জোড়াসাঁকো, ৮ আষাঢ়, ১৩১০
তোমার বীণায় কত তার আছে
তোমার বীণায় কত তার আছে
কত-না সুরে,
আমি তার সাথে আমার তারটি
দিব গো জুড়ে।
তার পর হতে প্রভাতে সাঁঝে
তব বিচিত্র রাগিণীমাঝে
আমারো হৃদয় রণিয়া রণিয়া
বাজিবে তবে।
তোমার সুরেতে আমার পরান
জড়ায়ে রবে।
তোমার তারায় মোর আশাদীপ
রাখিব জ্বালি।
তোমার কুসুমে আমার বাসনা
দিব গো ঢালি।
তার পর হতে নিশীথে প্রাতে
তব বিচিত্র শোভার সাথে
আমারো হৃদয় জ্বলিবে ফুটিবে,
দুলিবে সুখে–
মোর পরানের ছায়াটি পড়িবে
তোমার মুখে।
তোমারে পাছে সহজে বুঝি
তোমারে পাছে সহজে বুঝি
তাই কি এত লীলার ছল,
বাহিরে যবে হাসির ছটা
ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব
ছলনা,
যে কথা তুমি বলিতে চাও
সে কথা তুমি বল না।
তোমারে পাছে সহজে ধরি
কিছুরই তব কিনারা নাই–
দশের দলে টানি গো পাছে
বিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব
ছলনা,
যে পথে তুমি চলিতে চাও
সে পথে তুমি চল না।
সবার চেয়ে অধিক চাহ
তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও–
হেলার ভরে খেলার মতো
ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও।
বুঝেছি আমি বুঝেছি তব
ছলনা,
সবার যাহে তৃপ্তি হল
তোমার তাহে হল না।
তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব
তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব
লোকের মাঝে;
মোর আঁকা পটে দেখেছে তোমায়
অনেকে অনেক সাজে।
কত জনে এসে মোরে ডেকে কয়
“কে গো সে’, শুধায় তব পরিচয়–
“কে গো সে।’
তখন কী কই, নাহি আসে বাণী,
আমি শুধু বলি,”কী জানি! কী জানি!’
তুমি শুনে হাস, তারা দুষে মোরে
কী দোষে।
তোমার অনেক কাহিনী গাহিয়াছি আমি
অনেক গানে।
গোপন বারতা লুকায়ে রাখিতে
পারি নি আপন প্রাণে।
কত জন মোরে ডাকিয়া কয়েছে,
“যা গাহিছ তার অর্থ রয়েছে
কিছু কি।’
তখন কী কই, নাহি আসে বাণী,
আমি শুধু বলি,”অর্থ কী জানি!’
তারা হেসে যায়,তুমি হাস বসে
মুচুকি।
তোমায় জানি না চিনি না এ কথা বলো তো
কেমনে বলি।
খনে খনে তুমি উঁকি মারি চাও,
খনে খনে যাও ছলি।
জ্যোৎস্নানিশীথে পূর্ণ শশীতে
দেখেছি তোমার ঘোমটা খসিতে,
আঁখির পলকে পেয়েছি তোমায়
লখিতে।
বক্ষ সহসা উঠিয়াছে দুলি,
অকারণে আঁখি উঠেছে আকুলি,
বুঝেছি হৃদয়ে ফেলেছ চরণ
চকিতে।
তোমায় খনে খনে আমি বাঁধিতে চেয়েছি
কথার ডোরে।
চিরকাল-তরে গানের সুরেতে
রাখিতে চেয়েছি ধরে।
সোনার ছন্দে পাতিয়াছি ফাঁদ,
বাঁশিতে ভরেছি কোমল নিখাদ,
তবু সংশয় জাগে ধরা তুমি
দিলে কি!
কাজ নাই,তুমি যা খুশি তা করো–
ধরা না’ই দাও মোর মন হরো,
চিনি বা না চিনি প্রাণ উঠে যেন
পুলকি।
দিয়েছ প্রশ্রয় মোরে, করুণানিলয়
দিয়েছ প্রশ্রয় মোরে, করুণানিলয়,
হে প্রভু, প্রত্যহ মোরে দিয়েছ প্রশ্রয়।
ফিরেছি আপন-মনে আলসে লালসে
বিলাসে আবেশে ভেসে প্রবৃত্তির বশে
নানা পথে, নানা ব্যর্থ কাজে– তুমি তবু
তখনো যে সাথে সাথে ছিলে মোর প্রভু,
আজ তাহা জানি। যে অলস চিন্তা-লতা
প্রচুরপল্লবাকীর্ণ ঘন জটিলতা
হৃদয়ে বেষ্টিয়া ছিল, তারি শাখাজালে
তোমার চিন্তার ফুল আপনি ফুটালে
নিগূঢ় শিকড়ে তার বিন্দু বিন্দু সুধা
গোপনে সিঞ্চন করি। দিয়ে তৃষ্ণা-ক্ষুধা,
দিয়ে দণ্ড-পুরস্কার সুখ-দুঃখ-ভয়
নিয়ত টানিয়া কাছে দিয়েছ প্রশ্রয়।
২৩ ফাল্গুন, ১৩০৭
দুয়ারে তোমার ভিড় ক’রে যারা আছে
দুয়ারে তোমার ভিড় ক’রে যারা আছে,
ভিক্ষা তাদের চুকাইয়া দাও আগে।
মোর নিবেদন নিভৃতে তোমার কাছে–
সেবক তোমার অধিক কিছু না মাগে।
ভাঙিয়া এসেছি ভিক্ষাপাত্র,
শুধু বীণাখানি রেখেছি মাত্র,
বসি এক ধারে পথের কিনারে
বাজাই সে বীণা দিবসরাত্র।
দেখো কতজন মাগিছে রতনধূলি,
কেহ আসিয়াছে যাচিতে নামের ঘটা–
ভরি নিতে চাহে কেহ বিদ্যার ঝুলি,
কেহ ফিরে যাবে লয়ে বাক্যের ছটা।
আমি আনিয়াছি এ বীণাযন্ত্র,
তব কাছে লব গানের মন্ত্র,
তুমি নিজ-হাতে বাঁধো এ বীণায়
তোমার একটি স্বর্ণতন্ত্র।
নগরের হাটে করিব না বেচাকেনা,
লোকালয়ে আমি লাগিব না কোনো কাজে।
পাব না কিছুই,রাখিব না কারো দেনা,
অলস জীবন যাপিব গ্রামের মাঝে।
তরুতলে বসি মন্দ-মন্দ
ঝংকার দিব কত কী ছন্দ,
যত গান গাব তব বাঁধা তারে
বাজিবে তোমার উদার মন্দ্র।
দেখো চেয়ে গিরির শিরে
দেখো চেয়ে গিরির শিরে
মেঘ করেছে গগন ঘিরে,
আর কোরো না দেরি।
ওগো আমার মনোহরণ,
ওগো স্নিগ্ধ ঘনবরন,
দাঁড়াও, তোমায় হেরি।
দাঁড়াও গো ওই আকাশ-কোলে,
দাঁড়াও আমার হৃদয়-দোলে,
দাঁড়াও গো ওই শ্যামল-তৃণ-‘পরে,
আকুল চোখের বারি বেয়ে
দাঁড়াও আমার নয়ন ছেয়ে,
জন্মে জন্মে যুগে যুগান্তরে।
অমনি করে ঘনিয়ে তুমি এসো,
অমনি করে তড়িৎ-হাসি হেসো,
অমনি করে উড়িয়ে দিয়ো কেশ।
অমনি করে নিবিড় ধারা-জলে
অমনি করে ঘন তিমির-তলে
আমায় তুমি করো নিরুদ্দেশ।
ওগো তোমার দরশ লাগি
ওগো তোমার পরশ মাগি
গুমরে মোর হিয়া।
রহি রহি পরান ব্যেপে
আগুন-রেখা কেঁপে কেঁপে
যায় যে ঝলকিয়া।
আমার চিত্ত-আকাশ জুড়ে
বলাকা-দল যাচ্ছে উড়ে
জানি নে কোন্ দূর-সমুদ্র-পারে।
সজল বায়ু উদাস ছুটে,
কোথায় গিয়ে কেঁদে উঠে
পথবিহীন গহন অন্ধকারে।
ওগো তোমার আনো খেয়ার তরী,
তোমার সাথে যাব অকূল-‘পরি,
যাব সকল বাঁধন-বাধা-খোলা।
ঝড়ের বেলা তোমার স্মিতহাসি
লাগবে আমার সর্বদেহে আসি,
তরাস-সাথে হরষ দিবে দোলা।