রাজা-প্রজা
সাম্যের গান গাই
যেখানে আসিয়া সম-বেদনায় সকলে হয়েছি ভাই।
এ প্রশ্ন অতি সোজা,
এক ধরণির সন্তান, কেন কেউ রাজা, কেউ প্রজা?
অদ্ভুত দর্শন –
এই সোজা কথা বলি যদি ভাই, হবে তাহা সিডিশন!
প্রজা হয় শুধু রাজ-বিদ্রোহী, কিন্তু কাহারে কহি,
অন্যায় করে কেন হয় নাকো রাজাও প্রজাদ্রোহী!
প্রজারা সৃজন করেছে রাজায়, রাজা তো সৃজেনি প্রজা,
কৃতজ্ঞ রাজা তাই কি প্রজায় ধরে করে দিল খোজা?
বন্ধু হাসিছ চুটে,
আপনার ঘরে হয়ে আছি সব গোলাম নফর মুটে!
আপনার পুরুষত্ব অন্যে সঁপিয়া কী পেনু দাম?
আগলাতে রাজা-রাজ্য-হারেম হয়েছি খোজা গোলাম!
এ ব্যথা কাহারে কই,
যার ঘর তার ঘর নয় আর নেপো মারে এসে দই!
যাদের লইয়া রাজ্য, রাজ্যে নাই তাহাদেরই দাবি,
রাজা-দেবতার অনন্ত ভোগ, আমরা খেতেছি খাবি!
এ নিয়ে নালিশ কার কাছে করি, জয় রাজাজি কী জয়!
আমাদের হয় সুবিচার, নাই রাজারই বিচারালয়!
গুরু গুরু বাজে যুদ্ধ-ডঙ্কা, দলে দলে ছুটে ছেলে,
হেসে বুক চিরে কলসি কলসি তাজা খুন দিল ঢেলে।
কলিজা-ছিদ্রে দীর্ঘশ্বাস ফুঁ দিয়া বাজায় শাঁখ,
ঘরে ঘরে উঠে ক্রন্দন-উলু, চালে চালে ওড়ে কাক;
প্রস্তুত হল পথ –
বাজা শাঁখ বাজা, ওই দেখা জয়-লক্ষ্মীর রথ!
মাগো কাঁদ তোরা, আদুরি বোনেরা ধূলায় লুটায়ে পড়,
সিঁথায় সিঁদুর নাই দিলি বধূ, চল থেমে গেছে ঝড়।
ফেরেনি ছেলেরা ফেরেনি ভাইরা? ফেরোনিকো পতি? ওরে,
দুঃখ কী? ওরা স্থান পেয়েছে যে জয়-লক্ষ্মীর ক্রোড়ে!
আজিকে রাজ্যময়
শোকের তুফান ছাপাইয়া উঠে – জয় রাজাজি কী জয়!
বাজা রে ডঙ্কা বাজা –
এতদিন পরে কেল্লা ছাড়িয়া বাহির হয়েছে রাজা।
নিহত আহত বীরেরে মাড়ায়ে ছুটেছে রাজার রথ,
যুদ্ধ-ফেরত খঞ্জ পঙ্গু পালা পালা ছাড় পথ!
বন্ধু এমনই হয় –
জনগণ হল যুদ্ধে বিজয়ী, রাজার গাহিল জয়।
প্রজারা জোগায় খোরাক-পোশাক, কী বিচার বলিহারি,
প্রজার কর্মচারী নন, তাঁরা রাজার কর্মচারী!
মোদেরই বেতন-ভোগী চাকরেরে সালাম করিব মোরা,
ওরে ‘পাবলিক সারভেন্ট’দেরে আয় দেখে যাবি তোরা!
কালের চরকা ঘোর,
দেড়শত কোটি মানুষের ঘাড়ে – চড়ে দেড়শত চোর।
এ আশা মোদের দুরাশাও নয়, সেদিন সুদূরও নয় –
সমবেত রাজ-কণ্ঠে যেদিন শুনিব প্রজার জয়!
সাম্য
গাহি সাম্যের গান –
বুকে বুকে হেথা তাজা সুখ ফোটে, মুখে মুখে তাজা-প্রাণ!
বন্ধু, এখানে রাজা-প্রজা নাই, নাই দরিদ্র-ধনী,
হেথা পায় নাকো কেহ খুদ-ঘাঁটা, কেহ দুধ-সর-ননী।
অশ্ব-চরণে মোটর-চাকায় প্রণমে না হেথা কেহ,
ঘৃণা জাগে নাকো সাদাদের মনে দেখে হেথা কালা-দেহ।
সাম্যবাদী-স্থান
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গির্জা-ঘর,
নাইকো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশ্ত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই!
নেইকো এখানে ধর্মের ভেদ শাস্ত্রের কোলাহল,
পাদরি-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
হেথা স্রষ্টার ভজনা-আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুখের সিংহাসন!
সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে-নামে যে-কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে-নামে ডাকে সে মাকে!
পায়জামা প্যান্ট ধুতি নিয়া হেথা হয় নাকো ঘুঁষোঘুঁষি,
ধুলায় মলিন দুখের পোশাকে এখানে সকলে খুশি।
সাম্যবাদী
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, য্ত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!
বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।