বন্ধু, সন্ধ্যা এল, স্বপনভরা
পবন এরে চুমে।
ডালগুলি সব পাতা নিয়ে
জড়িয়ে এল ঘুমে।
ফুলগুলি সব নীল নয়ানে
চুপিচুপি আকাশপানে
তারার দিকে চেয়ে চেয়ে
কোন্ ধেয়ানে রতা।
আমার লজ্জাবতী লতা।
বন্ধু, আনো তোমার তড়িৎ-পরশ,
হরষ দিয়ে দাও,
করুণ চক্ষু মেলে ইহার
মর্মপানে চাও।
সারা দিনের গন্ধগীতি
সারা দিনের আলোর স্মৃতি
নিয়ে এ যে হৃদয়ভারে
ধরায় অবনতা–
আমার লজ্জাবতী লতা।
বন্ধু, তুমি জান ক্ষুদ্র যাহা
ক্ষুদ্র তাহা নয়,
সত্য যেথা কিছু আছে
বিশ্ব সেথা রয়
এই-যে মুদে আছে লাজে
পড়বে তুমি এরি মাঝে–
জীবনমৃত্যু রৌদ্রছায়া
ঝটিকার বারতা।
আমার লজ্জাবতী লতা।
কলিকাতা, ১৮ আষাঢ়, ১৩১৩
ওরে আমার কর্মহারা, ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া
ওরে আমার কর্মহারা, ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া,
ওরে আমার মন রে, আমার মন।
জানি নে তুই কিসের লাগিকোন্ জগতে আছিস জাগি–
কোন্ সেকালের বিলুপ্ত ভুবন।
কোন্ পুরানো যুগের বাণী অর্থ যাহার নাহি জানি
তোমার মুখে উঠছে আজি ফুটে।
অনন্ত তোর প্রাচীন স্মৃতি কোন্ ভাষাতে গাঁথছে গীতি,
শুনে চক্ষে অশ্রুধারা ছুটে।
আজি সকল আকাশ জুড়ে যাচ্ছে তোমার পাখা উড়ে,
তোমার সাথে চলতে আমি নারি।
তুমি যাদের চিনি ব’লে টানছ বুকে, নিচ্ছ কোলে,
আমি তাদের চিনতে নাহি পারি।
আজকে নবীন চৈত্রমাসে পুরাতনের বাতাস আসে,
খুলে গেছে যুগান্তরের সেতু।
মিথ্যা আজি কাজের কথা, আজ জেগেছে যে-সব ব্যথা
এই জীবনে নাইকো তাহার হেতু।
গভীর চিত্তে গোপন শালা সেথা ঘুমায় যে রাজবালা
জানি নে সে কোন্ জনমের পাওয়া।
দেখে নিলেম ক্ষণেক তারে, যেমনি আজি মনের দ্বারে
যবনিকা উড়িয়ে দিল হাওয়া।
ফুলের গন্ধ চুপে চুপে আজি সোনার কাঠি-রূপে
ভাঙালো তার চিরযুগের ঘুম।
দেখছে লয়ে মুকুর করে আঁকা তাহার ললাট-‘পরে
কোন্ জনমের চন্দনকুঙ্কুম।
আজকে হৃদয় যাহা কহে মিথ্যা নহে, সত্য নহে,
কেবল তাহা অরূপ অপরূপ।
খুলে গেছে কেমন করে আজি অসম্ভবের ঘরে
মর্চে-পড়া পুরানো কুলুপ।
সেথায় মায়াদ্বীপের মাঝে নিমন্ত্রণের বীণা বাজে,
ফেনিয়ে ওঠে নীল সাগরের ঢেউ,
মর্মরিত-তমাল-ছায়ে ভিজে চিকুর শুকায় বায়ে–
তাদের চেনে, চেনে না বা কেউ।
শৈলতলে চরায় ধেনু, রাখালশিশু বাজায় বেণু,
চূড়ায় তারা সোনার মালা পরে।
সোনার তুলি দিয়ে লিখা চৈত্রমাসের মরীচিকা
কাঁদায় হিয়া অপূর্বধন-তরে।
গাছের পাতা যেমন কাঁপে দখিনবায়ে মধুর তাপে
তেমনি মম কাঁপছে সারা প্রাণ।
কাঁপছে দেহে কাঁপছে মনে হাওয়ার সাথে আলোর সনে,
মর্মরিয়া উঠছে কলতান।
কোন্ অতিথি এসেছে গো, কারেও আমি চিনি নে গো
মোর দ্বারে কে করছে আনাগোনা।
ছায়ায় আজি তরুর মূলে ঘাসের ‘পরে নদীর কূলে
ওগো তোরা শোনা আমায় শোনা–
দূর-আকাশের-ঘুম-পাড়ানি মৌমাছিদের-মন-হারানি
জুঁই-ফোটানো ঘাস-দোলানো গান,
জলের-গায়ে-পুলক-দেওয়া ফুলের-গন্ধ-কুড়িয়ে-নেওয়া
চোখের পাতে-ঘুম-বোলানো তান।
শুনাস নে গো ক্লান্ত বুকের বেদনা যত সুখের দুখের —
প্রেমের কথা– আশার নিরাশার।
শুনাও শুধু মৃদুমন্দ অর্থবিহীন কথার ছন্দ,
শুধু সুরের আকুল ঝংকার।
ধারাযন্ত্রে সিনান করি যত্নে তুমি এসো পরি
চাঁপাবরন লঘু বসনখানি।
ভালে আঁকো ফুলের রেখা চন্দনেরই পত্রলেখা,
কোলের ‘পরে সেতার লহো টানি।
দূর দিগন্তে মাঠের পারে সুনীল-ছায়া গাছের সারে
নয়নদুটি মগ্ন করি চাও।
ভিন্নদেশী কবির গাঁথা অজানা কোন্ ভাষার গাথা
গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া গাও।
হাজারিবাগ, ১২ চৈত্র, ১৩০৯
ওরে পদ্মা, ওরে মোর রাক্ষসী প্রেয়সী
ওরে পদ্মা, ওরে মোর রাক্ষসী প্রেয়সী,
লুব্ধ বাহু বাড়াইয়া উচ্ছ্বসি উল্লসি
আমারে কি পেতে চাস চির আলিঙ্গনে।
শুধু এক মুহূর্তের উন্মত্ত মিলনে
তোর বক্ষোমাঝে চাস করিতে বিলয়
আমার বক্ষের যত সুখ দুঃখ ভয়?
আমিও তো কতদিন ভাবিয়াছি মনে
বসি তোর তটোপান্তে প্রশান্ত নির্জনে,
বাহিরে চঞ্চলা তুই প্রমত্তমুখরা,
শানিত অসির মতো ভীষণ প্রখরা,
অন্তরে নিভৃত স্নিগ্ধ শান্ত সুগম্ভীর–
দীপহীন রুদ্ধদ্বার অর্ধরজনীর
বাসরঘরের মতো নিষুপ্ত নির্জন–
সেথা কার তরে পাতা সুচির শয়ন।
কত দিবা কত বিভাবরী
কত দিবা কত বিভাবরী
কত নদী নদে লক্ষ স্রোতের
মাঝখানে এক পথ ধরি,
কত ঘাটে ঘাটে লাগায়ে,
কত সারিগান জাগায়ে,
কত অঘ্রানে নব নব ধানে
কতবার কত বোঝা ভরি
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে কত স্বর্ণভার
কোন্ গ্রামে আজ সাধিতে কী কাজ
বাঁধিয়া ধরিলে তব তরী।
হেথা বিকিকিনি কার হাটে।
কেন এত ত্বরা লইয়া পসরা,
ছুটে চলে এরা কোন্ বাটে।
শুন গো থাকিয়া থাকিয়া
বোঝা লয়ে যায় হাঁকিয়া,
সে করুণ স্বরে মন কী যে করে–
কী ভেবে আমার দিন কাটে।
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে লও স্বর্ণভার–
হেথা কারা রয় লহো পরিচয়,
কারা আসে যায় এই ঘাটে।
যেথা হতে যাই, যাই কেঁদে।
এমনটি আর পাব কি আবার
সরে না যে মন সেই খেদে।
সে-সব কাঁদন ভুলালে,
কী দোলায় প্রাণ দুলালে।
হোথা যারা তীরে আনমনে ফিরে
আমি তাহাদের মরি সেধে।
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে লও স্বর্ণভার।
এই হাটে নামি দেখে লব আমি–
এক বেলা তরী রাখো বেঁধে।