তুমি ও কবিতা
তোমার সাথে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি
মুহুর্তেই উৎসব-
তুমি যখন চলে যাও সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর
সব আলো নিবে যায়,
বইমেলা জনশূন্য হয়ে পড়ে,
কবিতা লেখা ভুলে যাই।
তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো
মনোরম
একেটি তুচ্ছ বাক্যালাপ অন্তহীন নদীর কল্লোল,
তোমার একটুখানি হাসি অর্থ এককোটি বছর
জ্যোৎস্নারাত
তুমি যখন চলে যাও পৃথিবীতে আবার হিমযুগ
নেমে আসে;
তোমার সাথে প্রতিটি কতাই কবিতা, প্রতিটি গোপন কটাক্ষই
অনিঃশেষ বসন্তকাল
তোমার প্রতিটি সম্বোধন ঝর্নার একেকটি কলধ্বনি,
তোমার প্রতিটি আহ্বান একেকটি
অনন্ত ভোরবেলা।
তাই তুমি যখন চলে যাও মুহূর্তে সব নদীপথ
বন্ধ হয়ে যায়
পদ্মার রুপালি ইলিশ তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে,
পুষ্পোদ্যান খাঁখাঁ মরুভূমি হয়ে ওঠে;
যতোক্ষণ তুমি থাকো আমার নিকটে থাকে
সপ্তর্ষিমণ্ডল
মাথার ওপরে থাকে তারাভরা রাতের আকাশ,
তুমি যতোক্ষণ থাকো আমার এই হাতে
দেখি ইন্দ্রজাল
আঙুলে বেড়ায় নেচে চঞ্চল হরিণ;
তুমি এলে খুব কাছে আসে সুদূর নীলিমা
তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত সঙ্গীতের
অপূর্ব মূর্ছনা
যেন কারো অবিরল গাঢ় অশ্রুপাত;
তোমার সাথে প্রতিটি বাক্য একেকটি কবিতা
প্রতিটি শব্দ শুভ্র শিশির।
তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি
তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি
কতোবার দ্বারস্ত হয়েছি আমি
গীতিকবিতার,
কতোদিন মুখস্ত করেছি এই নদীর কল্লোল
কান পেতে শুনেছি ঝর্ণার গান,
বনে বনে ঘুরে আহরণ করেছি পাখির শিস্ত
উদ্ভিদের কাছে নিয়েছি শব্দের পাঠ;
তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি
সংগ্রহ করেছি আমি ভোরের শিশির,
তোমাকে লেখার মতো প্রাঞ্জল ভাষার জন্য
সবুজ বৃক্ষের কাছে জোড়হাতে দাঁড়িয়েছি আমি-
ঘুরে ঘুরে গুহাগাত্র থেকে নিবিড় উদ্ধৃতি সব
করেছি চয়ন;
তোমাকে লিখবো বলে জীবনের গূঢ়তম চিঠি
হাজার বছর দেখো কেমন রেখেছি খুলে বুক।
ফুটেছে ফুল, বিরহীতবু চাঁদ
ফুটেছে ফুল ঠোঁটের মতো লাল
আকাশে চাঁদ বিরহী চিরকাল;
কে যেন একা গাইছে বসে গান
সন্ধ্যা নামে, দিনের অবসান।
দুর পাহাড়ে শান্ত মৃদু পায়ে
রাত্রি নামে স্তব্ধ নিঝুম গাঁয়ে;
শূন্যে ভাসে মেঘের জলাশয়
এই জীবনে সবকিছুই তো সয়।
বিরহী চাঁদ মোমের মতো গলে
বুকের মাঝে কিসের আগুন জ্বলে;
মন পড়ে রয় কোন অজানালোকে
নিজেকেই সে পোড়ায় নিজের শোকে।
ফুটেছে ফুল ঠোঁটের মতো লাল
বিরহী চাঁদ বিরহী চিরকাল;
ফুটেছে ফুল বিরহী তবু চাঁদ,
বাইরে আলো, ভেতরে অবসাদ।
মধুপুরে
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু, আমি যেন
উড়ো পাতা,
ঝাউবনের কান্না শুনি বুকের মধ্যে
সারা দুপুর-
উড়তে উড়তে কোথায় যাবো, ঠিকানা ঠিক
কোথায় পাবো
নাকি শেষে হারিয়ে যাবো,
এই আমি এই উড়ো পাতা, উড়ো পাতা!
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু টেবিলে বই, লেখার
কাগজ
ঝড় বয়ে যায় মনের ভেতর; সব
উড়ে যায়
আমিও যাই
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু শালবনে
কার ছায়া দেখি-
লোকাল ট্রেনে যাচ্ছি কোথায়!
আমার এখন মনে পড়ে তোমার চোখে
বৃষ্টি নামা,
তবু উড়ু উড়ু এই দুপুরে মধুপুরে হয় না নামা।
সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া
সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে
হুলিয়া,
হৃদয়ের তর্জমা নিষিদ্ধ আর মননের সম্মুখে প্রাচীর
বিবেক নিয়ত বন্দী, প্রেমের বিরুদ্ধে পরোয়ানা;
এখানে এখন পাখি আর প্রজাপতি ধরে ধরে
কারাগারে রাখে-
সবাই লাঞ্ছিত করে স্বর্ণচাঁপাকে;
সুপেয় নদীর জলে ঢেকে দেয় বিষ, আকাশকে
করে উপহাস।
আলোর বিরুদ্ধাচারী আঁধারের করে শুধু স্ততি,
বসন্তের বার্তা শুনে জারি করে পূর্বাহ্নে কারফিউ,
মানবিক উৎসমুখে ফেলে যতো শিলা ও পাথর-
কবিতাকে বন্দী করে, সৌন্দর্যকে পরায় শৃঙ্খল।