চিরদিন আছি আমি অকেজোর দলে
চিরদিন আছি আমি অকেজোর দলে;
বাজে লেখা, বাজে পড়া, দিন কাটে মিথ্যা বাজে ছলে।
যে গুণী কাটাতে পারে বেলা তার বিনা আবশ্যকে
তারে “এসো এসো” ব’লে যত্ন ক’রে বসাই বৈঠকে।
কেজো লোকদের করি ভয়,
কব্জিতে ঘড়ি বেঁধে শক্ত করে বেঁধেছে সময়–
বাজে খরচের তরে উদ্বৃত্ত কিছুই নেই হাতে,
আমাদের মতো কুঁড়ে লজ্জা পায় তাদের সাক্ষাতে।
সময় করিতে নষ্ট আমরা ওস্তাদ,
কাজের করিতে ক্ষতি নানামতো পেতে রাখি ফাঁদ।
আমার শরীরটা যে ব্যস্তদের তফাতে ভাগায়–
আপনার শক্তি নেই, পরদেহে মাশুল লাগায়।
সরোজদাদার দিকে চাই–
সব তাতে রাজি দেখি, কাজকর্ম যেন কিছু নাই,
সময়ের ভাণ্ডারেতে দেওয়া নেই চাবি,
আমার মতন এই অক্ষমের দাবি
মেটাবার আছে তার অক্ষুণ্ন উদার অবসর,
দিতে পারে অকৃপণ অক্লান্ত নির্ভর।
দ্বিপ্রহর রাত্রিবেলা স্তিমিত আলোকে
সহসা তাহার মূর্তি পড়ে যবে চোখে
মনে ভাবি, আশ্বাসের তরী বেয়ে দূত কে পাঠালে,
দুর্যোগের দুঃস্বপ্ন কাটালে।
দায়হীন মানুষের অভাবিত এই আবির্ভাব
দয়াহীন অদৃষ্টের বন্দীশালে মহামূল্য লাভ।
উদয়ন, ৯ জানুয়ারি, ১৯৪১ – সকাল
দিদিমণি– অফুরান সান্ত্বনার খনি
দিদিমণি–
অফুরান সান্ত্বনার খনি।
কোনো ক্লান্তি কোনো ক্লেশ
মুখে চিহ্ন দেয় নাই লেশ।
কোনো ভয় কোনো ঘৃণা কোনো কাজে কিছুমাত্র গ্লানি
সেবার মাধুর্যে ছায়া নাহি দেয় আনি।
এ অখণ্ড প্রসন্নতা ঘিরে তারে রয়েছে উজ্জ্বলি,
রচিতেছে শান্তির মণ্ডলী;
ক্ষিপ্র হস্তক্ষেপে
চারি দিকে স্বস্তি দেয় ব্যেপে;
আশ্বাসের বাণী সুমধুর
আবসাদ করি দেয় দূর।
এ স্নেহমাধুর্যধারা
অক্ষম রোগীরে ঘিরে আপনার রচিছে কিনারা;
অবিরাম পরশ চিন্তার
বিচিত্র ফসলে যেন উর্বর করিছে দিন তার।
এ মাধুর্য করিতে সার্থক
এতখানি নির্বলের ছিল আবশ্যক।
অবাক হইয়া তারে দেখি,
রোগীর দেহের মাঝে অনন্ত শিশুরে দেখেছে কি।
উদয়ন, ২ জানুয়ারি, ১৯৪১
দিন পরে যায় দিন
দিন পরে যায় দিন, স্তব্ধ বসে থাকি;
ভাবি মনে, জীবনের দান যত কত তার বাকি
চুকায়ে সঞ্চয় অপচয়।
অযত্নে কী হয়ে গেছে ক্ষয়,
কী পেয়েছি প্রাপ্য যাহা, কী দিয়েছি যাহা ছিল দেয়,
কী রয়েছে শেষের পাথেয়।
যারা কাছে এসেছিল, যারা চলে গিয়েছিল দূরে,
তাদের পরশখানি রয়ে গেছে মোর কোন্ সুরে।
অন্যমনে কারে চিনি নাই,
বিদায়ের পদধ্বনি প্রাণে আজি বাজিছে বৃথাই।
হয়তো হয় নি জানা ক্ষমা করে কে গিয়েছে চলে
কথাটি না ব’লে।
যদি ভুল করে থাকি তাহার বিচার
ক্ষোভ কি রাখিবে তবু যখন রব না আমি আর।
কত সূত্র ছিন্ন হল জীবনের আস্তরণময়,
জোড়া লাগাবারে আর রবে না সময়।
জীবনের শেষপ্রান্তে যে প্রেম রয়েছে নিরবধি
মোর কোনো অসম্মান তাহে ক্ষতচিহ্ন দেয় যদি,
আমার মৃত্যুর হস্ত আরোগ্য আনিয়া দিক তারে,
এ কথাই ভাবি বারে বারে।
উদয়ন, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – বিকাল
দ্বার খোলা ছিল মনে
