- বইয়ের নামঃ কণিকা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অকর্মার বিভ্রাট
লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খসে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব’সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চালা করে ধরাইব আখা।
হল্ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে—
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।
অকৃতজ্ঞ
ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে,
ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।
অচেতন মাহাত্ম্য
হে জলদ, এত জল ধরে আছ বুকে
তবু লঘুবেগে ধাও বাতাসের মুখে।
পোষণ করিছ শত ভীষণ বিজুলি
তবু স্নিগ্ধ নীল রূপে নেত্র যায় ভুলি।
এ অসাধ্য সাধিতেছ অতি অনায়াসে
কী করিয়া, সে রহস্য কহি দাও দাসে।
গুরুগুরু গরজনে মেঘ কহে বাণী,
আশ্চর্য কী আছে ইথে আমি নাহি জানি।
অদৃশ্য কারণ
রজনী গোপনে বনে ডালপালা ভ’রে
কুঁড়িগুলি ফুটাইয়া নিজে যায় স’রে।
ফুল জাগি বলে, মোরা প্রভাতের ফুল—
মুখর প্রভাত বলে, নাহি তাহে ভুল।
অধিকার বেশি কার বনের উপর
সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর।
বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল,
গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল।
পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া,
বর্ণে আমি দিগ্বিদিক রেখেছি কাড়িয়া।
গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব,
গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব।
কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে,
হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে।
মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর,
প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।
অনাবশ্যকের আবশ্যকতা
কী জন্যে রয়েছ, সিন্ধু তৃণশস্যহীন—
অর্ধেক জগৎ জুড়ি নাচো নিশিদিন।
সিন্ধু কহে, অকর্মণ্য না রহিত যদি
ধরণীর স্তন হতে কে টানিত নদী?
অনুরাগ ও বৈরাগ্য
প্রেম কহে, হে বৈরাগ্য, তব ধর্ম মিছে।
প্রেম, তুমি মহামোহ—বৈরাগ্য কহিছে—
আমি কহি, ছাড়্ স্বার্থ, মুক্তিপথ দেখ্।
প্রেম কহে, তা হলে তো তুমি আমি এক।
অপরিবর্তনীয়
এক যদি আর হয় কী ঘটিবে তবে?
এখনো যা হয়ে থাকে, তখনো তা হবে।
তখন সকল দুঃখ ঘোচে যদি ভাই,
এখন যা সুখ আছে দুঃখ হবে তাই।
অপরিহরণীয়
মৃত্যু কহে, পুত্র নিব; চোর কহে ধন।
ভাগ্য কহে, সব নিব যা তোর আপন।
নিন্দুক কহিল, লব তব যশোভার।
কবি কহে, কে লইবে আনন্দ আমার?
অযোগ্যের উপহাস
নক্ষত্র খসিল দেখি দীপ মরে হেসে।
বলে, এত ধুমধাম, এই হল শেষে!
রাত্রি বলে, হেসে নাও, বলে নাও সুখে,
যতক্ষণ তেলটুকু নাহি যায় চুকে।
অল্প জানা ও বেশি জানা
তৃষিত গর্দভ গেল সরোবরতীরে,
‘ছিছি কালো জল!’ বলি চলি এল ফিরে।
কহে জল, জল কালো জানে সব গাধা,
যে জন অধিক জানে বলে জল সাদা।
অসম্পূর্ণ সংবাদ
চকোরী ফুকারি কাঁদে, ওগো পূর্ণ চাঁদ,
পণ্ডিতের কথা শুনি গনি পরমাদ!
তুমি নাকি একদিন রবে না ত্রিদিবে,
মহাপ্রলয়ের কালে যাবে নাকি নিবে!
হায় হায় সুধাকর, হায় নিশাপতি,
তা হইলে আমাদের কী হইবে গতি!
চাঁদ কহে, পণ্ডিতের ঘরে যাও প্রিয়া,
তোমার কতটা আয়ু এসো শুধাইয়া।
অসম্ভব ভালো
যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,
কোন্ স্বর্গপুরী তুমি ক’রে থাকো আলো।
আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়,
অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।
অসাধ্য চেষ্টা
শক্তি যার নাই নিজে বড়ো হইবারে
বড়োকে করিতে ছোটো তাই সে কি পারে?
অস্ফুট ও পরিস্ফুট
ঘটিজল বলে, ওগো মহাপারাবার,
আমি স্বচ্ছ সমুজ্জ্বল, তুমি অন্ধকার।
ক্ষুদ্র সত্য বলে, মোর পরিষ্কার কথা,
মহাসত্য তোমার মহান্ নীরবতা।
আকাঙ্ক্ষা
আম্র, তোর কী হইতে ইচ্ছা যায় বল্।
সে কহে, হইতে ইক্ষু সুমিষ্ট সরল।—
ইক্ষু, তোর কী হইতে মনে আছে সাধ?
সে কহে, হইতে আম্র সুগন্ধ সুস্বাদ।
আত্মশত্রুতা
খোঁপা আর এলোচুলে বিবাদ হামাশা,
পাড়ার লোকেরা জোটে দেখিতে তামাশা।
খোঁপা কয় এলোচুল, কী তোমার ছিরি!
এলো কয়, খোঁপা তুমি রাখো বাবুগিরি।
খোঁপা কহে, টাক ধরে হই তবে খুশি।
তুমি যেন কাটা পড়ো, এলো কয় রুষি।
কবি মাঝে পড়ি বলে, মনে ভেবে দেখ্
দুজনেই এক তোরা, দুজনেই এক।
খোঁপা গেলে চুল যায়, চুলে যদি টাক—
খোঁপা, তবে কোথা রবে তব জয়ঢাক।
আদিরহস্য
বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব,
কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব।
ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি—
যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।
আরম্ভ ও শেষ
শেষ কহে, একদিন সব শেষ হবে,
হে আরম্ভ, বৃথা তব অহংকার তবে।
আরম্ভ কহিল ভাই, যেথা শেষ হয়
সেইখানে পুনরায় আরম্ভ-উদয়।
ঈর্ষার সন্দেহ
লেজ নড়ে, ছায়া তারি নড়িছে মুকুরে
কোনোমতে সেটা সহ্য করে না কুকুরে।
দাস যবে মনিবেরে দোলায় চামর
কুকুর চটিয়া ভাবে, এ কোন্ পামর?
গাছ যদি নড়ে ওঠে, জলে ওঠে ঢেউ,
কুকুর বিষম রাগে করে ঘেউ-ঘেউ।
সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে
ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারি প্রভু-কোলে।
মনিবের পাতে ঝোল খাবে চুকুচুকু,
বিশ্বে শুধু নড়িবেক তারি লেজটুকু।
উচ্চের প্রয়োজন
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল,
হাট ভ’রে দিই আমি কত শস্য ফল।
পর্বত দাঁড়ায়ে রন কী জানি কী কাজ,
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ।
বিধাতার অবিচার, কেন উঁচুনিচু
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে, সব হলে সমভূমি-পারা
নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গলধারা?