা।
বড়ো হলে খেলা যত ঢেলা বলি মানে,
দুই হাত তুলে চায় ধনজন-পানে।
আরো বড়ো হবে না কি যবে অবহেলে
ধরার খেলার হাট হেসে যাবে ফেলে?
গদ্য ও পদ্য
শর কহে, আমি লঘু, গুরু তুমি গদা,
তাই বুক ফুলাইয়া খাড়া আছ সদা।
করো তুমি মোর কাজ, তর্ক যাক চুকে—
মাথা ভাঙা ছেড়ে দিয়ে বেঁধো গিয়ে বুকে।
গরজের আত্মীয়তা
কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,
আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে?
থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে
আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।
গালির ভঙ্গি
লাঠি গালি দেয়, ছড়ি, তুই সরু কাঠি!
ছড়ি তারে গালি দেয়, তুমি মোটা লাঠি!
গুণজ্ঞ
আমি প্রজাপতি ফিরি রঙিন পাখায়,
কবি তো আমার পানে তবু না তাকায়।
বুঝিতে না পারি আমি, বলো তো ভ্রমর,
কোন্ গুণে কাব্যে তুমি হয়েছ অমর।
অলি কহে, আপনি সুন্দর তুমি বটে,
সুন্দরের গুণ তব মুখে নাহি রটে।
আমি ভাই মধু খেয়ে গুণ গেয়ে ঘুরি,
কবি আর ফুলের হৃদয় করি চুরি।
গ্রহণে ও দানে
কৃতাঞ্জলি কর কহে, আমার বিনয়,
হে নিন্দুক, কেবল নেবার বেলা নয়।
নিই যবে নিই বটে অঞ্জলি জুড়িয়া,
দিই যবে সেও দিই অঞ্জলি পুরিয়া।
চালক
অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।
চিরনবীনতা
দিনান্তের মুখ চুম্বি রাত্রি ধীরে কয়—
আমি মৃত্যু তোর মাতা, নাহি মোরে ভয়।
নব নব জন্মদানে পুরাতন দিন
আমি তোরে ক’রে দিই প্রত্যহ নবীন।
চুরি-নিবারণ
সুয়োরাণী কহে, রাজা দুয়োরাণীটার
কত মতলব আছে বুঝে ওঠা ভার।
গোয়াল্-ঘরের কোণে দিলে ওরে বাসা,
তবু দেখো অভাগীর মেটে নাই আশা।
তোমারে ভুলায়ে শুধু মুখের কথায়
কালো গরুটিরে তব দুয়ে নিতে চায়।
রাজা বলে, ঠিক ঠিক, বিষম চাতুরী—
এখন কী ক’রে ওর ঠেকাইব চুরি!
সুয়ো বল, একমাত্র রয়েছে ওষুধ,
গোরুটা আমারে দাও, আমি খাই দুধ।
ছলনা
সংসার মোহিনী নারী কহিল সে মোরে,
তুমি আমি বাঁধা রব নিত্য প্রেমডোরে।
যখন ফুরায়ে গেল সব লেনা দেনা,
কহিল, ভেবেছ বুঝি উঠিতে হবে না!
জীবন
জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা,
যেমন চলার অঙ্গ পা-তোলা পা-ফেলা।
জ্ঞানের দৃষ্টি ও প্রেমের সম্ভোগ
‘কালো তুমি’— শুনি জাম কহে কানে কানে,
যে আমারে দেখে সেই কালো বলি জানে,
কিন্তু সেটুকু জেনে ফের কেন জাদু?
