- বইয়ের নামঃ বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ সাহিত্যদেশ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
টুঙ্গিপাড়া
টুঙ্গিপাড়া একটি সবুজ গ্রাম, এই গ্রাম
গাভীর চোখের মতো সজল করুন
আজ সবকুছিতেই উদাসীন বিষন্ন বাউল;
এই গ্রামখানি বড়োই ব্যথিত
যদিও সে প্রকৃত কবির মতো ঢেকে রাখে
তার দুঃখ, শোক; কাউকে বলে না কিছু
তবু এই মধুমতী নদীটিকে দেখে মনে হয়
যেন অন্তহীন অশ্রুর সাগর;
এই সুনীল আকাশ যেন এক শোকের চাদর
এই নদীজলে, বৃক্ষের অন্তরে
অবিরাম শ্রাবণের বর্ষণের মতো বাজে শোকগাথা;
এখানে ঝিঁঝির ডাকে সন্ধ্যা নামে
মাঝে মাঝে দূর মাঠে রাখালের বাঁশি শোনা যায়,
কিন্তু জ্যোৎ্লারাতে শিশিরের স্পর্শে জেগে ওঠে
কার যেন অথই ক্রন্দন;
কাঁদে দেশ এইখানে নির্জন সমাধির পাশে।
এখানে এই সবুজ নিভৃত গ্রামে, মাটির হৃদয়ে
দোয়েল-শ্যামার শিসে,
নিরিবিলি গাছের ছায়ায়
ঘুমায় একটি দেশ, জ্যোতির্ময় একটি মানুষ;
টুঙ্গিপাড়া মাতৃস্নেহে তাকে বুকে রাখে।
প্রেমের কবিতা
আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
টেপ করে রাখলে
পৃথিবীর যে-কোনো গীতি কবিতার
শ্রেষ্ঠ সঙ্কলন হতে পারতো;
হয়তো আজ তার কিছুই মনে নেই
আমার মনে সেই বাক্যালাপগুলি নিরন্তর
শিশির হয়ে ঝরে পড়ে,
মৌমাছি হয়ে গুনগুন করে
স্বর্ণচাঁপা আর গোলাপ হয়ে ঝরতে থাকে;
সেই ফুলের গন্ধে, সেই মৌমাছির গুঞ্জনে
আর কোকিলের গানে
আমি সারারাত ঘুমাতে পারি না, নিঃশ্বাস ফেলতে
পারি না,
আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
আমার বুকের মধ্যে
দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত সোনার খনির চেয়েও
বড়ো স্বর্ণখনি হয়ে আছে-
আমি জানি এই বাক্যালাপগুলি গ্রথিত করলে
পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের
কবিতা হতে পারতো;
সেইসব বাক্যালাপ একেকটি
হীরকখণ্ড হয়ে আছে,
জলপ্রপাতের সঙ্গীত মূর্ছনা হয়ে আছে,
আকাশে বুকে অনন্ত জ্যোৎ্লারাত্রির
স্নিগ্ধতা হয়ে আছে;
এই বাক্যালাপের কোনো কোনো অংশ
কোকিল হয়ে গেয়ে ওঠে,
কেনো কোনো অংশ ঝর্না হয়ে নেচে বেড়ায়
আমি ঘুমাতে পারি না, জেগে থাকতেও পারি না,
সেই একেকটি তুচ্ছ শব্দ আমাকে কেন যে
এমন ব্যাকুল করে তোলে,
আপাদমস্তক আমকে বিহ্বল, উদাসীন,
আলুথালু করে
তোলে;
এই কথোপকথন, এই বাক্যালাপগুলি
হয়তো পাখির বুকের মধ্যে পেট করা আছে,
নদীর কলধ্বনির মধ্যে ধরে রাখা আছে
এর চেয়ে ভালো প্রেমের কবিতা আর কী
লেখা হবে!
বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ
আমি হয়তো কোনোদিন কারো বুকে
জাগাতে পারিনি ভালোবাসা,
ঢালতে পারিনি কোনো বন্ধুত্বের
শিকড়ের একটু জল-
ফোটাতে পারিনি কারো একটিও আবেগের ফুল
আমি তাই অন্যের বন্ধু বলেছি;
আমার হয়তো কোনো প্রেমিকা ছিলো না,
বন্ধু ছিলো না,
ঘরবাড়ি, বংশপরিচয় কিচ্ছু ছিলো না,
আমি ভাসমান শ্যাওলা ছিলাম,
শুধু স্বপ্ন ছিলাম;
কারো প্রেমিকাকে গোপনে বুকের মধ্যে
এভাবে প্রেমিকা ভেবে,
কারো সুখকে এভাবে বুকের মধ্যে
নিজের অনন্ত সুখ ভেবে,
আমি আজো বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ।
তোমাদের সকলের উষ্ণ ভালোবাসা, তোমাদের
সকল প্রেম
আমি সারি সারি চারাগাছের মতন আমার বুকে
রোপণ করেছি,
একাকী সেই প্রেমের শিকড়ে আমি
ঢেলেছি অজস্র জলধারা।
সকলের বুকের মধ্যেই একেকজন নারী আছে,
প্রেম আছে,
নিসর্গ-সৌন্দর্য আছে,
অশ্রুবিন্দু আছে
আমি সেই অশ্রু, প্রেম, নারী ও স্বপ্নের জন্যে
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি;
সকলের বুকের মধ্যে যেসব শহরতলী আছে,
সমুদ্রবন্দর আছে
সাঁকো ও সুড়ঙ্গ আছে, ঘরবাড়ি
আছে
একেকটি প্রেমিকা আছে, প্রিয় বন্ধু আছে,
ভালোবাসার প্রিয় মুখ আছে
ভালোবাসার প্রিয় মুখ আছে
সকলের বুকের মধ্যে স্বপ্নের সমুদ্রপোত আছে,
অপার্থিব ডালপালা আছে
আমি সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, সেই স্বপ্ন
সেই রূপকথার
জীবন্তমানুষ হয়ে আছি;
আমি সেই স্বপ্নকথা হয়ে আছি, তোমাদের
প্রেম হয়ে আছি,
তোমাদের স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে আছি
আমি হয়ে আছি সেই রূপকথার স্বপ্নমানুষ।
মগ্নজীবন
এই এটুকু জীবন আমি দিওয়ানার মতো
ঘুরেই কাটিয়ে দিতে পারি
দিগ্ভ্রান্ত নাবিকের মতো অকূল সমুদ্রে পারি
ভাসাতে জাহাজ;
আমার সমগ্র সত্তা পারি আমি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে
কোনো সুফী আউলিয়ার মতো
ধ্যানের আলোয়,
ঝরা বকুলের মতো পথে পথে নিজেকে ছড়াতে পারি আমি
ছেঁড়া কাগজের মতো এমনকি যত্রতত্র ফেলে দিতে পারি,
এইভাবে ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে এই এটুকু জীবন
আমি পাড়ি দিতে চাই-
এই এটুকু জীবন আমি হেসে খেলে দুচোখের জলে
ভালোবেসে, ভালোবাসা পেয়ে
কিংবা না পেয়ে
এভাবে কাটিয়ে দিতে চাই;
এই ছোটো এটুকু জীবন আমি বংশীবাদকের মতো
এভাবে কাটাতে পারি পথে পথে ঘুরে
উদাস পাখির মতো ভেসে যেতে পারি দূর নীলিমায়
সুদূরের স্বপ্ন চোখে নিয়ে,
পারি আমি এটুকু জীবন নিশ্চিত ডুবিয়ে দিতে গানের নদীতে
আনন্দধারায়,
এই তপ্ত এটুকু জীবন আমি স্বচ্ছেন্দে ভিজিয়ে নিতে পারি
পানপাত্রে-
ধুয়ে নিতে পারি এই জীবনের সব দুঃখ, অপমান, গ্লানি,
এই পরাজয়, এই অপর ব্যর্থতা, এই অখণ্ড বিরহ,
এই উপেক্সার অনন্ত দিবসরাত্রি, এই একা একা
নিভৃত জীবন;
এই এটুকু জীবন আমি নির্ঘাত কাটিয়ে দিতে পারি
এভাবে ট্রেনের হুইসিল শুনে
উদাসীন পথিকের মতো পথে, পর্বতারোহীর অদম্য নেশায়
আকাশে ঘুড়ির পানে চেয়ে;
এই মগ্ন জীবন আমি নাহয় নিঃসঙ্গ কয়েদীর মতো
এভাবে কাটিয়ে দিয়ে যাই
অন্ধকারে, অন্ধকারে।