এই ব্যর্থ আ-কার এ-কার
এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো খুঁটে খুঁটে দেখি যদি হয়,
যদি কিছু হয়
যদি একটি পাখিরও মৃদু ঠোঁট হয়ে ওঠে নিরুপায় শিথিল
অক্ষরে
চোখের অধীর অশ্রু যদি কাঁপে এ-কারের ক্ষীণ কণ্ঠস্বে
আমি তা জানি না; আমি শুধু অবিচল মুদ্রাকরের মতন
কালিঝুলি-মাখা এই কেসের ভিতরে সারাক্ষণ চালাই
আঙুল।
এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো জড়ো করি
আর ভেঙে ফেলি
কখনো ঘনায় মেঘ কখনোবা রঙিন সূর্যাস্ত নেমে আসে
টাইপের এই জীর্ণ কেসের গহ্বরে
কখনো একটি ভাঙা আ-কার খুঁজতে গিয়ে দেঝি তার গায়ে কতো রহস্যের
রাঙা স্পর্শ লেগে আছে, এ-কার কখনো দেখি তন্ময়ের
তীরে একা-একা,
আমি তবু ভাঙি আর জড়ো করি এই ব্যর্থ বর্ণের ব্যঞ্জনা।
মাঝে মাঝে আমিও কখনো হয়ে উঠি রোমাঞ্চিত যদি দেখি
একটিও সফল আ-কার কোনোখানে বসিয়েছি ঠিক,
আর তাই তো কখনো আমি পড়তে দিইনি ধুলো এই কালো
এ-কারে আ-কারে
তারা যেন ক্ষেতের সোনালি পাকা ধান, থোকা থোকা
পড়ে থাকা জুঁই!
আমি এই অসহায় চিহ্নগুলোকে নিয়েই হয়তো বানাতে
চাই ব্যাকুল বাগান
হয়তো ফোটাতে চাই তারই ডালে প্রত্যাশার গাঢ় স্বর্ণচাঁপা
এমনও হয়তো আমি তারই মাঝে ফুটিয়ে তুলতে চাই
জ্যোৎ্লার নিবিড় জড়োয়া!
এই তো আমার তুচ্ছ কাজ আ-কার এ-কারগুলো তুলি আর
তুলি ভেঙে ফেলি
দেখি যদি হয়, যদি কিছু হয়
কোনো মুখ, কোনো নাম, কোনো প্রিয় স্মৃতির রুমাল
যদি হয়, যদি কিছু হয় একটি আ-কার জুড়ে দিলে
সেই বিস্ফারিত চোখ, জলাশয়, চিত্রিত হরিণ
কিংবা পর্যটনের পাখিটি;
তাই তো এমন মনোযোগে
এতো রাশি রাশি অক্ষরের ফাঁকে বসিয়েছি এই ভালোবাসার
এ-কার
আ-কার তখনো বাকি আমি ভাবি বুঝি আ-কার এ-কার
জুড়ে দিলে
অনায়াসে হয়ে যাবে তোমার প্রকৃতি
তাই তো মেখেছি এতো কালিঝুলি এই হাতে, এই দুটি
হাতে!
যদি হয় এই ব্যর্থ আ-কার এ-কারগুলো তুলে কোনো মগ্ন
মাটির বারান্দা
পাতার ছাউনি আর গ্রিলের লতানো নিশ্চয়তা যদি হয়
একখানি ঘরোয়া ইমেজ;
সেই ভেবে রেফ আর অনুস্বরগুলো প্রায় ছুঁইনি আঙুলে
কেবল পরেছি এই আহত কপালে আমি অকারণ বিস্ময়ের ফোঁটা
আর মাঝে মাঝে প্রশ্নের দরোজাখানি খুলে ডেকেছি তোমাকে
যদি হয়, যদি কিছু হয এই আ-কার এ-কারগুলো থেকে
রঞ্জিত বা গূঢ় উচ্চাতি!
কোথাও পাই না দেখা
কেবল তোমারই দেখা পাই না কোথায। যেন তুমি
অদৃশ্য অলীক কিছু; স্বপ্নও জানে না কোনো খোঁজ
তারও রুপালি পর্দায় কখনো ওঠে না ভেসে তোমার ইমেজ
তুমি আছো এতোদূরে স্পর্শগন্ধহীন স্বপ্নেরাও সূক্ষ্ম অগোচরে
কেবল তোমারই দেখা পাই না এখন। জনারণ্যে এভেন্যুর
উদ্দীপনাময় ভিড়ে কোথাও তোমার দেখা নাই। তুমিই
কি সেই অদৃশ্য স্বপ্নের পাখি কিংবা মায়াবী হরিণ
চিলে, আর কোনোখানে নেই, তুমি কি সেই গ্রীক
পুরাণকাহিনী?
না হলে পাই না কেন কোথাও তোমার দেখা? যদিও
প্রত্যহ এ শহর
জনসংখ্যার চাপেই অস্থির তার বাহুতে গ্রীবায় গণ্ডে
কেবল চলেছে বেয়ে অবিরাম মানুষের ধারা; ফুটপাত, রাজপথ
কিংবা বিপণি সিক্ত ও ব্যাকুল এই লোকের বন্যায়
তবু তোমার একটি মুখ এ শহরে একান্ত দুর্লভ
এমনকি কোনো মনোরম চিত্রশালা কিংবা মিউজিয়াম ঘুরেও
কখনো তোমার একটি মুখ হয়নি তো নয়নগোচর
শাগালের সুসমৃদ্ধ ঐশ্বর্যশালীন প্রদর্শনী জুড়ে
সবার অজান্তে আমি খুঁজেছি তোমার মুখ; তোমারই
দুটি চোখ পিকাসোর চিত্রময় অ্যালবাম ব্যেপে করেছি
প্রত্যাশা
যামিনী কি জয়নুল-কামরুলেও তন্নতন্ন খুঁজেছি তোমায়
কি জানি হয়তো তুমি লোকচক্ষুর আড়ালে হয়ে আছো
এ-রকমই কোনো মুগ্ধ শিল্পের ব্যঞ্জনা;
আমারই ব্যর্থ চোখ দেখতে অক্ষম।
হয়তোবা আর সকলেই অতি সহজেই তোমাকে দেখতে পায়
কারো ঘরে অনিবার্যভাবে তুমি সন্ধ্যাদীপের মহিমা তাও জানি
কিংবা কারো কাতানের কাতর প্রশংসা এমনকি
হয়তোবা ফুটে আছো এইরূপই কোনো সংসারের পাশে
লোকায়ত টবে,
কেবল আমার জানা বা চেনা চাই কি স্বপ্নেরও অন্তরালে!
কিছুই দেখতে চাই না তবু সবকিছু দেখি আর
কেবল তোমারই পাই না দেখা। কেন যে আমার কাছে
তুমি হলে
এ-রকমই রূপহীন, বর্ণহনি, এই অবয়বহীন!
হঠাৎ পথের মোড়ে দুপুরে কি পড়ন্ত সন্ধ্যায়
এই অসংখ্য মুখে একটি মুখও কি রূপান্তরিত হয়ে যেতে
পারে না তোমার মুখে
অজস্র চোখের একটি চোখও কি অকস্মাৎ আমার সম্মুখে
তোমার দুসপ্রাপ্য চোখ হয়ে উঠতে পারে না তেমন?
বলো একটি গোলাপও কি রূপান্তরিত হয়ে যেতে
পারে না তোমার মৃদু ঠোঁটে?
কিংবা মেঘও কি তোমার মূর্তি পেতে পারে না সহসা
সব চিত্রশালা আর ভাস্কার্যের মেলা মুহূর্তে কি তোমার দিব্যদেহ নিয়ে একবারও জানাতে পারে না
সম্ভাষন?
জলাশয়ে বিচরণরত একটি মরাল
তোমার গ্রীবার ভঙ্গি আমাকে কি পারে না দেখাতে? তার অর্থ
তুমি কি বরতে চাও তোমার সাক্ষাৎলাভ স্বপ্নেও সম্ভব
নয় আর!
কিন্তু আমি তো ভালোই জানি তুমি যে মিশেই আচো
এ-দেশেরই চিরন্তর শিল্পের ঐতিহ্যে, স্থাপত্য ও দেশজ কলায়
তাই না দেখেও হয়তো প্রত্যহ আমি তোমাকেই প্রিয়তমা মানি।
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই
তোমার দুঃখের সাতমহল বাড়ির পুরনো বাসিন্দা বলেই
আমি হৈচৈ শামিয়ানার নিচে যাই না,
ভালোবাসার জন্য ব্যাকুলতা আছে বলেই তো
রঙিন কুয়াশা কুড়াতে যাই না কোথাও-
ঝরা বকুলের জন্য ব্যাকুল হয়েছি বহুবার কিন্তু বিদেশী
খেলনার দিকে ছুটিনি
নক্ষত্রপুঞ্জকে ডলার ভেবেছি বলেই আমি বসে আছি এমন
তোমার পথ চেয়ে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো বিমান
ধরার তাড়া নেই আমার,
তবু তোমার চোখ যদি একবার অশ্রুসজল হয়!
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই আমার,
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই
আমি আরো বহুদিন তোমার দুঃখের সাতমহলা
পাহাড়া দিতে পারবো
তুমি যতো অপেক্ষা করতে বলো
আমি তার চেয়েও বেশি প্রস্তত
আমি শুধু দেখতে চাই তোমার চোখ থেকে
একফোঁটা অশ্রু গড়াতে গড়াতে
কীভাবে সোনার খনি গড়ে ওঠে-
আর কোনো তাড়া নেই আমার,
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই!