নির্জন রোগীর ঘর
নির্জন রোগীর ঘর।
খোলা দ্বার দিয়ে
বাঁকা ছায়া পড়েছে শয্যায়।
শীতের মধ্যাহ্নতাপে তন্দ্রাতুর বেলা
চলেছে মন্থরগতি
শৈবালে দুর্বলস্রোত নদীর মতন।
মাঝে মাঝে জাগে যেন দূর অতীতের দীর্ঘশ্বাস
শস্যহীন মাঠে।
মনে পড়ে কতদিন
ভাঙা পাড়িতলে পদ্মা
কর্মহীন প্রৌঢ় প্রভাতের
ছায়াতে আলোতে
আমার উদাস চিন্তা দেয় ভাসাইয়া
ফেনায় ফেনায়।
স্পর্শ করি শূন্যের কিনারা
জেলেডিঙি চলে পাল তুলে,
যূথভ্রষ্ট শুভ্র মেঘ পড়ে থাকে আকাশের কোণে।
আলোতে ঝিকিয়া-ওঠা ঘট কাঁখে পল্লীমেয়েদের
ঘোমটায় গুন্ঠিত আলাপে
গুঞ্জরিত বাঁকা পথে আম্রবনচ্ছায়ে
কোকিল কোথায় ডাকে ক্ষণে ক্ষণে নিভৃত শাখায়,
ছায়ায় কুন্ঠিত পল্লীজীবনযাত্রার
রহস্যের আবরণ কাঁপাইয়া তোলে মোর মনে।
পুকুরের ধারে ধারে সর্ষেখেতে পূর্ণ হয়ে যায়
ধরণীর প্রতিদান রৌদ্রের দানের,
সূর্যের মন্দিরতলে পুষ্পের নৈবেদ্য থাকে পাতা।
আমি শান্ত দৃষ্টি মেলি নিভৃত প্রহরে
পাঠায়েছি নিঃশব্দ বন্দনা,
সেই সবিতারে যাঁর জ্যোতীরূপে প্রথম মানুষ
মর্তের প্রাঙ্গণতলে দেবতার দেখেছে স্বরূপ।
মনে মনে ভাবিয়াছি, প্রাচীন যুগের
বৈদিক মন্ত্রের বাণী কন্ঠে যদি থাকিত আমার
মিলিত আমার স্তব স্বচ্ছ এই আলোকে আলোকে;
ভাষা নাই, ভাষা নাই;
চেয়ে দূর দিগন্তের পানে
মৌন মোর মেলিয়াছি পাণ্ডুনীল মধ্যাহ্ন-আকাশে।
উদয়ন, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – দুপুর, পূর্বপাঠ: ৭ পৌষ, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪০
পরম সুন্দর আলোকের স্নানপুণ্য প্রাতে
পরম সুন্দর
আলোকের স্নানপুণ্য প্রাতে।
অসীম অরূপ
রূপে রূপে স্পর্শমণি
রসমূর্তি করিছে রচনা,
প্রতিদিন
চিরনূতনের অভিষেক
চিরপুরাতন বেদীতলে।
মিলিয়া শ্যামলে নীলিমায়
ধরণীর উত্তরীয়
বুনে চলে ছায়াতে আলোতে।
আকাশের হৃৎস্পন্দন
পল্লবে পল্লবে দেয় দোলা।
প্রভাতের কন্ঠ হতে মণিহার করে ঝিলিমিলি
বন হতে বনে।
পাখিদের অকারণ গান
সাধুবাদ দিতে থাকে জীবনলক্ষ্মীরে।
সবকিছু সাথে মিশে মানুষের প্রীতির পরশ
অমৃতের অর্থ দেয় তারে,
মধুময় করে দেয় ধরণীর ধূলি,
সর্বত্র বিছায়ে দেয় চিরমানবের সিংহাসন।
উদয়ন, ১২ জানুয়ারি, ১৯৪১ – দুপুর
পলাশ আনন্দমূর্তি জীবনের ফাগুনদিনের
পলাশ আনন্দমূর্তি জীবনের ফাগুনদিনের,
আজ এই সম্মানহীনের
দরিদ্র বেলায় দিলে দেখা
যেথা আমি সাথিহীন একা
উৎসবের প্রাঙ্গণ-বাহিরে
শস্যহীন মরুময় তীরে।
যেখানে এ ধরণীর প্রফুল্ল প্রাণের কুঞ্জ হতে
অনাদৃত দিন মোর নিরুদ্দেশ স্রোতে
ছিন্নবৃন্ত চলিয়াছে ভেসে
বসন্তের শেষে।
তবুও তো কৃপণতা নাই তব দানে,
যৌবনের পূর্ণ মূল্য দিলে মোর দীপ্তিহীন প্রাণে,
অদৃষ্টের অবজ্ঞারে কর নি স্বীকার —
ঘুচাইলে অবসাদ তার;
জানাইলে চিত্তে মোর লভি অনুক্ষণ
সুন্দরের অভ্যর্থনা, নবীনের আসে নিমন্ত্রণ।
উদয়ন, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – দুপুর
প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর
প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে আসনের কাছে
যতক্ষণে সঙ্গ তার না করি স্বীকার
করস্পর্শ দিয়ে।
এটুকু স্বীকৃতি লাভ করি
সর্বাঙ্গে তরঙ্গি উঠে আনন্দপ্রবাহ।
বাক্যহীন প্রাণীলোক-মাঝে
এই জীব শুধু
ভালো মন্দ সব ভেদ করি
দেখেছে সম্পূর্ণ মানুষেরে;
দেখেছে আনন্দে যারে প্রাণ দেওয়া যায়
যারে ঢেলে দেওয়া যায় অহেতুক প্রেম,
অসীম চৈতন্যলোকে
পথ দেখাইয়া দেয় যাহার চেতনা।
দেখি যবে মূক হৃদয়ের
প্রাণপণ আত্মনিবেদন
আপনার দীনতা জানায়ে,
ভাবিয়া না পাই ও যে কী মূল্য করেছে আবিষ্কার
আপন সহজ বোধে মানবস্বরূপে;
ভাষাহীন দৃষ্টির করুণ ব্যাকুলতা
বোঝে যাহা বোঝাতে পারে না,
আমারে বুঝায়ে দেয়– সৃষ্টি-মাঝে মানবের সত্য পরিচয়।
উদয়ন, ৭ই পৌষ, ১৩৪৭ – সকাল, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪০
ফসল কাটা হলে সারা মাঠ হয়ে যায় ফাঁক
ফসল কাটা হলে সারা মাঠ হয়ে যায় ফাঁক;
অনাদরের শস্য গজায়, তুচ্ছ দামের শাক।
আঁচল ভরে তুলতে আসে গরিব-ঘরের মেয়ে,
খুশি হয়ে বাড়িতে যায়, যা জোটে তাই পেয়ে।
আজকে আমার চাষ চলে না, নাই লাঙলের বালাই;
পোড়ো মাঠের কুঁড়েমিতে মন্থর দিন চালাই।
জমিতে রস কিছু আছে, শক্ত যায় নি আঁটি;
ফলায় না সে ফল তবুও সবুজ রাখে মাটি।
শ্রাবণ আমার গেছে চলে, নাই বাদলের ধারা;
অঘ্রান সে সোনার ধানের দিন করেছে সারা।
চৈত্র আমার রোদে পোড়া, শুকনো যখন নদী,
বুনো ফলের ঝোপের তলায় ছায়া বিছায় যদি,
জানব আমার শেষের মাসে ভাগ্য দেয় নি ফাঁকি,
শ্যামল ধরার সঙ্গে আমার বাঁধন রইল বাকি।
উদয়ন, ১০ জানুয়ারি, ১৯৪১ – সকাল
বাক্যের যে ছন্দোজাল শিখেছি গাঁথিতে
বাক্যের যে ছন্দোজাল শিখেছি গাঁথিতে
সেই জালে ধরা পড়ে
অধরা যা চেতনার সতর্কতা ছিল এড়াইয়া
আগোচরে মনের গহনে।
নামে বাঁধিবারে চাই, না মানে নামের পরিচয়।
মূল্য তার থাকে যদি
দিনে দিনে হয় তাহা জানা
হাতে হাতে ফিরে।
অকস্মাৎ পরিচয়ে বিস্ময় তাহার
ভুলায় যদি বা,
লোকালয়ে নাহি পায় স্থান,
মনের সৈকততটে বিকীর্ণ সে রহে কিছুকাল,
লালিত যা গোপনের
প্রকাশ্যের অপমানে
দিনে দিনে মিশায় বালুতে।
পণ্যহাটে অচিহ্নিত পরিত্যক্ত রিক্ত এ জীর্ণতা
যুগে যুগে কিছু কিছু দিয়ে গেছে অখ্যাতের দান
সাহিত্যের ভাষা-মহাদ্বীপে
প্রাণহীন প্রবালের মতো।
উদয়ন, ৪ ফ্রেবুয়ারি, ১৯৪১ – বিকাল