আজ মনে হয় সকলেরই মাঝে
আজ মনে হয় সকলেরই মাঝে
তোমারেই ভালোবেসেছি।
জনতা বাহিয়া চিরদিন ধরে
শুধু তুমি আমি এসেছি।
দেখি চারি দিক-পানে
কী যে জেগে ওঠে প্রাণে–
তোমার আমার অসীম মিলন
যেন গো সকল খানে।
কত যুগ এই আকাশে যাপিনু
সে কথা অনেক ভুলেছি।
তারায় তারায় যে আলো কাঁপিছে
সে আলোকে দোঁহে দুলেছি।
তৃণরোমাঞ্চ ধরণীর পানে
আশ্বিনে নব আলোকে
চেয়ে দেখি যবে আপনার মনে
প্রাণ ভরি উঠে পুলকে।
মনে হয় যেন জানি
এই অকথিত বাণী,
মূক মেদিনীর মর্মের মাঝে
জাগিছে সে ভাবখানি।
এই প্রাণে-ভরা মাটির ভিতরে
কত যুগ মোরা যেপেছি,
কত শরতের সোনার আলোকে
কত তৃণে দোঁহে কেঁপেছি।
প্রাচীন কালের পড়ি ইতিহাস
সুখের দুখের কাহিনী–
পরিচিতসম বেজে ওঠে সেই
অতীতের যত রাগিণী।
পুরাতন সেই গীতি
সে যেন আমার স্মৃতি,
কোন্ ভাণ্ডারে সঞ্চয় তার
গোপনে রয়েছে নিতি।
প্রাণে তাহা কত মুদিয়া রয়েছে
কত বা উঠিছে মেলিয়া–
পিতামহদের জীবনে আমরা
দুজনে এসেছি খেলিয়া।
লক্ষ বরষ আগে যে প্রভাত
উঠেছিল এই ভুবনে
তাহার অরুণকিরণকণিকা
গাঁথ নি কি মোর জীবনে?
সে প্রভাতে কোন্খানে
জেগেছিনু কেবা জানে।
কী মুরতি-মাঝে ফুটালে আমারে
সেদিন লুকায়ে প্রাণে!
হে চির-পুরানো,চিরকাল মোরে
গড়িছ নূতন করিয়া।
চিরদিন তুমি সাথে ছিলে মোর,
রবে চিরদিন ধরিয়া।
আজি হেরিতেছি আমি
আজি হেরিতেছি আমি, হে হিমাদ্রি, গভীর নির্জনে
পাঠকের মতো তুমি বসে আছ অচল আসনে,
সনাতন পুঁথিখানি তুলিয়া লয়েছ অঙ্ক’পরে।
পাষাণের পত্রগুলি খুলিয়া গিয়াছে থরে থরে,
পড়িতেছ একমনে। ভাঙিল গড়িল কত দেশ,
গেল এল কত যুগ– পড়া তব হইল না শেষ।
আলোকের দৃষ্টিপথে এই-যে সহস্র খোলা পাতা
ইহাতে কি লেখা আছে ভব-ভবানীর প্রেম-গাথা–
নিরাসক্ত নিরাকাঙক্ষ ধ্যানাতীত মহাযোগীশ্বর
কেমনে দিলেন ধরা সুকোমল দুর্বল সুন্দর
বাহুর করুণ আকর্ষণে – কিছু নাহি চাহি যাঁর
তিনি কেন চাহিলেন– ভালোবাসিলেন নির্বিকার–
পরিলেন পরিণয়পাশ। এই-যে প্রেমের লীলা
ইহারই কাহিনী বহে হে শৈল, তোমার যত শিলা।
আলমোড়া, ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১০
আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে
আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে, ওগো,
দিক্-দিগন্ত ঢাকি।
আজিকে আমরা কাঁদিয়া শুধাই সঘনে, ওগো,
আমরা খাঁচার পাখি–
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি কি আসিল প্রলয়রাত্রি ঘোর।
চিরদিবসের আলোক গেল কি মুছিয়া।
চিরদিবসের আশ্বাস গেল ঘুচিয়া?
দেবতার কৃপা আকাশের তলে কোথা কিছু নাহি বাকি?–
তোমাপানে চাই, কাঁদিয়া শুধাই আমরা খাঁচার পাখি।
ফাল্গুন এলে সহসা দখিনপবন হতে
মাঝে মাঝে রহি রহি
আসিত সুবাস সুদূরকুঞ্জভবন হতে
অপূর্ব আশা বহি।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
মাঝে মাঝে যবে রজনী হইত ভোর,
কী মায়ামন্ত্রে বন্ধনদুখ নাশিয়া
খাঁচার কোণেতে প্রভাত পশিত হাসিয়া
ঘনমসী-আঁকা লোহার শলাকা সোনার সুধায় মাখি।–
নিখিল বিশ্ব পাইতাম প্রাণে আমরা খাঁচার পাখি।
আজি দেখো ওই পূর্ব-অচলে চাহিয়া, হোথা
কিছুই না যায় দেখা–
আজি কোনো দিকে তিমিরপ্রান্ত দাহিয়া, হোথা
পড়ে নি সোনার রেখা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকঠোর।
আজি পিঞ্জর ভুলাবারে কিছু নাহি রে–
কার সন্ধান করি অন্তরে বাহিরে।
মরীচিকা লয়ে জুড়াব নয়ন আপনারে দিব ফাঁকি
সে আলোটুকুও হারায়েছি আজি আমরা খাঁচার পাখি।
ওগো আমাদের এই ভয়াতুর বেদনা যেন
তোমারে না দেয় ব্যথা।
পিঞ্জরদ্বারে বসিয়া তুমিও কেঁদো না যেন
লয়ে বৃথা আকুলতা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
তোমার চরণে নাহি তো লৌহডোর।
সকল মেঘের ঊর্ধ্বে যাও গো উড়িয়া,
সেথা ঢালো তান বিমল শূন্য জুড়িয়া–
“নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি’ কহো আমাদের ডাকি,
মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান আমরা খাঁচার পাখি।
আপনারে তুমি করিবে গোপন
আপনারে তুমি করিবে গোপন
কী করি।
হৃদয় তোমার আঁখির পাতায়
থেকে থেকে পড়ে ঠিকরি।
আজ আসিয়াছ কৌতুকবেশে,
মানিকের হার পরি এলোকেশে,
নয়নের কোণে আধো হাসি হেসে
এসেছ হৃদয়পুলিনে।
ভুলি নে তোমার বাঁকা কটাক্ষে,
ভুলি নে চতুর নিঠুর বাক্যে
ভুলি নে।
করপল্লবে দিলে যে আঘাত
করিব কি তাহে আঁখিজলপাত।
এমন অবোধ নহি গো।
হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব
সহি গো।
আজ এই বেশে এসেছ আমায়
ভুলাতে।
কভু কি আস নি দীপ্ত ললাটে
স্নিগ্ধ পরশ বুলাতে।
দেখেছি তোমার মুখ কথাহারা–
জলে-ছলছল ম্লান আঁখিতারা,
দেখেছি তোমার ভয়-ভরে সারা
করুণ পেলব মুরতি।
দেখেছি তোমার বেদনাবিধুর
পলকবিহীন নয়নে মধুর
মিনতি।
আজি হাসিমাখা নিপুণ শাসনে
তরাস আমি যে পাব মনে মনে
এমন অবোধ নহি গো
হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব
সহি গো।
আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা
আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা,
দেবদারুর কুঞ্জে ধেনু চরায় রাখালেরা।
কোথা হতে চৈত্রমাসে হাঁসের শ্রেণী উড়ে আসে,
অঘ্রানেতে আকাশপথে যায় যে তারা কোথা
আমরা কিছুই জানি নেকো সেই সুদূরের কথা।
আমরা জানি গ্রাম ক’খানি, চিনি দশটি গিরি–
মা ধরণী রাখেন মোদের কোলের মধ্যে ঘিরি।