হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি
হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি
দেখা দিলে আজ কী বেশে।
দেখিনু তোমারে পূর্বগগনে,
দেখিনু তোমারে স্বদেশে।
ললাট তোমার নীল নভতল
বিমল আলোকে চির-উজ্জ্বল
নীরব আশিস-সম হিমাচল
তব বরাভয় কর।
সাগর তোমার পরশি চরণ
পদধূলি সদা করিছে হরণ,
জাহ্নবী তব হার-আভরণ
দুলিছে বক্ষ’পর।
হৃদয় খুলিয়া চাহিনু বাহিরে,
হেরিনু আজিকে নিমেষে–
মিলে গেছ ওগো বিশ্বদেবতা,
মোর সনাতন স্বদেশে।
শুনিনু তোমার স্তবের মন্ত্র
অতীতের তপোবনেতে–
অমর ঋষির হৃদয় ভেদিয়া
ধ্বনিতেছে ত্রিভুবনেতে।
প্রভাতে হে দেব,তরুণ তপনে
দেখা দাও যবে উদয়গগনে
মুখ আপনার ঢাকি আবরণে
হিরণ-কিরণে গাঁথা–
তখন ভারতে শুনি চারি ভিতে
মিলি কাননের বিহঙ্গগীতে
প্রাচীন নীরব কণ্ঠ হইতে
উঠে গায়ত্রীগাথা।
হৃদয় খুলিয়া দাঁড়ানু বাহিরে
শুনিনু আজিকে নিমেষে,
অতীত হইতে উঠিছে হে দেব,
তব গান মোর স্বদেশে।
নয়ন মুদিয়া শুনিনু, জানি না
কোন্ অনাগত বরষে
তব মঙ্গলশঙ্খ তুলিয়া
বাজায় ভারত হরষে।
ডুবায়ে ধরার রণহুংকার
ভেদি বণিকের ধনঝংকার
মহাকাশতলে উঠে ওঙ্কার
কোনো বাধা নাহি মানি।
ভারতের শ্বেত হৃদিশতদলে,
দাঁড়ায়ে ভারতী তব পদতলে,
সংগীততানে শূন্যে উথলে
অপূর্ব মহাবাণী।
নয়ন মুদিয়া ভাবীকালপানে
চাহিনু, শুনিনু নিমেষে
তব মঙ্গলবিজয়শঙ্খ
বাজিছে আমার স্বদেশে।
হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে
হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে
শুন এ কবির গান।
তোমার চরণে নবীন হর্ষে
এনেছি পূজার দান।
এনেছি মোদের দেহের শকতি
এনেছি মোদের মনের ভকতি,
এনেছি মোদের ধর্মের মতি,
এনেছি মোদের প্রাণ।
এনেছি মোদের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য
তোমারে করিতে দান।
কাঞ্চন-থালি নাহি আমাদের,
অন্ন নাহিকো জুটে
যা আছে মোদের এনেছি সাজায়ে
নবীন পর্ণপুটে।
সমারোহে আজ নাই প্রয়োজন,
দীনের এ পূজা, দীন আয়োজন,
চিরদারিদ্র৻ করিব মোচন
চরণের ধুলা লুটে।
সুরদুর্লভ তোমার প্রসাদ
লইব পর্ণপুটে।
রাজা তুমি নহ, হে মহাতাপস,
তুমিই প্রাণের প্রিয়।
ভিক্ষাভূষণ ফেলিয়া পরিব
তোমারি উত্তরীয়।
দৈন্যের মাঝে আছে তব ধন,
মৌনের মাঝে রয়েছে গোপন
তোমার মন্ত্র অগ্নিবচন–
তাই আমাদের দিয়ো।
পরের সজ্জা ফেলিয়া পরিব
তোমার উত্তরীয়।
দাও আমাদের অভয়মন্ত্র
অশোকমন্ত্র তব।
দাও আমাদের অমৃতমন্ত্র,
দাও গো জীবন নব।
যে জীবন ছিল তব তপোবনে
যে জীবন ছিল তব রাজাসনে
মুক্ত দীপ্ত সে মহাজীবন
চিত্ত ভরিয়া লব।
মৃত্যুতরণ শঙ্কাহরণ
দাও সে মন্ত্র তব।
হে রাজন তুমি আমারে
হে রাজন্, তুমি আমারে
বাঁশি বাজাবার দিয়েছ যে ভার
তোমার সিংহদুয়ারে–
ভুলি নাই তাহা ভুলি নাই,
মাঝে মাঝে তবু ভুলে যাই,
চেয়ে চেয়ে দেখি কে আসে কে যায়
কোথা হতে যায় কোথা রে।
কেহ নাহি চায় থামিতে।
শিরে লয়ে বোঝা চলে যায় সোজা,
না চাহে দখিনে বামেতে।
বকুলের শাখে পাখি গায়,
ফুল ফুটে তব আঙিনায়–
না দেখিতে পায়,না শুনিতে চায়,
কোথা যায় কোন্ গ্রামেতে।
বাঁশি লই আমি তুলিয়া।
তারা ক্ষণতরে পথের উপরে
বোঝা ফেলে বসে ভুলিয়া।
আছে যাহা চিরপুরাতন
তারে পায় যেন হারাধন,
বলে, “ফুল এ কী ফুটিয়াছে দেখি।
পাখি গায় প্রাণ খুলিয়া।’
হে রাজন্,তুমি আমারে
রেখো চিরদিন বিরামবিহীন
তোমার সিংহদুয়ারে।
যারা কিছু নাহি কহে যায়,
সুখদুখভার বহে যায়,
তারা ক্ষণতরে বিস্ময়ভরে
দাঁড়াবে পথের মাঝারে
তোমার সিংহদুয়ারে।
হে হিমাদ্রি, দেবতাত্মা, শৈলে শৈলে আজিও তোমার
হে হিমাদ্রি, দেবতাত্মা, শৈলে শৈলে আজিও তোমার
অভেদাঙ্গ হরগৌরী আপনারে যেন বারম্বার
শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিস্তারিয়া ধরিছেন বিচিত্র মুরতি।
ওই হেরি ধ্যানাসনে নিত্যকাল স্তব্ধ পশুপতি,
দুর্গম দুঃসহ মৌন– জটাপুঞ্জতুষারসংঘাত
নিঃশব্দে গ্রহণ করে উদয়াস্তরবিরশ্মিপাত
পূজাস্বর্ণপদ্মদল। কঠিনপ্রস্তরকলেবর
মহান্-দরিদ্র, রিক্ত, আভরণহীন দিগম্বর,
হেরো তাঁরে অঙ্গে অঙ্গে এ কী লীলা করেছে বেষ্টন–
মৌনেরে ঘিরেছে গান, স্তব্ধেরে করেছে আলিঙ্গন
সফেন চঞ্চল নৃত্য, রিক্ত কঠিনেরে ওই চুমে
কোমল শ্যামলশোভা নিত্যনব পল্লবে কুসুমে
ছায়ারৌদ্রে মেঘের খেলায়। গিরিশেরে রয়েছেন ঘিরি
পার্বতী মাধুরীচ্ছবি তব শৈলগৃহে হিমগিরি।
শান্তিনিকেতন, ৬ আষাঢ়, ১৩১০