যে আমারে খায় সেই জানে আমি স্বাদু।
তন্নষ্টং যন্ন দীয়তে
গন্ধ চলে যায়, হায়, বন্ধ নাহি থাকে,
ফুল তারে মাথা নাড়ি ফিরে ফিরে ডাকে।
বায়ু বলে, যাহা গেল সেই গন্ধ তব,
যেটুকু না দিবে তারে গন্ধ নাহি কব।
দানরিক্ত
জলহারা মেঘখানি বরষার শেষে
পড়ে আছে গগনের এক কোণ ঘেঁষে।
বর্ষাপূর্ণ সরোবর তারি দশা দেখে
সারাদিন ঝিকিমিকি হাসে থেকে থেকে।
কহে, ওটা লক্ষ্মীছাড়া, চালচুলাহীন,
নিজেরে নিঃশেষ করি কোথায় বিলীন।
আমি দেখো চিরকাল থাকি জলভরা,
সারবান, সুগম্ভীর, নাই নড়াচড়া।
মেঘ কহে, ওহে বাপু, কোরো না গরব,
তোমার পূর্ণতা সে তো আমারি গৌরব।
দীনের দান
মরু কহে, অধমেরে এত দাও জল,
ফিরে কিছু দিব হেন কী আছে সম্বল?
মেঘ কহে, কিছু নাহি চাই, মরুভূমি,
আমারে দানের সুখ দান করো তুমি।
ধ্রুবসত্য
আমি বিন্দুমাত্র আলো, মনে হয় তবু
আমি শুধু আছি আর কিছু নাই কভু।
পলক পড়িল দেখি আড়ালে আমার
তুমি আছ হে অনাদি আদি অন্ধকার!
ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।
নতিস্বীকার
তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়
তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়,
অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে
প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে।
নদীর প্রতি খাল
খাল বলে, মোর লাগি মাথা-কোটাকুটি,
নদীগুলা আপনি গড়ায়ে আসে ছুটি।
তুমি খাল মহারাজ, কহে পারিষদ,
তোমারে জোগাতে জল আছে নদীনদ।
নম্রতা
কহিল কঞ্চির বেড়া, ওগো পিতামহ
বাঁশবন, নুয়ে কেন পড় অহরহ?
আমরা তোমারি বংশে ছোটো ছোটো ডাল,
তবু মাথা উঁচু করে থাকি চিরকাল।
বাঁশ কহে, ভেদ তাই ছোটোতে বড়োতে,
নত হই, ছোটো নাহি হই কোনোমতে।
নিজের ও সাধারণের
চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,
কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে।
নিন্দুকের দুরাশা
মালা গাঁথিবার কালে ফুলের বোঁটায়
ছুঁচ নিয়ে মালাকর দুবেলা ফোটায়।
ছুঁচ বলে মনদুঃখে, ওরে জুঁই দিদি,
হাজার হাজার ফুল প্রতিদিন বিঁধি,
কত গন্ধ কোমলতা যাই ফুঁড়ে ফুঁড়ে
কিছু তার নাহি পাই এত মাথা খুঁড়ে।
বিধি-পায়ে মাগি বর জুড়ি কর দুটি
ছুঁচ হয়ে না ফোটাই, ফুল হয়ে ফুটি।
জুঁই কহে নিশ্বসিয়া, আহা হোক তাই,
তোমারো পুরুক বাঞ্ছা আমি রক্ষা পাই।
নিরাপদ নীচতা
তুমি নীচে পাঁকে পড়ি ছড়াইছ পাঁক,
যে জন উপরে আছে তারি তো বিপাক।
নূতন ও সনাতন
রাজা ভাবে, নব নব আইনের ছলে
ন্যায় সৃষ্টি করি আমি। ন্যায়ধর্ম বলে,
আমি পুরাতন, মোরে জন্ম কেবা দেয়—
যা তব নূতন সৃষ্টি সে শুধু অন্যায়।
নূতন চাল
এক দিন গরজিয়া কহিল মহিষ,
ঘোড়ার মতন মোর থাকিবে সহিস।
একেবারে ছাড়িয়াছি মহিষি-চলন,
দুই বেলা চাই মোর দলন-মলন।
এই ভাবে প্রতিদিন, রজনী পোহালে,
বিপরীত দাপাদাপি করে সে গোহালে।
প্রভু কহে,চাই বটে! ভালো, তাই হোক!
