- বইয়ের নামঃ কবিতা (রবীন্দ্রনাথ)
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অবসাদ
অবসাদ
দয়াময়ি, বাণি, বীণাপাণি,
জাগাও — জাগাও, দেবি, উঠাও আমারে দীন হীন।
ঢালো এ হৃদয়মাঝে জ্বলন্ত অনলময় বল।
দিনে দিনে অবসাদে হইতেছি অবশ মলিন;
নির্জীব এ হৃদয়ের দাঁড়াবার নাই যেন বল।
নিদাঘ-তপন-শুষ্ক ম্রিয়মাণ লতার মতন
ক্রমে অবসন্ন হয়ে পড়িতেছি ভূমিতে লুটায়ে,
চারিদিকে চেয়ে দেখি শ্রান্ত আঁখি করি উন্মীলন —
বন্ধুহীন-প্রাণহীন-জনহীন মরু মরু মরু —
আঁধার — আঁধার সব — নাই জল নাই তৃণ তরু,
নির্জীব হৃদয় মোর ভূমিতলে পড়িছে লুটায়ে;
এসো দেবি, এসো, মোরে
রাখো এ মূর্ছার ঘোরে;
বলহীন হৃদয়েরে দাও দেবি, দাও গো উঠায়ে।
দাও দেবি সে ক্ষমতা, ওগো দেবি, শিখাও সে মায়া —
যাহাতে জ্বলন্ত, দগ্ধ, নিরানন্দ মরুমাঝে থাকি
হৃদয় উপরে পড়ে স্বরগের নন্দনের ছায়া —
শুনি সুহৃদের স্বর থাকিলেও বিজনে একাকী।
দাও দেবি সে ক্ষমতা, যাহে এই নীরব শ্মশানে,
হৃদয়-প্রমোদ-বনে বাজে সদা আনন্দের গীত।
মুমূর্ষু মনের ভার —
পারি না বহিতে আর —
হইতেছি অবসন্ন — বলহীন — চেতনা-রহিত —
অজ্ঞাত পৃথিবী-তলে — অকর্মণ্য-অনাথ-অজ্ঞান —
উঠাও উঠাও মোরে — করহ নূতন প্রাণ দান।
পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে যুঝিব — যুঝিব দিবারাত —
কালের প্রস্তরপটে লিখিব অক্ষয় নিজ নাম।
অবশ নিদ্রায় পড়ি করিব না এ শরীর পাত,
মানুষ জন্মেছি যবে করিব কর্মের অনুষ্ঠান।
দুর্গম উন্নতিপথে পৃথ্বীতরে গঠিব সোপান,
তাই বলি দেবি —
সংসারের ভগ্নোদ্যম, অবসন্ন, দুর্বল পথিকে
করো গো জীবন দান তোমার ও অমৃত-নিষেকে।
বালক, চৈত্র, ১২৯২
অভিলাষ
১
জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার ।
অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয়।
২
তোমার বাঁশরি স্বরে বিমোহিত মন–
মানবেরা, ওই স্বর লক্ষ্য করি হায়,
যত অগ্রসর হয় ততই যেমন
কোথায় বাজিছে তাহা বুঝিতে না পারে।
৩
চলিল মানব দেখো বিমোহিত হয়ে,
পর্বতের অত্যুন্নত শিখর লঙ্ঘিয়া,
তুচ্ছ করি সাগরের তরঙ্গ ভীষণ,
মরুর পথের ক্লেশ সহি অনায়াসে।
৪
হিমক্ষেত্র, জনশূন্য কানন, প্রান্তর,
চলিল সকল বাধা করি অতিক্রম।
কোথায় যে লক্ষ্যস্থান খুঁজিয়া না পায়,
বুঝিতে না পারে কোথা বাজিছে বাঁশরি।
৫
ওই দেখো ছুটিয়াছে আর-এক দল,
লোকারণ্য পথমাঝে সুখ্যাতি কিনিতে;
রণক্ষেত্রে মৃত্যুর বিকট মূর্তি মাঝে,
শমনের দ্বার সম কামানের মুখে।
৬
ওই দেখো পুস্তকের প্রাচীর মাঝারে
দিন রাত্রি আর স্বাস্থ্য করিতেছে ব্যয়।
পহুঁছিতে তোমার ও দ্বারের সম্মুখে
লেখনীরে করিয়াছে সোপান সমান।
৭
কোথায় তোমার অন্ত রে দুরভিলাষ
“স্বর্ণঅট্টালিকা মাঝে?’ তা নয় তা নয়।
“সুবর্ণখনির মাঝে অন্ত কি তোমার?’
তা নয়, যমের দ্বারে অন্ত আছে তব।
৮
তোমার পথের মাঝে, দুষ্ট অভিলাষ,
ছুটিয়াছে মানবেরা সন্তোষ লভিতে।
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা,
তোমার পথের মাঝে সন্তোষ থাকে না!
৯
নাহি জানে তারা হায় নাহি জানে তারা
দরিদ্র কুটির মাঝে বিরাজে সন্তোষ।
নিরজন তপোবনে বিরাজে সন্তোষ।
পবিত্র ধর্মের দ্বারে সন্তোষ আসন।
১০
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
তোমার কুটিল আর বন্ধুর পথেতে
সন্তোষ নাহিকো পারে পাতিতে আসন।
নাহি পশে সূর্যকর আঁধার নরকে।
১১
তোমার পথেতে ধায় সুখের আশয়ে
নির্বোধ মানবগণ সুখের আশয়ে;
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
কটাক্ষও নাহি করে সুখ তোমা পানে।
১২
সন্দেহ ভাবনা চিন্তা আশঙ্কা ও পাপ
এরাই তোমার পথে ছড়ানো কেবল
এরা কি হইতে পারে সুখের আসন
এ-সব জঞ্জালে সুখ তিষ্ঠিতে কি পারে।
১৩
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
নির্বোধ মানবগন নাহি জানে ইহা
পবিত্র ধর্মের দ্বারে চিরস্থায়ী সুখ
পাতিয়াছে আপনার পবিত্র আসন।
১৪
ওই দেখো ছুটিয়াছে মানবের দল
তোমার পথের মাঝে দুষ্ট অভিলাষ
হত্যা অনুতাপ শোক বহিয়া মাথায়
ছুটেছে তোমার পথে সন্দিগ্ধ হৃদয়ে।
১৫
প্রতারণা প্রবঞ্চনা অত্যাচারচয়
পথের সম্বল করি চলে দ্রুতপদে
তোমার মোহন জালে পড়িবার তরে।
ব্যাধের বাঁশিতে যথা মৃগ পড়ে ফাঁদে।
১৬
দেখো দেখো বোধহীন মানবের দল
তোমার ও মোহময়ী বাঁশরির স্বরে
এবং তোমার সঙ্গী আশা উত্তেজনে
পাপের সাগরে ডুবে মুক্তার আশয়ে।
১৭
রৌদ্রের প্রখর তাপে দরিদ্র কৃষক
ঘর্মসিক্ত কলেবরে করিছে কর্ষণ
দেখিতেছে চারি ধারে আনন্দিত মনে
সমস্ত বর্ষের তার শ্রমের যে ফল।
১৮
দুরাকাঙক্ষা হায় তব প্রলোভনে পড়ি
কর্ষিতে কর্ষিতে সেই দরিদ্র কৃষক
তোমার পথের শোভা মনোময় পটে
চিত্রিতে লাগিল হায় বিমুগ্ধ হৃদয়ে।
১৯
ওই দেখো আঁকিয়াছে হৃদয়ে তাহার
শোভাময় মনোহর অট্টালিকারাজি
হীরক মাণিক্য পূর্ণ ধনের ভাণ্ডার
নানা শিল্পে পরিপূর্ণ শোভন আপণ।
২০
মনোহর কুঞ্জবন সুখের আগার
শিল্প-পারিপাট্যযুক্ত প্রমোদভবন
গঙ্গা সমীরণ স্নিগ্ধ পল্লীর কানন
প্রজাপূর্ণ লোভনীয় বৃহৎ প্রদেশ।
২১
ভাবিল মুহূর্ত-তরে ভাবিল কৃষক
সকলই এসেছে যেন তারি অধিকারে
তারি ওই বাড়ি ঘর তারি ও ভাণ্ডার
তারি অধিকারে ওই শোভন প্রদেশ।
২২
মুহূর্তেক পরে তার মুহূর্তেক পরে
লীন হল চিত্রচয় চিত্তপট হতে
ভাবিল চমকি উঠি ভাবিল তখন
“আছে কি এমন সুখ আমার কপালে?’
২৩
“আমাদের হায় যত দুরাকাঙক্ষাচয়
মানসে উদয় হয় মুহূর্তের তরে
কার্যে তাহা পরিণত না হতে না হতে
হৃদয়ের ছবি হায় হৃদয়ে মিশায়।’
২৪
ওই দেখো ছুটিয়াছে তোমার ও পথে
রক্তমাখা হাতে এক মানবের দল
সিংহাসন রাজদণ্ড ঐশ্বর্য মুকুট
প্রভুত্ব রাজত্ব আর গৌরবের তরে।
২৫
ওই দেখো গুপ্তহত্যা করিয়া বহন
চলিতেছে অঙ্গুলির ‘পরে ভর দিয়া
চুপি চুপি ধীরে ধীরে অলক্ষিত ভাবে
তলবার হাতে করি চলিয়াছে দেখো।
২৬
হত্যা করিতেছে দেখো নিদ্রিত মানবে
সুখের আশয়ে বৃথা সুখের আশয়ে
ওই দেখো ওই দেখো রক্তমাখা হাতে
ধরিয়াছে রাজদণ্ড সিংহাসনে বসি।
২৭
কিন্তু হায় সুখলেশ পাবে কি কখন?
সুখ কি তাহারে করিবেক আলিঙ্গন?
সুখ কি তাহার হৃদে পাতিবে আসন?
সুখ কভু তারে কিগো কটাক্ষ করিবে?
২৮
নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
বৃষ্টি বজ্র সহ্য করি যে সুখের তরে
ছুটিয়াছে আপনার অভীষ্ট সাধনে?
২৯
কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়
পাপের কী ফল কভু সুখ হতে পারে
পাপের কী শাস্তি হয় আনন্দ ও সুখ
কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়
৩০
প্রজ্বলিত অনুতাপ হুতাশন কাছে
বিমল সুখের হায় স্নিগ্ধ সমীরণ
হুতাশনসম তপ্ত হয়ে উঠে যেন
তখন কি সুখ কভু ভালো লাগে আর।
৩১
নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
ছুটেছে না মানি বাধা অভীষ্ট সাধনে
মনস্তাপে পরিণত হয়ে উঠে শেষে।
৩২
হৃদয়ের উচ্চাসনে বসি অভিলাষ
মানবদিগকে লয়ে ক্রীড়া কর তুমি
কাহারে বা তুলে দাও সিদ্ধির সোপানে
কারে ফেল নৈরাশ্যের নিষ্ঠুর কবলে।
৩৩
কৈকেয়ী হৃদয়ে চাপে দুষ্ট অভিলাষ!
চতুর্দশ বর্ষ রামে দিলে বনবাস,
কাড়িয়া লইলে দশরথের জীবন,
কাঁদালে সীতায় হায় অশোক-কাননে।
৩৪
রাবণের সুখময় সংসারের মাঝে
শান্তির কলস এক ছিল সুরক্ষিত
ভাঙিল হঠাৎ তাহা ভাঙিল হঠাৎ
তুমিই তাহার হও প্রধান কারণ।
৩৫
দুর্যোধন-চিত্ত হায় অধিকার করি
অবশেষে তাহারেই করিলে বিনাশ
পাণ্ডুপুত্রগণে তুমি দিলে বনবাস
পাণ্ডবদিগের হৃদে ক্রোধ জ্বালি দিলে।
৩৬
নিহত করিলে তুমি ভীষ্ম আদি বীরে
কুরুক্ষেত্র রক্তময় করে দিলে তুমি
কাঁপাইলে ভারতের সমস্ত প্রদেশ
পাণ্ডবে ফিরায়ে দিলে শূন্য সিংহাসন।
৩৭
বলি না হে অভিলাষ তোমার ও পথ
পাপেতেই পরিপূর্ণ পাপেই নিম্নিত
তোমার কতকগুলি আছয়ে সোপান
কেহ কেহ উপকারী কেহ অপকারী।
৩৮
উচ্চ অভিলাষ! তুমি যদি নাহি কভু
বিস্তারিতে নিজ পথ পৃথিবীমণ্ডলে
তাহা হ’লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে?
৩৯
সকলেই যদি নিজ নিজ অবস্থায়
সন্তুষ্ট থাকিত নিজ বিদ্যা বুদ্ধিতেই
তাহা হ’লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে?
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, অগ্রহায়ণ ১৭৯৬ শক
আকুল আহ্বান
আকুল আহ্বান
অভিমান ক’রে কোথায় গেলি,
আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়।
দিন রাত কেঁদে কেঁদে ডাকি
আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়।
সন্ধে হল, গৃহ অন্ধকার,
মা গো, হেথায় প্রদীপ জ্বলে না।
একে একে সবাই ঘরে এল,
আমায় যে মা, “মা’ কেউ বলে না।
সময় হল বেঁধে দেব চুল,
পরিয়ে দেব রাঙা কাপড়খানি।
সাঁজের তারা সাঁজের গগনে —
কোথায় গেল, রানী আমার রানী!
ও মা, রাত হল, আঁধার করে আসে,
ঘরে ঘরে প্রদীপ নিবে যায়।
আমার ঘরে ঘুম নেইকো শুধু —
শূন্য শেজ শূন্যপানে চায়।
কোথায় দুটি নয়ন ঘুমে ভরা,
সেই নেতিয়ে-পড়া ঘুমিয়ে-পড়া মেয়ে।
শ্রান্ত দেহ ঢুলে ঢুলে পড়ে,
তবু মায়ের তরে আছে বুঝি চেয়ে।
আঁধার রাতে চলে গেলি তুই,
আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়।
কেউ তো তোরে দেখতে পাবে না,
তারা শুধু তারার পানে চায়।
পথে কোথাও জনপ্রাণী নেই,
ঘরে ঘরে সবাই ঘুমিয়ে আছে।
মা তোর শুধু একলা দ্বারে বসে,
চুপি চুপি আয় মা, মায়ের কাছে।
আমি তোরে নুকিয়ে রেখে দেব,
রেখে দেব বুকের মধ্যে করে —
থাক্, মা, সে তার পাষাণ হৃদি নিয়ে
অনাদর যে করেছে তোরে।
মলিন মুখে গেলি তাদের কাছে —
তবু তারা নিলে না মা কোলে?
বড়ো বড়ো আঁখি দুখানি
রইলি তাদের মুখের পানে তুলে?
এ জগৎ কঠিন — কঠিন —
কঠিন, শুধু মায়ের প্রাণ ছাড়া।
সেইখানে তুই আয় মা ফিরে আয় —
এত ডাকি দিবি নে কি সাড়া?
হে ধরণী, জীবের জননী,
শুনেছি যে মা তোমায় বলে।
তবে কেন তোর কোলে সবে
কেঁদে আসে কেঁদে যায় চলে।
তবে কেন তোর কোলে এসে
সন্তানের মেটে না পিপাসা।
কেন চায় — কেন কাঁদে সবে,
কেন কেঁদে পায় না ভালোবাসা।
কেন হেথা পাষাণ পরান
কেন সবে নীরস নিষ্ঠুর!
কেঁদে কেঁদে দুয়ারে যে আসে
কেন তারে করে দেয় দূর!
কেঁদে যে-জন ফিরে চলে যায়,
তার তরে কাঁদিস নে কেহ —
এই কি মা জননীর প্রাণ!
এই কি মা জননীর স্নেহ!
ফুলের দিনে সে যে চলে গেল,
ফুল ফোটা সে দেখে গেল না।
ফুলে ফুলে ভরে গেল বন,
একটি সে তো পরতে পেল না।
ফুল ফোটে, ফুল ঝরে যায় —
ফুল নিয়ে আর সবাই পরে।
ফিরে এসে সে যদি দাঁড়ায়,
একটিও রবে না তার তরে!
তার তরে মা কেবল আছে,
আছে শুধু জননীর স্নেহ,
আছে শুধু মা’র অশ্রুজল —
কিছু নাই, নাই আর কেহ।
খেলত যারা তারা খেলতে গেছে,
হাসত যারা তারা আজও হাসে,
তার তরে কেহ ব’সে নেই,
মা শুধু রয়েছে তারি আশে!
হায় বিধি, এ কি ব্যর্থ হবে!
ব্যর্থ হবে মা’র ভালোবাসা!
কত জনের কত আশা পুরে,
ব্যর্থ হবে মার প্রাণের আশা!
বালক , আশ্বিন-কার্তিক, ১২৯২
আগমনী
আগমনী
সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া
ফুটিল প্রভাততারা।
হেথা হোথা হতে পাখিরা গাহিল
ঢালিয়া সুধার ধারা।
মৃদুল প্রভাতসমীর পরশে
কমল নয়ন খুলিল হরষে,
হিমালয় শিরে অমল আভায়
শোভিল ধবল তুষারজটা।
খুলি গেল ধীরে পূরবদ্বার,
ঝরিল কনককিরণধার,
শিখরে শিখরে জ্বলিয়া উঠিল,
রবির বিমল কিরণছটা।
গিরিগ্রাম আজি কিসের তরে,
উঠেছে নাচিয়া হরষভরে,
অচল গিরিও হয়েছে যেমন
অধীর পাগল-পারা।
তটিনী চলেছে নাচিয়া ছুটিয়া,
কলরব উঠে আকাশে ফুটিয়া ,
ঝর ঝর ঝর করিয়া ধ্বনি
ঝরিছে নিঝরধারা।
তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া মালা,
চলিয়াছে গিরিবাসিনী বালা,
অধর ভরিয়া সুখের হাসিতে
মাতিয়া সুখের গানে।
মুখে একটিও নাহিকো বাণী
শবদচকিতা মেনকারানী
তৃষিত নয়নে আকুল হৃদয়ে,
চাহিয়া পথের পানে।
আজ মেনকার আদরিণী উমা
আসিবে বরষ-পরে।
তাইতে আজিকে হরষের ধ্বনি
উঠিয়াছে ঘরে ঘরে।
অধীর হৃদয়ে রানী আসে যায়,
কভু বা প্রাসাদশিখরে দাঁড়ায়,
কভু বসে ওঠে, বাহিরেতে ছোটে
এখনো উমা মা এলনা কেন?
হাসি হাসি মুখে পুরবাসীগণে
অধীরে হাসিয়া ভূধরভবনে,
“কই উমা কই’ বলে “উমা কই’,
তিলেক বেয়াজ সহে না যেন!
বরষের পরে আসিবেন উমা
রানীর নয়নতারা ,
ছেলেবেলাকার সহচরী যত
হরষে পাগল-পারা।
ভাবিছে সকলে আজিকে উমায়
দেখিবে নয়ন ভ’রে,
আজিকে আবার সাজাব তাহায়
বালিকা উমাটি ক’রে।
তেমনি মৃণালবলয়-যুগলে,
তেমনি চিকন-চিকন বাকলে,
তেমনি করিয়া পরাব গলায়
বনফুল তুলি গাঁথিয়া মালা।
তেমনি করিয়া পরায়ে বেশ
তেমনি করিয়া এলায়ে কেশ,
জননীর কাছে বলিব গিয়ে
“এই নে মা তোর তাপসী বালা’।
লাজ-হাসি-মাখা মেয়ের মুখ
হেরি উথলিবে মায়ের সুখ,
হরষে জননী নয়নের জলে
চুমিবে উমার সে মুখখানি।
হরষে ভূধর অধীর-পারা
হরষে ছুটিবে তটিনীধারা,
হরষে নিঝর উঠিবে উছসি,
উঠিবে উছসি মেনকারানী।
কোথা তবে তোরা পুরবাসী মেয়ে
যেথা যে আছিস আয় তোরা ধেয়ে
বনে বনে বনে ফিরিবি বালা,
তুলিবি কুসুম, গাঁথিবি মালা,
পরাবি উমার বিনোদ গলে।
তারকা-খচিত গগন-মাঝে
শারদ চাঁদিমা যেমন সাজে
তেমনি শারদা অবনী শশী
শোভিবে কেমন অবনীতলে!
ওই বুঝি উমা, ওই বুঝি আসে,
দেখো চেয়ে গিরিরানী!
আলুলিত কেশ, এলোথেলো বেশ,
হাসি-হাসি মুখখানি।
বালিকারা সব আসিল ছুটিয়া
দাঁড়াল উমারে ঘিরি।
শিথিল চিকুরে অমল মালিকা
পরাইয়া দিল ধীরি।
হাসিয়া হাসিয়া কহিল সবাই
উমার চিবুক ধ’রে,
“বলি গো স্বজনী, বিদেশে বিজনে
আছিলি কেমন করে?
আমরা তো সখি সারাটি বরষ
রহিয়াছি পথ চেয়ে —
কবে আসিবেক আমাদের সেই
মেনকারানীর মেয়ে!
এই নে, সজনী, ফুলের ভূষণ
এই নে, মৃণাল বালা,
হাসিমুখখানি কেমন সাজিবে
পরিলে কুসুম-মালা।’
কেহ বা কহিল,”এবার স্বজনি,
দিব না তোমায় ছেড়ে
ভিখারি ভবের সরবস ধন
আমরা লইব কেড়ে।
বলো তো স্বজনী, এ কেমন ধারা
এয়েছ বরষ-পরে,
কেমনে নিদিয়া রহিবে কেবল
তিনটি দিনের তরে।’
কেহ বা কহিল,”বলো দেখি,সখী,
মনে পড়ে ছেলেবেলা?
সকলে মিলিয়া এ গিরিভবনে
কত-না করেছি খেলা!
সেই মনে পড়ে যেদিন স্বজনী
গেলে তপোবন-মাঝে–
নয়নের জলে আমরা সকলে
সাজানু তাপসী-সাজে।
কোমল শরীরে বাকল পরিয়া
এলায়ে নিবিড় কেশ
লভিবারে পতি মনের মতন
কত-না সহিলে ক্লেশ।
ছেলেবেলাকার সখীদের সব
এখনো তো মনে আছে,
ভয় হয় বড়ো পতির সোহাগে
ভুলিস তাদের পাছে!’
কত কী কহিয়া হরষে বিষাদে
চলিল আলয়-মুখে,
কাঁদিয়া বালিকা পড়িল ঝাঁপায়ে
আকুল মায়ের বুকে।
হাসিয়া কাঁদিয়া কহিল রানী,
চুমিয়া উমার অধরখানি,
“আয় মা জননি আয় মা কোলে,
আজ বরষের পরে।
দুখিনী মাতার নয়নের জল
তুই যদি, মা গো, না মুছাবি বল্
তবে উমা আর ,কে আছে আমার
এ শূন্য আঁধার ঘরে?
সারাটি বরষ যে দুখে গিয়াছে
কী হবে শুনে সে ব্যথা,
বল্ দেখি, উমা, পতির ঘরের
সকল কুশল-কথা।’
এত বলি রানী হরষে আদরে
উমারে কোলেতে লয়ে,
হরষের ধারা বরষি নয়নে
পশিল গিরি-আলয়ে।
আজিকে গিরির প্রাসাদে কুটিরে
উঠিল হরষ-ধ্বনি,
কত দিন পরে মেনকা-মহিষী
পেয়েছে নয়নমণি!
ভারতী, আশ্বিন, ১২৮৪
আমার এ মনোজ্বালা
আমার এ মনোজ্বালা
আমার এ মনোজ্বালা কে বুঝিবে সরলে
কেন যে এমন করে, ম্রিয়মাণ হয়ে থাকি
কেন যে নীরবে হেন বসে থাকি বিরলে।
এ যাতনা কেহ যদি বুঝিতে পারিত দেবি,
তবে কি সে আর কভু পারিত গো হাসিতে?
হৃদয় আছয়ে যার সঁপিতে পারে সে প্রাণ
এ জ্বলন্ত যন্ত্রণার এক তিল নাশিতে!
হে সখী হে সখাগণ, আমার মর্মের জ্বালা
কেহই তোমরা যদি না পার গো বুঝিতে,
কী আগুন জ্বলে তার নিভৃত গভীর তলে
কী ঘোর ঝটিকা সনে হয় তারে যুঝিতে।
তবে গো তোমরা মোরে শুধায়ো না শুধায়ো না
কেন যে এমন করে রহিয়াছি বসিয়া
বিরলে আমারে হেথা, একলা থাকিতে দাও,
[আমা]র মনের কথা বুঝিবে কী করিয়া?
[ম্রিয়]মাণ মুখে, এই শূন্যপ্রায় নেত্রে
[ক]লঙ্ক সঁপি গো আমি তোমাদের হরষে;
পূর্ণিমা যামিনী যথা মলিন হইয়া যায়
ক্ষুদ্র এক অন্ধকার জলদের পরশে।
কিন্তু কী করিব বলো, কী চাও কী দিব আমি
তোমাদের আমোদ গো এক তিল বাড়াতে
হৃদয়ে এমন জ্বালা, কী করে হাসিব বলো
কিছুতে বিষণ্ণভাব পারি না যে তাড়াতে।
বিরক্ত হোয়ো না সখি, অমন বিরক্ত নেত্রে
আমার মুখের পানে রহিয়ো না চাহিয়া,
কী আঘাত লাগে প্রাণে, দেখি ও বিরক্ত মুখ
কেমনে সখি গো তাহা বুঝাইব কহিয়া?
ব্যথায় পাইয়া ব্যথা, যদি গো শুধাতে কথা
অশ্রুজলে মিশাইতে যদি অশ্রুজল
আদরে স্নেহের স্বরে, একটি কহিতে কথা,
অনেক নিভিত তবু এ হৃদি-অনল
জানিতাম ওগো সখি, কাঁদিলে মমতা পাব,
কাঁদিলে বিরক্ত হবে এ কী নিদারুণ?
চরণে ধরি গো সখি, একটু করিয়ো দয়া
নহিলে নিভিবে কিসে বুকের আগুন!
…
উপহার-গীতি
উপহার-গীতি
ছেলেবেলা হতে বালা, যত গাঁথিয়াছি মালা
যত বনফুল আমি তুলেছি যতনে
ছুটিয়া তোমারি কোলে, ধরিয়া তোমারি গলে
পরায়ে দিয়াছি সখি তোমারি চরণে।
আজো গাঁথিয়াছি মালা, তুলিয়া বনের ফুল
তোমারি চরণে সখি দিব গো পরায়ে —
না-হয় ঘৃণার ভরে, দলিয়ো চরণতলে
হৃদয় যেমন করে দলেছ দুপায়ে।
পৃথিবীর নিন্দাযশে, কটাক্ষ করি না বালা
তুমি যদি সোহাগেতে করহ গ্রহণ
আমার সর্বস্বধন, কবিতার মালাগুলি
পৃথিবীর তরে আমি করি নি গ্রন্থন।
আমি যে-সকল গান গাই গো মনের সুখে
সপ্তসুরে পূর্ণ করি এ শূন্য আকাশ
পৃথিবীর আর কেহ, শুনুক বা না শুনুক
তুমি যেন শুন বালা, এই অভিলাষ!
তোমার লাগিবে ভালো, তুমি গো বলিবে ভালো,
গলাবে তোমারি মন এ সংগীত-ধ্বনি
আমার মর্মের কথা, তুমিই বুঝিবে সখি
আর কেহ না বুঝুক খেদ নাহি গণি
একদিন মনে পড়ে, যাহা তাহা গাইতাম
সকলি তোমার সখি লাগিত গো ভালো
নীরবে শুনিতে তুমি, সমুখে বহিত নদী
মাথায় ঢালিত চাঁদ পূর্ণিমার আলো।
সুখের স্বপনসম, সেদিন গেল গো চলি
অভাগা অদৃষ্টে হায় এ জন্মের তরে
আমার মনের গান মর্মের রোদনধ্বনি
স্পর্শও করে না আজ তোমার অন্তরে।
তবুও — তবুও সখি তোমারেই শুনাইব
তোমারেই দিব সখি যা আছে আমার।
দিনু যা মনের সাথে, তুলিয়া লও তা হাতে
ভগ্নহৃদয়ের এই প্রীতি-উপহার।
বাড়িতে, ১লা কার্তিক, মঙ্গলবার
এ হতভাগারে ভালো কে বাসিতে চায়
এ হতভাগারে ভালো কে বাসিতে চায়
এ হতভাগারে ভালো কে বাসিতে চায়?
সুখ-আশা থাকে যদি বেসো না আমায়!
এ জীবন, অভাগার — নয়ন সলিলধার
বলো সখি কে সহিতে পারিবে তা হায়!
এ ভগ্নপ্রাণের অতি বিষাদের গান
বলো সখি কে শুনিতে পারে সারা প্রাণ
গেছি ভুলে ভালোবাসা — ছাড়িয়াছি সুখ-আশা
ভালোবেসে কাজ নাই স্বজনি আমায়!
এসো আজি সখা
এসো আজি সখা বিজন পুলিনে
বলিব মনের কথা;
মরমের তলে যা-কিছু রয়েছে
লুকানো মরম-ব্যথা।
সুচারু রজনী, মেঘের আঁচল
চাপিয়া অধরে হাসিছে শশি,
বিমল জোছনা সলিলে মজিয়া
আঁধার মুছিয়া ফেলেছে নিশি,
কুসুম কাননে বিনত আননে
মুচকিয়া হাসে গোলাপবালা,
বিষাদে মলিনা, শরমে নিলীনা,
সলিলে দুলিছে কমলিনী বধূ
ম্লানরূপে করি সরসী আলা!
আজি, খুলিয়া ফেলিব প্রাণ
আজি, গাইব কত গান,
আজি, নীরব নিশীথে,চাঁদের হাসিতে
মিশাব অফুট তান!
দুই হৃদয়ের যত আছে গান
এক সাথে আজি গাইব,
দুই হৃদয়ের যত আছে কথা
দুইজনে আজি কহিব;
কতদিন সখা, এমন নিশীথে
এমন পুলিনে বসি,
মানসের গীত গাহিয়া গাহিয়া
কাটাতে পাই নি নিশি!
স্বপনের মতো সেই ছেলেবেলা
সেইদিন সথা মনে কি হয়?
হৃদয় ছিল গো কবিতা মাখানো
প্রকৃতি আছিল কবিতাময়,
কী সুখে কাটিত পূরণিমা রাত
এই নদীতীরে আসি,
[কু]সুমের মালা গাঁথিয়া গাঁথিয়া
গনিয়া তারকারাশি।
যমুনা সুমুখে যাইত বহিয়া
সে যে কী সুখের গাইত গান,
ঘুম ঘুম আঁখি আসিত মুদিয়া
বিভল হইয়া যাইত প্রাণ!
[কত] যে সুখের কল্পনা আহা
আঁকিতাম মনে মনে
[সা] রাটি জীবন কাটাইব যেন
…
তখন কি সখা জানিতাম মনে
পৃথিবী কবির নহে
কল্পনা আর যতই প্রবল
ততই সে দুখ সহে!
এমন পৃথিবী, শোভার আকর
পাখি হেথা করে গান
কাননে কাননে কুসুম ফুটিয়া
পরিমল করে দান!
আকাশে হেথায় উঠে গো তারকা
উঠে সুধাকর, রবি,
বরন বরন জলদ দেখিছে
নদীজলে মুখছবি,
এমন পৃথিবী এও কারাগার
কবির মনের কাছে!
যে দিকে নয়ন ফিরাইতে যায়
সীমায় আটক আছে!
তাই [যে] গো সখা মনে মনে আমি
গড়েছি একটি বন,
সারাদিন সেথা ফুটে আছে ফুল,
গাইছে বিহগগণ!
আপনার ভাবে হইয়া পাগল
রাতদিন সুখে আছি গো সেথা
বিজন কাননে পাখির মতন
বিজনে গাইয়া মনের ব্যথা!
কতদিন পরে পেয়েছি তোমারে,
ভুলেছি মরমজ্বালা;
দুজনে মিলিয়া সুখের কাননে
গাঁথিব কুসুমমালা!
দুজনে মিলিয়া পূরণিমা রাতে
গাইব সুখের গান
যমুনা পুলিনে করিব দুজনে
সুখ নিশা অবসান,
আমার এ মন সঁপিয়া তোমারে
লইব তোমার মন
হৃদয়ের খেলা খেলিয়া খেলিয়া
কাটাইব সারাক্ষণ!
এইরূপে সখা কবিতার কোলে
পোহায়ে যাইবে প্রাণ
সুখের স্বপন দেখিয়া দেখিয়া
গাহিয়া সুখের গান।
ও কথা বোলো না সখি
ও কথা বোলো না সখি — প্রাণে লাগে ব্যথা —
আমি ভালোবাসি নাকো এ কিরূপ কথা!
কী জানি কী মোর দশা কহিব কেমনে
প্রকাশ করিতে নারি রয়েছে যা মনে —
পৃথিবী আমারে সখি চিনিল না তাই —
পৃথিবী না চিনে মোরে তাহে ক্ষতি নাই —
তুমিও কি বুঝিলে না এ মর্মকাহিনী
তুমিও কি চিনিলে না আমারে স্বজনি?
কী হবে বলো গো সখি
কী হবে বলো গো সখি ভালোবাসি অভাগারে
যদি ভালোবেসে থাক ভুলে যাও একেবারে —
একদিন এ হৃদয় — আছিল কুসুমময়
চরাচর পূর্ণ ছিল সুখের অমৃতধারে
সেদিন গিয়েছে সখি আর কিছু নাই
ভেঙে পুড়ে সব যেন হয়ে গেছে ছাই
হৃদয়-কবরে শুধু মৃত ঘটনার
…[র]য়েছে পড়ে স্মৃতি নাম যার।
ছেলেবেলাকার আহা, ঘুমঘোরে দেখেছিনু
ছেলেবেলাকার আহা, ঘুমঘোরে দেখেছিনু
মূরতি দেবতাসম অপরূপ স্বজনি,
ভেবেছিনু মনে মনে, প্রণয়ের চন্দ্রলোকে
খেলিব দুজনে মিলি দিবস ও রজনী,
আজ সখি একেবারে, ভেঙেছে সে ঘুমঘোর
ভেঙেছে সাধের ভুল মাখানো যা মরমে,
দেবতা ভাবিনু যারে, তার কলঙ্কের কথা
শুনিয়া মলিন মুখ ঢাকিয়াছি শরমে।
তাই ভাবিয়াছি সখি, এই হৃদয়ের পটে
এঁকেছি যে ছবিখানি অতিশয় যতনে,
অশ্রুজলে অশ্রুজলে, মুছিয়া ফেলিব তাহা,
আর না আনিব মনে, এই পোড়া জনমে।–
কিন্তু হায় — বৃথা এ আশা, মরমের মরমে যা।
আঁকিয়াছি সযতনে শোনিতের আখরে,
এ জনমে তাহা আর, মুছিবে না, মুছিবে না,
আমরণ রবে তাহা হৃদয়ের ভিতরে!
আমরণ কেঁদে কেঁদে, কাটিয়া যাইবে দিন,
নীরব আগুনে মন পুড়ে হবে ছাই লো!
মনের এ কথাগুলি গোপনে লুকায়ে রেখে
কতদিন বেঁচে রব ভাবিতেছি তাই লো!
জানি সখা অভাগীরে ভালো তুমি বাস না
জানি সখা অভাগীরে ভালো তুমি বাস না
জানি সখা অভাগীরে ভালো তুমি বাস না
ছেড়েছি ছেড়েছি নাথ তব প্রেম-কামনা —
এক ভিক্ষা মাগি হায় — নিরাশ কোরো না তায়
শেষ ভিক্ষা শেষ আশা — অন্তিম বাসনা —
এ জন্মের তরে সখা — আর তো হবে না দেখা
তুমি সুখে থেকো নাথ কী কহিব আর
একবার বোসো হেথা ভালো করে কও কথা
যে নামে ডাকিতে সখা ডাকো একবার —
ওকি সখা কেঁদোনাকো — দুখিনীর কথা রাখো
আমি গেলে বলো নাথ — কী ক্ষতি তাহার?
যাই সখা যাই তবে — ছাড়ি তোমাদের সবে —
সময় আসিছে কাছে বিদায় বিদায় ট্ট
১৮৭৪-১৮৮২ খৃস্টাব্দ
জ্বল্ জ্বল্ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ
জ্বল্ জ্বল্ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ,
পরাণ সঁপিবে বিধবা-বালা।
জ্বলুক্ জ্বলুক্ চিতার আগুন,
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা॥
শোন্ রে যবন!– শোন্ রে তোরা,
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে,
সাক্ষী র’লেন দেবতা তার
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে॥
ওই যে সবাই পশিল চিতায়,
একে একে একে অনলশিখায়,
আমরাও আয় আছি যে কজন,
পৃথিবীর কাছে বিদায় লই।
সতীত্ব রাখিব করি প্রাণপণ,
চিতানলে আজ সঁপিব জীবন–
ওই যবনের শোন্ কোলাহল,
আয় লো চিতায় আয় লো সই!
জ্বল্ জ্বল্ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ,
অনলে আহুতি দিব এ প্রাণ।
জ্বলুক্ জ্বলুক্ চিতার আগুন,
পশিব চিতায় রাখিতে মান।
দেখ্ রে যবন! দেখ্ রে তোরা!
কেমনে এড়াই কলঙ্ক-ফাঁসি;
জ্বলন্ত অনলে হইব ছাই,
তবু না হইব তোদের দাসী॥
আয় আয় বোন! আয় সখি আয়!
জ্বলন্ত অনলে সঁপিবারে কায়,
সতীত্ব লুকাতে জ্বলন্ত চিতায়,
জ্বলন্ত চিতায় সঁপিতে প্রাণ!
দেখ্ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন,
দেখ্ রে চন্দ্রমা দেখ্ রে গগন!
স্বর্গ হতে সব দেখ্ দেবগণ,
জলদ-অক্ষরে রাখ্ গো লিখে।
স্পর্ধিত যবন, তোরাও দেখ্ রে,
সতীত্ব-রতন, করিতে রক্ষণ,
রাজপুত সতী আজিকে কেমন,
সঁপিছে পরান অনল-শিখে॥
নভেম্বর, ১৮৭৫
দিল্লি দরবার
দেখিছ না অয়ি ভারত-সাগর,অয়ি গো হিমাদ্রি দেখিছ চেয়ে,
প্রলয়-কালের নিবিড় আঁধার, ভারতের ভাল ফেলেছে ছেয়ে।
অনন্ত সমুদ্র তোমারই বুকে, সমুচ্চ হিমাদ্রি তোমারি সম্মুখে,
নিবিড় আঁধারে, এ ঘোর দুর্দিনে, ভারত কাঁপিছে হরষ-রবে!
শুনিতেছি নাকি শত কোটি দাস, মুছি অশ্রুজল, নিবারিয়া শ্বাস,
সোনার শৃঙ্খল পরিতে গলায় হরষে মাতিয়া উঠেছে সবে?
শুধাই তোমারে হিমালয়-গিরি, ভারতে আজি কি সুখের দিন?
তুমি শুনিয়াছ হে গিরি-অমর, অর্জুনের ঘোর কোদণ্ডের স্বর,
তুমি দেখিয়াছ সুবর্ণ আসনে, যুধিষ্ঠির-রাজা ভারত শাসনে,
তুমি শুনিয়াছ সরস্বতী-কূলে, আর্য-কবি গায় মন প্রাণ খুলে,
তোমারে শুধাই হিমালয়-গিরি, ভারতে আজি কি সুখের দিন?
তুমি শুনিতেছ ওগো হিমালয়, ভারত গাইছে ব্রিটিশের জয়,
বিষণ্ণ নয়নে দেখিতেছ তুমি – কোথাকার এক শূন্যে মরুভূমি –
সেথা হতে আসি ভারত-আসন লয়েছে কাড়িয়া, করিছে শাসন,
তোমারে শুধাই হিমালয়-গিরি,ভারতে আজি কি সুখের দিন?
তবে এই-সব দাসের দাসেরা, কিসের হরষে গাইছে গান?
পৃথিবী কাঁপায়ে অযুত উচ্ছ্বাসে কিসের তরে গো উঠায় তান?
কিসের তরে গো ভারতের আজি, সহস্র হৃদয় উঠেছে বাজি?
যত দিন বিষ করিয়াছে পান,কিছুতে জাগে নি এ মহাশ্মশান,
বন্ধন শৃঙ্খলে করিতে সম্মান
ভারত জাগিয়া উঠেছে আজি?
কুমারিকা হতে হিমালয়-গিরি
এক তারে কভু ছিল না গাঁথা,
আজিকে একটি চরণ-আঘাতে, সমস্ত ভারত তুলেছে মাথা!
এসেছিল যবে মহম্মদ ঘোরি, স্বর্গ রসাতল জয়নাদে ভরি
রোপিতে ভারতে বিজয়ধ্বজা,
তখনো একত্রে ভারত জাগে নি, তখনো একত্রে ভারত মেলে নি,
আজ জাগিয়াছে, আজ মিলিয়াছে–
বন্ধনশৃঙ্খলে করিতে পূজা!
ব্রিটিশ-রাজের মহিমা গাহিয়া
ভূপগণ ওই আসিছে ধাইয়া
রতনে রতনে মুকুট ছাইয়া ব্রিটিশ-চরণে লোটাতে শির–
ওই আসিতেছে জয়পুররাজ, ওই যোধপুর আসিতেছে আজ
ছাড়ি অভিমান তেয়াগিয়া লাজ, আসিছে ছুটিয়া অযুত বীর!
হা রে হতভাগ্য ভারতভূমি,
কন্ঠে এই ঘোর কলঙ্কের হার
পরিবারে আজি করি অলংকার
গৌরবে মাতিয়া উঠেছে সবে?
তাই কাঁপিতেছে তোর বক্ষ আজি
ব্রিটিশ-রাজের বিজয়রবে?
ব্রিটিশ-বিজয় করিয়া ঘোষণা, যে গায় গাক্ আমরা গাব না
আমরা গাব না হরষ গান,
এসো গো আমরা যে ক’জন আছি, আমরা ধরিব আরেক তান।
১৮৭৭
পার কি বলিতে কেহ
পার কি বলিতে কেহ
পার কি বলিতে কেহ কী হল এ বুকে
যখনি শুনি গো ধীর সংগীতের ধ্বনি
যখনি দেখি গো ধীর প্রশান্ত রজনী
কত কী যে কথা আর কত কী যে ভাব
উচ্ছ্বসিয়া উথলিয়া আলোড়িয়া উঠে!
দূরাগত রাখালের বাঁশরির মতো
আধভোলা কালিকার স্বপ্নের মতন —
কী যে কথা কী যে ভাব ধরি ধরি করি
তবুও কেমন ধারা পারি না ধরিতে!
কী করি পাই না খুঁজি পাই না ভাবিয়া,
ইচ্ছা করে ভেঙেচুরে প্রাণের ভিতর
যা-কিছু যুঝিছে হৃদে খুলে ফেলি তাহা।
পাষাণ-হৃদয়ে কেন সঁপিনু হৃদয়
পাষাণ-হৃদয়ে কেন সঁপিনু হৃদয়?
মর্মভেদী যন্ত্রণায়, ফিরেও যে নাহি চায়
বুক ফেটে গেলেও যে কথা নাহি কয়
প্রাণ দিয়ে সাধিলেও, পায়ে ধরে কাঁদিলেও
এক তিল এক বিন্দু দয়া নাহি হয়
হেরিলে গো অশ্রুরাশি, বরষে ঘৃণার হাসি,
বিরক্তির তিরস্কার তীব্র বিষময়।
এত যদি ছিল মনে, তবে বলো কী কারণে
একদিন তুলেছিল স্বর্গের আলয়
একদিন স্নেহভরে, মাথা রাখি কোল -‘পরে
কেন নিয়েছিল হরে পরাণ-হৃদয়
ভগ্নবুকে কেন আর, বজ্র হানে বার বার
মনখানা নিয়ে যেন করে ছেলেখেলা —
গিয়াছে যা ভেঙেচুরে, আর কেন তার পরে
মিছামিছি বিঁধে আহা বাণ বিষময়!
প্রকৃতির খেদ – দ্বিতীয় পাঠ
[দ্বিতীয় পাঠ]
বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা, সুকুমারী শৈলবালা
অমল সলিলা গঙ্গা অই বহি যায় রে।
প্রদীপ্ত তুষাররাশি, শুভ্র বিভা পরকাশি
ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে গোমুখীর শিখরে।
ফুটিয়াছে কমলিনী অরুণের কিরণে।
নির্ঝরের এক ধারে, দুলিছে তরঙ্গ-ভরে
ঢুলে ঢুলে পড়ে জলে প্রভাত পবনে।
হেলিয়া নলিনী-দলে প্রকৃতি কৌতুকে দোলে
গঙ্গার প্রবাহ ধায় ধুইয়া চরণ।
ধীরে ধীরে বায়ু আসি দুলায়ে অলকরাশি
কবরী কুসুমগন্ধ করিছে হরণ।
বিজনে খুলিয়া প্রাণ, সপ্তমে চড়ায়ে তান,
শোভনা প্রকৃতিদেবী গা’ন ধীরে ধীরে।
নলিনী-নয়নদ্বয়, প্রশান্ত বিষাদময়
মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বহিল গভীরে।–
“অভাগী ভারত হায় জানিতাম যদি —
বিধবা হইবি শেষে, তা হলে কি এত ক্লেশে
তোর তরে অলংকার করি নিরমাণ।
তা হলে কি হিমালয়, গর্বে-ভরা হিমালয়,
দাঁড়াইয়া তোর পাশে, পৃথিবীরে উপহাসে,
তুষারমুকুট শিরে করি পরিধান।
তা হলে কি শতদলে তোর সরোবরজলে
হাসিত অমন শোভা করিয়া বিকাশ,
কাননে কুসুমরাশি, বিকাশি মধুর হাসি,
প্রদান করিত কি লো অমন সুবাস।
তা হলে ভারত তোরে, সৃজিতাম মরু করে
তরুলতা-জন-শূন্য প্রান্তর ভীষণ।
প্রজ্বলন্ত দিবাকর বর্ষিত জ্বলন্ত কর
মরীচিকা পান্থগণে করিত ছলনা।’
থামিল প্রকৃতি করি অশ্রু বরিষন
গলিল তুষারমালা, তরুণী সরসী-বালা
ফেলিল নীহারবিন্দু নির্ঝরিণীজলে।
কাঁপিল পাদপদল,উথলে গঙ্গার জল
তরুস্কন্ধ ছাড়ি লতা লুটায় ভূতলে।
ঈষৎ আঁধাররাশি, গোমুখী শিখর গ্রাসি
আটক করিল নব অরুণের কর।
মেঘরাশি উপজিয়া, আঁধারে প্রশ্রয় দিয়া,
ঢাকিয়া ফেলিল ক্রমে পর্বতশিখর।
আবার গাইল ধীরে প্রকৃতিসুন্দরী।–
“কাঁদ্ কাঁদ্ আরো কাঁদ্ অভাগী ভারত।
হায় দুখনিশা তোর, হল না হল না ভোর,
হাসিবার দিন তোর হল না আগত।
লজ্জাহীনা! কেন আর! ফেলে দে-না অলংকার
প্রশান্ত গভীর অই সাগরের তলে।
পূতধারা মন্দাকিনী ছাড়িয়া মরতভূমি
আবদ্ধ হউক পুন ব্রহ্ম-কমণ্ডলে।
উচ্চশির হিমালয়, প্রলয়ে পাউক লয়,
চিরকাল দেখেছে যে ভারতের গতি।
কাঁদ্ তুই তার পরে, অসহ্য বিষাদভরে
অতীত কালের চিত্র দেখাউক স্মৃতি।
দেখ্ আর্য-সিংহাসনে, স্বাধীন নৃপতিগণে
স্মৃতির আলেখ্যপটে রয়েছে চিত্রিত।
দেখ্ দেখি তপোবনে, ঋষিরা স্বাধীন মনে,
কেমন ঈশ্বর ধ্যানে রয়েছে ব্যাপৃত।
কেমন স্বাধীন মনে, গাইছে বিহঙ্গগণে,
স্বাধীন শোভায় শোভে কুসুম নিকর।
সূর্য উঠি প্রাতঃকালে, তাড়ায় আঁধারজালে
কেমন স্বাধীনভাবে বিস্তারিয়া কর।
তখন কি মনে পড়ে,ভারতী মানস-সরে
কেমন মধুর স্বরে বীণা ঝংকারিত।
শুনিয়া ভারত পাখি, গাইত শাখায় থাকি,
আকাশ পাতাল পৃথ্বী করিয়া মোহিত।
সে-সব স্মরণ করে কাঁদ্ লো আবার!
আয় রে প্রলয় ঝড়, গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর্,
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার।
প্রভঞ্জন ভীমবল, খুলে দেও বায়ুদল,
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক ভারতের বেশ।
ভারত-সাগর রুষি, উগরো বালুকারাশি,
মরুভূমি হয়ে থাক্ সমস্ত প্রদেশ।’
বলিতে নারিল আর প্রকৃতিসুন্দরী,
ধ্বনিয়া আকাশ ভূমি, গরজিল প্রতিধ্বনি,
কাঁপিয়া উঠিল বেগে ক্ষুদ্ধ হিমগিরি।
জাহ্নবী উন্মত্তপারা, নির্ঝর চঞ্চল ধারা,
বহিল প্রচণ্ড বেগে ভেদিয়া প্রস্তর।
প্রবল তরঙ্গভরে, পদ্ম কাঁপে থরে থরে,
টলিল প্রকৃতি-সতী আসন-উপর।
সুচঞ্চল সমীরণে, উড়াইল মেঘগণে,
সুতীব্র রবির ছটা হল বিকীরিত।
আবার প্রকৃতি-সতী আরম্ভিল গীত।–
“দেখিয়াছি তোর আমি সেই বেশ।
অজ্ঞাত আছিলি যবে মানব নয়নে।
নিবিড় অরণ্য ছিল এ বিস্তৃত দেশ।
বিজন ছায়ায় নিদ্রা যেত পশুগণে।
কুমারী অবস্থা তোর সে কি পড়ে মনে?
সম্পদ বিপদ সুখ, হরষ বিষাদ দুখ
কিছুই না জানিতিস সে কি পড়ে মনে?
সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ –
যখন মানবগণ, করে নাই নিরীক্ষণ,
তোর সেই সুদুর্গম অরণ্য প্রদেশ।
না বিতরি গন্ধ হায়, মানবের নাসিকায়
বিজনে অরণ্যফুল যাইত শুকায়ে –
তপনকিরণ-তপ্ত, মধ্যাহ্নের বায়ে।
সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ।
সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল।
না দেখি মনুষ্যমুখ, না জানিয়া দুঃখ সুখ,
না করিয়া অনুভব মান অপমান।
অজ্ঞান শিশুর মতো, আনন্দে দিবস যেত,
সংসারের গোলমালে থাকিয়া অজ্ঞান।
তা হলে তো ঘটিত না এ-সব জঞ্জাল।
সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল।
সৌভাগ্যে হানিয়া বাজ, তা হলে তো তোরে আজ
অনাথা ভিখারীবেশে কাঁদিতে হত না।
পদাঘাতে উপহাসে, তা হলে তো কারাবাসে
সহিতে হত না শেষে এ ঘোর যাতনা।
অরণ্যেতে নিরিবিলি, সে যে তুই ভালো ছিলি,
কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা।
দেখি মরীচিকা হায় আনন্দে বিহ্বলপ্রায়
না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না।
আর্যরা আইল শেষে, তোর এ বিজন দেশে,
নগরেতে পরিণত হল তোর বন।
হরষে প্রফুল্ল মুখে হাসিলি সরলা সুখে,
আশার দর্পণে মুখ দেখিলি আপন।
ঋষিগণ সমস্বরে অই সামগান করে
চমকি উঠিছে আহা হিমালয় গিরি।
ওদিকে ধনুর ধ্বনি, কাঁপায় অরণ্যভূমি
নিদ্রাগত মৃগগণে চমকিত করি।
সরস্বতী নদীকূলে, কবিরা হৃদয় খুলে
গাইছে হরষে আহা সুমধুর গীত।
বীণাপাণি কুতূহলে, মানসের শতদলে,
গাহেন সরসী-বারি করি উথলিত।
সেই-এক অভিনব, মধুর সৌন্দর্য তব,
আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে।
আঁধার সাগরতলে একটি রতন জ্বলে
একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে।
সুবিস্তৃত অন্ধকূপে, একটি প্রদীপ-রূপে
জ্বলিতিস তুই আহা, নাহি পড়ে মনে?
কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি
হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে?
এই অমানিশা তোর, আর কি হবে না ভোর
কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে।
অনন্তকালের মতো, সুখসূর্য অস্তগত
ভাগ্য কি অনন্তকাল রবে এই রূপে।
তোর ভাগ্যচক্র শেষে থামিল কি হেতা এসে,
বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার।
আয় রে প্রলয় ঝড়, গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর,
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার।
প্রভঞ্জন ভীমবল, খুলে দেও বায়ুদল,
ছিন্নভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ।
ভারতসাগর রুষি, উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ।’
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১৭৯৭ আষাঢ় শক, জুন-জুলাই ১৮৭৫
প্রকৃতির খেদ – প্রথম পাঠ
[প্রথম পাঠ]
১
বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা,
বিধির মানস-বালা,
মানস-সরসী ওই নাচিছে হরষে।
প্রদীপ্ত তুষাররাশি,
শুভ্র বিভা পরকাশি,
ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে হিমাদ্রি উরসে।
২
অদূরেতে দেখা যায়,
উজল রজত কায়,
গোমুখী হইতে গঙ্গা ওই বহে যায়।
ঢালিয়া পবিত্র ধারা,
ভূমি করি উরবরা,
চঞ্চল চরণে সতী সিন্ধুপানে ধায়।
৩
ফুটেছে কনকপদ্ম অরুণ কিরণে॥
অমল সরসী’ পরে,
কমল, তরঙ্গভরে,
ঢুলে ঢুলে পড়ে জলে প্রভাত পবনে।
৪
হেলিয়া নলিনীদলে,
প্রকৃতি কৌতুকে দোলে,
সরসী-লহরী ধায় ধুইয়া চরণ।
ধীরে ধীরে বায়ু আসি,
দুলায়ে অলকরাশি,
কবরী-কুসুম-গন্ধ করিছে হরণ।
৫
বিজনে খুলিয়া প্রাণ,
নিখাদে চড়ায়ে তান,
শোভনা প্রকৃতিদেবী গান ধীরে ধীরে।
নলিন নয়নদ্বয়,
প্রশান্ত বিষাদময়,
ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বহিল গভীরে।
৬
অভাগী ভারত! হায়, জানিতাম যদি,
বিধবা হইবি শেষে,
তা হলে কি এত ক্লেশে,
তোর তরে অলংকার করি নিরমাণ?
তা হলে কি পূতধারা মন্দাকিনী নদী
তোর উপত্যকা’পরে হত বহমান?
তা হলে কি হিমালয়,
গর্বে ভরা হিমালয়
দাঁড়াইয়া তোর পাশে
পৃথিবীরে উপহাসে,
তুষারমুকুট শিরে করি পরিধান।
৭
তা হলে কি শতদলে,
তোর সরোবরজলে,
হাসিত অমন শোভা করিয়া বিকাশ?
কাননে কুসুমরাশি,
বিকাশি মধুর হাসি,
প্রদান করিত কি লো অমন সুবাসে?
৮
তা হলে ভারত! তোরে,
সৃজিতাম মরু করে,
তরুলতা-জন-শূন্য প্রান্তর ভীষণ;
প্রজ্বলন্ত দিবাকর,
বর্ষিত জ্বলন্ত কর,
মরীচিকা পান্থদের করিত ছলন!’
থামিল প্রকৃতি করি অশ্রু বরিষন।
৯
গলিল তুষারমালা,
তরুণী সরসী বালা,
ফেনিল নীহার-নীর সরসীর জলে।
কাঁপিল পাদপদল;
উথলে গঙ্গার জল,
তরুস্কন্ধ ছাড়ি লতা লুটিল ভূতলে।
১০
ঈষৎ আঁধাররাশি,
গোমু্খী শিখর গ্রাসী,
আটক করিয়া দিল অরুণের কর।
মেঘরাশি উপজিয়া,
আঁধারে প্রশ্রয় দিয়া,
ঢাকিয়া ফেলিল ক্রমে পর্বতশিখর।
১১
আবার ধরিয়া ধীরে সুমধুর তান।
প্রকৃতি বিষাদে দুঃখে আরম্ভিল গান।
“কাঁদ্! কাঁদ্! আরো কাঁদ্ অভাগী ভারত
হায়! দুঃখ-নিশা তোর,
হল না হল না ভোর,
হাসিবার দিন তোর হল না আগত?
১২
লজ্জাহীনা! কেন আর,
ফেলে দে-না অলংকার ,
প্রশান্ত গভীর ওই সাগরের তলে?
পূতধারা মন্দাকিনী,
ছাড়িয়া মরতভূমি
আবদ্ধ হউক পুনঃ ব্রহ্ম-কমণ্ডলে।
১৩
উচ্চশির হিমালয়,
প্রলয়ে পাউক লয়,
চিরকাল দেখেছে যে ভারতের গতি।
কাঁদ্ তুই তার পরে,
অসহ্য বিষাদভরে,
অতীত কালের চিত্র দেখাউক স্মৃতি।
১৪
দেখ্, আর্য সিংহাসনে,
স্বাধীন নৃপতিগণে,
স্মৃতির আলেখ্যপটে রহেছে চিত্রিত।
দেখ্ দেখি তপোবনে,
ঋষিরা স্বাধীন মনে,
কেমন ঈশ্বরধ্যানে রহেছে ব্যাপৃত।
১৫
কেমন স্বাধীন মনে,
গাহিছে বিহঙ্গগনে,
স্বাধীন শোভায় শোভে প্রসূননিকর।
সূর্য উঠি প্রাতঃকালে,
তাড়ায় আঁধারজালে,
কেমন স্বাধীনভাবে বিস্তারিয়া কর!
১৬
তখন কি মনে পড়ে-
ভারতী-মানস-সরে,
কেমন মধুর স্বরে বীণা ঝংকারিত!
শুনিয়ে ভারত-পাখি
গাহিত শাখায় থাকি
আকাশ পাতাল পৃথ্বী করিয়া মোহিত?
১৭
সে-সব স্মরণ করে, কাঁদ লো আবার।
“আয় রে প্রলয় ঝড়
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার!
স্বর্গমর্ত্য রসাতল হোক একাকার।
১৮
প্রভাঞ্জন ভীম-বল!
খুলে দাও, বায়ুদল!
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক ভারতের বেশ।
ভারতসাগর রুষি
উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ।
১৯
বলিতে নারিল আর প্রকৃতি-সুন্দরী।
ধ্বনিয়া আকাশভূমি,
গরজিল প্রতিধ্বনি,
কাঁপিয়া উঠিল বেগে ক্ষুব্ধ হিমগিরি।
২০
জাহ্নবী উন্মত্তপারা,
নির্ঝর চঞ্চল ধারা,
বহিল প্রচন্ডবেগে ভেদিয়া প্রস্তর।
মানস সরস-পরে,
পদ্ম কাঁপে থরে থরে
দুলিল প্রকৃতি সতী আসন-উপর।
২১
সুচঞ্চল সমীরণে,
উড়াইল মেঘগণে,
সুতীব্র রবির ছটা হল বিকীরিত
আবার প্রকৃতি সতী আরম্ভিল গীত।
২২
“দেখিয়াছি তোর আমি সেই এক বেশ,
অজ্ঞাত আছিল যবে মানবনয়নে।
নিবিড় অরণ্য ছিল এ বিস্তৃত দেশ,
বিজন ছায়ায় নিদ্রা যেত পশুগণে,
কুমারী অবস্থা তোর সে কি পড়ে মনে?
সম্পদ বিপদ সুখ,
হরষ বিষাদ দুখ,কিছুই না জানিতিস্ সে কি পড়ে মনে?
সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ,
যখন মানবগণ,
করে নাই নিরীক্ষণ,
তোর সেই সুদুর্গম অরণ্যপ্রদেশ।
না বিতরি গন্ধ হায়,
মানবের নাসিকায়
বিজনে অরণ্যফুল, যাইত শুকায়ে
তপনকিরণ-তপ্ত মধ্যাহ্নের বায়ে।
সে এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ।
২৩
সেইরূপ রহিল না কেন চিরকাল!
না দেখি মনুষ্যমুখ
না জানিয়া দুঃখসুখ
না করিয়া অনুভব মান অপমান।
অজ্ঞান শিশুর মত
আনন্দে দিবস যেত,
সংসারের গোলমালে থাকিয়া অজ্ঞান।
তা হলে তো ঘটিত না এ-সব জঞ্জাল!
সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল?
সৌভাগ্যে হানিল বাজ,
তা হলে তো তোরে আজ
অনাথা ভিখারীবেশে কাঁদিতে হত না?
পদাঘাতে উপহাসে,
তা হলে তো কারাবাসে
সহিতে হত না শেষে এ ঘোর যাতনা।
২৪
অরণ্যেতে নিরিবিলি,
সে যে তুই ভালো ছিলি,
কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা।
দেখি মরীচিকা হায়!
আনন্দে বিহ্বলপ্রায়!
না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না।
২৫
আইল হিন্দুরা শেষে,
তোর এ বিজন দেশে,
নগরেতে পরিণত হল তোর বন।
হরিষে প্রফুল্লমুখে,
হাসিলি সরলা! সুখে,
আশার দর্পণে মুখ দেখিলি আপন।
২৬
ঋষিগণ সমস্বরে
অই সামগান করে
চমকি উঠিছে আহা! হিমালয় গিরি।
ওদিকে ধনুর ধ্বনি,
কাঁপায় অরণ্যভূমি
নিদ্রাগত মৃগগণে চমকিত করি।
সরস্বতী-নদীকূলে,
কবিরা হৃদয় খুলে
গাইছে হরষে আহা সুমধুর গীত।
বীণাপাণি কুতূহলে,
মানসের শতদলে
গাহেন সরসী বারি করি উথলিত।
২৭
সেই এক অভিনব
মধুর সৌন্দর্য তব,
আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে।
আঁধার সাগরতলে
একটি রতন জ্বলে
একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে।
সুবিস্তৃত অন্ধকূপে,
একটি প্রদীপ-রূপে
জ্বলিতিস তুই আহা,
নাহি পড়ে মনে?
কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি
হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে।
সেই অমানিশা তোর,
আর কি হবে না ভোর
কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে।
অনন্ত কালের মতো,
সুখসূর্য অস্তগত,
ভাগ্য কি অনন্ত কাল রবে এই রূপে।
তোর ভাগ্যচক্র শেষে,
থামিল কি হেথা এসে,
বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার
আয় রে প্রলয় ঝড়,
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার।
প্রভঞ্জন ভীমবল,
খুলে দেও বায়ুদল,
ছিন্ন ভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ।
ভারতসাগর রুষি,
উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ।
প্রতিবিম্ব, বৈশাখ, ১২৮২
প্রলাপ ২
ঢাল্! ঢাল্ চাঁদ! আরো আরো ঢাল্!
সুনীল আকাশে রজতধারা!
হৃদয় আজিকে উঠেছে মাতিয়া
পরাণ হয়েছে পাগলপারা!
গাইব রে আজ হৃদয় খুলিয়া
জাগিয়া উঠিবে নীরব রাতি!
দেখাব জগতে হৃদয় খুলিয়া
পরাণ আজিকে উঠেছে মাতি!
হাসুক পৃথিবী, হাসুক জগৎ,
হাসুক হাসুক চাঁদিমা তারা!
হৃদয় খুলিয়া করিব রে গান
হৃদয় হয়েছে পাগলপারা!
আধ ফুটো-ফুটো গোলাপ-কলিকা
ঘাড়খানি আহা করিয়া হেঁট
মলয় পবনে লাজুক বালিকা
সউরভ রাশি দিতেছে ভেট!
আয় লো প্রমদা! আয় লো হেথায়
মানস আকাশে চাcর ধারা!
গোলাপ তুলিয়া পর্ লো মাথায়
সাঁঝের গগনে ফুটিবে তারা ।
হেসে ঢল্ ঢল্ পূর্ণ শতদল
ছড়িয়ে ছড়িয়ে সুরভিরাশি
নয়নে নয়নে, অধরে অধরে
জ্যোছনা উছলি পড়িছে হাসি!
চুল হতে ফুল খুলিয়ে খুলিয়ে
ঝরিয়ে ঝরিয়ে পড়িছে ভূমে!
খসিয়া খসিয়া পড়িছে আঁচল
কোলের উপর কমল থুয়ে!
আয় লো তরুণী! আয় লো হেথায়!
সেতার ওই যে লুটায় ভূমে
বাজা লো ললনে! বাজা একবার
হৃদয় ভরিয়ে মধুর ঘুমে!
নাচিয়া নাচিয়া ছুটিবে আঙুল!
নাচিয়া নাচিয়া ছুটিবে তান!
অবাক্ হইয়া মুখপানে তোর
চাহিয়া রহিব বিভল প্রাণ!
গলার উপরে সঁপি হাতখানি
বুকের উপরে রাখিয়া মুখ
আদরে অস্ফুটে কত কি যে কথা
কহিবি পরানে ঢালিয়া সুখ!
ওই রে আমার সুকুমার ফুল
বাতাসে বাতাসে পড়িছে দুলে
হৃদয়েতে তোরে রাখিব লুকায়ে
নয়নে নয়নে রাখিব তুলে।
আকাশ হইতে খুঁজিবে তপন
তারকা খুঁজিবে আকাশ ছেয়ে!
খুঁজিয়া বেড়াবে দিকবধূগণ
কোথায় লুকাল মোহিনী মেয়ে?
আয় লো ললনে ! আয় লো আবার
সেতারে জাগায়ে দে-না লো বালা!
দুলায়ে দুলায়ে ঘাড়টি নামায়ে
কপোলেতে চুল করিবে খেলা!
কী-যে মূরতি শিশুর মতন!
আধ ফুটো-ফুটো ফুলের কলি!
