বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১০ (কেমনে কী হল পারি নে বলিতে)
কেমনে কী হল পারি নে বলিতে,
এইটুকু শুধু জানি–
নবীন কিরণে ভাসিছে সে দিন
প্রভাতের তনুখানি।
বসন্ত তখনো কিশোর কুমার,
কুঁড়ি উঠে নাই ফুটি,
শাখায় শাখায় বিহগ বিহগী
বসে আছে দুটি দুটি।
কী যে হয়ে গেল পারি নে বলিতে,
এইটুকু শুধু জানি–
বসন্তও গেল, তাও চলে গেল
একটি না কয়ে বাণী।
যা-কিছু মধুর সব ফুরাইল,
সেও হল অবসান–
আমারেই শুধু ফেলে রেখে গেল
সুখহীন ম্রিয়মাণ।
Christina Rossetti
কার্তিক, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১১ (রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে)
রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে
মনটি আমার আমি গোলাপে রাখিনু ঢেকে–
সে বিছানা সুকোমল, বিমল নীহার চেয়ে,
তারি মাঝে মনখানি রাখিলাম লুকাইয়ে।
একটি ফুল না নড়ে, একটি পাতা না পড়ে–
তবু কেন ঘুমায় না, চমকি চমকি চায়–
ঘুম কেন পাখা নেড়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায়?
আর কিছু নয়, শুধু গোপনে একটি পাখি
কোথা হতে মাঝে মাঝে উঠিতেছে ডাকি ডাকি।
ঘুমা তুই, ওই দেখ বাতাস মুদেছে পাখা,
রবির কিরণ হতে পাতায় আছিস ঢাকা–
ঘুমা তুই, ওই দেখ তো চেয়ে দুরন্ত বায়
ঘুমেতে সাগর-‘পরে ঢুলে পড়ে পায় পায়।
দুখের কাঁটায় কি রে বিঁধিতেছে কলেবর?
বিষাদের বিষদাঁতে করিছে কি জরজর?
কেন তবে ঘুম তোর ছাড়িয়া গিয়াছে আঁখি?
কে জানে, গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি।
শ্যামল কানন এই মোহমন্ত্রজালে ঢাকা,
অমৃতমধুর ফল ভরিয়ে রয়েছে শাখা,
স্বপনের পাখিগুলি চঞ্চল ডানাটি তুলি
উড়িয়া চলিয়া যায় আঁধার প্রান্তর-‘পরে–
গাছের শিখর হতে ঘুমের সংগীত ঝরে।
নিভৃত কানন-‘পর শুনি না ব্যাধের স্বর,
তবে কেন এ হরিণী চমকায় থাকি থাকি।
কে জানে, গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি।
Swinburne
কার্তিক, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১২ (দেখিনু যে এক আশার স্বপন)
দেখিনু যে এক আশার স্বপন
শুধু তা স্বপন, স্বপনময়–
স্বপন বই সে কিছুই নয়।
অবশ হৃদয় অবসাদময়
হারাইয়া সুখ শ্রান্ত অতিশয়–
আজিকে উঠিনু জাগি
কেবল একটি স্বপন লাগি!
বীণাটি আমার নীরব হইয়া
গেছে গীতগান ভুলি,
ছিঁড়িয়া টুটিয়া ফেলেছি তাহার
একে একে তারগুলি।
নীরব হইয়া রয়েছে পড়িয়া
সুদূর শ্মশান-‘পরে,
কেবল একটি স্বপন-তরে!
থাম্ থাম্ ওরে হৃদয় আমার,
থাম্ থাম্ একেবারে,
নিতান্তই যদি টুটিয়া পড়িবি
একেবারে ভেঙে যা রে–
এই তোর কাছে মাগি।
আমার জগৎ, আমার হৃদয়–
আগে যাহা ছিল এখন তা নয়
কেবল একটি স্বপন লাগি।
Christina Rossetti
কার্তিক, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১৩ (নহে নহে এ মনে মরণ)
নহে নহে এ মনে মরণ।
সহসা এ প্রাণপূর্ণ নিশ্বাসবাতাস
নীরবে করে যে পলায়ন,
আলোতে ফুটায় আলো এই আঁখিতারা
নিবে যায় একদা নিশীথে,
বহে না রুধিরনদী, সুকোমল তনু
ধূলায় মিলায় ধরণীতে,
ভাবনা মিলায় শূন্যে, মৃত্তিকার তলে
রুদ্ধ হয় অময় হৃদয়–
এই মৃত্যু? এ তো মৃত্যু নয়।
কিন্তু রে পবিত্র শোক যায় না যে দিন
পিরিতির স্মিরিতিমন্দিরে,
উপেক্ষিত অতীতের সমাধির ‘পরে
তৃণরাজি দোলে ধীরে ধীরে,
মরণ-অতীত চির-নূতন পরান
স্মরণে করে না বিচরণ–
সেই বটে সেই তো মরণ!
Hood
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ২ (সারাদিন গিয়েছিনু বনে)
সারাদিন গিয়েছিনু বনে
ফুলগুলি তুলেছি যতনে।
প্রাতে মধুপানে রত
মুগ্ধ মধুপের মতো
গান গাহিয়াছি আনমনে।
এখন চাহিয়া দেখি, হায়,
ফুলগুলি শুকায় শুকায়।
যত চাপিলাম মুঠি
পাপড়িগুলি গেল টুটি–
কান্না ওঠে, গান থেমে যায়।
কী বলিছ সখা হে আমার–
ফুল নিতে যাব কি আবার।
থাক্ বঁধু, থাক্ থাক্,
আর কেহ যায় যাক,
আমি তো যাব না কভু আর।
শ্রান্ত এ হৃদয় অতি দীন,
পরান হয়েছে বলহীন।
ফুলগুলি মুঠা ভরি
মুঠায় রহিবে মরি,
আমি না মরিব যত দিন।
Mrs. Browning
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৩ (আমায় রেখো না ধরে আর)
আমায় রেখো না ধরে আর,
আর হেথা ফুল নাহি ফুটে।
হেমন্তের পড়িছে নীহার,
আমায় রেখো না ধরে আর।
যাই হেথা হতে যাই উঠে,
আমার স্বপন গেছে টুটে।
কঠিন পাষাণপথে
যেতে হবে কোনোমতে
পা দিয়েছি যবে।
একটি বসন্তরাতে
ছিলে তুমি মোর সাথে–
পোহালো তো, চলে যাও তবে।
Ernest Myers
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৪ (প্রভাতে একটি দীর্ঘশ্বাস)
প্রভাতে একটি দীর্ঘশ্বাস
একটি বিরল অশ্রুবারি
ধীরে ওঠে, ধীরে ঝরে যায়,
শুনিলে তোমার নাম আজ।
কেবল একটুখানি লাজ–
এই শুধু বাকি আছে হায়।
আর সব পেয়েছে বিনাশ।
এক কালে ছিল যে আমারি
গেছে আজ করি পরিহাস।
Aubre De Vere
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৫ (গোলাপ হাসিয়া বলে, আগে বৃষ্টি যাক চলে)
১
গোলাপ হাসিয়া বলে, “আগে বৃষ্টি যাক চলে,
দিক দেখা তরুণ তপন–
তখন ফুটাব এ যৌবন।’
গেল মেঘ, এল উষা, আকাশের আঁখি হতে
মুছে দিল বৃষ্টিবারিকণা–
সে তো রহিল না।
কোকিল ভাবিছে মনে, “শীত যাবে কত ক্ষণে,
গাছপালা ছাইবে মুকুলে–
তখন গাহিব মন খুলে।’
কুয়াশা কাটিয়া যায়, বসন্ত হাসিয়া চায়,
কানন কুসুমে ভরে গেল–
সে যে মরে গেল!
২
এত শীঘ্র ফুটিলি কেন রে!
ফুটিলে পড়িতে হয় ঝরে–
মুকুলের দিন আছে তবু,
ফোটা ফুল ফোটে না তো আর।
বড়ো শীঘ্র গেলি মধুমাস,
দু দিনেই ফুরালো নিশ্বাস।
বসন্ত আবার আসে বটে,
গেল যে সে ফেরে না আবার।
Augusta Webster
শ্রাবণ, ১২৯১