স্পর্শমণি
ভক্তমাল
নদীতীরে বৃন্দাবনে সনাতন একমনে
জপিছেন নাম ,
হেনকালে দীনবেশে ব্রাহ্মণ চরণে এসে
করিল প্রণাম ।
শুধালেন সনাতন , ‘ কোথা হতে আগমন ,
কী নাম ঠাকুর ? ‘
বিপ্র কহে , ‘ কিবা কব , পেয়েছি দর্শন তব
ভ্রমি বহুদূর ।
জীবন আমার নাম , মানকরে মোর ধাম ,
জিলা বর্ধমানে —
এতবড়ো ভাগ্যহত দীনহীন মোর মতো
নাই কোনোখানে ।
জমিজমা আছে কিছু , করে আছি মাথা নিচু ,
অল্পস্বল্প পাই ।
ক্রিয়াকর্ম – যজ্ঞযাগে বহু খ্যাতি ছিল আগে ,
আজ কিছু নাই ।
আপন উন্নতি লাগি শিব – কাছে বর মাগি
করি আরাধনা ।
একদিন নিশিভোরে স্বপ্নে দেব কন মোরে —
পুরিবে প্রার্থনা !
যাও যমুনার তীর , সনাতন গোস্বামীর
ধরো দুটি পায় !
তাঁরে পিতা বলি মেনো , তাঁরি হাতে আছে জেনো
ধনের উপায় ।’
শুনি কথা সনাতন ভাবিয়া আকুল হন —
‘ কী আছে আমার !
যাহা ছিল সে সকলি ফেলিয়া এসেছি চলি —
ভিক্ষামাত্র সার ।’
সহসা বিস্মৃতি ছুটে , সাধু ফুকারিয়া উঠে ,
‘ ঠিক বটে ঠিক ।
একদিন নদীতটে কুড়ায়ে পেয়েছি বটে
পরশমানিক ।
যদি কভু লাগে দানে সেই ভেবে ওইখানে
পুঁতেছি বালুতে —
নিয়ে যাও হে ঠাকুর , দুঃখ তব হবে দূর
ছুঁতে নাহি ছুঁতে ।’
বিপ্র তাড়াতাড়ি আসি খুঁড়িয়া বালুকারাশি
পাইল সে মণি ,
লোহার মাদুলি দুটি সোনা হয়ে উঠে ফুটি ,
ছুঁইল যেমনি ।
ব্রাহ্মণ বালুর’পরে বিস্ময়ে বসিয়া পড়ে —
ভাবে নিজে নিজে ।
যমুনা কল্লোলগানে চিন্তিতের কানে কানে
কহে কত কী যে !
নদীপারে রক্তছবি দিনান্তের ক্লান্ত রবি
গেল অস্তাচলে —
তখন ব্রাহ্মণ উঠে সাধুর চরণে লুটে
কহে অশ্রুজলে ,
‘ যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি
তাহারি খানিক
মাগি আমি নতশিরে । ‘ এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মানিক ।
স্বামীলাভ
ভক্তমাল
একদা তুলসীদাস জাহ্নবীর তীরে
নির্জন শ্মশানে
সন্ধ্যায় আপন – মনে একা একা ফিরে
মাতি নিজগানে ।
হেরিলেন মৃত পতি – চরণের তলে
বসিয়াছে সতী ,
তারি সনে একসাথে এক চিতানলে
মরিবারে মতি ।
সঙ্গীগণ মাঝে মাঝে আনন্দচীৎকারে
করে জয়নাদ ,
পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা ঘেরি চারি ধারে
গাহে সাধুবাদ ।
সহসা সাধুরে নারী হেরিয়া সম্মুখে
করিয়া প্রণতি
কহিল বিনয়ে , ‘ প্রভো , আপন শ্রীমুখে
দেহো অনুমতি ।’
তুলসী কহিল , ‘ মাতঃ , যাবে কোন্খানে ,
এত আয়োজন ! ‘
সতী কহে , ‘ পতিসহ যাব স্বর্গপানে
করিয়াছি মন ।’
‘ ধরা ছাড়ি কেন , নারী , স্বর্গ চাহ তুমি ‘
সাধু হাসি কহে —
‘ হে জননী , স্বর্গ যাঁর , এ ধরণীভূমি
তাঁহারি কি নহে ? ‘
বুঝিতে না পারি কথা নারী রহে চাহি
বিস্ময়ে অবাক্ —
কহে করজোড় করি , ‘ স্বামী যদি পাই
স্বর্গ দূরে থাক্ ।’
তুলসী কহিল হাসি , ‘ ফিরে চলো ঘরে ,
কহিতেছি আমি ,
ফিরে পাবে আজ হতে মাসেকের পরে
আপনার স্বামী ।’
রমণী আশার বশে গৃহে ফিরি যায়
শ্মশান তেয়াগি —
তুলসী জাহ্নবীতীরে নিস্তব্ধ নিশায়
রহিলেন জাগি ।
নারী রহে শুদ্ধচিতে নির্জন ভবনে —
তুলসী প্রত্যহ
কী তাহারে মন্ত্র দেয় , নারী একমনে
ধ্যায় অহরহ ।
এক মাস পূর্ণ হতে প্রতিবেশীদলে
আসি তার দ্বারে
শুধাইল , ‘ পেলে স্বামী ?’ নারী হাসি বলে ,
‘ পেয়েছি তাঁহারে ।’
শুনি ব্যগ্র কহে তারা , ‘ কহো তবে কহো
আছে কোন্ ঘরে ।’
নারী কহে , ‘ রয়েছেন প্রভু অহরহ
আমারি অন্তরে ।’
হোরিখেলা
রাজস্থান
পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁ ‘ রে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী —
‘ লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা ?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া ,
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া —
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী ।’
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
কেতুন হতে পত্র দিল রানী ।
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি ,
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া ।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে ,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে ,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে —
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া ।
পাঠান সাথে হোরি খেলবে রানী ,
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া ।
ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হয়ে এল ।
বোল ধরেছে আমের বনে বনে ,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে ,
গুন্গুনিয়ে আপন – মনে – মনে
ঘুরেঘুরে বেড়ায় এলোমেলো ।
কেতুন পুরে দলে দলে আজি
পাঠান – সেনা হোরি খেলতে এল ।
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকিবেলা ।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি ,
মুলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি —
এল তখন একশো রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হোরিখেলা ।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা ,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা ।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে ,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে ।
ডাহিন হাতে বহে ফাগের থারি ,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচকারি ,
বামহস্তে গুলাব – ভরা ঝারি —
সারি সারি রাজপুতানী আসে ।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে ,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে ।
আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে
কেসর তবে কহে কাছে আসি ,
‘ বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি ,
আজকে বুঝি জানে – প্রাণে মরি ! ‘
শুনে রানীর শতেক সহচরী
হঠাৎ সবে উঠল অট্টহাসি ।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
রঙ্গভরে সেলাম করে আসি ।
শুরু হল হোরির মাতামাতি ,
উড়তেছে ফাগ রাঙা সন্ধ্যাকাশে ।
নব বরন ধরল বকুল ফুলে ,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে —
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে ।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে ।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ ।
বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি ,
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি ,
তেমন ক ‘ রে কাঁকন বাজছে না !
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
মনে মনে ভাগছে কেসর খাঁ ।
পাঠান কহে , ‘ রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা !
বাহুযুগল নয় মৃণালের মতো ,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত —
বড়ো কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা ।’
পাঠান ভাবে দেহে কিম্বা মনে
রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা ।
তান ধরিয়া ইমন – ভূপালীতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে ।
কুণ্ডলেতে দোলে মুক্তামালা ,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা ,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে ।
তান ধরিয়া ইমন – ভূপালীতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে ।
কেসর কহে , ‘ তোমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা ! ‘
রানী কহে , ‘ আমারো সেই দশা ।’
একশো সখী হাসিয়া বিবশা —
পাঠান – পতির ললাটে সহসা
মারেন রানী কাঁসার থালাখানা ।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
পাঠান – পতির চক্ষু হল কানা ।
বিনা মেঘে বজ্ররবের মতো
উঠল বেজে কাড়া – নাকাড়া ।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী ,
ঝন্ঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি ,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধরল কানাড়া ।
কুঞ্জবনের তরু – তলে – তলে
উঠল বেজে কাড়া – নাকাড়া ।
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে ,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত ।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কে রে
বাহির হল নারী – সজ্জা ছেড়ে ,
এক শত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হতে একশো সাপের মতো ।
স্বপ্নসম ওড়না গেল উড়ে ,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত ।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা ।
ফাগুন – রাতে কুঞ্জবিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে ,
কেতুনপুরে বকুল – বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা ।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা ।