বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৬ (হাসির সময় বড়ো নেই)
হাসির সময় বড়ো নেই,
দু দণ্ডের তরে গান গাওয়া।
নিমেষের মাঝে চুমো খেয়ে
মুহূর্তে ফুরাবে চুমো খাওয়া।
বেলা নাই শেষ করিবারে
অসম্পূর্ণ প্রেমের মন্ত্রণা–
সুখস্বপ্ন পলকে ফুরায়,
তার পরে জাগ্রত যন্ত্রণা।
কিছু ক্ষণ কথা কয়ে লও,
তাড়াতাড়ি দেখে লও মুখ,
দু দণ্ডের খোঁজ দেখাশুনা–
ফুরাইবে খুঁজিবার সুখ।
বেলা নাই কথা কহিবারে
যে কথা কহিতে ফাটে প্রাণ।
দেবতারে দুটো কথা ব’লে
পূজার সময় অবসান।
কাঁদিতে রয়েছে দীর্ঘ দিন–
জীবন করিতে মরুময়,
ভাবিতে রয়েছে চিরকাল–
ঘুমাইতে অনন্ত সময়।
P. B. Marston
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৭ (বেঁচেছিল, হেসে হেসে)
বেঁচেছিল, হেসে হেসে
খেলা করে বেড়াত সে–
হে প্রকৃতি, তারে নিয়ে কী হল তোমার!
শত রঙ-করা পাখি,
তোর কাছে ছিল না কি–
কত তারা, বন, সিন্ধু, আকাশ অপার!
জননীর কোল হতে কেন তবে কেড়ে নিলি!
লুকায়ে ধরার কোলে ফুল দিয়ে ঢেকে দিলি!
শত-তারা-পুষ্প-ময়ী
মহতী প্রকৃতি অয়ি,
নাহয় একটি শিশু নিলি চুরি ক’রে–
অসীম ঐশ্বর্য তব
তাহে কি বাড়িল নব?
নূতন আনন্দকণা মিলিল কি ওরে?
অথচ তোমারি মতো বিশাল মায়ের হিয়া
সব শূন্য হয়ে গেল একটি সে শিশু গিয়া।
Victor Hugo
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৮ (নিদাথের শেষ গোলাপ কুসুম)
নিদাথের শেষ গোলাপ কুসুম
একা বন আলো করিয়া,
রূপসী তাহার সহচরীগণ
শুকায়ে পড়েছে ঝরিয়া।
একাকিনী আহা, চারি দিকে তার
কোনো ফুল নাহি বিকাশে,
হাসিতে তাহার মিশাইতে হাসি
নিশাস তাহার নিশাসে।
বোঁটার উপরে শুকাইতে তোরে
রাখিব না একা ফেলিয়া–
সবাই ঘুমায়, তুইও ঘুমাগে
তাহাদের সাথে মিলিয়া।
ছড়ায়ে দিলাম দলগুলি তোর
কুসুমসমাধিশয়নে
যেথা তোর বনসখীরা সবাই
ঘুমায় মুদিত নয়নে।
তেমনি আমার সখারা যখন
যেতেছেন মোরে ফেলিয়া
প্রেমহার হতে একটি একটি
রতন পড়িছে খুলিয়া,
প্রণয়ীহৃদয় গেল গো শুকায়ে
প্রিয়জন গেল চলিয়া–
তবে এ আঁধার আঁধার জগতে
রহিব বলো কী বলিয়া।
Moore
আষাঢ়, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৯ (ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে)
ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে!
ছেলেবেলা ওই নামে আমায় ডাকিত–
তাড়াতাড়ি খেলাধুলা সব ত্যাগ করে
অমনি যেতেম ছুটে,
কোলে পড়িতাম লুটে।
রাশি-করা ফুলগুলি পড়িয়া থাকিত।
নীরব হইয়া গেছে যে স্নেহের স্বর–
কেবল স্তব্ধতা বাজে
আজি এ শ্মশান-মাঝে
কেবল ডাকি গো আমি “ঈশ্বর ঈশ্বর’!
মৃত কণ্ঠে আর যাহা শুনিতে না পাই
সে নাম তোমারি মুখে শুনিবারে চাই।
হাঁ সখা, ডাকিয়ো তুমি সেই নাম ধরে–
ডাকিলেই সাড়া পাবে,
কিছু না বিলম্ব হবে,
তখনি কাছেতে যাব সব ত্যাগ করে।
Mrs. Browning
আষাঢ়, ১২৮৮
বিসর্জন (যে তোরে বাসেরে ভালো, তারে ভালোবেসে বাছা)
যে তোরে বাসেরে ভালো, তারে ভালোবেসে বাছা,
চিরকাল সুখে তুই রোস্।
বিদায়! মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই,
এখন তাহারি তুই হোস্।
আমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তুই যা রে
এক পরিবার হতে অন্য পরিবারে।
সুখ শান্তি নিয়ে যাস্ তোর পাছে পাছে,
দুঃখ জ্বালা রেখে যাস্ আমাদের কাছে।
হেথা রাখিতেছি ধরে, সেথা চাহিতেছে তোরে,
দেরী হ’ল, যা’ তাদের কাছে।
প্রাণের বাছাটি মোর, লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই,
দুইটি কর্তব্য তোর আছে।
একটু বিলাপ যাস আমাদের দিয়ে,
তাহাদের তরে আশা যাস সাথে নিয়ে;
এক বিন্দু অশ্রু দিস আমাদের তরে,
হাসিটি লইয়া যাস তাহাদের ঘরে।
Victor Hugo
সম্মিলন (সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে)
সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে
দিবানিশি গাহে শুধু প্রেমের বিলাপ।
নবীন চাঁদের করে একটি হরিণী
আমাদের গৃহদ্বারে আরামে ঘুমায়।
তার শান্ত নিদ্রাকালে নিশ্বাস পতনে
প্রহর গণিতে পারি স্তব্ধ রজনীর।
সুখের আবাসে সেই কাটাব জীবন,
দুজনে উঠিব মোরা, দুজনে বসিব,
নীল আকাশের নীচে ভ্রমিব দুজনে,
বেড়াইব মাঠে মাঠে উঠিব পর্বতে
সুনীল আকাশ যেথা পড়েছে নামিয়া।
অথবা দাঁড়াব মোরা সমুদ্রের তটে,
উপলমণ্ডিত সেই স্নিগ্ধ উপকূল
তরঙ্গের চুম্বনেতে উচ্ছ্বাসে মাতিয়া
থর থর কাঁপে আর জ্বল’ জ্বল’ জ্বলে!
যত সুখ আছে সেথা আমাদের হবে,
আমরা দুজনে সেথা হব দুজনের,
অবশেষে বিজন সে দ্বীপের মাঝারে
ভালোবাসা, বেঁচে থাকা, এক হ’য়ে যাবে।
মধ্যাহ্নে যাইব মোরা পর্বতগুহায়,
সে প্রাচীন শৈল-গুহা স্নেহের আদরে
অবসান রজনীর মৃদু জোছনারে
রেখেছে পাষাণ কোলে ঘুম পাড়াইয়া।
প্রচ্ছন্ন আঁধারে সেথা ঘুম আসি ধীরে
হয়তো হরিবে তোর নয়নের আভা।
সে ঘুম অলস প্রেমে শিশিরের মতো।
সে ঘুম নিভায়ে রাখে চুম্বন-অনল
আবার নূতন করি জ্বালাবার তরে।
অথবা বিরলে সেথা কথা কব মোরা,
কহিতে কহিতে কথা, হৃদয়ের ভাব
এমন মধুর স্বরে গাহিয়া উঠিবে
আর আমাদের মুখে কথা ফুটিবে না।
মনের সে ভাবগুলি কথায় মরিয়া
আমাদের চোখে চোখে বাঁচিয়া উঠিবে!
চোখের সে কথাগুলি বাক্যহীন মনে
ঢালিবে অজস্র স্রোতে নীরব সংগীত,
মিলিবেক চৌদিকের নীরবতা সনে।
মিশিবেক আমাদের নিশ্বাসে নিশ্বাসে।
আমাদের দুই হৃদি নাচিতে থাকিবে,
শোণিত বহিবে বেগে দোঁহার শিরায়।
মোদের অধর দুটি কথা ভুলি গিয়া
ক’বে শুধু উচ্ছ্বসিত চুম্বনের ভাষা।
দুজনে দুজন আর রব না আমরা,
এক হয়ে যাব মোরা দুইটি শরীরে।
দুইটি শরীর? আহা তাও কেন হল?
যেমন দুইটি উল্কা জ্বলন্ত শরীর,
ক্রমশ দেহের শিখা করিয়া বিস্তার
স্পর্শ করে, মিশে যায়, এক দেহ ধরে,
চিরকাল জ্বলে তবু ভস্ম নাহি হয়,
দুজনেরে গ্রাস করি দোঁহে বেঁচে থাকে;
মোদের যমক-হৃদে একই বাসনা,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে বাড়িয়া বাড়িয়া,
তেমনি মিলিয়া যাবে অনন্ত মিলন।
এক আশা রবে শুধু দুইটি ইচ্ছার
এই ইচ্ছা রবে শুধু দুইটি হৃদয়ে,
একই জীবন আর একই মরণ,
একই স্বরগ আর একই নরক,
এক অমরতা কিংবা একই নির্বাণ,
হায় হায় এ কী হল এ কী হল মোর!
আমার হৃদয় চায় উধাও উড়িয়া
প্রেমের সুদূর রাজ্যে করিতে ভ্রমণ,
কিন্তু গুরুভার এই মরতের ভাষা
চরণে বেঁধেছে তার লোহার শৃঙ্খল।
নামি বুঝি, পড়ি বুঝি, মরি বুঝি মরি।
Shelley