একুশের কবিতা
ভিতরমহলে খুব চুনকাম, কৃষ্ণচূড়া
এই তো ফোটার আয়োজন
বাড়িঘর কী রকম যেন তাকে হলুদ অভ্যাসবশে চিনি,
হাওয়া একে তোলপাড় করে বলে, একুশের ঋতু!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার সময় সমস্ত রঙ মনে পড়ে, সূর্যাস্তের
ন্নি সরলতা
হঠাৎ আমারই জামা সূর্যাস্তের রঙে ছেয়ে যায়,
আর আমার অজ্ঞাতে কারা আর্তনাদ করে ওঠে রক্তাক্ত রক্তিম
বলে তাকে!
আমি পুনরায় আকাশখানিরে চেয়ে দেখি
নক্ষত্রপুঞ্জের মৌনমেলা,
মনে হয় এঁকেবেঁকে উঠে যাবে আমাদের
ছিন্নভিন্ন পরাস্ত জীবন,
অবশেষে বহুদূরে দিগন্তের দিকচিহ্ন মুছে দিয়ে
ডাক দেবে আমরাই জয়ী!
তোমরা কি জানো
তোমরা কি জানো এ শহর কেন হঠাৎ এমন
মৌনমিছিলে হয়ে ওঠে ভারী, অশ্রুসিক্ত? কেন
বয়ে যায় শোকার্ত মেঘ আর থোকা থোকা শিশিরবিন্দু
পথে কেন এতো কৃষ্ণচূড়ার গাঢ় সমাবেশ; আমি জানি এতো
মেঘ নয়, নয় শীতের শিশির; প্রিয়হারা এ যে
একুশে রাজপথ জুড়ে এতো রঙিন আল্পনা আঁকা
তোমরা কি জানো সে তো নয় কোনো রঙ ও তুলির ব্যঞ্জনা কিছু
এই আল্পনা, পথের শিল্প শহীদেরই তাজা রক্তের রঙ মাখা!
তোমার জন্য
তোমার জন্য জয় করেছি একটি যুদ্ধ
একটি দেশের স্বাধীনতা,
তোমার হাসি, তোমার মুখের শব্দগুলি
সেই নিরালা দূর বিদেশে আমার ছিলো
সঙ্গী এমন,
অস্ত্র কিংবা যুদ্ধজাহাজ ছিলো না তো সেসব কিছুই
ছিলো তোমার ভালোবাসার রাঙা গোলাপ
আমার হাতে
ছিলো তোমার খোঁপা থেকে মধ্যরাতে খুলে নেয়া
ভালোবাসার সবুজ গ্রেনেড, গুপ্ত মাইন
স্বর্ণচাপা কিংবা ছিলো বক্ষ থেকে তুলে নেয়া
তোমার ভালোবাসার দেশে আমি স্বাধীন
পরাক্রান্ত।
আমার কাছে ছিলো তোমার ভালোবাসার নীল অবরোধ
তোমার জন্য জয় করেছি একটি যুদ্ধ
একটি দেশের স্বাধীনতা!
তোমার বাড়ি
এই বাড়িটি একলা বাড়ি কাঁপছে এখন চোখের জলে
ভালোবাসার এই বাড়িতে তুমিও নেই, তারাও নেই!
এই বাড়িটি সন্ধ্যা-সকাল তাকিয়ে আছে নগ্ন দুচোখ
একলা বাড়ি ধূসর বাড়ি তোমার স্মৃতি জড়িয়ে বুকে
অনাগত ভবিষ্যতের দিকেই কেবল তাকিয়ে থাকে,
কেউ জানে না এই বাড়িটি ঘুমায় কখন, কখন জাগে
স্তব্ধ লেকের কান্নাভেজা এই বাড়িটি রক্তমাখা!
এই বাড়িতে সময় এসে হঠাৎ কেমন থমকে আছে
এই বাড়িটি বাংলাদেশের প্রাণের ভিতরমর্মরিত,
এই বাড়িতে শহীদমিনার, এই বাড়িতে ফেব্রুয়ারি
এই বাড়িটি স্বাধীনতা, এই বাড়িটি বাংলাদেশ
এই বাড়িটি ধলেশ্বরী, এই বাড়িটি পদ্মাতীর
এই বাড়িটি শেখ মুজিবের, এই বাড়িটি বাঙালীর!
নববর্ষের চিঠি
এবারও তেমনি শেষ চৈত্রের খর নিঃশ্বাসে
নতুন বছর আসবে হয়তো; কিন্তু তুমি কি জানো
এদেশে কখন আসবে নতুন দিন? কখন উদ্দীপনা
অবসাদ আর ব্যর্থতাকেই দেবে নিদারুণ হানা
ছড়াবে হৃদয়ে আগামীর গাঢ় রঙ, ভাসাবে
মেঘের দূর নীলিমায় স্বপ্নের সাম্পান?
বলো না কখন এই ক্ষীণ হাতে ঘুরবে যুগের চাকা
কখন সত্যি নতুন বছরে আসবে নতুন দিন,
তুলবে তাদের গর্বিত মাথা আজ যারা নতজানু
এই প্রাসাদে ও অট্টালিকায় উড়বে তাদেরই নাম?
বলো না কখন ফুটবে গোলাপ গোলাপের চেয়ে বড়ো
কখন মানুষ পাবে এই দেশে শস্যের অধিকার
নতুন বছরে সেই অনাগত নতুনের প্রত্যাশা
বন্ধু, তোমাকে নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ!