দ্বার খোলা ছিল মনে, অসর্তকে সেথা অকস্মাৎ
লেগেছিল কী লাগিয়া কোথা হতে দুঃখের আঘাত;
সে লজ্জায় খুলে গেল মর্মতলে প্রচ্ছন্ন যে বল
জীবনের নিহিত সম্বল।
ঊর্ধ্ব হতে জয়ধ্বনি
অন্তরে দিগন্তপথে নামিল তখনি,
আনন্দের বিচ্ছুরিত আলো
মুহূর্তে আঁধার-মেঘ দীর্ণ করি হৃদয়ে ছড়ালো।
ক্ষুদ্র কোটরের অসম্মান
লুপ্ত হল, নিখিলের আসনে দেখিনু নিজ স্থান,
আনন্দে আনন্দময়
চিত্ত মোর করি নিল জয়,
উৎসবের পথ
চিনে নিল মুক্তিক্ষেত্রে সগৌরবে আপন জগৎ।
দুঃখ-হানা গ্লানি যত আছে,
ছায়া সে, মিলালো তার কাছে।
উদয়ন, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – দুপুর
ধীরে সন্ধ্যা আসে
ধীরে সন্ধ্যা আসে, একে একে গ্রন্থি যত যায় স্খলি
প্রহরের কর্মজাল হতে। দিন দিল জলাঞ্জলি
খুলি পশ্চিমের সিংহদ্বার
সোনার ঐশ্বর্য তার
অন্ধকার আলোকের সাগরসংগমে।
দূর প্রভাতের পানে নত হয়ে নিঃশব্দে প্রণমে।
চক্ষু তার মুদে আসে,এসেছে সময়
গভীর ধানের তলে আপনার বাহ্য পরিচয়
করিতে মগন।
নক্ষত্রের শান্তিক্ষেত্র অসীম গগন
যেথা ঢেকে রেখে দেয় দিনশ্রীর অরূপ সত্তারে,
সেথায় করিতে লাভ সত্য আপনারে
খেয়া দেয় রাত্রি পারাবারে।
উদয়ন, ১৬ ফ্রেবুয়ারি, ১৯৪১ – দুপুর
নগাধিরাজের দূর নেবু-নিকুঞ্জের
নগাধিরাজের দূর নেবু-নিকুঞ্জের
রসপাত্রগুলি
আনিল এ শয্যাতলে
জনহীন প্রভাতের রবির মিত্রতা,
অজানা নির্ঝরিণীর
বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটার
হিরন্ময় লিপি,
সুনিবিড় অরণ্যবীথির
নিঃশব্দ মর্মরে বিজড়িত
স্নিগ্ধ হৃদয়ের দৌত্যখানি।
রোগপঙ্গু লেখনীর বিরল ভাষার
ইঙ্গিতে পাঠায় কবি আর্শীবাদ তার।
শান্তিনিকেতন, ২৫ নভেম্বর, ১৯৪০
নারী তুমি ধন্যা
নারী তুমি ধন্যা–
আছে ঘর, আছে ঘরকন্না।
তারি মধ্যে রেখেছ একটুখানি ফাঁক।
সেথা হতে পশে কানে বাহিরের দুর্বলের ডাক।
নিয়ে এসো শুশ্রূষার ডালি,
স্নেহ দাও ঢালি।
যে জীবলক্ষ্মীর মনে পালনের শক্তি বহমান,
নারী তুমি নিত্য শোন তাহারি আহ্বান।
সৃষ্টিবিধাতার
নিয়েছ কর্মের ভার,
তুমি নারী
তাঁহারি আপন সহকারী।
উন্মুক্ত করিতে থাকো আরোগ্যের পথ,
নবীন করিতে থাকো জীর্ণ যে-জগৎ,
শ্রীহারা যে তার ‘পরে তোমার ধৈর্যের সীমা নাই,
আপন অসাধ্য দিয়ে দয়া তব টানিছে তারাই।
বুদ্ধিভ্রষ্ট অসহিষ্ঞু অপমান করে বারে বারে,
চক্ষু মুছে ক্ষমা কর তারে।
অকৃতজ্ঞতার দ্বারে আঘাত সহিছ দিনরাতি,
লও শির পাতি।
যে অভাগ্য নাহি লাগে কাজে,
প্রাণলক্ষ্মী ফেলে যারে আবর্জনা-মাঝে,
তুমি তারে আনিছ কুড়ায়ে,
তার লাঞ্ছনার তাপ স্নিগ্ধ হস্তে দিতেছ জুড়ায়ে।
দেবতারে যে পূজা দেবার
দুর্ভাগারে কর দান সেই মূল্য তোমার সেবার।
বিশ্বের পালনী শক্তি নিজ বীর্যে বহ চুপে চুপে
মাধুরীর রূপে।
ভ্রষ্ট যেই, ভগ্ন যেই, বিরূপ বিকৃত,
তারি লাগি সুন্দরের হাতের অমৃত।
উদয়ন, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪১ – সকাল