কত সে জনম কত সে লোক
দুর্গা-মান্দ – দাদরা
কত সে জনম কত সে লোক
পার হয়ে এলে হে প্রিয় মোর।
নিভে গেছে কত তপন চাঁদ
তোমারে খুঁজিয়া হে মনোচোর॥
কত গ্রহে, প্রিয়, কত তারায়
তোমারে খুঁজিয়া ফিরেছি, হায়!
চাহো এ নয়নে, হেরিবে তায়
সে দূর স্মৃতির স্বপন-ঘোর॥
হারাই হারাই ভয় সদাই
বুকে পেয়ে বুক কাঁপে গো তাই,
বারে বারে মালা গাঁথিতে চাই
বারে বারে ছিঁড়ে মিলন-ডোর॥
মিলনের ক্ষণ স্বপন প্রায়
হে প্রিয়, চকিতে মিলায়ে যায়,
শুকাল না মোর আঁখি-পাতায়
চির-অভিশাপ নয়ন-লোর॥
আজও অপূর্ণ কত সে সাধ,
অভিমানী, তাহে সেধো না বাদ!
না মিটিতে সাধ, স্বপন-চাঁদ,
মিলনের নিশি কোরো না ভোর॥
কহ প্রিয়ে, কেমন এ রাতি কাটাই
পিলু – দাদরা
কহ প্রিয়ে, কেমন এ রাতি কাটাই।
কহিতে শরমে বাধে, তামুক যে নাই॥
প্রাণ করে আঁকুপাঁকু,
কোথায় গেলে পাই তামাকু,
পেটে যেন চলে মাকু
বুক করে আইঢাই।
তামাকু যে নাই॥
বসে আছি নইচে ধরে
শূন্য কলকে শূন্যে তুলে,
ধোঁয়া বিনে চোঁয়া ঢেকুর
ঠেলে ওঠে কণ্ঠ-মূলে।
প্রাণের দায়ে খেতে হবে
চেঁছে হুঁকোর কাই।
তামাকু যে নাই॥
হুঁকোর জলের গন্ধ শুঁকে
কোনোরূপে কাটত এ-রাত
ছুঁচো তাড়াইতে তাহাও
শেষ করেছ, হায় রে বরাত!
গুল থাকলেও হত উপায়,
দাঁত মেজেছ তাই দিয়ে, হায়!
রংপুরে তোমার বাড়ি ভেবেও শান্তি পাই॥
কাহার তরে হায় নিশিদিন কাঁদে মন প্রাণ
ভৈরবী মিশ্র – কারফা
কাহার তরে হায় নিশিদিন কাঁদে মন প্রাণ
জানে শুধু সেই, জানে আর হৃদি ব্যথা-ম্লান॥
কমল-পাতে যেন জল প্রণয় তার সই
বুলবুলি চপল ছলে যায় লতিকা-বিতান॥
জানে শুধু সে নিতে মন, দিতে জানে না,
দলিয়া চলে সে মুকুল, বারণ মানে না।
জীবন লয়ে খেলে সে মরণ-খেলা,
সকালে যারে চাহে তায় বিকালে হেলা।
কুসুম-সমাধি রচে সে নিঠুর পাষাণ॥
চাহি শুধু এই–যেন সে বাসিয়া ভালো
এমনই ব্যথা পায় সে ওগো ভগবান॥
কুঁচ-বরন কন্যা রে তার মেঘ-বরন কেশ
ভাটিয়ালি – কারফা
কুঁচ-বরন কন্যা রে তার মেঘ-বরন কেশ।
আমায় লয়ে যাও রে নদী সেই সে কন্যার দেশ॥
পরনে তার মেঘ-ডম্বুর উদয়-তারার শাড়ি,
রূপ নিয়ে তার চাঁদ-সুরুযে করে কাড়াকাড়ি,
আমি তারই লাগি বিবাগি ভাই,
আমার চির-পথিক বেশ॥
পিছলে পড়ে চাঁদের কিরণ নিটোল তারই গায়ে,
সন্ধ্যা সকাল আসে তারই আলতা হতে পায়ে।
সে রয় না ঘরে, ঘুরে বেড়ায় ময়নামতীর চরে,
তারে দেখলে মরা বেঁচে ওঠে, জ্যান্ত মানুষ মরে,
তোর জল-তরঙ্গে বাজে রে তার সোনার চুড়ির রেশ॥
কে দুয়ারে এলে মোর তরুণ ভিখারি
পিলু – আদ্ধা কাওয়ালি
কে দুয়ারে এলে মোর তরুণ ভিখারি
কী যাচে ও আঁখি বুঝিতে যে নারি॥
হৃদি প্রাণ মন
বিভব রতন
ডারিনু চরণে, লহো পথচারী॥
দুয়ারে মোর নিতি গেয়ে যাও যে গীতি
নিশিদিন বুকে বেঁধে তারইস্মৃতি,