নীরব নয়নে কী-যে কথা কয়
এ জনমে আর যাব না ভুলি!
কী-যে ঘুমঘোরে ছায় প্রাণমন
লাজে ভরা ওই মধুর হাসি!
পাগলিনী বালা গলাটি কেমন
ধরিস্ জড়িয়ে ছুটিয়ে আসি!
ভুলেছি পৃথিবী ভুলেছি জগৎ
ভুলেছি, সকল বিষয় মানে!
হেসেছে পৃথিবী– হেসেছে জগৎ
কটাক্ষ করিলি কাহারো পানে!
আয়! আয় বালা! তোরে সাথে লয়ে
পৃথিবী ছাড়িয়া যাই লো চলে!
চাঁদের কিরণে আকাশে আকাশে
খেলায়ে বেড়াব মেঘের কোলে!
চল্ যাই মোরা আরেক জগতে
দুজনে কেবল বেড়াব মাতি
কাননে কাননে, খেলাব দুজনে
বনদেবীকোলে যাপিব রাতি!
যেখানে কাননে শুকায় না ফুল!
সুরভি-পূরিত কুসুমকলি!
মধুর প্রেমেরে দোষে না যেথায়
সেথায় দুজনে যাইব চলি!
জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব, ফাল্গুন, ১২৮২
প্রলাপ ১
১
গিরির উরসে নবীন নিঝর,
ছুটে ছুটে অই হতেছে সারা।
তলে তলে তলে নেচে নেচে চলে,
পাগল তটিনী পাগলপারা।
২
হৃদি প্রাণ খুলে ফুলে ফুলে ফুলে,
মলয় কত কী করিছে গান।
হেতা হোতা ছুটি ফুল-বাস লুটি,
হেসে হেসে হেসে আকুল প্রাণ।
৩
কামিনী পাপড়ি ছিঁড়ি ছিঁড়ি ছিঁড়ি,
উড়িয়ে উড়িয়ে ছিঁড়িয়ে ফেলে।
চুপি চুপি গিয়ে ঠেলে ঠেলে দিয়ে,
জাগায়ে তুলিছে তটিনীজলে।
৪
ফিরে ফিরে ফিরে ধীরে ধীরে ধীরে,
হরষে মাতিয়া, খুলিয়া বুক।
নলিনীর কোলে পড়ে ঢ’লে ঢ’লে,
নলিনী সলিলে লুকায় মুখ।
৫
হাসিয়া হাসিয়া কুসুমে আসিয়া,
ঠেলিয়া উড়ায় মধুপ দলে।
গুন্ গুন্ গুন্ রাগিয়া আগুন,
অভিশাপ দিয়া কত কী বলে।
৬
তপন কিরণ — সোনার ছটায়,
লুটায় খেলায় নদীর কোলে।
ভাসি ভাসি ভাসি স্বর্ণ ফুলরাশি
হাসি হাসি হাসি সলিলে দোলে।
৭
প্রজাপতিগুলি পাখা দুটি তুলি
উড়িয়া উড়িয়া বেড়ায় দলে।
প্রসারিয়া ডানা করিতেছে মানা
কিরণে পশিতে কুসুমদলে।
৮
মাতিয়াছে গানে সুললিত তানে
পাপিয়া ছড়ায় সুধার ধার।
দিকে দিকে ছুটে বন জাগি উঠে
কোকিল উতর দিতেছে তার।
৯
তুই কে লো বালা! বন করি আলা,
পাপিয়ার সাথে মিশায়ে তান!
হৃদয়ে হৃদয়ে লহরী তুলিয়া,
অমৃত ললিত করিস্ গান।
১০
স্বর্গ ছায় গানে বিমানে বিমানে
ছুটিয়া বেড়ায় মধুর তান।
মধুর নিশায় ছাইয়া পরান,
হৃদয় ছাপিয়া উঠেছে গান।
১১
নীরব প্রকৃতি নীরব ধরা।
নীরবে তটিনী বহিয়া যায়।
তরুণী ছড়ায় অমৃতধারা,
ভূধর, কানন, জগত ছায়।
১২
মাতাল করিয়া হৃদয় প্রাণ,
মাতাল করিয়া পাতাল ধরা।
হৃদয়ের তল অমৃতে ডুবায়ে,
ছড়ায় তরুণী অমৃতধারা।
১৩
কে লো তুই বালা! বন করি আলা,
ঘুমাইছে বীণা কোলের ‘পরে।
জ্যোতির্ম্ময়ী ছায়া স্বরগীয় মায়া,
ঢল ঢল ঢল প্রমোদ-ভরে।
১৪
বিভোর নয়নে বিভোর পরানে —
চারি দিক্ পানে চাহিস্ হেসে!
হাসি উঠে দিক্! ডাকি উঠে পিক্!
নদী ঢলে পড়ে পুলিন দেশে!!
১৫
চারি দিক্ চেয়ে কে লো তুই মেয়ে,
হাসি রাশি রাশি ছড়িয়ে দিস্?
আঁধার ছুটিয়া জোছনা ফুটিয়া
কিরণে উজলি উঠিছে দিশ্!
১৬
কমলে কমলে এ ফুলে ও ফুলে,
ছুটিয়া খেলিয়া বেড়াস্ বালা!
ছুটে ছুটে ছুটে খেলায় যেমন
মেঘে মেঘে মেঘে দামিনী-মালা।
১৭
নয়নে করুণা অধরে হাসি,
উছলি উছলি পড়িছে ছাপি।
মাথায় গলায় কুসুমরাশি
বাম করতলে কপোল চাপি।
১৮
এতকাল তোরে দেখিনু সেবিনু —
হৃদয়-আসনে দেবতা বলি।
নয়নে নয়নে, পরানে পরানে,
হৃদয়ে হৃদয়ে রাখিনু তুলি।
১৯
তবুও তবুও পূরিল না আশ,
তবুও হৃদয় রহেছে খালি।
তোরে প্রাণ মন করিয়া অর্পণ
ভিখারি হইয়া যাইব চলি।
২০
আয় কল্পনা মিলিয়া দুজনা,
ভূধরে কাননে বেড়াব ছুটি।
সরসী হইতে তুলিয়া কমল
লতিকা হইতে কুসুম লুটি।
২১
দেখিব ঊষার পূরব গগনে,
মেঘের কোলেতে সোনার ছটা।
তুষার-দর্পণে দেখিছে আনন
সাঁজের লোহিত জলদ-ঘটা।
২২
কনক-সোপানে উঠিছে তপন
ধীরে ধীরে ধীরে উদয়াচলে।
ছড়িয়ে ছড়িয়ে সোনার বরন,
তুষারে শিশিরে নদীর জলে।
২৩
শিলার আসনে দেখিব বসিয়ে,
প্রদোষে যখন দেবের বালা
পাহাড়ে লুকায়ে সোনার গোলা
আঁখি মেলি মেলি করিবে খেলা।
২৪
ঝর ঝর ঝর নদী যায় চলে,
ঝুরু ঝুরু ঝুরু বহিছে বায়।
চপল নিঝর ঠেলিয়া পাথর
ছুটিয়া — নাচিয়া — বহিয়া যায়।
২৫
বসিব দুজনে — গাইব দুজনে,
হৃদয় খুলিয়া, হৃদয়ব্যথা;
তটিনী শুনিবে, ভূধর শুনিবে
জগত শুনিবে সে-সব কথা।
২৬
যেথায় যাইবি তুই কলপনা,
আমিও সেথায় যাইব চলি।
শ্মশানে, শ্মশানে — মরু বালুকায়,
মরীচিকা যথা বেড়ায় ছলি।
২৭
আয় কলপনা আয় লো দুজনা,
আকাশে আকাশে বেড়াই ছুটি।
বাতাসে বাতাসে আকাশে আকাশে
নবীন সুনীল নীরদে উঠি।
২৮
বাজাইব বীণা আকাশ ভরিয়া,
প্রমোদের গান হরষে গাহি,
যাইব দুজনে উড়িয়া উড়িয়া,
অবাক জগত রহিবে চাহি!
২৯
জলধররাশি উঠিবে কাঁপিয়া,
নব নীলিমায় আকাশ ছেয়ে।
যাইব দুজনে উড়িয়া উড়িয়া,
দেবতারা সব রহিবে চেয়ে।
৩০
সুর-সুরধুনী আলোকময়ী,
উজলি কনক বালুকারাশি।
আলোকে আলোকে লহরী তুলিয়া,
বহিয়া বহিয়া যাইছে হাসি।
৩১
প্রদোষ তারায় বসিয়া বসিয়া,
দেখিব তাহার লহরীলীলা।
সোনার বালুকা করি রাশ রাশ,
সুর-বালিকারা করিবে খেলা।
৩২
আকাশ হইতে দেখিব পৃথিবী!
অসীম গগনে কোথায় পড়ে।
কোথায় একটি বালুকার রেণু
বাতাসে আকাশে আকাশে ঘোরে।
৩৩
কোথায় ভূধর কোথায় শিখর
অসীম সাগর কোথায় পড়ে।
কোথায় একটি বালুকার রেণু,
বাতাসে আকাশে আকাশে ঘোরে।
৩৪
আয় কল্পনা আয় লো দুজনা,
এক সাথে সাথে বেড়াব মাতি।
পৃথিবী ফিরিয়া জগত ফিরিয়া,
হরষে পুলকে দিবস রাতি।
জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব, অগ্রহায়ণ, ১২৮২
প্রলাপ ৩
আয় লো প্রমদা! নিঠুর ললনে
বার বার বল্ কী আর বলি!
মরমের তলে লেগেছে আঘাত
হৃদয় পরাণ উঠেছে জ্বলি!
আর বলিব না এই শেষবার
এই শেষবার বলিয়া লই
মরমের তলে জ্বলেছে আগুন
হৃদয় ভাঙিয়া গিয়াছে সই!
পাষাণে গঠিত সুকুমার ফুল!
হুতাশনময়ী দামিনী বালা!
অবারিত করি মরমের তল
কহিব তোরে লো মরম জ্বালা!
কতবার তোরে কহেছি ললনে!
দেখায়েছি খুলে হৃদয় প্রাণ!
মরমের ব্যথা,হৃদয়ের কথা,
সে-সব কথায় দিস্ নি কান।
কতবার সখি বিজনে বিজনে
শুনায়েছি তোরে প্রেমের গান,
প্রেমের আলাপক প্রেমের প্রলাপ
সে-সব প্রলাপে দিস্ নি কান!
কতবার সখি! নয়নের জল
করেছি বর্ষণ চরণতলে!
প্রতিশোধ তুই দিস্ নিকো তার
শুধু এক ফোঁটা নয়নজলে!
শুধা ওলো বালা! নিশার আঁধারে
শুধা ওলো সখি! আমার রেতে
আঁখিজল কত করেছে গোপন
মর্ত্য পৃথিবীর নয়ন হতে!
শুধা ওলো বালা নিশার বাতাসে
লুটিতে আসিয়া ফুলের বাস
হৃদয়ে বহন করেছে কিনা সে–
নিরাশ প্রেমীর মরম শ্বাস!
সাক্ষী আছ ওগো তারকা চন্দ্রমা!
কেঁদেছি যখন মরম শোকে–
হেসেছে পৃথিবী, হেসেছে জগৎ
কটাক্ষ করিয়া হেসেছে লোকে!
সহেছি সে-সব তোর তরে সখি!
মরমে মরমে জ্বলন্ত জ্বালা !
তুচ্ছ করিবারে পৃথিবী জগতে
তোমারি তরে লো শিখেছি বালা!
মানুষের হাসি তীব্র বিষমাখা
হৃদয় শোণিত করেছে ক্ষয়!
তোমারি তরে লো সহেছি সে-সব
ঘৃণা উপহাস করেছি জয়!
কিনিতে হৃদয় দিয়েছি হৃদয়
নিরাশ হইয়া এসেছি ফিরে;
অশ্রু মাগিবারে দিয়া অশ্রুজল
উপেক্ষিত হয়ে এয়েছি ফিরে।
কিছুই চাহি নি পৃথিবীর কাছে-
প্রেম চেয়েছিনু ব্যাকুল মনে।
সে বাসনা যবে হল না পূরণ
চলিয়া যাইব বিজন বনে!
তোর কাছে বালা এই শেষবার
ফেলিল সলিল ব্যাকুল হিয়া
ভিখারি হইয়া যাইব লো চলে
প্রেমের আশায় বিদায় দিয়া !
সেদিন যখন ধন, যশ, মান,
অরির চরণে দিলাম ঢালি
সেইদিন আমি ভেবেছিনু মনে
উদাস হইয়া যাইব চলি।
তখনো হায় রে একটি বাঁধনে
আবদ্ধ আছিল পরাণ দেহ।
সে দৃঢ় বাঁধন ভেবেছিনু মনে
পারিবে না আহা ছিঁড়িতে কেহ!
আজ ছিঁড়িয়াছে, আজ ভাঙিয়াছে,
আজ সে স্বপন গিয়াছে চলি।
প্রেম ব্রত আজ করি উদ্যাপন
ভিখারি হইয়া যাইব চলি!
পাষাণের পটে ও মূরতিখানি
আঁকিয়া হৃদয়ে রেখেছি তুলি
গরবিনি! তোর ওই মুখখানি
এ জনমে আর যাব না ভুলি!
মুছিতে নারিব এ জনমে আর
নয়ন হইতে নয়নবারি
যতকাল ওই ছবিখানি তোর
হৃদয়ে রহিবে হৃদয় ভরি।
কী করিব বালা মরণের জলে
ওই ছবিখানি মুছিতে হবে!
পৃথিবীর লীলা ফুরাইবে আজ,
আজিকে ছাড়িয়া যাইব ভবে!
এ ভাঙা হৃদয় কত সবে আর!
জীর্ণ প্রাণ কত সহিবে জ্বালা!
মরণের জল ঢালিয়া অনলে
হৃদয় পরাণ জুড়াল বালা!
তোরে সখি এত বাসিতাম ভালো
খুলিয়া দেছিনু হৃদয়তল
সে-সব ভাবিয়া ফেলিবি না বালা
শুধু এক ফোঁটা নয়ন জল?
আকাশ হইতে দেখি যদি বালা
নিঠুর ললনে! আমার তরে
এক ফোঁটা আহা নয়নের জল
ফেলিস্ কখনো বিষাদভরে!
সেই নেত্রজলে– এক বিন্দু জলে
নিভায়ে ফেলিব হৃদয় জ্বালা!
প্রদোষে বসিয়া প্রদোষ তারায়
প্রেম গান সুখে করিব বালা!
জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব, বৈশাখ, ১২৮৩
ভারতী
শুধাই অয়ি গো ভারতী তোমায়
তোমার ও বীণা নীরব কেন?
কবির বিজন মরমে লুকায়ে
নীরবে কেন গো কাঁদিছ হেন?
অযতনে, আহা, সাধের বীণাটি
ঘুমায়ে রয়েছে কোলের কাছে,
অযতনে, আহা, এলোথেলো চুল
এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে।
কেন গো আজিকে এ-ভাব তোমার
কমলবাসিনী ভারতী রানী–
মলিন মলিন বসন ভূষণ
মলিন বদনে নাহিকো বাণী।
তবে কি জননি অমৃতভাষিণি
তোমার ও বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও বীণা আর না বাজিবে তবে?
দেখো তবে মাতা দেখো গো চাহিয়া
তোমার ভারত শ্মশান-পারা,
ঘুমায়ে দেখিছে সুখের স্বপন
নরনারী সব চেতনহারা।
যাহা-কিছু ছিল সকলি গিয়াছে,
সে-দিনের আর কিছুই নাই,
বিশাল ভারত গভীর নীরব,
গভীর আঁধার যে-দিকে চাই।
তোমারো কি বীণা ভারতি জননী,
তোমারো কি বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও-বীণা আর না বাজিবে তবে?
না না গো, ভারতী, নিবেদি চরণে
কোলে তুলে লও মোহিনী বীণা।
বিলাপের ধ্বনি উঠাও জননি,
দেখিব ভারত জাগিবে কি না।
অযুত অযুত ভারতনিবাসী
কাঁদিয়া উঠিবে দারুণ শোকে,
সে রোদনধ্বনি পৃথিবী ভরিয়া
উঠিবে, জননি, দেবতালোকে।
তা যদি না হয় তা হলে, ভারতি,
তুলিয়া লও বিজয়ভেরী,
বাজাও জলদগভীর গরজে
অসীম আকাশ ধ্বনিত করি।
গাও গো হুতাশ-পূরিত গান,
জ্বলিয়া উঠুক অযুত প্রাণ,
উথলি উঠুক ভারত-জলধি–
কাঁপিয়া উঠুক অচলা ধরা।
দেখিব তখন প্রতিভাহীনা
এ ভারতভূমি জাগিবে কি না,
ঢাকিয়া বয়ান আছে যে শয়ান
শরমে হইয়া মরমে-মরা!
এই ভারতের আসনে বসিয়া
তুমিই ভারতী গেয়েছ গান,
ছেয়েছে ধরার আঁধার গগন
তোমারি বীণার মোহন তান।
আজও তুমি, মাতা, বীণাটি লইয়া
মরম বিঁধিয়া গাও গো গান–
হীনবল সেও হইবে সবল,
মৃতদেহ সেও পাইবে প্রাণ।
ভারতী, শ্রাবণ, ১২৮৪
ভেবেছি কাহারো সাথে
ভেবেছি কাহারো সাথে মিশিব না আর
কারো কাছে বর্ষিব না অশ্রুবারিধার।
মানুষ পরের দুখে, করে শুধু উপহাস
জেনেছি, দেখেছি তাহা শত শত বার
যাহাদের মুখ আহা একটু মলিন হলে
যন্ত্রণায় ফেটে যায় হৃদয় আমার
তারাই — তারাই যদি এত গো নিষ্ঠুর হল
তবে আমি হতভাগ্য কী করিব আর!
সত্য তুমি হও সাক্ষী, ধর্ম তুমি জেনো ইহা
ঈশ্বর! তুমিই শুন প্রতিজ্ঞা আমার।
যার তরে কেঁদে মরি, সেই যদি উপহাসে
তবে মানুষের সাথে মিশিব না আর।
মেঘ্লা শ্রাবণের বাদ্লা রাতি
মেঘ্লা শ্রাবণের বাদ্লা রাতি
মেঘ্লা শ্রাবণের বাদ্লা রাতি,
বাহিরে ঝড় বাতাস,
জান্লা রুধি ঘরে জ্বালায়ে বাতি
বন্ধু মিলি খেলে তাস।
বন্ধু পাঁচ জনে বসিয়া গৃহকোণে
চিত্ত বড়োই উদাস,
কর্ম হাতে নাই, কভু বা উঠে হাই
কভু বা করে হা-হুতাশ।
বিরস ম্লান-মুখো, মেজাজ বড়ো রুখো,
শেষে বা বাধে হাতাহাতি!
আকাশ ঢাকা মেঘে, বাতাস রেগেমেগে
বাহিরে করে মাতামাতি।
অবন বলে ভাই তর্কে কাজ নাই
প্রমারা হোক এক বাজি —
সমর মুদি চোখ বলিল তাই হোক
সত্য কহে আছি রাজি।
বজ্র দিক জুড়ি করিছে হুড়োমুড়ি
হরিশ ভয়ে হত-বুলি,
গগন এক ধারে কিছু না বলি কারে
পলকে ছবি নিল তুলি।
শারদা
ওই শুনি শূন্যপথে রথচক্রধ্বনি,
ও নহে শারদমেঘে লঘু গরজন।
কাহার আসার আশে নীরবে অবনী
আকুল শিশিরজলে ভাসায় নয়ন!
কার কন্ঠহার হ’তে সোনার ছটায়
চারি দিকে ঝলমল শারদ-কিরণ!
প্রফুল্ল মালতী বনে প্রভাতে লুটায়
কাহার অমল শুভ্র অঞ্চল-বসন!
কাহার মঞ্জুল হাসি, সুগন্ধ নিশ্বাস
নিকুঞ্জে ফুটায়ে তুলে শেফালি কামিনী।
ওকি রাজহংসরব, ওই কলভাষ?
নহে গো, বাজিছে অঙ্গে কঙ্কণ কিঙ্কিনী।
ছাড়িয়া অনন্তধাম সৌন্দর্য-কৈলাস,
আসিছেন এ বঙ্গের আনন্দ-রূপিণী।
হা বিধাতা — ছেলেবেলা হতেই এমন
প্রথম সর্গ
হা বিধাতা — ছেলেবেলা হতেই এমন
দুর্বল হৃদয় লয়ে লভেছি জনম,
আশ্রয় না পেলে কিছু, হৃদয় আমার
অবসন্ন হয়ে পড়ে লতিকার মতো।
স্নেহ-আলিঙ্গন-পাশে বদ্ধ না হইলে
কাঁদে ভূমিতলে পড়ে হয়ে ম্রিয়মাণ।
তবে হে ঈশ্বর! তুমি কেন গো আমারে
ঐশ্বর্যের আড়ম্বরে করিলে নিক্ষেপ;
যেখানে সবারি হৃদি যন্ত্রের মতন;
স্নেহ প্রেম হৃদয়ের বৃত্তি সমুদয়
কঠোর নিয়মে যেথা হয় নিয়মিত।
কেন আমি হলেম না কৃষক-বালক,
ভায়ে ভায়ে মিলে মিলে করিতাম খেলা,
গ্রামপ্রান্তে প্রান্তরের পর্ণের কুটিরে
পিতামাতা ভাইবোন সকলে মিলিয়া
স্বাভাবিক হৃদয়ের সরল উচ্ছ্বাসে,
মুক্ত ওই প্রান্তরের বায়ুর মতন
হৃদয়ের স্বাধীনতা করিতাম ভোগ।
শ্রান্ত হলে খেলা-সুখে সন্ধ্যার সময়ে
কুটিরে ফিরিয়া আসি ভালোবাসি যারে
তার স্নেহময় কোলে রাখিতাম মাথা,
তা হইলে দ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদ
মুহূর্তে মুহূর্তে আর হত না সহিতে।
হৃদয়বিহীন প্রাসাদের আড়ম্বর
গর্বিত এ নগরের ঘোর কোলাহল
কৃত্রিম এ ভদ্রতার কঠোর নিয়ম
ভদ্রতার কাষ্ঠ হাসি,নহে মোর তরে।
দরিদ্র গ্রামের ভাঙাচোরা পথ,
গৃহস্থের ছোটোখাটো নিভৃত কুটির
যেখানে কোথা বা আছে, তৃণ রাশি রাশি,
কোথা বা গাছের তলে বাঁধা আছে গাভী
অযত্নে চিবায় কভু গাছের পল্লব
কভু বা দেখিছে চাহি বাৎসল্য-নয়নে
ক্রীড়াশীল কুটিরের শিশুদের দিকে।
কুটিরের বধূগন উঠিয়া প্রভাতে
আপনার আপনার কাজে আছে রত।
সে ক্ষুদ্র কুটির আর ভাঙাচোরা পথ,
দিগন্তের পদতলে বিশাল প্রান্তর
… যৌবনময় হৃদয়ে যাহার
… তৃণফুল শুকায় নিভৃতে
ছবি দেখে কল্পনার স্বপ্নের মতন
তা হইলে মধুময় কবিতার মতো
কেমন আরামে যেত জীবন কাটিয়া।
এমন হৃদয়হীন উপেক্ষার মাঝে
একজন ছিল মোর প্রেমের প্রতিমা,
অমিয়া, সে বালিকারে কত ভালোবাসি।
দিগন্তের দূর প্রান্তে ঘুমন্ত চন্দ্রমা,
ধবল জলদ জালে, আধো আধো ঢাকা–
বালিকা তেমনি আহা মধুর কোমল।
সেই বালা দয়া করি হৃদয় আমার
রেখেছিল জুড়াইয়া স্নেহের ছায়ায়।
অনন্ত-প্রণয়ময়ী রমণী তোমরা
পৃথিবীর মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
তোমাদের স্নেহধারা যদি না বর্ষিত
হৃদয় হইত তবে মরুভূমিসম
স্নেহ দয়া প্রেম ভক্তি যাইত শুকায়ে।
তোমরাই পৃথিবীর সংগীত, কবিতা,
স্বর্গ, সে তো তোমাদের বিরাজে
সে হৃদয়ে স্নেহছায়ে দিলে গো আশ্রয়
পাষাণ-হৃদয় সেও যায় গো গলিয়া!
কেহই আশ্রয় যবে ছিল না অমিয়া!
জননী, ভগ্নীর মতো বেসেছিলে ভালো
সে কি আর এ জনমে পারিব ভুলিতে?
বিষণ্ণ কাতর এক বালকের ‘পরে
সে যে কী স্নেহের ধারা করেছ বর্ষণ
চিরকাল হৃদয়ে তা রহিবে মুদ্রিত।
ওই স্নেহময় কোলে রাখি শ্রান্ত মাথা
কাতর হইয়া কত করেছি রোদন
কত-না ব্যথিত হয়ে আদরে যতনে
অঞ্চলে সে অশ্রুজল দিয়াছ মুছায়ে।
কবিতা লিখিলে ছুটে ওই কোলে গিয়া
ওই গলা ধরে তাহা শুনিতাম কত
বাল্যহৃদয়ের মোর যত ছিল কথা
তোমার কাছেতে কিছু করিনি গোপন।
ওই স্নেহময় কোল ছিল স্বর্গ মোর
সেইখানে একবার মুখ লুকাইলে
সব শ্রান্তি সব জ্বালা যেত দূর হয়ে।
শ্রান্ত শিশুটির মতো ওই কোলে যবে
নীরবে নিষ্পন্দ হয়ে রহিতাম শুয়ে
অনন্ত স্নেহেতে পূর্ণ আনত নয়নে
কেমন মুখের পানে চাহিয়া রহিতে
তখন কী হর্ষে হৃদি যাইত ফাটিয়া!