পশ্চাতে রাখিল তার দশ জন লোক।
দুটো দিন না যাইতে কেঁদে কয় মোষ,
আর কাজ নেই প্রভু, হয়েছে সন্তোষ।
সহিসের হাত হতে দাও অব্যাহতি,
দলন-মলনটার বাড়াবাড়ি অতি।
পর ও আত্মীয়
ছাই বলে, শিখা মোর ভাই আপনার,
ধোঁওয়া বলে, আমি তো যমজ ভাই তার।
জোনাকি কহিল, মোর কুটুম্বিতা নাই,
তোমাদের চেয়ে আমি বেশি তার ভাই।
পর-বিচারে গৃহভেদ
আম্র কহে, এক দিন, হে মাকাল ভাই,
আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই—
মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি,
মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি।
পরস্পর
বাণী কহে, তোমারে যখন দেখি, কাজ,
আপনার শূণ্যতায় বড়ো পাই লাজ।
কাজ শুনি কহে, অয়ি পরিপূর্ণা বাণী,
নিজেরে তোমার কাছে দীন ব’লে জানি।
পরিচয়
দয়া বলে, কে গো তুমি মুখে নাই কথা?
অশ্রুভরা আঁখি বলে, আমি কৃতজ্ঞতা।
পরের কর্ম-বিচার
নাক বলে, কান কভু ঘ্রাণ নাহি করে,
রয়েছে কুণ্ডল দুটো পরিবার তরে।
কান বলে, কারো কথা নাহি শুনে নাক,
ঘুমোবার বেলা শুধু ছাড়ে হাঁকডাক।
প্রকারভেদ
বাবলাশাখারে বলে আম্রশাখা, ভাই,
উনানে পুড়িয়া তুমি কেন হও ছাই?
হায় হায়, সখী, তব ভাগ্য কী কঠোর!
বাবলার শাখা বলে, দুঃখ নাহি মোর।
বাঁচিয়া সফল তুমি, ওগো চূতলতা,
নিজেরে করিয়া ভস্ম মোর সফলতা।
প্রতাপের তাপ
ভিজা কাঠ অশ্রুজলে ভাবে রাত্রিদিবা,
জ্বলন্ত কাঠের আহা দীপ্তি তেজ কিবা।
অন্ধকার কোণে পড়ে মরে ঈর্ষারোগে—
বলে, আমি হেন জ্যোতি পাব কী সুযোগে।
জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, কাঁচা কাঠ ওগো,
চেষ্টাহীন বাসনায় বৃথা তুমি ভোগো।
আমরা পেয়েছি যাহা মরিয়া পুড়িয়া,
তোমারি হাতে কি তাহা আসিবে উড়িয়া?
ভিজা কাঠ বলে, বাবা, কে মরে আগুনে!
জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, তবে খাক ঘুণে।
প্রত্যক্ষ প্রমাণ
বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ
আমার গর্জনে বলে মেঘের গর্জন,
বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,
মাথায় পড়িলে তবে বলে—বজ্র বটে!
প্রবীণ ও নবীন
পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়,
কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায়-হায়।
পাকা চুল বলে, মান সব লও বাছা,
আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।
প্রভেদ
অনুগ্রহ দুঃখ করে, দিই, নাহি পাই।
করুণা কহেন, আমি দিই, নাহি চাই।
প্রশ্নের অতীত
হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা
সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা।
কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর?
হিমাদ্রি কহিল, মোর চির-নিরুত্তর।
ফুল ও ফল
ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল,
কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্।
ফল কহে, মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি,
তোমারি অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি।
বলের অপেক্ষা বলী
ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ—
কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ।
বস্ত্রহরণ
‘সংসারে জিনেছি’ ব’লে দুরন্ত মরণ
জীবন বসন তার করিছে হরণ।
যত বস্ত্রে টান দেয়, বিধাতার বরে।
বস্ত্র বাড়ি চলে তত নিত্যকাল ধ’রে।
বিফল নিন্দা
‘তোরে সবে নিন্দা করে গুণহীন ফুল’
শুনিয়া নীরবে হাসি কহিল শিমূল,
যতক্ষণ নিন্দা করে, আমি চুপে চুপে
ফুটে উঠি আপনার পরিপূর্ণ রূপে।
বিরাম
বিরাম কাজেরই অঙ্গ এক সাথে গাঁথা,
নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।
ভক্তি ও অতিভক্তি
ভক্তি আসে রিক্তহস্ত প্রসন্নবদন—
অতিভক্তি বলে, দেখি কী পাইলে ধন।
ভক্তি কয়, মনে পাই, না পারি দেখাতে।—
অতিভক্তি কয়, আমি পাই হাতে হাতে।
ভক্তিভাজন
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।
ভার
টুনটুনি কহিলেন, রে ময়ূর, তোকে
দেখে করুণায় মোর জল আসে চোখে।
ময়ূর কহিল, বটে! কেন, কহ শুনি,
ওগো মহাশয় পক্ষী, ওগো টুনটুনি
টুনটুনি কহে, এ যে দেখিতে বেআড়া,
দেহ তব যত বড়ো পুচ্ছ তারে বাড়া।
আমি দেখো লঘুভারে ফিরি দিনরাত,
তোমার পশ্চাতে পুচ্ছ বিষম উৎপাত।
ময়ূর কহিল, শোক করিয়ো না মিছে,
জেনো ভাই, ভার থাকে গৌরবের পিছে।
ভালো মন্দ
জাল কহে, পঙ্ক আমি উঠাব না আর।
জেলে কহে, মাছ তবে পাওয়া হবে ভার।
ভিক্ষা ও উপার্জন
বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা,
কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস—
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস।
বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী,
আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।
মহতের দুঃখ
সূর্য দুঃখ করি বলে নিন্দা শুনি স্বীয়,
কী করিলে হব আমি সকলের প্রিয়।
বিধি কহে, ছাড়ো তবে এ সৌর সমাজ,
দু-চারি জনেরে লয়ে করো ক্ষুদ্র কাজ।
মাঝারির সতর্কতা
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।
মূল
আগা বলে, আমি বড়ো, তুমি ছোটো লোক।
গোড়া হেসে বলে, ভাই, ভালো তাই হোক।
তুমি উচ্চে আছ ব’লে গর্বে আছ ভোর,
তোমারে করেছি উচ্চ এই গর্ব মোর।
মৃত্যু
ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময়
মুহূর্তে নিখিল তবে হয়ে যেত লয়।
তুমি পরিপূর্ণ রূপ, তব বক্ষে কোলে
জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে।
মোহ
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
মোহের আশঙ্কা
শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধভরা—
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যত কাল থাকি তুমিও থাকিয়ো।
যথাকর্তব্য
ছাতা বলে, ধিক্ ধিক্ মাথা মহাশয়,
এ অন্যায় অবিচার আমারে না সয়।
তুমি যাবে হাটে বাটে দিব্য অকাতরে,
রৌদ্র বৃষ্টি যতকিছু সব আমা-’পরে।
তুমি যদি ছাতা হতে কী করিতে দাদা?
মাথা কয়, বুঝিতাম মাথার মর্যাদা,
বুঝিতাম তার গুণে পরিপূর্ণ ধরা,
মোর একমাত্র গুণ তারে রক্ষা করা।
যথার্থ আপন
কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ভাই ভাই।
নভশ্চর ব’লে তার মনের বিশ্বাস,
শূণ্যপানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতা-ডোরে।
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি,
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।
রাষ্ট্রনীতি
কুড়াল কহিল, ভিক্ষা মাগি ওগো শাল,
হাতল নাহিকো, দাও একখানি ডাল।
ডাল নিয়ে হাতল প্রস্তুত হল যেই,
তার পরে ভিক্ষুকের চাওয়া-চিন্তা নেই—
একেবারে গোড়া ঘেঁষে লাগাইল কোপ,
শাল বেচারার হল আদি অন্ত লোপ।
শক্তির শক্তি
দিবসে চক্ষুর দম্ভ দৃষ্টিশক্তি লয়ে,
রাত্রি যেই হল সেই অশ্রু যায় বয়ে!
আলোরে কহিল—আজ বুঝিয়াছি ঠেকি
তোমারি প্রসাদবলে তোমারেই দেখি।
শক্তির সীমা
কহিল কাঁসার ঘটি খন্ খন্ স্বর—
কূপ,তুমি কেন খুড়া হলে না সাগর?
তাহা হলে অসংকোচে মারিতাম ডুব,
জল খেয়ে লইতাম পেট ভরে খুব।
কূপ কহে,সত্য বটে ক্ষুদ্র আমি কূপ,
সেই দুঃখে চিরদিন করে আছি চুপ।
কিন্তু বাপু, তার লাগি তুমি কেন ভাব!
যতবার ইচ্ছা যায় ততবার নাবো—
তুমি যত নিতে পার সব যদি নাও
তবু আমি টিঁকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও।
শক্তের ক্ষমা
নারদ কহিল আসি, হে ধরণী দেবী,
তব নিন্দা করে নর তব অন্ন সেবি।
বলে মাটি, বলে ধূলি, বলে জড় স্থুল,
তোমারে মলিন বলে অকৃতজ্ঞকুল।
বন্ধ করো অন্নজল, মুখ হোক চুন,
ধুলামাটি কী জিনিস বাছারা বুঝুন।
ধরণী কহিলা হাসি, বালাই, বালাই!
ওরা কি আমার তুল্য, শোধ লব তাই?
ওদের নিন্দায় মোর লাগিবে না দাগ,
ওরা যে মরিবে যদি আমি করি রাগ।
ত্রুতাগৌরব
পেঁচা রাষ্ট্র করি দেয় পেলে কোনো ছুতা,
জান না আমার সাথে সূর্যের শত্রুতা!
সজ্ঞান আত্মবিসর্জন
বীর কহে, হে সংসার, হায় রে পৃথিবী,
ভাবিস নে মোরে কিছু ভুলাইয়া নিবি—
আমি যাহা দিই তাহা দিই জেনে-শুনে
ফাঁকি দিয়ে যা পেতিস তার শতগুণে।
সত্যের আবিষ্কার
কহিলেন বসুন্ধরা, দিনের আলোকে
আমি ছাড়া আর কিছু পড়িত না চোখে,
রাত্রে আমি লুপ্ত যবে শূন্যে দিল দেখা
অনন্ত এ জগতের জ্যোতির্ময়ী লেখা।।
সত্যের সংযম
স্বপ্ন কহে, আমি মুক্ত, নিয়মের পিছে
নাহি চলি। সত্য কহে, তাই তুমি মিছে।
স্বপ্ন কয়, তুমি বদ্ধ অনন্ত শৃঙ্খলে।
সত্য কয়, তাই মোরে সত্য সবে বলে।
সন্দেহের কারণ
কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি।—
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।
সমালোচক
কানা-কড়ি পিঠ তুলি কহে টাকাটিকে,
তুমি ষোলো আনা মাত্র, নহ পাঁচ সিকে।
টাকা কয়, আমি তাই, মূল্য মোর যথা,
তোমার যা মূল্য তার ঢের বেশি কথা।
সাম্যনীতি
কহিল ভিক্ষার ঝুলি, হে টাকার তোড়া,
তোমাতে আমাতে, ভাই, ভেদ অতি থোড়া—
আদান-প্রদান হোক। তোড়া কহে রাগে,
সে থোড়া প্রভেদটুকু ঘুচে যাক আগে।
সুখদুঃখ
শ্রাবণের মোটা ফোঁটা বাজিল যূথীরে—
কহিল, মরিনু হায় কার মৃত্যুতীরে!
বৃষ্টি কহে, শুভ আমি নামি মর্তমাঝে,
কারে সুখরূপে লাগে কারে দুঃখ বাজে।
সুসময়
শোকের বরষা দিন এসেছে আঁধারি—
ও ভাই গৃহস্থ চাষি, ছেড়ে আয় বাড়ি।
ভিজিয়া নরম হল শুষ্ক মরু মন,
এই বেলা শস্য তোর করে নে বপন।
সৌন্দর্যের সংযম
নর কহে, বীর মোরা যাহা ইচ্ছা করি।
নারী কহে জিহ্বা কাটি, শুনে লাজে মরি!
পদে পদে বাধা তব, কহে তারে নর।
কবি কহে, তাই নারী হয়েছে সুন্দর।
স্তুতি নিন্দা
স্তুতি নিন্দা বলে আসি, গুণ মহাশয়,
আমরা কে মিত্র তব? গুণ শুনি কয়,
দুজনেই মিত্র তোরা শত্রু দুজনেই—
তাই ভাবি শত্রু মিত্র কারে কাজ নেই।
স্পর্ধা
হাউই কহিল, মোর কী সাহস, ভাই,
তারকার মুখে আমি দিয়ে আসি ছাই!
কবি কহে, তার গায়ে লাগে নাকো কিছু,
সে ছাই ফিরিয়া আসে তোরি পিছু পিছু।
স্পষ্ট সত্য
সংসার কহিল, মোর নাহি কপটতা,
জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, সবই স্পষ্ট কথা।
আমি নিত্য কহিতেছি যথাসত্য বাণী,
তুমি নিত্য লইতেছ মিথ্যা অর্থখানি।
স্পষ্টভাষী
বসন্ত এসেছে বনে, ফুল ওঠে ফুটি,
দিনরাত্রি গাহে পিক, নাহি তার ছুটি।
কাক বলে, অন্য কাজ নাহি পেলে খুঁজি,
বসন্তের চাটুগান শুরু হল বুঝি!
গান বন্ধ করি পিক উঁকি মারি কয়,
তুমি কোথা হতে এলে কে গো মহাশয়?
আমি কাক স্পষ্টভাষী, কাক ডাকি বলে।
পিক কয়, তুমি ধন্য, নমি পদতলে;
স্পষ্টভাষা তব কণ্ঠে থাক বারো মাস,
মোর থাক্ মিষ্টভাষা আর সত্যভাষ।
স্বদেশদ্বেষী
কেঁচো কয়, নীচ মাটি, কালো তার রূপ।
কবি তারে রাগ ক’রে বলে, চুপ চুপ!
তুমি যে মাটির কীট, খাও তারি রস,
মাটির নিন্দায় বাড়ে তোমারি কি যশ!
স্বাধীনতা
শর ভাবে, ছুটে চলি, আমি তো স্বাধীন,
ধনুকটা একঠাঁই বদ্ধ চিরদিন।
ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা—
আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা।
হাতে-কলমে
বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।
হার-জিত
ভিমরুলে মৌমাছিতে হল রেষারেষি,
দুজনায় মহাতর্ক শক্তি কার বেশি।
ভিমরুল কহে, আছে সহস্র প্রমাণ
তোমার দংশন নহে আমার সমান।
মধুকর নিরুত্তর ছলছল-আঁখি—
বনদেবী কহে তারে কানে কানে ডাকি,
কেন বাছা, নতশির! এ কথা নিশ্চিত
বিষে তুমি হার মানো, মধুতে যে জিত।