গান ধর তুমি কোন্ সুরে।
মনে পড়ে যায় দূর হতে এনু,
যেতে হবে পুন কোন্ দূরে।
শুনে মনে পড়ে, দুজনে
খেলেছি সজনে বিজনে,
সে যে কত দেশ নাহি তার শেষ–
সে যে কতকাল এনু ঘুরে।
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে লও স্বর্ণভার।
বাজিয়াছে শাঁখ, পড়িয়াছে ডাক
সে কোন্ অচেনা রাজপুরে।
কাল যবে সন্ধ্যাকালে বন্ধুসভাতলে
কাল যবে সন্ধ্যাকালে বন্ধুসভাতলে
গাহিতে তোমার গান কহিল সকলে
সহসা রুধিয়া গেল হৃদয়ের দ্বার–
যেথায় আসন তব, গোপন আগার।
স্থানভেদে তব গান– মূর্তি নব নব–
সখাসনে হাস্যোচ্ছ্বাস সেও গান তব,
প্রিয়াসনে প্রিয়ালাপ, শিশুসনে খেলা–
জগতে যেথায় যত আনন্দের মেলা
সর্বত্র তোমার গান বিচিত্র গৌরবে
আপনি ধ্বনিতে থাকে সরবে নীরবে।
আকাশে তারকা ফুটে, ফুলবনে ফুল,
খনিতে মানিক থাকে– হয় নাকো ভুল।
তেমনি আপনি তুমি যেখানে যে গান
রেখেছ, কবিও যেন রাখে তার মান।
কী কথা বলিব বলে
কী কথা বলিব বলে
বাহিরে এলেম চলে,
দাঁড়ালেম দুয়ারে তোমার–
ঊর্ধ্বমুখে উচ্চরবে
বলিতে গেলেম যবে
কথা নাহি আর।
যে কথা বলিতে চাহে প্রাণ
সে শুধু হইয়া উঠে গান।
নিজে না বুঝিতে পারি,
তোমারে বুঝাতে নারি,
চেয়ে থাকি উৎসুক-নয়ান।
তবে কিছু শুধায়ো না–
শুনে যাও আনমনা,
যাহা বোঝ, যাহা নাই বোঝ।
সন্ধ্যার আঁধার-পরে
মুখে আর কণ্ঠস্বরে
বাকিটুকু খোঁজো।
কথায় কিছু না যায় বলা,
গান সেও উন্মত্ত উতলা।
তুমি যদি মোর সুরে
নিজ কথা দাও পুরে
গীতি মোর হবে না বিফলা।
কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে
কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে–
কাঁদিছে আপন মনে,
কুসুমের দলে বন্ধ হয়ে
করুণ কাতর স্বনে।
কহিছে সে,”হায় হায়,
বেলা যায় বেলা যায় গো
ফাগুনের বেলা যায়।’
ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে ভয় নাই,
কিছু নাই তোর ভাবনা।
কুসুম ফুটিবে, বাঁধন টুটিবে,
পুরিবে সকল কামনা।
নিঃশেষ হয়ে যাবি যবে তুই
ফাগুন তখনো যাবে না।
কুঁড়ির ভিতরে ফিরিছে গন্ধ কিসের আশে–
ফিরিছে আপনমাঝে,
বাহিরিতে চায় আকুল শ্বাসে
কী জানি কিসের কাজে।
কহিছে সে,”হায় হায়,
কোথা আমি যাই,কারে চাই গো
না জানিয়া দিন যায়।’
ভয় নাই তোর,ভয় নাই ওরে, ভয় নাই,
কিছু নাই তোর ভাবনা।
দখিনপবন দ্বারে দিয়া কান
জেনেছে রে তোর না কামনা।
আপনারে তোর না করিয়া ভোর
দিন তোর চলে যাবে না।
কুঁড়ির ভিতরে আকুল গন্ধ ভাবিছে বসে–
ভাবিছে উদাসপারা,
“জীবন আমার কাহার দোষে
এমন অর্থহারা।’
কহিছে সে,”হায় হায়,
কেন আমি বাঁচি,কেন আছি গো
অর্থ না বুঝা যায়।’
ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে, ভয় নাই,
কিছু নাই তোর ভাবনা।
যে শুভ প্রভাতে সকলের সাথে
মিলিবি, পুরাবি কামনা,
আপন অর্থ সেদিন বুঝিবি–
জনম ব্যর্থ যাবে না।
কেবল তব মুখের পানে চাহিয়া
কেবল তব মুখের পানে
চাহিয়া,
বাহির হনু তিমির-রাতে
তরণীখানি বাহিয়া।
অরুণ আজি উঠেছে–
আশোক আজি ফুটেছে–
না যদি উঠে,না যদি ফুটে,
তবুও আমি চলিব ছুটে
তোমার মুখে চাহিয়া।
নয়নপাতে ডেকেছ মোরে
নীরবে।
হৃদয় মোর নিমেষ-মাঝে
উঠেছে ভরি গরবে।
শঙ্খ তব বাজিল–
সোনার তরী সাজিল–
না যদি বাজে, না যদি সাজে,
গরব যদি টুটে গো লাজে
চলিব তবু নীরবে।
কথাটি আমি শুধাব নাকো
তোমারে।
দাঁড়াব নাকো ক্ষণেক-তরে
দ্বিধার ভরে দুয়ারে।
বাতাসে পাল ফুলিছে–
পতাকা আজি দুলিছে–
না যদি ফুলে, না যদি দুলে,
তরণী যদি না লাগে কূলে
শুধাব নাকো তোমারে।
ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে
ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে, তাই হেরো আজি
তোমার সর্বাঙ্গ ঘেরি পুলকিছে শ্যাম শস্পরাজি
প্রস্ফুটিত পুষ্পজালে; বনস্পতি শত বরষার
আনন্দবর্ষণকাব্য লিখিতেছে পত্রপুঞ্জে তার
বল্কলে শৈবালে জটে; সুদুর্গম তোমার শিখর
নির্ভয় বিহঙ্গ যত কলোল্লাসে করিছে মুখর।
আসি নরনারীদল তোমার বিপুল বক্ষপটে
নিঃশঙ্ক কুটিরগুলি বাঁধিয়াছে নির্ঝরিণীতটে।
যেদিন উঠিয়াছিলে অগ্নিতেজে স্পর্ধিতে আকাশ,
কম্পমান ভূমণ্ডলে, চন্দ্রসূর্য করিবারে গ্রাস —
সেদিন হে গিরি, তব এক সঙ্গী আছিল প্রলয়;
যখনি থেমেছ তুমি, বলিয়াছ “আর নয় নয়’,
চারি দিক হতে এল তোমা’পরে আনন্দনিশ্বাস,
তোমার সমাপ্তি ঘেরি বিস্তারিল বিশ্বের বিশ্বাস।
জোড়াসাঁকো, ৯ আষাঢ়, ১৩১০
চিরকাল একি লীলা গো
চিরকাল একি লীলা গো–
অনন্ত কলরোল।
অশ্রুত কোন্ গানের ছন্দে
অদ্ভুত এই দোল।
দুলিছ গো, দোলা দিতেছ।
পলকে আলোকে তুলিছ, পলকে
আঁধারে টানিয়া নিতেছ।
সমুখে যখন আসি
তখন পুলকে হাসি,
পশ্চাতে যবে ফিরে যায় দোলা
ভয়ে আঁখিজলে ভাসি।
সমুখে যেমন পিছেও তেমন,
মিছে করি মোরা গোল।
চিরকাল একই লীলা গো–
অনন্ত কলরোল।
ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
বাম হাত হতে ডানে।
নিজধন তুমি নিজেই হরিয়া
কী যে কর কে বা জানে।
কোথা বসে আছ একেলা–
সব রবিশশী কুড়ায়ে লইয়া
তালে তালে কর এ খেলা।
খুলে দাও ক্ষণতরে,
ঢাকা দাও ক্ষণপরে–
মোরা কেঁদে ভাবি, আমারি কী ধন
কে লইল বুঝি হ’রে!
দেওয়া-নেওয়া তব সকলি সমান
সে কথাটি কে বা জানে।
ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
বাম হাত হতে ডানে।
এইমতো চলে চির কাল গো
শুধু যাওয়া, শুধু আসা।
চির দিনরাত আপনার সাথ
আপনি খেলিছ পাশা।
আছে তো যেমন যা ছিল–
হারায় নি কিছু, ফুরায় নি কিছু
যে মরিল যে বা বাঁচিল।
বহি সব সুখদুখ
এ ভুবন হাসিমুখ,
তোমারি খেলার আনন্দে তার
ভরিয়া উঠেছে বুক।
আছে সেই আলো, আছে সেই গান,
আছে সেই ভালোবাসা।
এইমতো চলে চির কাল গো
শুধু যাওয়া, শুধু আসা।
তুমি আছ হিমাচল ভারতের অনন্তসঞ্চিত
তুমি আছ হিমাচল ভারতের অনন্তসঞ্চিত
তপস্যার মতো। স্তব্ধ ভূমানন্দ যেন রোমাঞ্চিত
নিবিড় নিগূঢ়-ভাবের পথশূন্য তোমার নির্জনে,
নিষ্কলঙ্ক নীহারের অভ্রভেদী আত্মবিসর্জনে।
তোমার সহস্র শৃঙ্গ বাহু তুলি কহিছে নীরবে
ঋষির আশ্বাসবাণী, “শুন শুন বিশ্বজন সবে,
জেনেছি, জেনেছি আমি।’ যে ওঙ্কার আনন্দ-আলোতে
উঠেছিল ভারতের বিরাট গভীর বক্ষ হতে
আদি-অন্ত-বিহীনের অখণ্ড অমৃতলোক-পানে,
সে আজি উঠিছে বাজি, গিরি, তব বিপুল পাষাণে।
একদিন এ ভারতে বনে বনে হোমাগ্নি-আহুতি
ভাষাহারা মহাবার্তা প্রকাশিতে করেছে আকূতি,
সেই বহ্নিবাণী আজি অচল প্রস্তরশিখারূপে
শৃঙ্গে শৃঙ্গে কোন্ মন্ত্র উচ্ছ্বাসিছে মেঘধুম্রস্তূপে।