সে তো সে দিনের কথা, বাক্যহীন যবে
সে তো সে দিনের কথা, বাক্যহীন যবে
এসেছিনু প্রবাসীর মতো এই ভবে
বিনা কোনো পরিচয়, রিক্ত শূন্য হাতে,
একমাত্র ক্রন্দন সম্বল লয়ে সাথে।
আজ সেথা কী করিয়া মানুষের প্রীতি
কণ্ঠ হতে টানি লয় যত মোর গীতি।
এ ভুবনে মোর চিত্তে অতি অল্প স্থান
নিয়েছ, ভুবননাথ। সমস্ত এ প্রাণ
সংসারে করেছ পূর্ণ। পাদপ্রান্তে তব
প্রত্যহ যে ছন্দে-বাঁধা গীত নব নব
দিতেছি অঞ্জলি, তাও তব পূজাশেষে
লবে সবে তোমা সাথে মোরে ভালোবেসে
এই আশাখানি মনে আছে অবিচ্ছেদে।
যে প্রবাসে রাখ সেথা প্রেমে রাখো বেঁধে।
নব নব প্রবাসেতে নব নব লোকে
বাঁধিবে এমনি প্রেমে। প্রেমের আলোকে
বিকশিত হব আমি ভুবনে ভুবনে
নব নব পুষ্পদলে; প্রেম-আকর্ষণে
যত গূঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে
উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে,
বাহিরে আসিবে ছুটি– অন্তহীন প্রাণে
নিখিল জগতে তব প্রেমের আহ্বানে
নব নব জীবনের গন্ধ যাব রেখে,
নব নব বিকাশের বর্ণ যাব এঁকে।
কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ অমরতাকূপে
এক ধরাতলমাঝে শুধু একরূপে
বাঁচিয়া থাকিতে। নব নব মৃত্যুপথে
তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।
সেদিন কি তুমি এসেছিলে ওগো
সেদিন কি তুমি এসেছিলে ওগো,
সে কি তুমি, মোর সভাতে।
হাতে ছিল তব বাঁশি,
অধরে অবাক হাসি,
সেদিন ফাগুন মেতে উঠেছিল
মদবিহ্বল শোভাতে।
সে কি তুমি ওগো, তুমি এসেছিলে
সেদিন নবীন প্রভাতে–
নবযৌবনসভাতে।
সেদিন আমার যত কাজ ছিল
সব কাজ তুমি ভুলালে।
খেলিলে সে কোন্ খেলা,
কোথা কেটে গেল বেলা–
ঢেউ দিয়ে দিয়ে হৃদয়ে আমার
রক্তকমল দুলালে।
পুলকিত মোর পরানে তোমার
বিলোল নয়ন বুলালে,
সব কাজ মোর ভুলালে।
তার পরে হায় জানি নে কখন
ঘুম এল মোর নয়নে।
উঠিনু যখন জেগে
ঢেকেছে গগন মেঘে
তরুতলে আছি একেলা পড়িয়া
দলিত পত্রশয়নে।
তোমাতে আমাতে রত ছিনু যবে
কাননে কুসুমচয়নে
ঘুম এল মোর নয়নে।
সেদিনের সভা ভেঙে গেছে সব
আজি ঝরঝর বাদরে।
পথে লোক নাহি আর,
রুদ্ধ করেছি দ্বার,
একা আছে প্রাণ ভূতলশয়ান
আজিকার ভরা ভাদরে।
তুমি কি দুয়ারে আঘাত করিলে–
তোমারে লব কি আদরে
আজি ঝরঝর বাদরে।
তুমি যে এসেছ ভস্মমলিন
তাপসমুরতি ধরিয়া।
স্তিমিত নয়নতারা
ঝলিছে অনলপারা,
সিক্ত তোমার জটাজুট হতে
সলিল পড়িছে ঝরিয়া।
বাহির হইতে ঝড়ের আঁধার
আনিয়াছ সাথে করিয়া
তাপসমুরতি ধরিয়া।
নমি হে ভীষণ, মৌন, রিক্ত,
এসো মোর ভাঙা আলয়ে।
ললাটে তিলকরেখা
যেন সে বহ্নিলেখা,
হস্তে তোমার লৌহদণ্ড
বাজিছে লৌহবলয়ে।
শূন্য ফিরিয়া যেয়ো না অতিথি,
সব ধন মোর না লয়ে।
এসো এসো ভাঙা আলয়ে।
হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা
“হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা
ওগো তপন তোমার স্বপন দেখি যে,করিতে পারি নে সেবা।’
শিশির কহিল কাঁদিয়া,
“তোমারে রাখি যে বাঁধিয়া
হে রবি,এমন নাহিকো আমার বল।
তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন কেবলি অশ্রুজল।’
“আমি বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো,
তবু শিশিরটুকুরে ধরা দিতে পারি
বাসিতে পারি যে ভালো।’
শিশিরের বুকে আসিয়া
কহিল তপন হাসিয়া,
“ছোটো হয়ে আমি রহিব তোমারে ভরি,
তোমার ক্ষুদ্র জীবন গড়িব
হাসির মতন করি।’
হে জনসমুদ্র, আমি ভাবিতেছি মনে
হে জনসমুদ্র, আমি ভাবিতেছি মনে
কে তোমারে আন্দোলিছে বিরাট মন্থনে
অনন্ত বরষ ধরি। দেবদৈত্যদলে
কী রত্ন সন্ধান লাগি তোমার অতলে
অশান্ত আবর্ত নিত্য রেখেছে জাগায়ে
পাপে-পুণ্যে সুখে-দুঃখে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়
ফেনিল কল্লোলভঙ্গে। ওগো, দাও দাও
কী আছে তোমার গর্ভে– এ ক্ষোভ থামাও।
তোমার অন্তরলক্ষ্মী যে শুভ প্রভাতে
উঠিবেন অমৃতের পাত্র বহি হাতে
বিস্মিত ভুবন-মাঝে, লয়ে বরমালা
ত্রিলোকনাথের কণ্ঠে পরাবেন বালা,
সেদিন হইবে ক্ষান্ত এ মহামন্থন,
থেমে যাবে সমুদ্রের রুদ্র এ ক্রন্দন।
আলমোড়া, ২২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১০
হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ
হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ, অভ্রভেদী তোমার সংগীত
তরঙ্গিয়া চলিয়াছে অনুদাত্ত উদাত্ত স্বরিত
প্রভাতের দ্বার হতে সন্ধ্যার পশ্চিমনীড়-পানে
দুর্গম দুরূহ পথে কী জানি কী বাণীর সন্ধানে!
দুঃসাধ্য উচ্ছ্বাস তব শেষ প্রান্তে উঠি আপনার
সহসা মুহূর্তে যেন হারায়ে ফেলেছে কণ্ঠ তার,
ভুলিয়া গিয়াছে সব সুর — সামগীত শব্দহারা
নিয়ত চাহিয়া শূন্যে বরষিছে নির্ঝরিণীধারা।
হে গিরি,যৌবন তব যে দুর্দম অগ্নিতাপবেগে
আপনারে উৎসারিয়া মরিতে চাহিয়াছিল মেঘে
সে তাপ হারায়ে গেছে, সে প্রচণ্ড গতি অবসান —
নিরুদ্দেশ চেষ্টা তব হয়ে গেছে প্রাচীন পাষাণ।
পেয়েছ আপন সীমা, তাই আজি মৌন শান্ত হিয়া
সীমাবিহীনের মাঝে আপনারে দিয়েছ সঁপিয়া।
আলমোড়া, ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১০
হে পথিক, কোন্খানে চলেছ কাহার পানে
“হে পথিক, কোন্খানে
চলেছ কাহার পানে।’
গিয়েছে রজনী, উঠে দিনমণি,
চলেছি সাগরস্নানে।
উষার আভাসে তুষারবাতাসে
পাখির উদার গানে
শয়ন তেয়াগি উঠিয়াছি জাগি,
চলেছি সাগরস্নানে।
“শুধাই তোমার কাছে
সে সাগর কোথা আছে।’
যেথা এই নদী বহি নিরবধি
নীল জলে মিশিয়াছে।
সেথা হতে রবি উঠে নবছবি,
লুকায় তাহারি পাছে–
তপ্ত প্রাণের তীর্থস্নানের
সাগর সেথায় আছে।
“পথিক তোমার দলে
যাত্রী ক’জন চলে।’
গণি তাহা ভাই শেষ নাহি পাই,
চলেছে জলে স্থলে।
তাহাদের বাতি জ্বলে সারারাতি
তিমির-আকাশ-তলে।
তাহাদের গান সারা দিনমান
ধ্বনিছে জলে স্থলে।
“সে সাগর, কহো,তবে
আর কত দূরে হবে।’
“আর কত দূরে’ “আর কত দূরে’
সেই তো শুধাই সবে।
ধ্বনি তার আসে দখিন বাতাসে
ঘনভৈরবরবে।
কভু ভাবি “কাছে’, কভু “দূরে আছে’–
আর কত দূরে হবে।
“পথিক, গগনে চাহো,
বাড়িছে দিনের দাহ।’
বাড়ে যদি দুখ হব না বিমুখ,
নিবাব না উৎসাহ।
ওরে ওরে ভীত তৃষিত তাপিত
জয়সংগীত গাহো।
মাথার উপরে খররবিকরে
বাড়ুক দিনের দাহ।
“কী করিবে চলে চলে
পথেই সন্ধ্যা হলে।’
প্রভাতের আশে স্নিগ্ধ বাতাসে
ঘুমাব পথের কোলে।
উদিবে অরুণ নবীন করুণ
বিহঙ্গকলরোলে।
সাগরের স্নান হবে সমাধান
নূতন প্রভাত হলে।