কী দিয়ে ব্যথা নিবারিতে পারি॥
মিলন বিরহ
যা চাও প্রিয় লহো,
দাও ভিখারিনি-বেশ
দাও ব্যথা অসহ,
মোর নয়নে দাও তব নয়ন-বারি॥
কে পাঠালে লিপির দূতী
ঝিঁঝিট-খাম্বাজ – দাদরা
কে পাঠালে লিপির দূতী
গোপন লোকের বন্ধু গোপন।
চিনতে নারি হাতের লেখা
মনের লেখা চেনে গো মন॥
গান গেয়ে যাই আপন মনে
সুরের পাখি গহন বনে,
সে সুর বেঁধে কার নয়নে
জানে শুধু তারই নয়ন॥
কে গো তুমি গন্ধ-কুসুম,
গান গেয়ে কি ভেঙেছি ঘুম,
তোমার ব্যথার নিশীথ নিঝুম
হেরে কি মোর গানের স্বপন॥
নাই ঠিকানা নাই পরিচয়
কে জানে ও মনে কী ভয়,
গানের কমল ও চরণ ছোঁয়
তাইতে মানি ধন্য জীবন॥
সুরের গোপন বাসর-ঘরে
গানের মালা বদল করে
সকল আঁখির অগোচরে
না দেখাতে মোদের মিলন॥
কেরানি আর গোরুর কাঁধ
জংলা – কারফা
কেরানি আর গোরুর কাঁধ
এই দুই-ই সমান দাদা।
এক নাগাড়ে জোয়াল বাঁধা
টানছে খেয়ে নুন আদা॥
দুইজনে যা জাবনা পায়
দশগুণ তার নাদনা খায়,
হটর হটর টানছে গাড়ি
মানে নাকো জল কাদা॥
দুইজনাতে কথায় কথায়
পাঁচন-গুঁতো ন্যাজমলা খায়,
ছ্যাকড়াটানে বোঝাও বহে
কভু ঘোড়া কভু গাধা॥
বড়ো সায়েব আর গাড়োয়ান
দুই স্যাঙাতই এক সমান,
হতে নাহি পারে হবেও নাকো
এমন সম্বন্ধ পাতান,
গরিবের বউ বউদি সবার
বলে নে বাপ, নেই বাধা॥
খ্যাপা হাওয়াতে মোর আঁচল উড়ে যায়
খাম্বাজ-পিলু – দাদরা
খ্যাপা হাওয়াতে মোর আঁচল উড়ে যায়।
চলিতে নারি পথে দাঁড়ায়ে নিরুপায়॥
খুলে পড়ে গো বাজুবন্দ ধরিতে আঁচল,
কোন ঘূর্ণি বাতাস এল ছন্দ-পাগল,
লাগে নাচের ছোঁয়া দেহের কাচ-মহলায়।
হয়ে পায়েলা উতলা সাধে ধরিয়া পায়॥
খুলিয়া পড়ে খোঁপা, কবরী ফুলহার,
হাওয়ার রূপে গো এল কি বঁধু আমার,
এমনই দুরন্ত আদর সোহাগ তার,
এ কী পুলক-শিহরণে পরান মুরছায়॥
গানগুলি মোর আহত পাখির সম
গানগুলি মোর আহত পাখির সম
লুটাইয়া পড়ে তব পায় প্রিয়তম।।
বাণ বেধা মোর গানের পাখিরে
তু’লে নিও প্রিয় তব বুকে ধীরে,
লভিবে মরণ চরণে তোমার
সুন্দর অনুপম।।
তারা সুখের পাখায় উড়িতেছিল গো নভে,
তব নয়ন শায়কে বিঁধিলে তাহাদের কবে।
মৃত্যু আহত কন্ঠে তাহার
একি এ গানের জাগিল জোয়ান,
মরণ বিষাদে অমৃতের স্বাদ
আনিলে বিষাদ মম।।
(ভৈরবী–একতালা)
গেরুয়া-রং মেঠো পথে বাঁশরি বাজিয়ে কে যায়
বাউল – নবতাল
গেরুয়া-রং মেঠো পথে বাঁশরি বাজিয়ে কে যায়।
সুরের নেশায় নুয়ে পড়ে ভুঁই-কদম তার পায়ে জড়ায়॥
সুর শুনে তার সাঁঝের ঠোঁটে,
বাঁকা শশীর হাসি ফোটে
গো-পথ বেয়ে ধেনু ছোটে
রাঙা মাটির আবির ছড়ায়॥
গগন-গোঠে গ্রহ তারা
সে সুর শুনে দিশাহারা,
হাটের পথিক ভেবে সারা
ঘরে ফেরার পথ ভুলে যায়॥
জল নিতে নদীকূলে
কুলবালা কুল ভুলে,
সন্ধ্যাতারা প্রদীপ তুলে
বাঁশুরিয়ার নয়নে চায়॥