উদারচরিতানাম্
প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।
ধিক্ ধিক্ করে তারে কাননে সবাই—
সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?
উপলক্ষ
কাল বলে,আমি সৃষ্টি করি এই ভব।
ঘড়ি বলে, তা হলে আমিও স্রষ্টা তব।
এক পরিণাম
শেফালি কহিল, আমি ঝরিলাম, তারা!
তারা কহে, আমারো তো হল কাজ সারা—
ভরিলাম রজনীর বিদায়ের ডালি
আকাশের তারা আর বনের শেফালি।
এক-তরফা হিসাব
সাতাশ, হলে না কেন এক-শো সাতাশ,
থলিটি ভরিত, হাড়ে লাগিত বাতাস।
সাতাশ কহিল, তাহে টাকা হত মেলা,
কিন্তু কী করিতে বাপু বয়সের বেলা?
একই পথ
দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি।
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?
কর্তব্যগ্রহণ
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
কলঙ্কব্যবসায়ী
ধুলা, করো কলঙ্কিত সবার শুভ্রতা
সেটা কি তোমারি নয় কলঙ্কর কথা?
কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ
দেহটা যেমনি ক’রে ঘোরাও যেখানে
বাম হাত বামে থাকে, ডান হাত ডানে।
কীটের বিচার
মহাভারতের মধ্যে ঢুকেছেন কীট,
কেটেকুটে ফুঁড়েছেন এপিঠ-ওপিঠ।
পণ্ডিত খুলিয়া দেখি হস্ত হানে শিরে;
বলে, ওরে কীট, তুই এ কী করিলি রে!
তোর দন্তে শান দেয়, তোর পেট ভরে,
হেন খাদ্য কত আছে ধূলির উপরে।
কীট বলে, হয়েছে কী, কেন এত রাগ,
ওর মধ্যে ছিল কী বা, শুধু কালো দাগ!
আমি যেটা নাহি বুঝি সেটা জানি ছার,
আগাগোড়া কেটেকুটে করি ছারখার।
কুটুম্বিতা-বিচার
কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা—
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!
কুয়াশার আক্ষেপ
‘কুয়াশা, নিকটে থাকি, তাই হেলা মোরে—
মেঘ ভায়া দূরে রন, থাকেন গুমরে!’
কবি কুয়াশারে কয়, শুধু তাই না কি?
মেঘ দেয় বৃষ্টিধারা, তুমি দাও ফাঁকি।
কৃতীর প্রমাদ
টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি,
হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি।
হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল,
কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।
ক্ষুদ্রের দম্ভ
শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।
খেলেনা
ভাবে শিশু, বড়ো হলে শুধু যাবে কেনা
বাজার উজাড় করি সমস্ত খেলেনা।
বড়ো হলে খেলা যত ঢেলা বলি মানে,
দুই হাত তুলে চায় ধনজন-পানে।
আরো বড়ো হবে না কি যবে অবহেলে
ধরার খেলার হাট হেসে যাবে ফেলে?
গদ্য ও পদ্য
শর কহে, আমি লঘু, গুরু তুমি গদা,
তাই বুক ফুলাইয়া খাড়া আছ সদা।
করো তুমি মোর কাজ, তর্ক যাক চুকে—
মাথা ভাঙা ছেড়ে দিয়ে বেঁধো গিয়ে বুকে।
গরজের আত্মীয়তা
কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,
আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে?
থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে
আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।
গালির ভঙ্গি
লাঠি গালি দেয়, ছড়ি, তুই সরু কাঠি!
ছড়ি তারে গালি দেয়, তুমি মোটা লাঠি!
গুণজ্ঞ
আমি প্রজাপতি ফিরি রঙিন পাখায়,
কবি তো আমার পানে তবু না তাকায়।
বুঝিতে না পারি আমি, বলো তো ভ্রমর,
কোন্ গুণে কাব্যে তুমি হয়েছ অমর।
অলি কহে, আপনি সুন্দর তুমি বটে,
সুন্দরের গুণ তব মুখে নাহি রটে।
আমি ভাই মধু খেয়ে গুণ গেয়ে ঘুরি,
কবি আর ফুলের হৃদয় করি চুরি।
গ্রহণে ও দানে
কৃতাঞ্জলি কর কহে, আমার বিনয়,
হে নিন্দুক, কেবল নেবার বেলা নয়।
নিই যবে নিই বটে অঞ্জলি জুড়িয়া,
দিই যবে সেও দিই অঞ্জলি পুরিয়া।
চালক
অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।
চিরনবীনতা
দিনান্তের মুখ চুম্বি রাত্রি ধীরে কয়—
আমি মৃত্যু তোর মাতা, নাহি মোরে ভয়।
নব নব জন্মদানে পুরাতন দিন
আমি তোরে ক’রে দিই প্রত্যহ নবীন।
চুরি-নিবারণ
সুয়োরাণী কহে, রাজা দুয়োরাণীটার
কত মতলব আছে বুঝে ওঠা ভার।
গোয়াল্-ঘরের কোণে দিলে ওরে বাসা,
তবু দেখো অভাগীর মেটে নাই আশা।
তোমারে ভুলায়ে শুধু মুখের কথায়
কালো গরুটিরে তব দুয়ে নিতে চায়।
রাজা বলে, ঠিক ঠিক, বিষম চাতুরী—
এখন কী ক’রে ওর ঠেকাইব চুরি!
সুয়ো বল, একমাত্র রয়েছে ওষুধ,
গোরুটা আমারে দাও, আমি খাই দুধ।
ছলনা
সংসার মোহিনী নারী কহিল সে মোরে,
তুমি আমি বাঁধা রব নিত্য প্রেমডোরে।
যখন ফুরায়ে গেল সব লেনা দেনা,
কহিল, ভেবেছ বুঝি উঠিতে হবে না!
জীবন
জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা,
যেমন চলার অঙ্গ পা-তোলা পা-ফেলা।
জ্ঞানের দৃষ্টি ও প্রেমের সম্ভোগ
‘কালো তুমি’— শুনি জাম কহে কানে কানে,
যে আমারে দেখে সেই কালো বলি জানে,
কিন্তু সেটুকু জেনে ফের কেন জাদু?
যে আমারে খায় সেই জানে আমি স্বাদু।
তন্নষ্টং যন্ন দীয়তে
গন্ধ চলে যায়, হায়, বন্ধ নাহি থাকে,
ফুল তারে মাথা নাড়ি ফিরে ফিরে ডাকে।
বায়ু বলে, যাহা গেল সেই গন্ধ তব,
যেটুকু না দিবে তারে গন্ধ নাহি কব।
দানরিক্ত
জলহারা মেঘখানি বরষার শেষে
পড়ে আছে গগনের এক কোণ ঘেঁষে।
বর্ষাপূর্ণ সরোবর তারি দশা দেখে
সারাদিন ঝিকিমিকি হাসে থেকে থেকে।
কহে, ওটা লক্ষ্মীছাড়া, চালচুলাহীন,
নিজেরে নিঃশেষ করি কোথায় বিলীন।
আমি দেখো চিরকাল থাকি জলভরা,
সারবান, সুগম্ভীর, নাই নড়াচড়া।
মেঘ কহে, ওহে বাপু, কোরো না গরব,
তোমার পূর্ণতা সে তো আমারি গৌরব।