আমার নয়নে নয়ন রাখি
মালবশ্রী মিশ্র – কারফা
আমার নয়নে নয়ন রাখি
পান করিতে চাও কোন অমিয়।
আছে এ আঁখিতে উষ্ণ আঁখিজল
মধুর সুধা নাই পরান-প্রিয়॥
ওগো ও শিল্পী, গলাইয়া মোরে
গড়িতে চাহ কোন মানস-প্রতিমারে,
ওগো ও পূজারি, কেন এ আরতি
জাগাতে পাষাণ-প্রণয়-দেবতারে।
এ দেহ-ভৃঙ্গারে থাকে যদি মদ
ওগো প্রেমাস্পদ, পিয়ো গো পিয়ো॥
আমারে করো গুণী, তোমার বীণা,
কাঁদিব সুরে সুরে কণ্ঠ-লীনা,
আমার মুখের মুকুরে কবি
হেরিতে চাহো কোন মানসীর ছবি।
চাহো যদি–মোরে করো গো চন্দন
তপ্ত তনু তব শীতল করিয়ো॥
আমার শ্যামলা বরন বাংলা মায়ের
খাম্বাজ মিশ্র – দাদরা
আমার শ্যামলা বরন বাংলা মায়ের
রূপ দেখে যা, আয় রে আয়।
গিরি-দরি-বনে মাঠে-প্রান্তরে রূপ ছাপিয়া যায়॥
ধানের খেতে বনের ফাঁকে
দেখে যা মোর কালো মাকে,
ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিণী বীণ বাজায়॥
ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিণী বীণ বাজায়॥
বিজন মাঠে গ্রাম সে বসায় নিয়ে কাদা খড় মাটি,
কাজল মেঘের ঝারি নিয়ে করুণা-বারি ছিটায়॥
কাজলা-দিঘির পদ্মফুলে যায় দেখা তার পদ্ম-মুখ,
খেলে বেড়ায় ডাকাত মেয়ে বনে লয়ে বাঘ ভালুক,
ঝড়ের সাথে নৃত্যে মাতে, বেদের সাথে সাপ নাচায়॥
নদীর স্রোতে পাথর নুড়ির কাঁকন চুড়ি বাজে তার,
দাঁড়ায় সাঁঝের অলিন্দে সে টিপ পরে সন্ধ্যা তারার,
উষার গাঙে ঘট ভরিতে যায় সে মেয়ে ভোর বেলায়॥
হরিৎ শস্যে লুটায় আঁচল ঝিল্লিতে নূপুর বাজে
ভাটিয়ালি গায় ভাটির স্রোতে, গায় বাউল মাঠের মাঝে,
গঙ্গা-তীরে শ্মশান-ঘাটে কেঁদে কভু বুক ভাসায়॥
আমার সোনার হিন্দুস্থান
পাহাড়ি মিশ্র – কারফা
আমার সোনার হিন্দুস্থান।
দেশ-দেশ-নন্দিতা তুমি বিশ্বের প্রাণ॥
ধরণির জ্যেষ্ঠা কন্যা তুমি আদি মাতা,
তব পুত্র গাহিল বেদ-বেদান্ত সাম-গাথা,
তব কোলে বারেবারে এল ভগবান॥
আদিম যুগের তুমি প্রথমা ধাত্রী,
তোমার আলোকে হল প্রভাত রাত্রি,
সবে বিলাইলে অমৃত সংগীত জ্ঞান॥
সোনার শস্যে তব ঝলমল বর্ণ
অন্তরে মাণিক্য-মণি-হিরা-স্বর্ণ,
তুমি বর্বরে করিয়াছ মানব মহান॥
হিংসা-দ্বেষ-ভোগ-ক্লান্ত এ বিশ্ব
আবার শিখিবে ত্যাগ, হবে তব শিষ্য,
তুমি বাঁচাবে সবারে করি অমৃত দান॥
আমার হরিনামে রুচি কারণ পরিনামে লুচি
কীর্তন
আমার হরিনামে রুচি কারণ পরিনামে লুচি
আমি ভোজনের লাগি করি ভজন।
আমি মালপোর লাগি তল্পি বাঁধিয়া
এ কল্প-লোকে এসেছি মন॥
‘রাধাবল্লভি’-লোভে পূজি রাধা-বল্লভে,
রস-গোল্লার লাগি আসি রাস-মোচ্ছবে!
আমার গোল্লায় গেছে মন রস-গোল্লায় গেছে মন!
ও তো রসগোল্লা কভু নয়
যেন ন্যাড়া-মাথা বাবাজি থালাতে হয়েন উদয়!
গজা দেখে প্রেম যে গজায় হৃদিতলে রে,
পানতোয়া দেখে প্রাণ নাচে হরি বলে রে!
ওই গোলগাল মোয়া মায়াময় এই সংসার দেয় ভুলিয়ে,
আর ক্ষীরের খোয়াতে খোয়াইতে কুল মন ওঠে চুলবুলিয়ে!
মন বলে হরি হরি হাত বলে হরো হে
অরসিকে তেড়ে আসে বলে ওহে ধরো হে!
সংসারেতে ভক্ত শুধু রাঁধুনি ও ময়রাই–
সেই দুই ভাই আজি এসেছে রে!
যারা ময়দা পেয়ে মালপো বিলোয়
সে দুই ভাই আজি এসেছে রে!
আমি চিনি মেখে গায়ে যোগী হব দাদা যাব ময়রার দেশে
রস- করার কড়াই-এ ডুবিয়া মরিব গলে সন্দেশ ঠেসে।
ভোজন-ভজহরির শোনো এই তথ্য
গো-ময় সংসারে ভোজনই সত্য॥
আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম
কীর্তন
আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম
কালারে কালো কালিন্দী-কূলে।
সে যে বাঁশরির তানে সকরুণ গানে
ডাকিল প্রেম-কদম্ব-মূলে।
তার সাগর-অতল ডাগর আঁখির কূলে
সে কী ঢেউ উঠিল দুলে॥
সখী সে কী সকরুণ আঁখি লো
ভয়- অনুরাগ-মাখামাখি লো,
তার অশ্রু-সজল আঁখি ছলছল
দূর মেঘপানে ডাকিল॥
কেন কলস ভরিতে গেনু যমুনা-তীরে,
মোর কলাসির সাথে গেল ভাসি লাজ-কুল-মান
আকুল নীরে।
কলসির জল মোর নয়নে ভরিয়া সই
আসিনু ফিরে॥
সখী লো, তোদের সে রাই নাই,
তোদের গোকুলের রাই গোকুলে নাই,
এ-কুলে নাই ও কুলে নাই।
গোকুলের রাই গোকুলে নাই।
সে যে হারাইয়া গেছে শ্যামের রূপে লো
নবীন নীরদে বিজলি-প্রায়।
সে রবি শশী সম ডুবিয়া গেছে লো
সুনীল রূপের গগন-গায়॥
হরি-চন্দন-পঙ্কে লো সখি
শীতল করে দে জ্বালা,
দুলায়ে দে গলে বল্লভ-রূপী
শ্যাম পল্লব-মালা!
নীল কমল আর অপরাজিতার
শেজ পেতে দে লো কোমল বিথার,
পেতে দে শয্যা পেতে দে,
নীল শয্যা পেতে দে পেতে দে!
মোর শ্যামের স্মৃতির নীল শিখী-পাখা,
চূড়া বেঁধে কেশে গেঁথে দে!
পরাইয়া দে লো সখী
অঙ্গে নীলাম্বরী,
জড়াইয়া কালো বরন
আমি যেন মরি॥
আমি দেখন-হাসি আমায় দেখলে পরে হাসতে হাসতে
বেহাগ মিশ্র – দাদরা
আমি দেখন-হাসি
আমায় দেখলে পরে হাসতে হাসতে
পেয়ে যাবে কাশি॥
আমি হাসির হাঁসলি ফিরি করি,
এলে আমার হাসির দেশে
বুড়োরা সব ছোঁড়া হয়, হেসে
ছোঁড়ারা যায় টেঁসে!
আমার হাঁস-খালিতে বাড়ি
আমি হাসনুহানার মাসি॥
এলে আমার হাসির হেঁসেলে,
তার হাঁসফাঁসানি লেগে
অন্তে শুধু দন্ত থাকে
শরীরটা যায় ভেগে!
আমি পাতিহাঁসির আন্ডা বেচি,
আর হাসির ময়দা থাঁসি॥
সেদিন পথে যাচ্ছিল সব রাজার হাতি উট
আমায় দেখে হাসতে হাসতে চোঁ চাঁ দিলে ছুট,
হেসে পালায় দড়ি ছিঁড়ে মটরু মিয়াঁর খাসি॥
আয় গোপিনী খেলবি হোরি
ধানী – হোরি
আয় গোপিনী খেলবি হোরি
ফাগের রাঙা পিচকারিতে।
আজ শ্যামে লো করব ঘায়েল
আবির হাসির টিটকারিতে।
রঙে রাঙা হয়ে শ্যাম আজ
হবে যেন রাই কিশোরী,
যমুনা-জল লাল হবে আজ
আবির ফাগের রঙে ভরি।
কপালের কলঙ্ক মোদের
ধুয়ে যাবে রং ঝারিতে॥
গুরুজনের গঞ্জনা আজ
সইব না লো মানব না লাজ,
কুল ভুলে আজ গোকুল পানে
ভেসে যাব রাঙা গীতে॥