কতবার করিয়াছি কত অভিমান,
আদরেতে উচ্ছ্বসিয়া কেঁদেছি কতই।
মালতী পুঁথি
হা রে বিধি কী দারুণ অদৃষ্ট আমার
হা রে বিধি কী দারুণ অদৃষ্ট আমার
হারে বিধি কী দারুণ অদৃষ্ট আমার
যারে যত ভালোবাসি, যার তরে কাঁদে প্রাণ
হৃদয়ে আঘাত দেয় সেই বারে বার —
যারে আমি বন্ধু বলি, করিয়াছি আলিঙ্গন
সেই এ হৃদয় করিয়াছে চুরমার
যারেই বেসেছি ভালো, সেই চিরকাল-তরে
পৃথিবীর কাছে দুঃখ পেয়েছে অপার।
হান বিধি হান বজ্র, আমার এ ভগ্নহৃদে
তিলেক বাঁচিতে নাই বাসনা আমার
প্রস্তরে গঠিত এই, হৃদয়বিহীন ধরা
হেথা কত কাল বলো বেঁচে রব আর।
হিন্দুমেলায় উপহার
১
হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন’পরি,
গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি —
কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন,
কাঁপায়ে নীহারশীতল বায়।
২
স্তব্ধ শিখর স্তব্ধ তরুলতা,
স্তব্ধ মহীরূহ নড়েনাকো পাতা।
বিহগ নিচয় নিস্তব্ধ অচল;
নীরবে নির্ঝর বহিয়া যায়।
৩
পূরণিমা রাত — চাঁদের কিরণ —
রজতধারায় শিখর, কানন,
সাগর-ঊরমি, হরিত-প্রান্তর,
প্লাবিত করিয়া গড়ায়ে যায়।
৪
ঝংকারিয়া বীণা কবিবর গায়,
“কেন রে ভারত কেন তুই, হায়,
আবার হাসিস্! হাসিবার দিন
আছে কি এখনো এ ঘোর দুঃখে।
৫
দেখিতাম যবে যমুনার তীরে,
পূর্ণিমা নিশীথে নিদাঘ সমীরে,
বিশ্রামের তরে রাজা যুধিষ্ঠির,
কাটাতেন সুখে নিদাঘ-নিশি।
৬
তখন ওহাসি লেগেছিল ভালো,
তখন ওবেশ লেগেছিল ভালো,
শ্মশান লাগিত স্বরগ সমান,
মরু উরবরা ক্ষেতের মতো।
৭
তখন পূর্ণিমা বিতরিত সুখ,
মধুর উষার হাস্য দিত সুখ,
প্রকৃতির শোভা সুখ বিতরিত
পাখির কূজন লাগিত ভালো।
৮
এখন তা নয়, এখন তা নয়,
এখন গেছে সে সুখের সময়।
বিষাদ আঁধার ঘেরেছে এখন,
হাসি খুশি আর লাগে না ভালো।
৯
অমার আঁধার আসুক এখন,
মরু হয়ে যাক ভারত-কানন,
চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন
প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক্।
১০
যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে,
প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে,
ডুবাক ভারতে সাগরের জলে,
ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্।
১১
চাই না দেখিতে ভারতেরে আর,
চাই না দেখিতে ভারতেরে আর,
সুখ-জন্মভূমি চির বাসস্থান,
ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক।
১২
দেখেছি সে-দিন যবে পৃথ্বীরাজ,
সমরে সাধিয়া ক্ষত্রিয়ের কাজ,
সমরে সাধিয়া পুরুষের কাজ,
আশ্রয় নিলেন কৃতান্ত-কোলে।
১৩
দেখেছি সে-দিন দুর্গাবতী যবে,
বীরপত্নীসম মরিল আহবে
বীরবালাদের চিতার আগুন,
দেখেছি বিস্ময়ে পুলকে শোকে।
১৪
তাদের স্মরিলে বিদরে হৃদয়,
স্তব্ধ করি দেয় অন্তরে বিস্ময়;
যদিও তাদের চিতাভস্মরাশি,
মাটির সহিত মিশায়ে গেছে!
১৫
আবার সেদিন (ও) দেখিয়াছি আমি,
স্বাধীন যখন এ-ভারতভূমি
কী সুখের দিন! কী সুখের দিন!
আর কি সেদিন আসিবে ফিরে?
১৬
রাজা যুধিষ্ঠির (দেখেছি নয়নে)
স্বাধীন নৃপতি আর্য-সিংহাসনে,
কবিতার শ্লোকে বীণার তারেতে,
সেসব কেবল রয়েছে গাঁথা!
১৭
শুনেছি আবার, শুনেছি আবার,
রাম রঘুপতি লয়ে রাজ্যভার,
শাসিতেন হায় এ-ভারতভূমি,
আর কি সে-দিন আসিবে ফিরে!
১৮
ভারত-কঙ্কাল আর কি এখন,
পাইবে হায় রে নূতন জীবন;
ভারতের ভস্মে আগুন জ্বলিয়া,
আর কি কখনো দিবে রে জ্যোতি।
১৯
তা যদি না হয় তবে আর কেন,
হাসিবি ভারত! হাসিবি রে পুনঃ,
সে-দিনের কথা জাগি স্মৃতিপটে,
ভাসে না নয়ন বিষাদজলে?
২০
অমার আঁধার আসুক এখন,
মরু হয়ে যাক ভারত-কানন,
চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন,
প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক।
২১
যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে,
প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে,
ডুবাক ভারতে সাগরের জলে,
ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্।
২২
মুছে যাক্ মোর স্মৃতির অক্ষর,
শূন্যে হোক্ লয় এ শূন্য অন্তর,
ডুবুক আমার অমর জীবন,
অনন্ত গভীর কালের জলে।’
অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫
হিমালয়
যেখানে জ্বলিছে সূর্য, উঠিছে সহস্র তারা,
প্রজ্বলিত ধূমকেতু বেড়াইছে ছুটিয়া।
অসংখ্য জগৎযন্ত্র, ঘুরিছে নিয়মচক্রে
অসংখ্য উজ্জ্বল গ্রহ রহিয়াছে ফুটিয়া।
গম্ভীর অচল তুমি, দাঁড়ায়ে দিগন্ত ব্যাপি,
সেই আকাশের মাঝে শুভ্র শির তুলিয়া।
নির্ঝর ছুটিছে বক্ষে, জলদ ভ্রমিছে শৃঙ্গে,
চরণে লুটিছে নদী শিলারাশি ঠেলিয়া।
তোমার বিশাল ক্রোড়ে লভিতে বিশ্রাম-সুখ
ক্ষুদ্র নর আমি এই আসিয়াছি ছুটিয়া।
পৃথিবীর কোলাহল, পারি না সহিতে আর ,
পৃথিবীর সুখ দুখ গেছে সব মিটিয়া ।
সারাদিন, সারারাত, সমুচ্চ শিখরে বসি,
চন্দ্র-সূর্য-গ্রহময় শূন্যপানে চাহিয়া।
জীবনের সন্ধ্যাকাল কাটাইব ধীরে ধীরে,
নিরালয় মরমের গানগুলি গাহিয়া।
গভীর নীরব গিরি, জোছনা ঢালিবে চন্দ্র,
দূরশৈলমালাগুলি চিত্রসম শোভিবে।
ধীরে ধীরে ঝুরু ঝুরু, কাঁপিবেক গাছপালা
একে একে ছোটো ছোটো তারাগুলি নিভিবে।
তখন বিজনে বসি, নীরবে নয়ন মুদি,
স্মৃতির বিষণ্ণ ছবি আঁকিব এ মানসে।
শুনিব সুদূর শৈলে, একতানে নির্ঝারিণী,
ঝর ঝর ঝর ঝর মৃদুধ্বনি বরষে।
ক্রমে ক্রমে আসিবেক জীবনের শেষ দিন,
তুষার শয্যার ‘ পরে রহিব গো শুইয়া।
মর মর মর মর দুলিবে গাছের পাতা
মাথার উপরে হুহু — বায়ু যাবে বহিয়া।
চোখের সামনে ক্রমে , নিভিবে রবির আলো
বনগিরি নির্ঝরিণী অন্ধকারে মিশিবে।
তটিনীর মৃদুধ্বনি, নিঝরের ঝর ঝর
ক্রমে মৃদুতর হয়ে কানে গিয়া পশিবে।
এতকাল যার বুকে, কাটিয়া গিয়াছে দিন,
দেখিতে সে ধরাতল শেষ বার চাহিব।
সারাদিন কেঁদে কেঁদে — ক্লান্ত শিশুটির মতো
অনন্তের কোলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়িব।
সে ঘুম ভাঙিবে যবে, নূতন জীবন ল’য়ে,
নূতন প্রেমের রাজ্যে পুন আঁখি মেলিব।
যত কিছু পৃথিবীর দুখ,জ্বালা, কোলাহল,
ডুবায়ে বিস্মৃতি-জলে মুছে সব ফেলিব।
ওই যে অসংখ্য তারা, ব্যাপিয়া অনন্ত শূন্য
নীরবে পৃথিবী-পানে রহিয়াছে চাহিয়া।
ওই জগতের মাঝে, দাঁড়াইব এক দিন,
হৃদয় বিস্ময়-গান উঠিবেক গাহিয়া।
রবি শশি গ্রহ তারা, ধূমকেতু শত শত
আঁধার আকাশ ঘেরি নিঃশবদে ছুটিছে।
বিস্ময়ে শুনিব ধীরে, মহাস্তব্ধ প্রকৃতির
অভ্যন্তর হতে এক গীতধ্বনি উঠিছে।
গভীর আনন্দ-ভরে, বিস্ফারিত হবে মন
হৃদয়ের ক্ষুদ্র ভাব যাবে সব ছিঁড়িয়া।
তখন অনন্ত কাল, অনন্ত জগত-মাঝে
ভুঞ্জিব অনন্ত প্রেম মনঃপ্রাণ ভরিয়া।
ভারতী, ভাদ্র, ১২৮৪
হোক্ ভারতের জয়!
এসো এসো ভ্রাতৃগণ! সরল অন্তরে
সরল প্রীতির ভরে
সবে মিলি পরস্পরে
আলিঙ্গন করি আজ বহুদিন পরে।
এসেছে জাতীয় মেলা ভারতভূষণ,
ভারত সমাজে তবে
হৃদয় খুলিয়া সবে
এসো এসো এসো করি প্রিয়সম্ভাষণ।
দূর করো আত্মভেদ বিপদ-অঙ্কুর,
দূর করো মলিনতা
বিলাসিতা অলসতা,
হীনতা ক্ষীণতা দোষ করো সবে দূর।
ভীরুতা বঙ্গীয়জন-কলঙ্ক-প্রধান —
সে-কলঙ্ক দূর করো,
সাহসিক তেজ ধরো,
স্বকার্যকুশল হও হয়ে একতান।
হল না কিছুই করা যা করিতে এলে —
এই দেখো হিন্দুমেলা,
তবে কেন কর হেলা?
কী হবে কী হবে আর তুচ্ছ খেলা খেলে?
সাগরের স্রোতসম যাইছে সময়।
তুচ্ছ কাজে কেন রও,
স্বদেশহিতৈষী হও —
স্বদেশের জনগণে দাও রে অভয়।
নাহি আর জননীর পূর্বসুতগণ —
হরিশ্চন্দ্র যুধিষ্ঠির
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীর,
অনন্তজলধিতলে হয়েছে মগন।
নাহি সেই রাম আদি সম্রাট প্রাচীন,
বিক্রম-আদিত্যরাজ,
কালিদাস কবিরাজ,
পরাশর পারাশর পণ্ডিত প্রবীণ।
সকলেই জল বায়ু তেজ মৃত্তিকায়
মিশাইয়া নিজদেহ
অনন্ত ব্রহ্মের গেহ
পশেছে কীর্তিরে শুধু রাখিয়ে ধরায়।
আদরে সে প্রিয় সখী আচ্ছাদি গগনে
সে লোকবিশ্রুত নাম
সে বিশ্ববিজয়ী ধাম
নির্ঘোষে ঘুষিছে সদা অখিল ভুবনে।
যবনের রাজ্যকালে কীর্তির আধার
চিতোর-নগর নাম
অতুলবীরত্বধাম,
কেমন ছিল রে মনে ভাবো একবার।
এইরূপ কত শত নগর প্রাচীন
সুকীর্তি-তপন-করে
ভারত উজ্জ্বল ক’রে
অনন্ত কালের গর্ভে হয়েছে বিলীন।
নাহি সেই ভারতের একতা-বিভব,
পাষাণ বাঁধিয়া গলে
সকলের পদতলে
লুটাইছে আর্যগণ হইয়া নীরব।
গেল, হায়, সব সুখ অভাগী মাতার —
ছিল যত মনোআশা
নিল কাল সর্বনাশা,
প্রসন্ন বদন হল বিষণ্ণ তাঁহার।
কী আর হইবে মাতা খুলিয়া বদন।
দীপ্তভানু অস্ত গেল,
এবে কালরাত্রি এল,বসনে আবরি মুখ কাঁদো সর্বক্ষণ।
বিশাল অপার সিন্ধু, গভীর নিস্বনে
যেখানে যেখানে যাও
কাঁদিতে কাঁদিতে গাও —
ডুবিল ভারতরবি অনন্ত জীবনে।
সুবিখ্যাত গৌড় যেই বঙ্গের রতন —
তার কীর্তিপ্রতিভায়
খ্যাতাপন্ন এ ধরায়
হয়েছিল একদিন বঙ্গবাসিগণ।
গেল সে বঙ্গের জ্যোতিঃ কিছুকাল পরে —
কোনো চিহ্ন নাহি তার,
পরিয়া হীনতাহার,
ডুবিয়াছে এবে বঙ্গ কলঙ্কসাগরে।
হিন্দুজনভ্রাতৃগণ! করি হে বিনয় —
একতা উৎসাহ ধরো,
জাতীয় উন্নতি করো,
ঘুষুক ভুবনে সবে ভারতের জয়।
জগদীশ! তুমি, নাথ, নিত্য-নিরাময়
করো কৃপা বিতরণ,
অধিবাসিজনগণ,
করুক উন্নতি — হোক্ ভারতের জয়!
বান্ধব, মাঘ ১২৮১