- বইয়ের নামঃ ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ আফসার ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আফ্রিকা, তোমার দুঃখ বুঝি
আফ্রিকার বুকের ভেতর আমি শুনতে পাই এই
বাংলাদেশের হাহাকার
বাংলাদেশের বুকের ভেতর আফ্রিকার কান্না;
এশিয়া-আফ্রিকা দুইবোন, দুই গরিব ঘরের মেয়ে!
আফ্রিকার কালো মানচিত্র
যেন বাংলাদেশেরই দারিদ্রপীড়িত গ্রাম,
আফ্রিকার দিকে তাকালে তাই আমার
এই নিপীড়িত বাংলার কথাই মনে পড়ে
হয়তো আফ্রিকার কোনো কবিও বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে
তার আর্ত স্বদেশের কথাই ভাবে,
ঔপনিবেশিক সভ্যতা যাকে নাম দিয়েছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ;
কিন্তু আফ্রিকার মানুষের বুকে আজ আলোর মশাল,
আফ্রিকার চোখে স্বপ্ন!
আমি দেখতে পাই এঙ্গোলার কৃষকের মতোই
বাংলাদেশের ভূমিহীন চাষীও
মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলেছে আকাশে
সে-হাত শোষণের বিরুদ্ধে দুর্জয় হাতিয়ার;
আজ এশিয়া তাকিয়ে আছে আফ্রিকার দিকে
এশিয়ার দিকে আফ্রিকা,
এই কালো মানুষের ধারা এসে মিশেছে এশিয়া-আফ্রিকার গ্রামে;
জানি দারিদ্র্য আমাদের উভয়ের সাধারণ পোশাক
বহু যুগের বিদেশী শাসনের ক্ষতচিহ্ন আমাদের উভয়ের কপালে
তাই আফ্যিকার বুকে যখন রক্ত ঝরে
তখন এই বাংলাদেশের মাটিতেও শিশির-ভেজা ঘাস
মনে হয় রক্তমাখা,
ইথিওপিয়া কিংবা নামিবিয়ার পল্লীতে যখন জেগে ওঠে
সাহসী মানুষ
তখন এই বাংলায়ও প্রাণের জোয়ার জাগে পদ্মা-মেঘনায়;
আফ্রিকা, তোমার দুঃখ বুঝি
আমি জানি বর্ণবাদি শাসনের হাত
একদিন ভেঙে দেবে এই মানুষেরই মহৎ সংগ্রাম
আমি জানি এশিয়া ও আফ্রিকার ঘরে ঘরে একদিন উড়বেই
বিপ্লবের লাল পতাকা,
বাংলার স্বপ্নভ্রষ্ট ফুল তাই তো তাকিয়ে আছে
আফ্রিকার অরণ্যের দিকে-
সেদিন একটি পাখির মতো উড়ে যাবো মেঘমুক্ত আফ্রিকার
সুনীল আকাশে
পদ্মার পাড় তেকে আফ্রিকার স্বচ্ছতোয়া নদীটির পাশে
দেখবো মাথার উপরে দ্বিতীয় আকাশ নেই , আছে শুধু
এশিয়া ও আফ্রিকার অভিন্ন আকাশ!
এই কবিতাটি কোথায় পেয়েছি
এই কবিতাটি ছিলো যে নিঝুম ঘুমের পুরীতে অলস নিদ্রা
ছিলো কারো চোখে সুদূর স্বপ্ন রোমাঞ্চকর গাঢ় শিহরন,
দূর নীলিমায় এই কবিতাটি ছিলো ভাসমান উদাসীন মেঘ
স্বর্ণচাঁপার বুকে থরো থরো হয়তোবা কোনো শুভ্র শিশির;
এই কবিতাটি ছিলো পাহাড়ের মৌনতাভরা গূঢ় উদ্ধৃতি
ছিলো গোলাপের হার্দ্য আলাপ অনুভূতিময় পাখিদের শিস
আকাশের ছিলো মন্ময় ভাষা এই কবিতাটি নদীর ভাষ্য,
এই কবিতাটি ছিলো কোনো এক শিশুর হুদয়ে মৃদু স্পন্দন
মধ্যরাতের ঘুমহীন চোখে এই কবিতাটি জেগে ছিলো একা
এই কবিতাটি ছিলো কৃষকের মাটির শানকি-ভরা শাদা ভাত;
এই কবিতাটি ছিলো মিছিলেতে উদ্দীপনার গনগনে ভাষা
বস্তিতে ছিলো এই কবিতাটি মাথা গুঁজে-থাকা কাতর দুঃখ!
এই কবিতাটি ব্যথিত মায়ের কতো যে গভীর করুন অশ্রু
উবু হয়ে পথে জলপানরত এই কবিতাটি দারুণ তৃষ্ণা,
এই কবিতাটি মারীমড়কের মাঝখানে ছিলো ক্ষীণতম আশা
হানাহানি আর রক্তপাতের বিরুদ্ধে ছিলো এই কবিতাটি;
এই কবিতাটি ছিলো একখানি সবুজ গ্রামের স্বচ্ছ ইমেজ
এই কবিতাটি মানবিকতার একটিমাত্র সহজ উৎস,
অনাহারী সব শিশুর মুখে তো এই কবিতাটি দুমুঠো অন্ন
এই কবিতাটি ছিলো বা কখনো দূরে ভাসমান মেঘের রাজ্যে
কখনোবা ছিলো খুব কাছাকাছি আমাদের এই মাটির উঠোনে,
এই কবিতাটি কখনোবা ছিলো চাঁদের কিরণে অধিক সিক্ত
কখনোবা ছিলো এই কবিতাটি খর দুপুরের তাপে কী দগ্ধ
এই কবিতাটি কোথায় যে ছিলো উধও স্বপ্নে দূর কল্পনা,
এই কবিতাটি পেয়েছি এখানে ধুলো ও মাটিতে রূঢ় বাস্তবে।
একটা কোনো সুসংবাদ চাই
হয়তো আজই ঠিক পেয়ে যাবো একটা লুফে নেয়ার মতো
সুসংবাদ
একটা কিছু অনবদ্য নীল খামে;
অনেকদিন পর আজ হয়তো ঠিকই পেয়ে যাবো সেই চিঠিখানি
সেই পাখির শিস, ফুলের হৃদ্যতা, সেই আঙুলের ছাপ
আজ ঠিকইপেয়ে যাবো একটা কিছু চমৎকার প্রাঞ্জল সংবাদ!
কতোকাল কোথাও পাইনে কোনো সুখবর,
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নব্ ইথারের রাজ্যে শুধু শুনি দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ
মহামারী-
পোর্ট স্ট্যানলীতে যুদ্ধ থামতে না থামতেই দেখি
আক্রান্ত বৈরুত ;
দেখি মারণাস্ত্র, নিউট্রন বোমার হুঙ্কার
আজ তাই মআমাকে পেতেই হবে একটা কোনো রম্য সুসংবাদ।
কারো কাছ থেকে পাইনে একটাও কোনো আনন্দ-সংবাদ,
একটিও হার্দ্য টেলিফোন, রোমাঞ্চকর বার্তা কোনো
এমন সংবাদ আর পাইনে কখনো যা কিনা মুহূর্তে ঠিক
করে তোলে আরক্তিম গাঢ় উচ্ছসিত ;
পৃথিবীর সবকিছু পাওয়াও যার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।
কতোকাল কোথঅও আমার জন্য একটিও সুসংবাদ নেই
খাম খুলে দেখি কালো বিষণ্ন অক্ষরগুলো
একটা না একটা কিছু দুঃসংবাদ নিয়ে বসে আছে
ঘরে এসে দুঃসংবাদ ছাড়া আর কিছুই মুনি না
এমনকি রেডিওর উত্তেজিত নবে আঙুল রাখতেই শুনি
বেজে ওঠে খাঁখাঁ দুঃসংবাদ,
আবার কলিংবেল বাজিয়েও দুঃসংবাদ ঢুকে পড়ে ঘরে
আজ তাই যেভাবেই হোক একটা কোনো সুসংবাদ চাই,
তুমুল, গভীর একটা কোনো উষ্ণ সুসংবাদ।
কী যেন বলতে চায় বন্দী স্বদেশ
আজ যেখানেই কান পাতি শুনি সজকলে চাপা কণ্ঠস্বর,
খুব ধীরে কানের নিকটে মুখ এনে
কী যেন বলতে চায় এই ফাল্গুনের বিষণ্ন গোলাপ,
বসন্তের প্রথম কোকিল
মনে হয় কী যেন বলতে চায় প্রতিটি নিঃশব্দ মুখ;
কী যেন বলতে চায় মেঘমুক্ত ভোরের আকাশ গতরাতের কাহিনী
লাইটপোস্ট, আইল্যাণ্ডের নীরব দোয়েল আর
রমনার সবুজ চত্বর আমাকে দেখেই যেন ঠোঁট নাড়ে,
আমাকে দেখেই যেন জ্বলে ওঠে রাতজাগা ইউক্যালিপ্টাসের সারি
সামান্য দূরেই আরো একগুচ্ছ ম্লান স্বর্ণচাঁপা;
তাদের যে-কারো দিকে তাকালেই মনে হয়
কী যেন বলতে চায় তারা।
মানুষের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়
ভীষণ জরুরী কোনো কথা যেন তাদের বলার আছে,
তাই কারো চোখের দিকে চোখ পড়তেই সভয়ে সরিয়ে নিই চোখ
কারো মুখের দিকে ভালো করে তাকানোর সাহস পাইনে-
যদি রমনার সবুজ মাঠ, স্বচ্ছ লেক আর এই নিঃসঙ্গ ফুটপাত
আমাকে বলতে থাকে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
তারা যা দেখেছে চোখ মেলে, প্রত্যহ অভিজ্ঞতা
তারা যা দেখেছে চোখ মেলে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
তারা যা দেখেছে চোখ মেলে, প্রত্যহ যেসব ঘটনার সাক্ষী তারা-
কোথায় রাখবো এতো চাপা উত্তপ্ত নিঃশ্বাস!
তাই তো এমন মাথা হেট করে চলে যাই লজ্জার মুখোশ পরে
কোনোদিকে তাকাইনে বড়ো;
আমি তো শুনিনি তাই কী যেন বলতে চায় ক্ষুধার্ত যুবতী
তার অনাহারী কোলের শিশুটি, রুগ্ন বৃদ্ধা, শোকার্ত তরুণ!
গতরাতে বীভৎস রক্তপাত দেখে আহত গোলাপ
নিজের দেহের রঙ নিয়ে যেন নিজেই লজ্জিত,
সেদিন দুপুরবেলা নিষ্ঠুরতা দেখে একদল গ্রামের শালিক
হয়ে আছে সেই থেকে মর্মাহত, গভীর হতাশ।
সবাই আমার কাছে কী যেন বলতে চায় এই গোলাপ, শালিক
আর ব্যথিত মানুষ,
কী যেন বলতে চায় ঝরাপাতা, মায়ের করুণ অশ্রু, বন্দী স্বদেশ!
তোমরা হয়তো পারো
তোমাদের পক্ষে সম্ভব তোমরা এক ধমকে চলন্ত ট্রেন
থামিয়ে দিতে পারো
বেয়াড়া বাসটি তোমাদের গলার শব্দেই কেঁপে ওঠে,
তোমরা চুলের ঝুঁটি ধরে শাসন করতে পারো এই শহরকে
গ্রামের তো কথাই নেই হাঁক না দিতেই তটস্ত;
তোমাদের সবাই সমীহ করে, উঠতে বসতে তোমাদের নিয়ে
সবাই ব্যস্ত
তোমরা চোখ তুলে তোকাতেই লাইটপোস্টগুলোও কেমন বিব্রত
হয়ে যায়
তোমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব, সবই সম্ভব;
আমার কথা ছাড়ো আমি সারাদিন গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েও
একটি শিশুর কান্না থামাতে পারিনে
বাইরের কথঅ থাক নিজের ভিতরই আমার কেমন ভাঙচুর
আমার কথা ঠিক কেউ বোঝে না
ফুলের জন্য আমাকে তাই ফুলদানিই কতোবার ভাঙতে হয়েছে
গানের বদলে গিটার থেকে ঝরেছে কেবল চিৎকার
এই রুক্ষ সংসারে এতোটুকু প্রাঞ্জলতা আনতে পারিনি আমি,
মাটিতে হাত দিয়েছি মাটিই হয়ে গেছে পাথর-
কেউ কেউ পারে না, ঠিক এমনি পারে না;
তাই তোমাদের পক্ষে যা সম্ভব দোস্ত তা হয়তো আমার জন্য নয়
তোমরা যে-কারো মতোই এমনকি গাছপালারও কলার চেপে ধরে
বলতে পারো, চুপ করো,
আমার হয়তো সামান্যও ক্ষমতা নেই
যেমন এক ধরনের লোক থাকে যারা চোখ রাঙাতে গেলে
ক্রোধের বদলে সেখান থেকে অশ্রুই ঝরে পড়ে
ধমকের বদলে গলা থেকে বেরিয়ে আসে অসহায় কান্না
তাই আমি ঠিক অনেক কিছুই পারিনে, তাই এমন লুকোতে হয়,
দৌড়ঝাঁপ করতে হয়, কাদামাটি মাখতে হয়;
আমার জন্য এই শহরে কোনো টেলিফোন-সেট নেই
এমনকি কয়েন বক্সে একটার পর একটা বাঘমার্কা সিকি ফেলে
দেখেছি সেখানে শীতল নীরবতা
কতোদিন মাত্র পাঁচ টাকার একটি নোট হাতে কাউন্টার থেকে
কাউন্টারে ঘুরেছি খুচরো টাকার জন্য
অথচ কতোদিন তোমাদের ওস্তাদের মতো যেখানে সেখানে
নোট বাড়িয়ে দিয়েই ভাড়িয়ে নিতে দেখেছি,
যে-কোনো জায়গায় টেলিফোন মরালের মতো গলা বাড়িয়ে
দিয়েছে তোমাদের জন্য
কতোদিন যে কতোজনের বন্ধ দরোজা দেখে দেখে ফিরে এসেছি
আর কড়া নাড়ারই সাহস হয়নি,
অথচ নিজের চোখেই দেখেছি তোমাদের যাওয়ার শব্দেই
কলরোল করে খুলে গেছে বন্ধ দরোজা
ভিতর থেকে বেজে উঠেছে উষ্ণ আপ্যায়ন;
তোমরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই সেখানে ঝরে পড়ে ফুলের
পাপড়ি
হাত তুলে অভিবাদনের পর অভিবাদন স্বাগত জানায় তোমাদের,
আমার সারা পথে কন্টকশয্যা
একটি পরিচিত মুখেরও দেখা মেলে না কখনো;
তোমাদের সুখদুঃখ-হাসিকান্না নিয়ে রচিত হয় ডকুমেন্টারি
তোমাদের কথাই আলাদা-
তোমরা যেখানেই হাত দিয়েছো সেখানেই ম্যাজিক,
আমার কথা ছাড়ো, আমি অনেক কিছুই পারিনে।
নারীর মুখের যোগ্য শোভা নেই
কী করে বলো না করি অস্বীকার এখনো আমার কাছে
একটি নারীর মুখই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দর্শনীয়,
তার চেয়ে অধিক সুন্দর কিছু অদ্যাবধি দেখিনি কোথাও;
অন্তত আমার কাছে নারীর মুখের চেয়ে অনবদ্য শিল্প কিছু নেই
তাই নারীর মুখের দিকে নির্বোধের মতো চেয়ে রই,
মাঝে মাঝে বিসদৃশ লাগে তবু চোখ ফেরাতে পারি না
নিতান্ত হ্যাংলা ভেবে পাছে করে নীরব ভর্ৎসনা তাই এই পোড়া চোখে
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখি কোনো পার্শ্ববর্তী শোখা, লেক কিংবা জলাশয়
আসলে নারীর মুখই একমাত্র দর্শনীয় এখনো আমার!
এখনো নারীর মুখের দিকে চেয়ে হতে পারি প্রকৃত তন্ময়
সময়ের গতিবিধি, প্রয়োজন একমাত্র নারীর মুখের দিকে চেয়ে
ভুলে যেতে পারি;
তা সে যতোক্ষণই হোক নারীর মুখের দৃশ্য ছাড়া পৃথিবীতে
বাস্তবিকই অভিভূত হওয়ার যোগ্য শিল্প কি স্থাপত্য কিছু নেই।
মিথ্যা বলবো না এখনো আমার কাছে একটি নারীর মুখই
সর্বাপেক্ষা প্রিয়
তার দিক থেকে এখনো ফেরাতে চোখ সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়,
শহরের দর্শনীয় বস্তু ফেলে তাই আমি হাবাগোবা নির্বোধের মতো
নারীর মুখের দিকে অপলক শুধু চেয়ে রই
মনে হয় এই যেন পৃথিবীতে প্রথম দেখেছি আমি একটি নারীর মুখ;
নয়ন জুড়ানো এতো শোভা আর কোনো পত্রপুষ্পে নেই-
সেসব সুন্দর শুধু পৃথিবীতে নারী আছে বলে।
তাই নারীর মুখের দৃশ্য ছাড়া মনোরম বিপণিও কেমন
বেখাপ্পা লাগে যেন
অপেরা বা সিনেমা নিষপ্রাণ,
পার্কের সকল দৃশ্য অর্থহীন বিন্যাস কেবল
নারীর সান্নিধ্য ছাড়া দর্শনীয় স্থানের মহিমা কিছু নেই ;
তাই তো এখনো পথে দুপাশের দৃশ্য ফেলে নারীর মুখের
দিকে ব্যগ্র চেয়ে থাকি
লোকে আর কি দেখে জানি না
আমি শুধু দেখি এই সৌন্দর্র্যের শুদ্ধ শিল্পকলা, নারীর সুন্দর মুখ।
এর চেয়ে সম্পূর্ণ গোলাপ কিংবা অনবদ্য গাঢ় স্বর্ণচাঁপা
আমার মানুষ জন্মে আমি আর কোথাও দেখিনি,
এর চেয়ে শুদ্ধ শিল্প, সম্যক ভাস্কর্য কিংবা অটুট নির্মণ
মিউজিয়াম, চিত্রশালা আর ইতিহাস-প্রসিদ্ধ কোথাও
আমি তো পাইনি খুঁজে ;
কী করে বলবো বলো নারীর মুখের চেয়ে দর্শনীয় ক্রিসানথিমান
কী করে বলবো আমি নারীর মুখের চেয়ে স্মরণীয়
অন্য কোনো নাম!
ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস
কতোদিন কোথাও ফোটে না ফুল, দেখি শুধু
অস্ত্রের উল্লাস
দেখি মার্চপাস্ট, লেফট রাইট, কুচকাওয়াজ ;
স্বর্ণচাঁপার বদলে দেখি মাথা উঁচু করে আছে হেলমেট
ফুলের কুঁড়ির কোনো চিহ্ন নেই, গাছের আড়ালে থেকে
উঁকি দেয় চকচকে নল,
যেখানে ফুটতো ঠিক জুঁই, বেলি, রঙিন গোলাপ
এখন সেখানে দেখি শোভা পাচ্ছে বারুদ ও বুলেট ;
প্রকৃতই ফুলের দুর্ভিক্ষে আজ বিরান এদেশ
কোথাও সামান্য কোনো সবুজ অঞ্চল নেই, খাদ্য নেই,
শুধু কংক্রিট, পাথর আর ভয়ল আগুন
এখানে কারফিউ-ঘেরা রাতে নিষিদ্ধ পূর্ণিমা ;
আজ গানের বদলে মুহুর্মুহু মেশিনগানের শব্দ-
সারাক্ষণ বিউগল, সাইরেন আর বিকট হুইসিল
বুঝি কোথাও ফুলের কোনো অস্তিত্বই নেই।
ফুলের শরীর ভেদ করে জিরাফের মতো আজ
অস্ত্রই বাগয়েছে গ্রীবা
পাতার প্রতীক তাই ভুলে গেছি দেখে দেখে অস্ত্রের মডেল!
খেলনার দোকানগুলিতে একটিও গিটার, পুতুল কিংবা
ফুল পাখি নেই
শিশুদের জন্য শো-কেসে সাজানো শুধু অস্ত্রের সঞ্চার
বাইরেবাতাস শ্বাসদুদ্ধকর, রাজপথে সারি সারি বুট,
সব কিছু চেয়ে আছে অস্ত্রেরই বিশাল ডালপালা ;
কোথাও ফোটে না ফূল, কোথাও শুনি না আর
হৃদয়ের ভাষা,
কেবল তাকিয়ে দেখি মার্চপাস্ট, কুচকাওয়াজ, লেফট রাইট
এই রক্তাক্ত মাটিতে আর ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস।
মেঘ দেখার দুঃখ, গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
কী করে বলি এই মেঘ দেখর দুঃখ, এই গোলাপ দেখার
ব্যাকুলতা-
কিন্তু আমিও যখন মেঘের দিকে তাকাই দেখি কালিদাসই
দেখছেন বিরহী যক্ষকে,
হঠাৎ মন ভরে যায় বহু যুগের ওপার থেকে আসা বর্ষণে:
এই গোলাপ দেখর কথা আমার হয়তো বলাই হবে না
কিন্তু যখান গোলাপের দিকে তাকাই দেখি ব্রেক
তাকিয়ে আছেন গেলোপের রুগ্নতার দিকে,
কিংবা রিলকে আয়ত্ত করে চলেছেন একটি শ্বেতগোলাপ,
কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
মেঘ দেখতে দেখতে আমি যে কখন মেঘদূতের ভেতর ডুবে যাই,
বিরহকাতর যক্ষের জন্য ভারী হয়ে ওঠে এই বুক
কিংবা গোলাপের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসৈ ওঠে
রিলকের মুখটি,
এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
কাউকে বলাই হবে না ;
আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ
দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী
সেই ব্যকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায় –
এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা।
যখন মানুষের সুদ্ধতার কথা ভাবি দেখি দাঁড়িয়ে আছেন
ব্যথিত বোদলেয়ার
শহরের রাত্রির দিকে তাকালে মনে হয় জীবনানন্দ দাশ দেখছেন
লিবিয়ার জঙ্গল,
যখন একজন বিপ্লবীর দিকে তাকাই দেখি দুচোখে
মায়াকোভস্কির স্বপ্ন
আর্ত স্বদেশের দিকে তাকিয়ে আমিও নেরুদার কথাই ভাবি,
