দীনের দান
মরু কহে, অধমেরে এত দাও জল,
ফিরে কিছু দিব হেন কী আছে সম্বল?
মেঘ কহে, কিছু নাহি চাই, মরুভূমি,
আমারে দানের সুখ দান করো তুমি।
ধ্রুবসত্য
আমি বিন্দুমাত্র আলো, মনে হয় তবু
আমি শুধু আছি আর কিছু নাই কভু।
পলক পড়িল দেখি আড়ালে আমার
তুমি আছ হে অনাদি আদি অন্ধকার!
ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।
নতিস্বীকার
তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়
তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়,
অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে
প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে।
নদীর প্রতি খাল
খাল বলে, মোর লাগি মাথা-কোটাকুটি,
নদীগুলা আপনি গড়ায়ে আসে ছুটি।
তুমি খাল মহারাজ, কহে পারিষদ,
তোমারে জোগাতে জল আছে নদীনদ।
নম্রতা
কহিল কঞ্চির বেড়া, ওগো পিতামহ
বাঁশবন, নুয়ে কেন পড় অহরহ?
আমরা তোমারি বংশে ছোটো ছোটো ডাল,
তবু মাথা উঁচু করে থাকি চিরকাল।
বাঁশ কহে, ভেদ তাই ছোটোতে বড়োতে,
নত হই, ছোটো নাহি হই কোনোমতে।
নিজের ও সাধারণের
চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,
কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে।
নিন্দুকের দুরাশা
মালা গাঁথিবার কালে ফুলের বোঁটায়
ছুঁচ নিয়ে মালাকর দুবেলা ফোটায়।
ছুঁচ বলে মনদুঃখে, ওরে জুঁই দিদি,
হাজার হাজার ফুল প্রতিদিন বিঁধি,
কত গন্ধ কোমলতা যাই ফুঁড়ে ফুঁড়ে
কিছু তার নাহি পাই এত মাথা খুঁড়ে।
বিধি-পায়ে মাগি বর জুড়ি কর দুটি
ছুঁচ হয়ে না ফোটাই, ফুল হয়ে ফুটি।
জুঁই কহে নিশ্বসিয়া, আহা হোক তাই,
তোমারো পুরুক বাঞ্ছা আমি রক্ষা পাই।
নিরাপদ নীচতা
তুমি নীচে পাঁকে পড়ি ছড়াইছ পাঁক,
যে জন উপরে আছে তারি তো বিপাক।
নূতন ও সনাতন
রাজা ভাবে, নব নব আইনের ছলে
ন্যায় সৃষ্টি করি আমি। ন্যায়ধর্ম বলে,
আমি পুরাতন, মোরে জন্ম কেবা দেয়—
যা তব নূতন সৃষ্টি সে শুধু অন্যায়।
নূতন চাল
এক দিন গরজিয়া কহিল মহিষ,
ঘোড়ার মতন মোর থাকিবে সহিস।
একেবারে ছাড়িয়াছি মহিষি-চলন,
দুই বেলা চাই মোর দলন-মলন।
এই ভাবে প্রতিদিন, রজনী পোহালে,
বিপরীত দাপাদাপি করে সে গোহালে।
প্রভু কহে,চাই বটে! ভালো, তাই হোক!
পশ্চাতে রাখিল তার দশ জন লোক।
দুটো দিন না যাইতে কেঁদে কয় মোষ,
আর কাজ নেই প্রভু, হয়েছে সন্তোষ।
সহিসের হাত হতে দাও অব্যাহতি,
দলন-মলনটার বাড়াবাড়ি অতি।
পর ও আত্মীয়
ছাই বলে, শিখা মোর ভাই আপনার,
ধোঁওয়া বলে, আমি তো যমজ ভাই তার।
জোনাকি কহিল, মোর কুটুম্বিতা নাই,
তোমাদের চেয়ে আমি বেশি তার ভাই।
পর-বিচারে গৃহভেদ
আম্র কহে, এক দিন, হে মাকাল ভাই,
আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই—
মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি,
মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি।
পরস্পর
বাণী কহে, তোমারে যখন দেখি, কাজ,
আপনার শূণ্যতায় বড়ো পাই লাজ।
কাজ শুনি কহে, অয়ি পরিপূর্ণা বাণী,
নিজেরে তোমার কাছে দীন ব’লে জানি।
পরিচয়
দয়া বলে, কে গো তুমি মুখে নাই কথা?
অশ্রুভরা আঁখি বলে, আমি কৃতজ্ঞতা।
পরের কর্ম-বিচার
নাক বলে, কান কভু ঘ্রাণ নাহি করে,
রয়েছে কুণ্ডল দুটো পরিবার তরে।
কান বলে, কারো কথা নাহি শুনে নাক,
ঘুমোবার বেলা শুধু ছাড়ে হাঁকডাক।
প্রকারভেদ
বাবলাশাখারে বলে আম্রশাখা, ভাই,
উনানে পুড়িয়া তুমি কেন হও ছাই?
হায় হায়, সখী, তব ভাগ্য কী কঠোর!
বাবলার শাখা বলে, দুঃখ নাহি মোর।
বাঁচিয়া সফল তুমি, ওগো চূতলতা,
নিজেরে করিয়া ভস্ম মোর সফলতা।
প্রতাপের তাপ
ভিজা কাঠ অশ্রুজলে ভাবে রাত্রিদিবা,
জ্বলন্ত কাঠের আহা দীপ্তি তেজ কিবা।
অন্ধকার কোণে পড়ে মরে ঈর্ষারোগে—
বলে, আমি হেন জ্যোতি পাব কী সুযোগে।
জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, কাঁচা কাঠ ওগো,
চেষ্টাহীন বাসনায় বৃথা তুমি ভোগো।
আমরা পেয়েছি যাহা মরিয়া পুড়িয়া,
তোমারি হাতে কি তাহা আসিবে উড়িয়া?
ভিজা কাঠ বলে, বাবা, কে মরে আগুনে!
জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, তবে খাক ঘুণে।
প্রত্যক্ষ প্রমাণ
বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ
আমার গর্জনে বলে মেঘের গর্জন,
বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,
মাথায় পড়িলে তবে বলে—বজ্র বটে!
প্রবীণ ও নবীন
পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়,
কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায়-হায়।
পাকা চুল বলে, মান সব লও বাছা,
আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।
প্রভেদ
অনুগ্রহ দুঃখ করে, দিই, নাহি পাই।
করুণা কহেন, আমি দিই, নাহি চাই।
প্রশ্নের অতীত
হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা
সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা।
কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর?
হিমাদ্রি কহিল, মোর চির-নিরুত্তর।
ফুল ও ফল
ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল,
কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্।
ফল কহে, মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি,
তোমারি অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি।
বলের অপেক্ষা বলী
ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ—
কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ।
বস্ত্রহরণ
‘সংসারে জিনেছি’ ব’লে দুরন্ত মরণ
জীবন বসন তার করিছে হরণ।
যত বস্ত্রে টান দেয়, বিধাতার বরে।
বস্ত্র বাড়ি চলে তত নিত্যকাল ধ’রে।
বিফল নিন্দা
‘তোরে সবে নিন্দা করে গুণহীন ফুল’
শুনিয়া নীরবে হাসি কহিল শিমূল,
যতক্ষণ নিন্দা করে, আমি চুপে চুপে
ফুটে উঠি আপনার পরিপূর্ণ রূপে।