ওগো তুমি ভোরের পাখি,
ভোরের ছোটো পাখি,
কোন্ অরুণের আভাস পেয়ে
মেল’ তোমার আঁখি।
কোমল তোমার পাখার ‘পরে
সোনার রেখা স্তরে স্তরে,
বাঁধা আছে ডানায় তোমার
উষার রাঙা রাখি।
ওগো তুমি ভোরের পাখি,
ভোরের ছোটো পাখি।
রয়েছে বট, শতেক জটা
ঝুলছে মাটি ব্যেপে,
পাতার উপর পাতার ঘটা
উঠছে ফুলে ফেঁপে।
তাহারি কোন্ কোণের শাখে
নিদ্রাহারা ঝিঁঝির ডাকে
বাঁকিয়ে গ্রীবা ঘুমিয়েছিলে
পাখাতে মুখ ঝেঁপে,
যেখানে বট দাঁড়িয়ে একা
জটায় মাটি ব্যেপে।
ওগো ভোরের সরল পাখি,
কহো আমায় কহো–
ছায়ায় ঢাকা দ্বিগুণ রাতে
ঘুমিয়ে যখন রহ,
হঠাৎ তোমার কুলায়-‘পরে
কেমন ক’রে প্রবেশ করে
আকাশ হতে আঁধার-পথে
আলোর বার্তাবহ।
ওগো ভোরের সরল পাখি
কহো আমায় কহো!
কোমল তোমার বুকের তলে
রক্ত নেচে উঠে,
উড়বে ব’লে পুলক জাগে
তোমার পক্ষপুটে।
চক্ষু মেলি পুবের পানে
নিদ্রা-ভাঙা নবীন গানে
অকুণ্ঠিত কণ্ঠ তোমার
উৎস-সমান ছুটে।
কোমল তোমার বুকের তলে
রক্ত নেচে উঠে।
এত আঁধার-মাঝে তোমার
এতই অসংশয়!
বিশ্বজনে কেহই তোরে
করে না প্রত্যয়।
তুমি ডাক,”দাঁড়াও পথে,
সূর্য আসেন স্বর্ণরথে–
রাত্রি নয়, রাত্রি নয়,
রাত্রি নয় নয়।’
এত আঁধার-মাঝে তোমার
এতই অসংশয়!
আনন্দেতে জাগো আজি
আনন্দেতে জাগো।
ভোরের পাখি ডাকে যে ওই
তন্দ্রা এখন না গো।
প্রথম আলো পড়ুক মাথায়,
নিদ্রা-ভাঙা আঁখির পাতায়,
জ্যোতির্ময়ী উদয়-দেবীর
আশীর্বচন মাগো।
ভোরের পাখি গাহিছে ওই,
আনন্দেতে জাগো।
হাজারিবাগ, ১১ চৈত্র, ১৩০৯
মন্ত্রেসে যে পূত রাখীররাঙা সুতো
মন্ত্রেসে যে পূত
রাখীররাঙা সুতো
বাঁধন দিয়েছিনু হাতে,
আজ কিআছে সেটি সাথে।
বিদায়বেলা এল মেঘের মতো ব্যেপে,
গ্রন্থি বেঁধে দিতে দু হাত গেল কেঁপে,
সেদিন থেকে থেকে চক্ষুদুটি ছেপে
ভরে যে এল জলধারা।
আজকে বসে আছি পথের এক পাশে,
আমের ঘন বোলে বিভোল মধুমাসে
তুচ্ছ কথাটুকু কেবল মনে আসে
ভ্রমর যেন পথহারা–
সেই-যে বাম হাতে একটি সরু রাখী–
আধেক রাঙা, সোনা আধা,
আজো কি আছে সেটি বাঁধা।
পথ যে কতখানি
কিছুই নাহি জানি,
মাঠের গেছে কোন্ শেষে
চৈত্র-ফসলের দেশে।
যখন গেলে চলে তোমার গ্রীবামূলে
দীর্ঘ বেণী তব এলিয়ে ছিল খুলে,
মাল্যখানি গাঁথা সাঁজের কোন্ ফুলে
লুটিয়ে পড়েছিল পায়ে।
একটুখানি তুমি দাঁড়িয়ে যদি যেতে!
নতুন ফুলে দেখো কানন ওঠে মেতে,
দিতেম ত্বরা করে নবীন মালা গেঁথে
কনকচাঁপা-বনছায়ে।
মাঠের পথে যেতে তোমার মালাখানি
প’ল কি বেণী হতে খসে
আজকে ভাবি তাই বসে।
নূপুর ছিল ঘরে
গিয়েছ পায়ে প’রে–
নিয়েছ হেথা হতে তাই,
অঙ্গে আর কিছু নাই।
আকুল কলতানে শতেক রসনায়
চরণ ঘেরি তব কাঁদিছে করুণায়,
তাহারা হেথাকার বিরহবেদনায়
মুখর করে তব পথ।
জানি না কী এত যে তোমার ছিল ত্বরা,
কিছুতে হল না যে মাথার ভূষা পরা,
দিতেম খুঁজে এনে সিঁথিটি মনোহরা–
রহিল মনে মনোরথ।
হেলায়-বাঁধা সেই নূপুর-দুটি পায়ে
আছে কি পথে গেছে খুলে
সে কথা ভাবি তরুমূলে।
অনেক গীতগান
করেছি অবসান
অনেক সকালে ও সাঁজে
অনেক অবসরে কাজে।
তাহারি শেষ গান আধেক লয়ে কানে
দীর্ঘ পথ দিয়ে গেছ সুদূর-পানে,
আধেক-জানা সুরে আধেক-ভোলা তানে
গেয়েছ গুন্ গুন্ স্বরে।
কেন না গেলে শুনি একটি গান আরো–
সে গান শুধু তব, সে নহে আর কারো–
তুমিও গেলে চলে সময় হল তারো,
ফুটল তব পূজাতরে।
মাঠের কোন্খানে হারালো শেষ সুর
যে গান নিয়ে গেল শেষে,
ভাবি যে তাই অনিমেষে।
হাজারিবাগ, ১০ চৈত্র, ১৩০৯
মোর কিছু ধন আছে সংসারে
মোর কিছু ধন আছে সংসারে,
বাকি সব ধন স্বপনে
নিভৃতস্বপনে।
ওগো কোথা মোর আশার অতীত,
ওগো কোথা তুমি পরশচকিত,
কোথা গো স্বপনবিহারী।
তুমি এসো এসো গভীর গোপনে,
এসো গো নিবিড় নীরব চরণে
বসনে প্রদীপ নিবারি,
এসো গো গোপনে।
মোর কিছু ধন আছে সংসারে
বাকি সব আছে স্বপনে
নিভৃত স্বপনে।
রাজপথ দিয়ে আসিয়ো না তুমি,
পথ ভরিয়াছে আলোকে
প্রখর আলোকে।
সবার অজানা, হে মোর বিদেশী,
তোমারে না যেন দেখে প্রতিবেশী,
হে মোর স্বপনবিহারী।
তোমারে চিনিব প্রাণের পুলকে,
চিনিব সজল আঁখির পলকে,
চিনিব বিরলে নেহারি
পরমপুলকে।
এসো প্রদোষের ছায়াতল দিয়ে,
এসো না পথের আলোকে
প্রখরআলোকে।
যদি ইচ্ছা কর তবে কটাক্ষে হে নারী
যদি ইচ্ছা কর তবে কটাক্ষে হে নারী,
কবির বিচিত্র গান নিতে পার কাড়ি
আপন চরণপ্রান্তে; তুমি মুগ্ধচিতে
মগ্ন আছ আপনার গৃহের সংগীতে।
স্তবে তব নাহি কান, তাই স্তব করি,
তাই আমি ভক্ত তব, অনিন্দ্যসুন্দরী।
ভুবন তোমারে পূজে, জেনেও জান না;
ভক্তদাসীসম তুমি কর আরাধনা
খ্যাতিহীন প্রিয়জনে। রাজমহিমারে
যে করপরশে তব পার’ করিবারে
দ্বিগুণ মহিমান্বিত, সে সুন্দর করে
ধূলি ঝাঁট দাও তুমি আপনার ঘরে।
সেই তো মহিমা তব, সেই তো গরিমা–
সকল মাধুর্য চেয়ে তারি মধুরিমা।
রোগীর শিয়রে রাত্রে একা ছিনু জাগি
রোগীর শিয়রে রাত্রে একা ছিনু জাগি
বাহিরে দাঁড়ানু এসে ক্ষণেকের লাগি।
শান্ত মৌন নগরীর সুপ্ত হর্ম্য-শিরে
হেরিনু জ্বলিছে তারা নিস্তব্ধ তিমিরে।
ভূত ভাবী বর্তমান একটি পলকে
মিলিল বিষাদস্নিগ্ধ আনন্দপুলকে
আমার অন্তরতলে; অনির্বচনীয়
সে মুহূর্তে জীবনের যত-কিছু প্রিয়,
দুর্লভ বেদনা যত, যত গত সুখ,
অনুদ্গত অশ্রুবাষ্প, গীত মৌনমূক
আমার হৃদয়পাত্রে হয়ে রাশি রাশি
কী অনলে উজ্জ্বলিল। সৌরভে নিশ্বাসি
অপরূপ ধূপধূম উঠিল সুধীরে
তোমার নক্ষত্রদীপ্ত নিঃশব্দ মন্দিরে।
শূন্য ছিল মন
শূন্য ছিল মন,
নানা-কোলাহলে-ঢাকা
নানা-আনাগোনা-আঁকা
দিনের মতন।
নানা-জনতায়-ফাঁকা
কর্মে-অচেতন
শূন্য ছিল মন।