Site icon BnBoi.Com

শেষ সওগাত – কাজী নজরুল ইসলাম

শেষ সওগাত - কাজী নজরুল ইসলাম

 অমৃতের সন্তান

নীহারিকালোকে অনিমিখে চেয়ে আছেন বৈজ্ঞানিক,
কত শত নব সূর্য জনমি রাঙায় অজানা দিক!
আমি চেয়ে আছি তোদের পানে যে, ওরে ও শিশুর দল,
নূতন সূর্য আসিছে কোথায় বিদারিয়া নভোতল!
দিব্য জ্যোতির্দীপ্ত কত সে রবি শশী গ্রহ তারা
তোদের মাঝারে লভিয়া জনম ঘুরিতেছে পথহারা,
আত্মা আমার জেগে আছে যেন মেলি অনন্ত আঁখি,
মাহেন্দ্রক্ষণ উদয় উষার – আরও কতদিন বাকি?
জাগো অমৃতের সন্তান, জাগো বেদ-ভাষিণীর দল!
বিশ্বে ভোগের মন্থনে আজ উঠিয়াছে হলাহল।
অসুর-শক্তি শ্রান্ত হইয়া আজিকে আপন বিষে
ঊর্ধ্বে চাহিছে দেবতার পানে, জ্বালা জুড়াইবে কীসে।
আমি দেখিয়াছি, তোমাদের শুচি ক্ষুদ্র তনুর মাঝে
সেই ঊর্ধ্বের দিব্য শক্তি শান্তি অমৃত রাজে।
খোলো গুন্ঠন, ভোলো বন্ধন, ভাঙো ভবনের কারা,
বাহির ভুবনে আসিয়া দাঁড়াও, বাধাহীন ভয়হারা।
শোনো অমৃতের পুত্র! দুয়ারে দাঁড়ায়ে তোমার কাছে
জরাগ্রস্ত ভিখারি যযাতি নবযৌবন যাচে!
কুমারী উমার রূপে কতকাল অচল পিতার গেহে
হে মহাশক্তিরূপিণী শিবানী, বদ্ধ রহিবে স্নেহে?
হে মহাশক্তি, তোমারে হারায়ে পুরুষোত্তম শিব
পথের ভিখারি, মৃতের শ্মশানে হয়েছে ঘৃণ্য জীব!
কে বলে তোমরা বালক বালিকা? তোমরা ঊর্ধ্ব হতে
নামিয়া এসেছ শুদ্ধ শক্তি দিব্য জ্যোতিস্রোতে।
হৃদয়-কমণ্ডলু হতে তব অমৃতধারা ছিটাও,
ঈর্ষাক্লান্ত জর্জরিত এ বিশ্বে শান্তি দাও।
বাঁচাতে এসেছ, বাঁচিতে আসনি হেথা শুধু পশু সম,
তপস্যা ত্যাগে পুরুষ হেথায় হয় পুরুষোত্তম;
সংসারী হয়ে নারী এই দেশে হয় ঋষি বেদবতী,
আনো সেই আশা, শক্তি, ধরায় স্বর্গের সেই জ্যোতি।
দূর করো এই ভেদজ্ঞান, এই হানাহানি, মলিনতা,
আনো ধূর্জটি-জটা হতে তব জাহ্নবীর পবিত্রতা।…
প্রণাম-পুষ্পাঞ্জলি লয়ে আছি পূজারি বসিয়া একা,
তোমাদের সেই দিব্য স্বরূপে কবে পাব হায় দেখা!

 আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন

ঘুমাইয়া ছিল আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন,
বহু বৎসর মুখ চেপে ছিল পাষাণের আবরণ।
তার এ ঘুমের অবসরে যত ধনলোভী রাক্ষস
প্রলোভন দিয়ে করেছিল যত বুদ্ধিজীবীরে বশ।
অর্থের জাব খাওয়ায়ে তাদের বলদ করিয়ে শেষে
লুঠতরাজের হাট ও বাজার বসাইল সারা দেশে।
সেই জাব খেয়ে বুদ্ধিওয়ালার হইল সর্বনাশ,
‘শুদ্ধি স্বামী’ ও ‘বুদ্ধু মিয়াঁ-র হইল তাহারা দাস!
বুঝিল না, এই শুদ্ধি স্বামী ও বুদ্ধু মিয়াঁরা কারা
খাওয়ায় কাগুজে পুরিয়ায় পুরে এরাই আফিম, পারা!
সাত কোটি বাঙালির সাত জনে শুধু টাকা দিয়ে
দাস করে, এরা হল কোটিপতি বাঙালি রক্ত পিয়ে।
কাগুজে মগুজে ধূর্ত বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিবলে,
ছুরি আর লাঠি ধরাইয়া দিল বাঙালির করতলে।
জানে এরা ভায়ে ভায়ে হেথা যদি নাহি করে লাঠালাঠি,
কেমন করিয়া শাঁস শুষে খাবে, ইহাদের দিয়া আঁটি?
আঁটি খেয়ে যবে ভরে নাকো পেট, শূন্য বাটি ও থালা,
বাঙালি দেখিল এত পাট, ধান, মেটে না ক্ষুধার জ্বালা!
তখন বিরাট আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবনে
নাড়া দিয়া যেন জাগাইয়া দিল ঝঞ্জা প্রভঞ্জনে!
জেগে উঠে দেখে রক্তনয়নে আগ্নেয়গিরি একী!
ওরই ধান ওরই বুকে কুটিতেছে বিদেশি কল ও ঢেঁকি!
উহারই বিরাট অঙ্গে উঠেছে মিলের চিমনিরাশি,
উহারই ধোঁয়ায় ধোঁয়াটে হয়েছে আঁখির দৃষ্টি, হাসি।
এ কোন যন্ত্রদৈত্য আসিয়া যন্ত্রণা দেয় দেহে?
দাসদাসী হয়ে আছে নরনারী স্বীয় পৈতৃক গেহে।
একী কুৎসিত মূর্তিরা ফেরে আগুনের পর্বতে,
ক্যাঙালির মতো, বাঙালি কি ওরা – লেজ ধরে চলে পথে?
ভুঁড়ি-দাস আর নুড়ি-দাস যত মুড়ি খায় আর চলে,
যে-কথা উহারা বলাইতে চায়, চিৎকার করে বলে!
বিদারিত হল বহ্নিগিরির মুখের পাষাণভার,
কাঁপিয়া উঠিল লোভীর প্রাসাদ ভীম কম্পনে তার!
ক্রোধ হুংকার ওঠে ঘন ঘন প্রাণ-গহ্বর হতে,
‘লাভা’ ও অগ্নিশিখা উঠে ছুটে উর্ধ্ব আকাশপথে।

কই রে কই রে স্বৈরাচারীরা বৈরী এ বাংলার?
দৈন্য দেখেছ ক্ষুদ্রের, দেখনিকো প্রবলের মার!
দেখেছ বাঙালি দাস, দেখনিকো বাঙালির যৌবন,
অগ্নিগিরির বক্ষে বেঁধেছ যক্ষ তব ভবন!
হেরো, হেরো, কুণ্ডলী-পাক খুলি আগ্নেয় অজগর
বিশাল জিহ্বা মেলিয়া নামিছে ক্রোধ-নেত্র প্রখর।
ঘুমাইয়া ছিল পাথর হইয়া তার বুকে যত প্রাণ,
অগ্নিগোলক হইয়া ছুটিছে তিরবেগে সে পাষাণ!
নিঃশেষ করে দেবে আপনারে আগ্নেয়গিরি আজি,
ফুলঝুরি-সম ঝরিবে এবার প্রাণের আতসবাজি!
ঊর্ধ্বে উঠেছে ক্রুদ্ধ হইয়া অদেখা আকাশ ঘেরি ;
তোমাদের শিরে পড়িবে আগুন, নাই বেশি আর দেরি!
তোমাদের যন্ত্রের এই যত যন্ত্রণা-কারাগার
এই যৌবনবহ্নি করিবে পুড়াইয়া ছারখার।
সুতি ধুতিপরা দেখেছ বিনয়- নম্র বাঙালি ছেলে,
ঢল ঢল চোখ জলে ছলছল একটু আদর পেলে!
দুধ পায় নাই, মানুষ হয়েছে শুধু শাকভাত খেয়ে,
তবুও কান্তি মাধুরী ঝরিছে কোমল অঙ্গ বেয়ে।
তোমাদের মতো পলোয়ান নয়, নয় মাংসল ভারী,
ওরা কৃশ, তবু ঝকমক করে সুতীক্ষ্ণ তরবারি!
বঙ্গভূমির তারুণ্যের এ রঙ্গনাটের খেলা
বুঝেও বোঝেনি যক্ষ রক্ষ, বুঝিবে সে শেষ বেলা!