ফিরে আসা গ্রাম
এই গ্রাম প্রতিরাতে হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমাকে
উৎকন্ঠিতা প্রেমিকার মতো
কানে কানে শোনাতো কাহিনী,
যুদ্ধক্ষেত্রে মধ্যরাতে কখনো হঠাৎ
স্বদেশ-স্বজনহারা কান্নায় ভরে যেতো বুক
আমার দুঃখিনী গ্রাম কিছুতেই তোমাকে পারিনি ভুলে যেতে;
এই গ্রাম, লতাগুল্ম-আচ্ছাদিত শৈশবের স্মৃতি
অকস্মাৎ মধ্যরাতে ডাকতো আমাকে মৌনস্বরে,
হয়তো তখন আমি শত্রুর সতর্ক গতিবিধি লক্ষ্য করে
ছুঁড়ছি গ্রেনেড, পাতছি মাইন ব্রিজে, কালভার্ট করছি বিলোপ,
কিংবা রয়েছি লুকিয়ে আমি পার্শ্ববর্তী ঝোপে
ওদিকে দাগছে কামান শত্রুসেনা
ক্রলিংরত আমরা তখন তবু ভাবছি তোমারই কথা-
মাথার ওপর শত্রুর বিমান ক্রমাগত দিচ্ছে চকাকর
সেই মধ্যরাতে, এই গ্রাম ডাকতো আমাকে ফিরে যেতে,
রাত্রির নির্জন চাঁদ ভেঙে যেতো জঙ্গীবিমানের শব্দে
সেই অন্ধকারে বসে শুনতাম গ্রামের লিরিক
যেন ভাসতাম স্নেহময়ী জননীর কোলে,
মৃত দিদিমার সান্ধ্য গল্পের আসরে।
কোথায় সে গ্রাম, সবুজচিত্রিত গাছপালা
মাটির নির্মিত বাড়ি, কাঁসার বাসন,
চাল-ডাল-নুন-মরিচের হাটখোলা?
এই কি আমার গ্রাম, মধ্যরাতে যে আমাকে
করতো উন্মন, গাঢ়স্বরে ডাকতো আমার নাম ধরে?
এই কি আমার গ্রাম নরকঙ্কালের অস্থিমালা পরিহিত মাটি,
আমার গ্রাম কি এই ধ্বংসের স্বাক্ষর
বয়ে খাঁটি বধ্যভূমি?
স্বপ্নপ্রোথিত সত্তা
আমার স্বপ্নকে কারা রাত্রিদিন এমন পাহারা দিয়ে ফেরে
মনে হচ্ছে এই একগুচ্ছ স্বপ্নকে নিয়ে তারা অধিক চিন্তিত
শলা-পরামর্শে ব্যস্ত, গেরিলারও চেয়ে বেশি ভীত
আমার স্বপ্নকে নিয়ে তারা;
মাইনেরও চেয়ে বেশি ক্ষতিকর একগুচ্ছ সোনালি স্বপ্নের ডালপালা
তাই তারা সর্বদা শঙ্কিত এই বক্ষলগ্ন স্বর্ণচাঁপাগুলিকে নিয়েই।
তারাও কি জানে এই স্বপ্নগুচ্ছ হয়তো একদা নকশীকাঁথার মতো
দেশজুড়ে আঁকবে একটি নাম, তৃণগুল্ম ধীরে ধীরে হবে সেই
স্বপ্নের আহার
মেঘে মেঘে নবীন মল্লার বুনে দিয়ে আসবে গোপনে
নক্ষত্রপুঞ্জের খোলা বিশাল তোরণ অনায়াসে করবে রচনা,
আমার স্বপ্নকে তাই রাত্রিদিন এমন করছে কেউ তাড়া
মাঝে মাঝে হঠাৎ চড়াও হয়ে করছে প্রবল আক্রমণ
আমার স্বপ্নকে নিয়ে মনে হয় ওরা আজ সর্বাধিক ভীত।
ওরাও কি জানে এই স্বপ্নের ভিতর রাবণের মৃত্যুবরণ লুক্কায়িত
আছে
এই শাদামাঠা স্বপ্নের ভিতরে জ্যোতিমৃয় ভবিষ্যৎ
আছে মুখ গুঁজে
কি রঙমহল, মিনার, গম্বুজ, পাথরের প্রাণবন্ত পাখি
প্রজ্বলিত প্রকোষ্ঠে কোথাও দাউ দাউ দরুণ আগুন
এই স্বপ্নের ভিতরে কী যে রৌদ্রকরোজ্জ্বল সবুজাভ দিন
আর কি জেনেছে তাও? তাই আমার স্বপ্নের পিছে
লেলিয়ে দিয়েছে এতো সশস্ত্র প্রহরী
বুটের আওয়াজ ঘন ঘন কানে এলে যাতে এই
স্বপ্ন অন্তর্হিত হয়;
কিন্তু ওরা তো জানে না এই স্বপ্নকে আমি কতোদিন
শত্রু ছাউনির পাশে রেখে
কতোদিন সশব্দ কামানের মুখে ফেলে
কতোদিন যুদ্ধের মহড়া দিয়ে তাকে করেছি প্রস্তত এতোখানি।
আমার স্বপ্ন তো আজ নিজেই সইতে পারে
সব শোকাবহ ঘটনার বেগ, বিদ্যুৎ কি অগ্নির ছোবল
আমার স্বপ্নের মধ্যে কখন ঢুকেছে এই
বিশাল বেদনা
তাই তাকে দিয়েছে ব্যঞ্জনা সেই একটি নামের
স্বপ্নেরও অধিক সেই স্বপ্নভেদী নাম,
স্বপ্ন ভেদ করে আমার হৃদয়ও ভেদ করে সেই মৌন মগ্ন এপিটাফ!