কেউ জানে না একটি ফুলের মৃত্যু দেখে, একটি পাখির ক্রন্দন দেখে
আমারও হৃদয় পৃথিবীর আহত কবিদের মতোই হাহাকার
করে ওঠে।
একটি ফুল দেখে আমিও একজন প্রেমিকের মতোই পরাজিত
হতে ভালোবাসি
একটি ঝরাফুলের দুঃখ বুকে নিয়ে যে-কোনো ব্যথিত কবির
মতোই সারাদনি ঘুরে বেড়াই,
আসলে সে-কথাগুলোই বলা হয়নি, বলা হয়নি;
মানুষের সমাজে এই বৈষম্য দেখে আমিও একজন
বিপ্লবীর মতোই শ্রেনীসংগ্রামের জন্য তৈরি হই,
এই জরা বার্ধক্য দেখে কতোবার বুদ্ধের মতোই
ব্যথিত হয়ে উঠি;
কিন্তু কী করে বলবো এইসব মেঘ দেখার দুঃখ, এইসব
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
লেলিন, এইনাম উচ্চারিত হলে
লেনিন, এই নাম উচ্চারিত হলে
রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে প্রাণ;
দেখি ভলগা থেকে নেমে আসে মানবিক উৎসধারা
আমাদের বঙ্গোপসাগরে
আমাদের পদ্মা-মেঘনা ছেয়ে যায় প্রাণের বন্যায়;
লেনিন নামের অর্থ আমি তাই করি শোষণহীন একটি গোলাপ
লেনিন নামের অর্থ আমি তাই করি শোষণমুক্ত একঝাঁক পাখি,
লেনিন নামের অর্থ আমি তাই করি শোষণহীন একটি সমাজ।
ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো যোগ্য প্রতিশব্দ আমি দেখিনি কোথাও
যা হতে পারে লেনিন শব্দের ঠিক স্বচ্ছ অনুবাদ,
মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কখনো যে হতে পারে
সীমাহীন আকাশের মতো
কখনো যে মানুষের এই হাত এতোটা উপরে উঠতে পারে
তোমার আগে কখনো তা কেউ দেখায়নি, কমরেড লেনিন।
তুমিই প্রথম পৃথিবীর মাটিতে উড়িয়ে দিলে সাম্যের পতাকা
এই মাটিতেই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ এভারেস্ট জয়ের
চেয়েও যে কঠিন,
কঠিন যে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে কোনো নতুন দেশের
সন্ধান লাভের চেয়েও
কিংবা কোনো অজ্ঞাত দ্বীপ আবিস্কারের চেয়েও যে দুরূহ
তু তুমি জানতে বলেই এই কাজই বেছে নিয়েছিলে;
তাই তুমি পৃথিবীর মাটিতে উড়ালে প্রথম এই মানুষের মুক্তির পতাকা।
এর আগে মানুষ কোথাও আর প্রকৃতই স্বাধীন ছিলো না
মানুষ তোমারই হাতে এই পেলো প্রথম স্বীকৃতি
তার আগে মেহনতী মানুষের ছিলো না কিছুই;
এবার শস্য তার, শস্যের খামার তার, শিল্প-কারখানাও এবার তাদেরই।
সমরেড লেনিন, এই নাম উচ্চারিত হলে রক্তে খেলে যায়
প্রত্যাশার কী যে বিদ্যুৎ ঝিলিক
ইতিহাস হয়ে ওঠে সচকিত গভরি উজ্জ্বল
দেখতে পাই মানুষের কাছে কীভাবে খুলে যাচ্ছে সম্ভাবনার
একেকটি দুয়ার;
লেনিনের নামে মুহূর্তে শূন্যে ওঠে মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত
লেনিনের নামে উড়ে যায় একঝাঁক শান্তি কপোত,
লেনিন নামের, সেদিন মানুষের দেহে ছিলো শোষকের
নিষ্ঠুর দাঁতের চিহ্ন
সেই চিহ্ন সুদুর বাংলায় আজো মানচিত্রের শরীরে ব্যাপক
আরো বহু দেশে মানুষের এই চরম নিগ্রহ ;
তাই যখন তোমার দিকে ফিরে চাই কমরেড লেনিন
মনে হয় আর কোনো ভয় নেই-
শোষণের দিন শেষ পৃথিবীতে মেহনতী মানুষ জেগেছে!
লেনিন এনেছে পৃথিবীতে নবযুগ
কাস্তে-হাতুড়ি সাম্যের সংবাদ,
লেনিন এনেছে ঐক্যের মহামন্ত্র
মানুষের মানুষে মৈত্রীর সেতুবন্ধন
কমরেড লেনিন এই নাম উচ্চারিত হলে
হৃদয়ে হৃদয়ে ওঠে গঢ় শিঞরন, খুলে যায় মানবিক সকল উৎসধারা
ভলগা এসে মোশে এই গৈরিক পদ্মায়-
আকাশ হঠাৎ যেন নিচু হয়ে মাটিকেই জানায় সেলাম,
মানুষের অফুরন্ত প্রাণের জোয়ারে ভেসে ওঠে তোমার মুখ,
কমরেড লেনিন
আমি আর কিছুই দেখি না, সেইদিকে শুধু চেয়ে থাকি।
স্বাধীন প্যালেস্টাইন তোমার জন্য এই কবিতা
আমার এই কবিতা, গোলাপ ও স্বর্ণচাঁপার প্রতি যার
বিশেষ দুর্বলতা ছিলো
যার তন্ময়তা ছিলো পাখি, ফুল ও প্রজাপতির দিকে
সে এখন প্যালেস্টাইনী গেরিলাদের কানে স্বাধীনতার
গান গাইছে;
ইসরাইলী হামলায় ক্ষতবিক্ষত লেবাননের পল্লীতে সে
এখন ব্যস্ত উদ্ধারকর্মী,
হাতে শুশ্রূষার ব্যাগ নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাহুতে
ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে আমার এই কবিতা;
ধ্বংসস্তপের মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া একটি ভাঙা গিটারে
সে আবার বাজিয়ে দিচ্ছে প্রত্যাশার গান,
আমার এই উদাসীন ও লাজুক কবিতাটিই এখন
নক্ষত্র ও চন্দ্রমল্লিকার বদলে আহরণ করছে বুলেট-
যে-হাতে গোলাপ কুড়াতো সেই হাতেই সে এখন
প্যালেস্টাইন্তমুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মেশিনগান,
বুকে বাংলাদেশের নয় কোটি মাুনষের উষ্ণ ভালোবাসা নিয়ে
আমার এই কবিতাটি এখন সারারাত জেগে আছে অবরুদ্ধ
গেরিলাদের পাশে।
আমার এই কবিতাটি এখন আহত একজন প্যালেস্টাইনী যোদ্ধার
সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র নার্স,
যুদেধ মৃত লেবাননের সেই স্বজনহারা যুবতিিটর জন্য
আমার কবিতাটিই এখন ব্যথিত এপিটাফ;
প্যালেস্টাইনের সেইসব শহীদ যাদের জন্য কোনো শোকের
গান গাওয়া হয়নি
আমার কবিতাটিই তাদের জন্য আজ সারাদিন শোকের
গান গাইবে,
শ্রাবণের বর্ষণের মতো আমার এই কবিতাটিই এখন তাদের
কবরে ঝরে-পড়া নীরব শোকাশ্রু।
স্বাধীন প্যালেস্টাইন তোমাকে কেউ স্বীকৃতি দেবে কি না দেবে
সে-কথা আমার জানা নেই-
কিন্তু আমার এই কবিতাটির নিবিড় উষ্ণতার মধ্যে
প্যালেস্টাইন তোমার স্বাধীনতার চিরকালীন স্বীকৃতি
লেখা রইলো;
আমি জানি জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতির সনদপত্রের চাইতেও
এই ভালোবাসার স্বীকৃতি অনেক বেশি মূল্যবান!
তাই তোমাদের জন্য বাড়িয়ে দিচ্ছি বাংলাদেশের
সবুজ মাঠের বিশাল হাতছানি,
ভাটিয়ালি গানের ব্যঞ্জনা
আর পৃথিবীর একই আকাশের অভিন্নতার সাথে
আমার এই কবিতার রক্তিম অভিনন্দন।