শাড়ি-মোড়া যেন আনন্দ-শ্রী দেখো বাংলার নারী,
দেখনি এখনও, ওঁরাই হবেন অসি-লতা তরবারি!
ওরা বিদ্যুল্লতা-সম, তবু ওরাই বজ্র হানে,
ওরা কোথা থাকে, তোমরা জান না, সাগর ও মেঘ জানে।
যুগান্তরের সূর্য যখন উদয়-গগনে ওঠে,
সূর্যের টানে ছুটে আসে মেঘ ; তাহারই আড়ালে ছোটে
ওরা যেন ভীরু পর্দানশীন! ওরাই সময় হলে
ঘন ঘন ছোঁড়ে অশনি অত্যাচারীর বক্ষতলে!
শ্যামবঙ্গের লীলা সে ভীষণ সুন্দর, রেখো জেনে,
বাঘের মতন নাগের মতন দেখি, যে বাঙালি চেনে!
তাদেরই জড়তা-পাষাণ টুটিয়া ঝরিছে অগ্নিশিখা,
কে জানে কাহার তকদীরে ভাই কী শাস্তি আছে লিখা!
ধোঁয়া দেখে যদি না নোয়াও মাথা, বছর খানিক বেঁচো!
দেখিবে হয়েছি ফেরেশতা মোরা, তোমরা হয়েছ কেঁচো!

আত্মগত

আর জিজ্ঞাসা করিব না কোনো কথা
আপনার মনে কয়ে যাব আমি আপন মনের ব্যথা।
ভোরের প্রথম-ফোটা ফুলগুলি গোপনে তুলিয়া আনি
অঞ্জলি দিতে তোমার দুয়ারে দাঁড়াই যুক্তপাণি।
আমার চেয়েও সকরুণ চোখে ফুলগুলি চেয়ে থাকে,
মোর সাথে ওরা তব পায়ে চাহে অর্পিতে আপনাকে, –
তব তনু হেরি ফুলগুলি যেন অধিক ফুল্ল হয়,
মনে ভাবে, ওই অঙ্গের সাথে কবে হবে পরিচয়!
তুমি দ্বিধাভরে যেন ভয়ে ভয়ে আস উহাদের কাছে!
ভাব বুঝি ওই ফুলের ঝাঁপিতে লোভের সাপিনি আছে!
মুখ ফুটে তাই বলিতে পার না, ‘ওই ফুলগুলি দাও।’
আমার গানের ফুলগুলি বোঝে, উহাদের ভয় পাও।
চেয়ে দেখি, হায়, বেদনায় মোর ফুল্ল ফুলের গুছি
সূর্যের নামে শপথ করিয়া কাঁদে – ‘শুচি মোরা শুচি।’
ছড়াইয়া দিই পথের ধুলাতে প্রেম-ফুল-অঞ্জলি,
‘দেখ সাপ নাই, নাই কাঁটা’ – আমি ফিরে যেতে যেতে বলি।
অবুঝ ভিখারি-মন যেতে যেতে পিছু ফিরে ফিরে চায় –
ছড়ানো একটি ফুল তুলে সে কি লুকাল এলো-খোঁপায়?
দূর হতে দেখে পাষাণ-মুরতি তেমনি দাঁড়ায়ে আছে,
ফুল এড়াইয়া চলে গেলে তুমি কলঙ্ক লাগে পাছে!
তোমার চলার পথে পড়ে যত এই পৃথিবীর ধূলি
তারও চেয়ে কি গো মলিনতা-মাখা আমার কুসুমগুলি?
ধুলায় তোমায় ভুলায় না পথ, পথ ভোলাবে কি ফুল?
ভয় পাও কি গো যদি শোনো পথে গাহে বন-বুলবুল?
তুমি শুনিলে না, তবু মোর কথা থামিতে চাহে না কেন?
তোমার ফুলের ফাল্গুন মাসে ঝোড়ো মেঘ আমি যেন!
তব ফুল-ভরা উৎসবে কেন জল ছিটিয়ে সে যায়
তব সাথে তার কোন সে জীবনে কোন যোগ ছিল, হায়!
ভয় করিয়ো না, মেঘ আসে – মেঘ শেষ হয়ে যায় গলে,
আমার না-বলা কথা বলা হলে আমিও যাইব চলে।
আমি জানি, এই ফাগুন ফুরাবে, খর-বৈশাখ এসে
কী যেন দারুণ আগুন জ্বালাবে তোমাদের এই দেশে।
ভালো লাগিবে না কিছু সেই দিন উৎসব হাসি গান,
ফাগুনে যে মেঘ এসেছিল, তার তরে কাঁদিবে গো প্রাণ।
ডাকিবে, ‘এসো হে ঘনশ্যাম বারিবাহ,
জ্বলে গেল বুক, জুড়াও জুড়াও দাহ।’

অভিমানী মেঘ সেদিন যদি গো নাহি আসে আর ফিরে,
যে সাগর থেকে মেঘ এসেছিল – যেয়ো সে সাগর তীরে।
তোমারে হেরিলে হয়তো আমার অভিমান যাব ভুলে,
তব কুন্তল-সুরভিতে সাড়া পড়িবে সাগরকূলে।
আমি উত্তাল তরঙ্গ হয়ে আছাড়ি পড়িব পায়ে,
জলকণা হয়ে ছিটায়ে পড়িব তব অঞ্চলে, গায়ে।
এই ভিখারির কথা শুনি আজ হাসিবে হয়তো প্রিয়া,
তবু বলি, তুমি কাঁদিয়া উঠিবে সাগর দেখিতে গিয়া।
মনে পড়ে যাবে, তোমার আকাশে মেঘ হয়ে কোনোদিন
কেঁদেছিল এই সাগর তোমারে ঘিরিয়া বিরামহীন।
তোমারে না পেয়ে শত পথ ঘুরে কেঁদে শত নদীনীরে
সাগরের জল সাগরে এসেছে ফিরে।
তোমারে সিনান করায়েছিল সে অমৃতধারার কূলে
ছেয়ে দিয়েছিল তোমার ভুবন বিহ্বল ফুলে ফুলে!
তব ফুলময় তনু লয়ে ওঠে বৃন্দাবনে যে গীতি,
তোমারে যে আজ নিবেদন করে ত্রিলোক শ্রদ্ধা প্রীতি।
মেঘ-ঘনশ্যাম কোনো বিরহীর স্মৃতি আছে তার সাথে,
মেঘ হয়ে কেঁদে এসেছিল, গেছে আঁধারে মিশায়ে রাতে।
‍সাগরে যেদিন ঝাঁপায়ে পড়িবে! তোমার পরশ পেয়ে
প্রলয়-সলিলে রূপ ধরে আমি উঠিব গোপনে গেয়ে!
আমার হৃদয় ছোঁয় যদি প্রিয়া তোমার তনুর মায়া,
পরম শূন্যে ভাসিয়া উঠিবে আবার আমার কায়া।
আজ চলে যাই – এই পৃথিবীরে আর লাগে নাকো ভালো।
হেথা মানুষের নিশ্বাসে নিভে যায় যে প্রেমের আলো!
সেদিন যেন গো দ্বিধা নাহি আসে
কোনো লোক যেন নাহি থাকে পাশে,
যে নামে আমারে ডাকিলে না আজ সেদিন ডেকো সে নামে
কী বলে ডাকিলে বেঁচে উঠি আমি শুধাইয়ো রাধা শ্যামে।

যে নিরাধার শ্যাম শ্রীরাধার প্রেমে
রূপ ধরে আসে পৃথিবীর বুকে নেমে,
যদি কোনো দিন দেখা পাও তার – মোর স্মৃতি থাকে মনে,
রোদনের বান আনে যদি তব প্রেমের বৃন্দাবনে,
‘কোথায় হারিয়ে গেছি আমি’ শুধায়ো নিরালা ডাকি,
খুঁজিয়া আনিবে হয়তো আমারে তাঁহার পরম আঁখি॥

আর কত দিন?

