- বইয়ের নামঃ কথা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপমান-বর
ভক্তমাল
ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে ।
কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে ।
কেহ কহে ‘ মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো ‘ ,
সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ ।
কেহ বলে ‘ তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে ‘ ,
কেহ কয় ‘ ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে ‘ ।
কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে ,
‘ দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে —
ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব ,
সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব ।
একি কৌশল খেলেছ মায়াবী , বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি ।
বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে নাকি ! ‘
ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি —
লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি !
চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা ,
এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা ।
ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে —
গোপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল , কাঞ্চন দিল হাতে ।
বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে ,
সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তারে ।
কহিল , ‘ রে শঠ , নিঠুর কপট , কহি নে কাহার ও কাছে —
এমনি করে কি সরলা নারীর ছলনা করিতে আছে !
বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো ,
অন্নবসন বিহনে আমার বরন হয়েছে কালো ! ‘
কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ ,
‘ ভণ্ডতাপস , ধর্মের নামে করিছ ধর্মলোপ !
তুমি সুখে ব ‘ সে ধুলা ছড়াইছ সরল লোকের চোখে ,
অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অন্নশোকে ! ‘
কহিল কবীর , ‘ অপরাধী আমি , ঘরে এসো নারী তবে —
আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী রবে ? ‘
দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি
কবীর কহিল , ‘ দীনের ভবনে তোমারে পাঠালো হরি ।’
কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে ,
‘ লোভে পড়ে আমি করিয়াছি পাপ , মরিব সাধুর শাপে ।’
কহিল কবীর , ‘ ভয় নাই মাত :, লইব না অপরাধ —
এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপবাদ ।’
ঘুচাইল তার মনের বিকার , করিল চেতনা দান —
সঁপি দিল তার মধুর কণ্ঠে হরিনামগুণগান ।
রটি গেল দেশে — কপট কবীর , সাধুতা তাহার মিছে ।
শুনিয়া কবীর কহে নতশির , ‘ আমি সকলের নীচে ।
যদি কূল পাই তরণী – গরব রাখিতে না চাহি কিছু —
তুমি যদি থাক আমার উপরে আমি রব সব – নিচু ।’
রাজার চিত্তে কৌতুক হল শুনিতে সাধুর গাথা ।
দূত আসি তারে ডাকিল যখন সাধু নাড়িলেন মাথা ।
কহিলেন , ‘ থাকি সবা হতে দূরে আপন হীনতা – মাঝে ;
আমার মতন অভাজন জন রাজার সভায় সাজে ! ‘
দূত কহে , ‘ তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ ,
যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ ।’
রাজা বসে ছিল সভার মাঝারে , পারিষদ সারি সারি —
কবীর আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে লয়ে নারী ।
কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটি , কেহ রহে নতশিরে ,
রাজা ভাবে — এটা কেমন নিলাজ রমণী লইয়া ফিরে !
ইঙ্গিতে তাঁর সাধুরে সভার বাহির করিল দ্বারী ,
বিনয়ে কবীর চলিল কুটিরে সঙ্গে লইয়া নারী ।
পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল , কৌতুকভরে হাসে —
শুনায়ে শুনায়ে বিদ্রূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে ।
তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে —
কহিল , ‘ পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে !
কেন অধমারে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান ! ‘
কহিল কবীর , ‘ জননী , তুমি যে আমার প্রভুর দান ।’
অভিসার
বোধিসত্ত্বাবদান-কল্পলতা
সন্ন্যাসী উপগুপ্ত
মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে
একদা ছিলেন সুপ্ত —
নগরীর দীপ নিবেছে পবনে ,
দুয়ার রুদ্ধ পৌর ভবনে ,
নিশীথের তারা শ্রাবণগগনে
ঘন মেঘে অবলুপ্ত ।
কাহার নূপুরশিঞ্জিত পদ
সহসা বাজিল বক্ষে !
