বাহিরে আনিনু তাহারে, করিতে
হৃদয়দিগ্বিজয়।
সারথি হইয়া রথখানি তার
চালানু ধরণীময়।
রমণীরে কে বা জানে–
মন তার কোন্খানে।
দিকে দিকে লোক সঁপি দিল প্রাণ,
দিকে দিকে তার উঠে চাটুগান,
মনে হল তবে দীপ্ত গরবে
চাহিল সে মোর পানে।
কিছু দিন যায়,মুখ সে ফিরায়,
ফেলে সে নয়নবারি–
“হৃদয় কুড়ায়ে কোনো সুখ নাই’
কহে বিরহিণী নারী।
আমি কহিলাম,”কারে তুমি চাও
ওগো বিরহিণী নারী।’
সে কহিল,”আমি যারে চাই,তার
নাম না কহিতে পারি।’
রমণীরে কে বা জানে–
মন তার কোন্খানে।
সে কহিল,”আমি যারে চাই তারে
পলকে যদি গো পাই দেখিবারে,
পুলকে তখনি লব তারে চিনি
চাহি তার মুখপানে।’
দিন চলে যায়, সে কেবল হায়
ফেলে নয়নের বারি–
অজানারে কবে আপন করিব’
কহে বিরহিণী নারী।
আমি চঞ্চল হে
আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসি।
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে,
ওগো প্রাণে মনে আমি যে তাহার
পরশ পাবার প্রয়াসী।
আমি সুদূরের পিয়াসি।
ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই,
সে কথা যে যাই পাসরি।
আমি উৎসুক হে,
হে সুদূর, আমি প্রবাসী।
তুমি দুর্লভ দুরাশার মতো
কী কথা আমায় শুনাও সতত।
তব ভাষা শুনে তোমারে হৃদয়
জেনেছে তাহার স্বভাষী।
হে সুদূর,আমি প্রবাসী।
ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
নাহি জানি পথ, নাহি মোর রথ
সে কথা যে যাই পাসরি। ‘
আমি উন্মনা হে,
হে সুদূর,আমি উদাসী।
রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায়
তরুমর্মরে, ছায়ার খেলায়,
কী মুরতি তব নীলাকাশশায়ী
নয়নে উঠে গো আভাসি।
হে সুদূর,আমি উদাসী।
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার
সে কথা যে যাই পাসরি।
আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে
আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে,
বাঁকা পথের ডাহিন পাশে, ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে।
কে জানে এই গ্রাম,
কে জানে এর নাম,
খেতের ধারে মাঠের পারে বনের ঘন ছায়ে–
শুধু আমার হৃদয় জানে সে ছিল এই গাঁয়ে।
বেণুশাখারা আড়াল দিয়ে চেয়ে আকাশ-পানে
কত সাঁঝের চাঁদ-ওঠা সে দেখেছে এইখানে।
কত আষাঢ় মাসে
ভিজে মাটির বাসে
বাদলা হাওয়া বয়ে গেছে তাদের কাঁচা ধানে।
সে-সব ঘনঘটার দিনে সে ছিল এইখানে।
এই দিঘি, ওই আমের বাগান, ওই-যে শিবালয়,
এই আঙিনা ডাক-নামে তার জানে পরিচয়।
এই পুকুরে তারি,
সাঁতার-কাটা বারি,
ঘাটের পথরেখা তারি চরণ-লেখা-ময়।
এই গাঁয়ে সে ছিল কে সেই জানে পরিচয়।
এই যাহারা কলস নিয়ে দাঁড়ায় ঘাটে আসি
এরা সবাই দেখেছিল তারি মুখের হাসি।
কুশল পুছি তারে
দাঁড়াত তার দ্বারে
লাঙল কাঁধে চলছে মাঠে ওই-যে প্রাচীন চাষি।
সে ছিল এই গাঁয়ে আমি যারে ভালোবাসি।
পালের তরী কত-যে যায় বহি দখিনবায়ে,
দূর প্রবাসের পথিক এসে বসে বকুলছায়ে।
পারের যাত্রিদলে
খেয়ার ঘাটে চলে,
কেউ গো চেয়ে দেখে না ওই ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে।
আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে।
আলমোড়া, ২৯ বৈশাখ, ১৩১০
আলো নাই, দিন শেষ হল, ওরে
আলো নাই, দিন শেষ হল, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
ঘন্টা বাজিল দূরে
ও পারের রাজপুরে,
এখনো যে পথে চলেছিস তুই
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
দেখ্ সবে ঘরে ফিরে এল, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
পূজা সারি দেবালয়ে
প্রসাদী কুসুম লয়ে,
এখন ঘুমের কর্ আয়োজন
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
রজনী আঁধার হয়ে আসে, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
ওই-যে গ্রামের ‘পরে
দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে–
দীপহীন পথে কী করিবি একা
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
এত বোঝা লয়ে কোথা যাস, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
নামাবি এমন ঠাঁই
পাড়ায় কোথা কি নাই।
কেহ কি শয়ন রাখে নাই পাতি
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
পথের চিহ্ন দেখা নাহি যায়
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
কোন্ প্রান্তরশেষে
কোন্ বহুদূর দেশে
কোথা তোর রাত হবে যে প্রভাত
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায়
আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায়,
আঁধারেতে চলে যায় বাহিরে।
ভাবে মনে, বৃথা এই আসা আর যাওয়া,
অর্থ কিছুই এর নাহি রে।
কেন আসি, কেন হাসি,
কেন আঁখিজলে ভাসি,
কার কথা বলে যাই, কার গান গাহি রে–
অর্থ কিছুই তার নাহি রে।
ওরে মন, আয় তুই সাজ ফেলে আয়,
মিছে কী করিস নাট-বেদীতে।
বুঝিতে চাহিস যদি বাহিরেতে আয়,
খেলা ছেড়ে আয় খেলা দেখিতে।
ওই দেখ্ নাটশালা
পরিয়াছে দীপমালা,
সকল রহস্য তুই চাস যদি ভেদিতে
নিজে না ফিরিলে নাট-বেদীতে।
নেমে এসে দূরে এসে দাঁড়াবি যখন–
দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি,
এই হাসি-রোদনের মহানাটকের
অর্থ তখন কিছু বুঝিবি।
একের সহিত একে
মিলাইয়া নিবি দেখে,
বুঝে নিবি, বিধাতার সাথে নাহি যুঝিবি–
দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি।
উৎসর্গ (উৎসর্গ)
বিজ্ঞানাচার্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু
করকমলেষু
বন্ধু, এ যে আমার লজ্জাবতী লতা
কী পেয়েছে আকাশ হতে
কী এসেছে বায়ুর স্রোতে
পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে
সে যে প্রাণের কথা।
যত্নভরে খুঁজে খুঁজে
তোমায় নিতে হবে বুঝে,
ভেঙে দিতে হবে যে তার
নীরব ব্যাকুলতা।
আমার লজ্জাবতী লতা।