বিরাম
বিরাম কাজেরই অঙ্গ এক সাথে গাঁথা,
নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।
ভক্তি ও অতিভক্তি
ভক্তি আসে রিক্তহস্ত প্রসন্নবদন—
অতিভক্তি বলে, দেখি কী পাইলে ধন।
ভক্তি কয়, মনে পাই, না পারি দেখাতে।—
অতিভক্তি কয়, আমি পাই হাতে হাতে।
ভক্তিভাজন
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।
ভার
টুনটুনি কহিলেন, রে ময়ূর, তোকে
দেখে করুণায় মোর জল আসে চোখে।
ময়ূর কহিল, বটে! কেন, কহ শুনি,
ওগো মহাশয় পক্ষী, ওগো টুনটুনি
টুনটুনি কহে, এ যে দেখিতে বেআড়া,
দেহ তব যত বড়ো পুচ্ছ তারে বাড়া।
আমি দেখো লঘুভারে ফিরি দিনরাত,
তোমার পশ্চাতে পুচ্ছ বিষম উৎপাত।
ময়ূর কহিল, শোক করিয়ো না মিছে,
জেনো ভাই, ভার থাকে গৌরবের পিছে।
ভালো মন্দ
জাল কহে, পঙ্ক আমি উঠাব না আর।
জেলে কহে, মাছ তবে পাওয়া হবে ভার।
ভিক্ষা ও উপার্জন
বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা,
কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস—
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস।
বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী,
আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।
মহতের দুঃখ
সূর্য দুঃখ করি বলে নিন্দা শুনি স্বীয়,
কী করিলে হব আমি সকলের প্রিয়।
বিধি কহে, ছাড়ো তবে এ সৌর সমাজ,
দু-চারি জনেরে লয়ে করো ক্ষুদ্র কাজ।
মাঝারির সতর্কতা
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।
মূল
আগা বলে, আমি বড়ো, তুমি ছোটো লোক।
গোড়া হেসে বলে, ভাই, ভালো তাই হোক।
তুমি উচ্চে আছ ব’লে গর্বে আছ ভোর,
তোমারে করেছি উচ্চ এই গর্ব মোর।
মৃত্যু
ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময়
মুহূর্তে নিখিল তবে হয়ে যেত লয়।
তুমি পরিপূর্ণ রূপ, তব বক্ষে কোলে
জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে।
মোহ
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
মোহের আশঙ্কা
শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধভরা—
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যত কাল থাকি তুমিও থাকিয়ো।
যথাকর্তব্য
ছাতা বলে, ধিক্ ধিক্ মাথা মহাশয়,
এ অন্যায় অবিচার আমারে না সয়।
তুমি যাবে হাটে বাটে দিব্য অকাতরে,
রৌদ্র বৃষ্টি যতকিছু সব আমা-’পরে।
তুমি যদি ছাতা হতে কী করিতে দাদা?
মাথা কয়, বুঝিতাম মাথার মর্যাদা,
বুঝিতাম তার গুণে পরিপূর্ণ ধরা,
মোর একমাত্র গুণ তারে রক্ষা করা।
যথার্থ আপন
কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ভাই ভাই।
নভশ্চর ব’লে তার মনের বিশ্বাস,
শূণ্যপানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতা-ডোরে।
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি,
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।
রাষ্ট্রনীতি
কুড়াল কহিল, ভিক্ষা মাগি ওগো শাল,
হাতল নাহিকো, দাও একখানি ডাল।
ডাল নিয়ে হাতল প্রস্তুত হল যেই,
তার পরে ভিক্ষুকের চাওয়া-চিন্তা নেই—
একেবারে গোড়া ঘেঁষে লাগাইল কোপ,
শাল বেচারার হল আদি অন্ত লোপ।
শক্তির শক্তি
দিবসে চক্ষুর দম্ভ দৃষ্টিশক্তি লয়ে,
রাত্রি যেই হল সেই অশ্রু যায় বয়ে!
আলোরে কহিল—আজ বুঝিয়াছি ঠেকি
তোমারি প্রসাদবলে তোমারেই দেখি।
শক্তির সীমা
কহিল কাঁসার ঘটি খন্ খন্ স্বর—
কূপ,তুমি কেন খুড়া হলে না সাগর?
তাহা হলে অসংকোচে মারিতাম ডুব,
জল খেয়ে লইতাম পেট ভরে খুব।
কূপ কহে,সত্য বটে ক্ষুদ্র আমি কূপ,
সেই দুঃখে চিরদিন করে আছি চুপ।
কিন্তু বাপু, তার লাগি তুমি কেন ভাব!
যতবার ইচ্ছা যায় ততবার নাবো—
তুমি যত নিতে পার সব যদি নাও
তবু আমি টিঁকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও।
শক্তের ক্ষমা
নারদ কহিল আসি, হে ধরণী দেবী,
তব নিন্দা করে নর তব অন্ন সেবি।
বলে মাটি, বলে ধূলি, বলে জড় স্থুল,
তোমারে মলিন বলে অকৃতজ্ঞকুল।
বন্ধ করো অন্নজল, মুখ হোক চুন,
ধুলামাটি কী জিনিস বাছারা বুঝুন।
ধরণী কহিলা হাসি, বালাই, বালাই!
ওরা কি আমার তুল্য, শোধ লব তাই?
ওদের নিন্দায় মোর লাগিবে না দাগ,
ওরা যে মরিবে যদি আমি করি রাগ।
ত্রুতাগৌরব
পেঁচা রাষ্ট্র করি দেয় পেলে কোনো ছুতা,
জান না আমার সাথে সূর্যের শত্রুতা!
সজ্ঞান আত্মবিসর্জন
বীর কহে, হে সংসার, হায় রে পৃথিবী,
ভাবিস নে মোরে কিছু ভুলাইয়া নিবি—
আমি যাহা দিই তাহা দিই জেনে-শুনে
ফাঁকি দিয়ে যা পেতিস তার শতগুণে।
সত্যের আবিষ্কার
কহিলেন বসুন্ধরা, দিনের আলোকে
আমি ছাড়া আর কিছু পড়িত না চোখে,
রাত্রে আমি লুপ্ত যবে শূন্যে দিল দেখা
অনন্ত এ জগতের জ্যোতির্ময়ী লেখা।।
সত্যের সংযম
স্বপ্ন কহে, আমি মুক্ত, নিয়মের পিছে
নাহি চলি। সত্য কহে, তাই তুমি মিছে।
স্বপ্ন কয়, তুমি বদ্ধ অনন্ত শৃঙ্খলে।
সত্য কয়, তাই মোরে সত্য সবে বলে।