সন্ন্যাসীবর চমকি জাগিল ,
স্বপ্নজড়িমা পলকে ভাগিল ,
রূঢ় দীপের আলোক লাগিল
ক্ষমাসুন্দর চক্ষে ।
নগরীর নটী চলে অভিসারে
যৌবনমদে মত্তা ।
অঙ্গে আঁচল সুনীল বরন ,
রুনুঝুনু রবে বাজে আভরণ —
সন্ন্যাসী – গায়ে পড়িতে চরণ
থামিল বাসবদত্তা ।
প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাঁহার
নবীন গৌরকান্তি —
সৌম্য সহাস তরুণ বয়ান ,
করুণাকিরণে বিকচ নয়ান ,
শুভ্র ললাটে ইন্দুসমান
ভাতিছে স্নিগ্ধ শান্তি ।
কহিল রমণী ললিত কণ্ঠে ,
নয়নে জড়িত লজ্জা ,
ক্ষমা করো মোরে কুমার কিশোর ,
দয়া করো যদি গৃহে চলো মোর ,
এ ধরণীতল কঠিন কঠোর
এ নহে তোমার শয্যা ।’
সন্ন্যাসী কহে করুণ বচনে ,
‘ অয়ি লাবণ্যপুঞ্জে ,
এখনো আমার সময় হয় নি ,
যেথায় চলেছ যাও তুমি ধনী ,
সময় যেদিন আসিবে আপনি
যাইব তোমার কুঞ্জে । ‘
সহসা ঝঞ্ঝা তড়িৎশিখায়
মেলিল বিপুল আস্য ।
রমণী কাঁপিয়া উঠিল তরাসে ,
প্রলয়শঙ্খ বাজিল বাতাসে ,
আকাশে বজ্র ঘোর পরিহাসে
হাসিল অট্টহাস্য ।
…
বর্ষ তখনো হয় নাই শেষ ,
এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা ।
বাতাস হয়েছে উতলা আকুল ,
পথতরুশাখে ধরেছে মুকুল ,
রাজার কাননে ফুটেছে বকুল
পারুল রজনীগন্ধা ।
অতি দূর হতে আসিছে পবনে
বাঁশির মদির মন্দ্র ।
জনহীন পুরী , পুরবাসী সবে
গেছে মধুবনে ফুল – উৎসবে —
শূন্য নগরী নিরখি নীরবে
হাসিছে পূর্ণচন্দ্র ।
নির্জন পথে জ্যোৎস্না – আলোতে
সন্ন্যাসী একা যাত্রী ।
মাথার উপরে তরুবীথিকার
কোকিল কুহরি উঠে বারবার ,
এতদিন পরে এসেছে কি তাঁর
আজি অভিসাররাত্রি ?
নগর ছাড়ায়ে গেলেন দণ্ডী
বাহিরপ্রাচীরপ্রান্তে ।
দাঁড়ালেন আসি পরিখার পারে —
আম্রবনের ছায়ার আঁধারে
কে ওই রমণী প ‘ ড়ে এক ধারে
তাঁহার চরণোপ্রান্তে !
নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায়
ভরে গেছে তার অঙ্গ —
রোগমসীঢালা কালী তনু তার
লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার
বাহিরে ফেলেছে , করি’ পরিহার
বিষাক্ত তার সঙ্গ ।
সন্ন্যাসী বসি আড়ষ্ট শির
তুলি নিল নিজ অঙ্ক —
ঢালি দিল জল শুষ্ক অধরে ,
মন্ত্র পড়িয়া দিল শির – ‘ পরে ,
লেপি দিল দেহ আপনার করে
শীতচন্দনপঙ্ক ।
ঝরিছে মুকুল , কূজিছে কোকিল ,
যামিনী জোছনামত্তা ।
‘ কে এসেছ তুমি ওগো দয়াময় ‘
শুধাইল নারী , সন্ন্যাসী কয় —
‘ আজি রজনীতে হয়েছে সময় ,
এসেছি বাসবদত্তা ! ‘