ছাত্রদলের গান
আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান
উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই
বিষম চলার ঘায়!
যুগে-যুুগে রক্তে মোদের
সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদরে কক্ষচ্যুত ধুমকেতু-প্রায়
লক্ষহারা প্রাণ,
আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর
নিত্য বলিদান।
যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন,
আমরা পশি নীল অতল,
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা ধরি মৃত্যু-রাজার
যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
জীবন-ইতিহাস!
হাসির দেশে আমরা আনি
সর্বনাশী চোখের জল।
আমরা ছাত্রদল।।
সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়,
আমরা করি ভুল।
সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
আমরা ভাঙি কূল।
দার”ণ-রাতে আমরা তর”ণ
রক্তে করি পথ পিছল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল
বক্ষে ভরা বাক্,
কন্ঠে মোদের কুন্ঠ বিহীন
নিত্য কালের ডাক।
আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি
সরস্বতীর শ্বেত কমল।
আমরা ছাত্রদল।।
ঐ দারুণ উপপ্লাবের দিনে
আমরা দানি শির,
মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
বিংশ শতাব্দীর!
মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে
ভ’রেছি মা’র শ্যাম আঁচল।
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা রচি ভালোবাসার
আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়
আকাশ-ছায়াপথ!
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
আমরা ছাত্রদল।।
ধীবরদের গান
আমরা নীচে পড়ে রইব না আর
শোন রে ও ভাই জেলে,
এবার উঠব রে সব ঠেলে!
ওই বিশ্ব-সভায় উঠল সবাই রে,
ওই মুটে মজুর হেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আজ সবার গায়ে লাগছে ব্যথা
সবাই আজই কইছে কথা রে,
আমরা এমনি মরা, কই নে কিছু
মড়ার লাথি খেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আমরা মেঘের ডাকে জেগে উঠে
পানসিতে পাল তুলি।
আমরা ঝড়-তুফানে সাগর-দোলার
নাগরদোলায় দুলি।
ও ভাই আকাশ মোদের ছত্র ধরে
বাতাস মোদের বাতাস করে রে।
আমরা সলিল অনিল নীল গগনে
বেড়াই পরান মেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
হায় ভাই রে, মোদের ঠাঁই দিল না
আপন মাটির মায়ে
তাই জীবন মোদের ভেসে বেড়ায়
ঝড়ের মুখে নায়ে।
ও ভাই নিত্য-নূতন হুকুম জারি
করছে তাই সব অত্যাচারী রে,
তারা বাজের মতন ছোঁ মেরে খায়
আমরা মৎস্য পেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আমরা তল করেছি কতই সে ভাই
অথই নদীর জল,
ও ভাই হাজার করেও ওই হুজুরদের
পাইনে মনের তল।
আমরা অতল জলের তলা থেকে
রোহিত-মৃগেল আনি ছেঁকে রে,
এবার দৈত্য-দানব ধরব রে ভাই
ডাঙাতে জাল ফেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আমরা পাথর-জলে ডুব-সাঁতার দিই
মরেও নাহি মরি,
আমরা হাঙর-কুমির-তিমির সাথে
নিত্য বসত করি।
ও ভাই জলের কুমির জয় করে কি
কুমির হল ঘরের ঢেঁকি রে,
ও ভাই মানুষ হতে কুমির ভালো
খায় না কাছে পেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
ও ভাই আমরা জলে জাল ফেলে রই,
হোথা ডাঙার পরে
আজ জাল ফেলেছে জালিম যত
জমাদারের চরে।
ও ভাই ডাঙার বাঘ ওই মানুষ-দেশে
ছেলে-মেয়ে ফেলে এসে রে,
আমরা বুকের আগুন নিবাই রে ভাই,
নয়ন-সলিল ঢেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
ও ভাই সপ্ত লক্ষ শির মোদের ভাই
চৌদ্দ লক্ষ বাহু,
ওরে গ্রাস করেছে তাদের ভাই আজ
চৌদ্দজনা রাহু।
যে চৌদ্দ লক্ষ হাত দিয়ে ভাই
সাগর মথে দাঁড় টেনে যাই রে,
সেই দাঁড় নিয়ে আজ দাঁড়া দেখি
মায়ের সাত লাখ ছেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
ও ভাই আমরা জলের জল-দেবতা,
বরুণ মোদের মিতা,
মোদের মৎস্যগন্ধার ছেলে ব্যাসদেব
গাইল ভারত-গীতা।
আমরা দাঁড়ের ঘায়ে পায়ের তলে
জলতরঙ্গ বাজাই জলে রে,
আমরা জলের মতন জল কেটে যাই,
কাটব দানব পেলে
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
অ আমরা খেপলা জাল আর ফেলব না ভাই,
একলা নদীর তীরে,
আয় এক সাথে ভাই সাত লাখ জেলে
ধর বেড়াজাল ঘিরে।
ওই চৌদ্দ লক্ষ দাঁড় কাঁধে ভাই
মল্লভূমির মল্ল-বীর আয়রে,
ওই আঁশ-বটিতে মাছ কাটি ভাই,
কাটব অসুর এলে!
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
কৃষ্ণনগর
২৪ ফাল্গুন, ১৩৩২
প্রার্থনা
[গান]
এসো যুগ-সারথি নিঃশঙ্ক নির্ভয়।
এসো চির-সুন্দর অভেদ অসংশয়।
জয় জয়।
জয় জয়।
এসো বীর অনাগত
বজ্র-সমুদ্যত।
এসো অপরাজেয় উদ্ধত নির্দয়।
জয় জয়।
জয় জয়।
হে মৌনী জন-গণ-
বেদনা-বিমোচন-
যুগ-সেনানায়ক! জাগো জ্যোতির্ময়।
জয় জয়।
জয় জয়।
ওঠে ক্রন্দন ওই,
এসো বন্ধন-জয়ী।
জাগে শিশু, মাগে আলো, এসো অরুণোদয়।
জয় জয়।
জয় জয়।
কলিকাতা
১ আশ্বিন ১৩৩২
ফরিয়াদ
এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান
মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান!-
আমার আঁখির দুখ-দীপ নিয়া
বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া,
যতটুকু হেরি বিস্ময়ে মরি, ভ’রে ওঠে সারা প্রাণ!
এত ভালো তুমি? এত ভালোবাসা? এত তুমি মহীয়ান্?
ভগবান! ভগবান!
তোমার সৃষ্টি কত সুন্দর, কত সে মহৎ, পিতা!
সৃষ্টি-শিয়রে ব’সে কাঁদ তবু জননীর মতো ভীতা!
নাহি সোয়াসি-, নাহি যেন সুখ,
ভেঙে গড়ো, গড়ে ভাঙো, উৎসুক!
আকাশ মুড়েছ মরকতে-পাছে আঁখি হয় রোদে ম্লান।
তোমার পবন করিছে বীজন জুড়াতে দগ্ধ প্রাণ!
ভগবান! ভগবান!
রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে-
‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।
এই ধরণীর যাহা সম্বল,-
বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল,
সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখীর কন্ঠে গান,-
সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!’
ভগবান! ভগবান!
শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।
আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ!
তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে
জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,
সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান।
সন-ান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান!
ভগবান! ভগবান!
তব কনিষ্ঠ মেয়ে ধরণীরে দিলে দান ধুলা-মাটি,
তাই দিয়ে তার ছেলেদের মুখে ধরে সে দুধের বাটি!
ময়ূরের মতো কলাপ মেলিয়া
তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া-
সন-ান তার সুখী নয়, তারা লোভী, তারা শয়তান!
ঈর্ষায় মাতি’ করে কাটাকাটি, রচে নিতি ব্যবধান!
ভগবান! ভগবান!
তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,
রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী!
মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া
রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া!
সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস’ান!
ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান!
ভগবান! ভগবান!
জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন-ান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,
মাটির মালিক তাঁহারাই হন-
যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান।
নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান।
ভগবান! ভগবান!
অন্যায় রণে যারা যত দড় তারা তত বড় জাতি,
সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি!
তোমার চক্র রুধিয়াছে আজ
বেনের রৌপ্য-চাকায়, কি লাজ!
এত অনাচার স’য়ে যাও তুমি, তুমি মহা মহীয়ান্ ।
পীড়িত মানব পারে না ক’ আর, সবে না এ অপমান-
ভগবান! ভগবান!
ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহি ক’ আর!
‘ মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে ‘মার মার!’
রক্ত যা ছিল ক’রেছে শোষণ,
নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ!
শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান-
‘ জয় নিপীড়িত জনগণ জয়! জয় নব উত্থান!
জয় জয় ভগবান!’
তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে কবির ভোগ,
এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ।
তাজা ফুল ফলে অঞ্চলি পুরে
বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে,
কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান?
আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ-
এতদিনে ভগবান!
যে-আকাশে হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা,
সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কা’রা?
উদার আকাশ বাতাস কাহারা
করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা?
তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান?
হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান?
ভগবান! ভগবান!
তোমার দত্ত হসে-রে বাঁধে কোন্ নিপীড়ন-চেড়ী?
আমার স্বাধীন বিচরণ রোধে কার আইনের বেড়ী?
ক্ষুধা তৃষা আছে, আছে মোর প্রাণ,
আমিও মানুষ, আমিও মহান্ !
আমার অধীনে এ মোর রসনা, এই খাড়া গর্দান!
মনের শিকল ছিঁড়েছি, পড়েছে হাতের শিকলে টান-
এতদিনে ভগবান!
চির-অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উ”চ শির।
বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর।
এতদিনে তার লাগিয়াছে ভালো-
আকাশ বাতাস বাহিরেতে আলো,
এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ।
মুক্ত-কন্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান-
জয় নিপীড়িত প্রাণ!
জয় নব অভিযান!
জয় নব উত্থান!