আর কত দিন?

প্রভু, আর কত দিন
তোমার প্রথম বেহেশ্‌ত পৃথিবী রহিবে গ্লানি-মলিন?
ধরার অঙ্ক পাপ-কলঙ্ক-পঙ্ক-লিপ্ত করি,
বরাহ মহিষ অসুর দানব ফিরিতেছে সঞ্চরি?
অত্যাচারীর মার খেয়ে মরে তব দুর্বল জীব,
যত খুন খায় তত বেড়ে যায় লোভী ও ভোগীর জিভ!
তোমার সত্য-পথভ্রষ্ট হয়েছে মানুষ ভয়ে,
আত্মা আত্মহত্যা করেছে অপমানে পরাজয়ে!
মনুষ্যত্ব মুমূর্ষ আজ, ক্লৈব্য কাপুরুষতা
পঙ্গু পাষাণ করেছে জীবন! – মালিন্য, দৈন্যতা,
হীন প্রবৃত্তি, চামচিকা-সম জীবনের পোড়া ঘরে
বাঁধিয়াছে বাসা! আশার আলোক জ্বলে নাকো অন্তরে।
প্রভু, আলো দাও, আলো!
ঘুচুক ভয়ের ভ্রান্তি, জড়তা, ঘন নিরাশার কালো।

প্রভু আর কত দিন
ধূর্তের কাছে বিশ্বাস সরলতা রবে দীন হীন?
স্বার্থান্বেষী চতুরের কাছে ‘সবর’ ধৈর্য আর,
ওগো কাঙালের পরম বন্ধু, কত দিন খাবে মার?
যত মার খায় তত তারা জপে নিত্য তোমার নাম,
আশ্রয় শুধু যাচে প্রভু তব! চায় না জপের দাস।
আশ্রয় দাও পূর্ণ পরম আশ্রয়দাতা স্বামী,
আশ্রয়হীনে রক্ষিতে তব শক্তি আসুক নামি।
শুনিয়াছি, তুমি নহ জালিমের, উৎপীড়কের নহ,
নির্যাতিত ও অসহায় যথা, তার দ্বারে জাগি রহ;
ডাকিনি বলিয়া অভিমানে বুঝি লও নাই প্রতিশোধ,
আপনার হাতে করেছি আপন ঘরের দুয়ার রোধ।

আর ভয় নাই, প্রভু, দ্বার খুলিয়াছি,
আঁধারে মরেছি তিলে তিলে, যদি আঁধারে আসিয়া বাঁচি।
তুমি কৃপা করো, ক্ষমা-সুন্দর, অপরাধ ক্ষমা করো,
আশ্রয় দাও দুর্বলে, উৎপীড়কেরে সংহারো।

অন্ধ বধির পথভ্রান্তে দেখাও তোমার পথ,
আমাদের ঘিরে থাকুক নিত্য তোমার অভয়-রথ!
পশ্চিমে তব শাস্তি নেমেছে, পূর্বে নামিল কই?
হে চির-অভেদ! আমরা কি তবে তোমার সৃষ্ট নই?
যে শাস্তি দাও পশ্চিমে, পুবে সে ভয় দাওনি প্রভু;
বিশ্বাস আর তব নাম লয়ে বেঁচে আছি মোরা তবু।
সব কেড়ে নিক অত্যাচারীরা, প্রভু গো দাও অভয়,
বিশ্বাস আর ধৈর্য ও তব নাম – যেন সাথি রয়।
এই বিশ্বাসে, তোমার নামের মহিমায় – ফিরে পাব
শান্তি, সাম্য। তব দাস মোর তব কাছে ফিরে যাব।
প্রেম, আনন্দ, মাধুরী ও রস পাব এই দুনিয়াতে,
তোমার বিরহে কাঁদিব আমরা জাগিয়া নিশীথ রাতে।
বলো প্রেমময়, বলো হে পরম সুন্দর, বলো প্রভু,
অন্ধ জীবের এই প্রার্থনা মিথ্যা হবে না কভু!
তুমি বল দাও, তুমি আশা দাও, পরম শক্তিমান!
বহু সুখ সহিয়াছি, এইবারে দাও চিরকল্যাণ।
সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের মিটাও মিটাও সাধ,
তোমারই এ বাণী – দেখিব তোমার কৃপার পূর্ণ চাঁদ।
প্রসন্ন হও, প্রসন্ন হও নিত্য মোদের পর,
পূর্ণ হউক তোমার প্রসাদে আমাদের কুঁড়েঘর।
আমরা কাঙাল, আমরা গরিব, ভিক্ষুক, মিসকিন
ভোগীদের দিন অস্ত হউক, আসুক মোদের দিন।
তুমিই শক্তি, ভক্তি ও প্রেম, জ্ঞান আনন্দ দাও,
কবুল করো এ প্রার্থনা, প্রভু, কৃপা করো, ফিরে চাও!
এক সে তোমারই ধ্যান তপস্যা আরাধনা হোক স্বামী,
নিরভাব হোক মানুষ, গাহুক তব নাম দিবাযামী।
ঊর্ধ্ব হইতে কে বলে ‘আমেন’, ‘তথাস্তু’ বলো, বলো,
চোখের পানিতে বুকে ভেসে যায়, দেহ কাঁপে টলমল!
সত্য হউক সত্য হউক ঊর্ধ্বের এই বাণী,
দরিদ্রে দান করিতে করুণা, আসিছেন মহাদানী!

 আরতি

শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির নির্মল
শান্ত অচঞ্চল ধ্রুব-জ্যোতি।
অশান্ত এ চিত করো হে সমাহিত
সদা আনন্দিত রাখো মতি॥
দুঃখ শোক সহি অসীম সাহসে
অটল রহি যেন সম্মানে যশে
তোমার ধ্যানের আনন্দ-রসে
নিমগ্ন রহি হে বিশ্বপতি॥

মন যেন না টলে কল কোলাহলে, হে রাজ-রাজ,
অন্তরে তুমি নাথ সতত বিরাজ।
বহে তব ত্রিলোক ব্যাপিয়া, হে গুণী
ওংকার-সংগীত সুর-সুরধুনী,
হে মহামৌনী, যেন সদা শুনি
সে সুরে তোমার নীরব আরতি॥

আল্লার রাহে ভিক্ষা দাও

(‘ফি সবিলিল্লাহ্’)

মোর পরম-ভিক্ষু আল্লার নামে চাই
ভিক্ষা দাও গো মাতা পিতা বোন ভাই,
দাও ভিখারিরে ভিক্ষা দাও।

মোর পরম-ডাকাত ঘরের দুয়ার খুলি
হরিয়া আমার সর্বস্ব সে
দিয়াছে ভিক্ষাঝুলি,
তাঁর মহাদান সেই ঝুলি কাঁধে তুলি
এসেছি ভিখারি, হে ধনী, ফিরিয়া চাও।
আল্লার নামে ভিক্ষা দাও।

হে ধনিক, তাঁর পাইয়াছ বহু দান,
রত্ন মানিক ভোগ যশ সম্মান,
তব প্রাসাদের চারিদিকে ভিখারিরা
প্রসাদ মেগেছে ক্ষুধার অন্ন,
চায়নি তোমার হিরা।
বলো, বলো, সেই নিরন্নদের মুখে
অন্ন দিয়াছ? কেঁদেছ তাদের দুখে?
লজ্জা ঢাকিয়া নগ্ন দেহের তার
মুক্তি, পেয়েছে তোমার মুক্তি-হার?

তব আত্মার আত্মীয় যারা,
তারা ক্ষুধা তৃষ্ণায়
কাঙালের বেশে কাঁদে তব দরজায় –
তাড়ায় তাদেরে গাল দিয়ে দরওয়ান,
তুমিও মানুষ, কাঁদে না তোমার প্রাণ?
হিরা মানিকের পাষাণ পরিয়া
তুমি কি পাষাণ হলে?
তোমার আত্মা কাঁদে না তোমার দুয়ারে
মানুষ মলে?
পাওনি শান্তি, আনন্দ প্রেম –
জানি আমি তাহা জানি,
তোমার অর্থ ঢাকিয়া রেখেছে
তোমার চোখের পানি!
কাঙালিনি মা-র বুকে ক্ষুধাতুর শিশু
তোমার দুয়ারে কাঁদে শোনো, ওই শোনো।
ভিক্ষা দাও না, রাশি রাশি হিরা মণি
তুলে রাখো আর গোনো।
এ টাকা তোমার রবে না, বন্ধু জানি,
এ লোভ তোমারে নরকে লইবে টানি।
‘আর্শ’ আসন টলিয়াছে আল্লার,
শুনি ক্ষুধিতের কাঙালের হাহাকার।
তাই সে পরম-ভিক্ষু ভিক্ষা চায়
ভিখারির মারফতে তব দরজায়।
ক্ষমা পাবে তুমি, আজিও সময় আছে,
ভিক্ষা না দিলে পুড়িবে অগ্নি-আঁচে।
মৃত্যুর আর দেরি নাই তব –
ফিরে চাও ফিরে চাও,
পরম-ভিক্ষু মোর আল্লার নামে –
দরিদ্র উপবাসীরে ভিক্ষা দাও।

ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি,
তোমরা দেখেছ ঊর্ধ্বের শশী রবি।
তোমরা তাঁহার সুন্দর সৃষ্টিরে
রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে।
তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপ-মালা
করে নাকো কেন কাঙালের ঘর আলা?
এত জ্ঞান এত শক্তি, বিলাস সে কি?
আলো তার দূর কুটিরে যায় না
কোন সে শিলায় ঠেকি?

যাহারা বুদ্ধিজীবী, সৈনিক
হবে না তাহারা কভু,
তারা কল্যাণ আনেনি কখনও
তারা বুদ্ধির প্রভু।
তাহাদের রস দেবার তরে কি
লেখনী করিছ ক্ষয়?
শতকরা নিরানব্বই জন
তারা তব কেহ নয়?
এই দরিদ্র ভিখারিরা আজ
অসহায় গৃহহারা
‘আলো দাও’ বলে কাঁদিছে দুয়ারে –
ভিক্ষা পাবে না তারা?
অজ্ঞান-তিমিরান্ধকারের
ইহারা বদ্ধ জীব,
উৎপীড়কের পীড়নে পীড়িত
দলিত বদ্‌-নসিব।
তোমাদের আছে বিপুল শক্তি,
কৃপণ হইয়া তবে
কেন সহ মানুষের অপমান,
মানুষ কি দাস রবে?
আমার পিছনে পীড়িত আত্মা
অগণন জনগণ
অসহ জুলুম যন্ত্রণা পেয়ে
করিতেছে ক্রন্দন।
পরম-ভিক্ষু আদেশ দিলেন,
ভিক্ষা চাহিতে, তাই
এই অগণন জনগণ তরে
আসিয়াছি দ্বারে, ভাই!
ভোলো ভয়, দূর করো কৃপণতা,
পাষাণে প্রাণ জাগাও,
ভিখারির ঝুলি পূর্ণ হইবে,
তোমরা ভিক্ষা দাও।

তোমরা কি দলপতি,
তোমরা কি নেতা?
শুনেছি, তোমরা কল্যাণকামী
মহান উদারচেতা।
তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাহিব
চরম আত্মদান,
চাহিব তোমার অভিনন্দন-মালা,
যশ,খ্যাতি, প্রাণ।

চাহিব তোমার গোপন ইচ্ছা
আত্ম-প্রতিষ্ঠার,
চাহিব ভিক্ষা তোমার সর্ব
লোভ ও অহংকার।
পরম ভিক্ষু পাঠায়েছে মোরে,
দাও সে ভিক্ষা দাও।
আপনার সব লোভ ও তৃষ্ণা
তাঁহারে বিলায়ে দাও!
তিনি নিরভাব, পূর্ণ। ভিক্ষা
চাহেন, এ তাঁর সাধ,
শালুক ফুটায়ে যেমন তাহারই
প্রেম-প্রীতি চায় চাঁদ।
যশ খ্যাতি আর অহংকারের
লোভ তাঁরে দিলে ভিখ,
ফিরে পাবে তাঁর মহাদান,
হবে মহানেতা নির্ভীক!
নিজেরা আত্মা ত্যাগ করে মহা
ত্যাগের পথ দেখাও!
ভিক্ষা চাহে এ ভিখারি, ভিক্ষা
দাও গো ভিক্ষা দাও!

তুমি কে? তুমি মদোন্মত্ত
মানবের যৌবন,
তুমি বারিদের ধারাজল, মহা
গিরির প্রস্রবণ।
তুমি প্রেম, তুমি আনন্দ, তুমি
ছন্দ মূর্তিমান,
তুমিই পূর্ণ প্রাণের প্রকাশ,
রুদ্রের অভিযান!
যুগে যুগে তুমিই অকল্যাণেরে
করিয়াছ সংহার,
তুমিই বৈরাগী, বক্ষের প্রিয়া
ত্যজি ধরো তলোয়ার!
জরাজীর্ণের যুক্তি শোন না,
গতি শুধু সম্মুখে,
মৃত্যুরে প্রিয় বন্ধুর সম
জড়াইয়া ধরো বুকে।
তোমরাই বীর সন্তান, যুগে
যুগে এই পৃথিবীর,
হাসিয়া তোমরা ফুলের মতন
লুটায়েছ নিজ শির।

দেহেরে ভেবেছ ঢেলার মতন,
প্রাণ নিয়ে কর খেলা,
তোমারই রক্তে যুগে যুগে আসে
অরুণ-উদয়-বেলা।
তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাহিতে
আঁখি ভরে উঠে জলে,
তোমরা যে পথে চল, কেঁদে আমি
লুটাই সে পথতলে।
তোমাদেরই প্রাণ ভিক্ষা চাহিতে
এসেছি ভিখারি আমি,
ভিক্ষা চাহিতে পাঠাল সর্ব–
জাতির পরম স্বামী।
তোমরা শহিদ, তোমরা অমর,
নিতি আনন্দধামে
তোমরা খেলিবে, তোমাদের তরে
তাঁর কৃপা নিতি নামে।
তোমরাই আশা-ভরসা জাতির
স্বদেশের সেনাদল,
তোমরা চলিলে, আনন্দে ধরা
কেঁপে ওঠে টলমল।
তোমরা প্রবাহ, তোমরা শক্তি,
তোমরা জীবনধারা,
তোমাদেরই স্রোত যুগে যুগে ভাঙে
সব বন্ধন-কারা।
তুষার হইয়া কেন আছ আজও,
আগুন উঠেছে জ্বলে,
দিগ্‌দিগন্ত কাঁপাইয়া, ছুটে
এসো সবে দলে দলে।
তোমরা জাগিলে ঘুচে যাবে সব
ক্লৈব্য ও অবসাদ,
পরম-ভিক্ষু এক আল্লার
পুরিবে সেদিন সাধ।
আর কেহ ভিখ দিক বা না দিক
তোমরা ভিক্ষা দাও,
সাম্য শান্তি আসিবে না যদি
তোমরা ফিরে না চাও।
নহি নেতা, রাজনৈতিক, প্রেম-
ভিক্ষা আমার নীতি।
পৃথিবী স্বর্গ, পৃথিবীতে ফের
জাগুক স্বর্গ-প্রীতি।
অসম্ভবেরে সম্ভব করা
জাগো নবযৌবন।
ভিক্ষা দাও গো, এ ধরা হউক
আল্লার গুলশন।

 এক আল্লাহ্‌ ‘জিন্দাবাদ’

উহারা প্রচার করুক, হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ ;
আমরা বলিব, ‘সাম্য, শান্তি, এক আল্লাহ্‌ জিন্দাবাদ।’
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।

উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহিদি দর্জা চাই ;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবে না, যুদ্ধ বাধিলে লুকাইবে ওরা কচু-বনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।

ওরা নির্জীব, জিভ নাড়ে তবু শুধু স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা ‘জিন’, প্রেত, যক্ষ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নবযৌবন, মৃত্যুর সাথে সঞ্চরি,
উহাদেরে ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি নাকো তাই দয়া করি।

মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির-অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানি-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুলভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লা-মানুষে জানাজানি!

উহারা চাহুক অশান্তি ; মোরা চাহিব ক্ষমা ও প্রেম তাঁহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুল-বাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব,
ফিরিবে ভোগের পথ হতে ভয়ে, চাহিবে শান্তি সাম্য সব।

হুতুমপ্যাঁচারা কহিছে কোটরে, হইবে না আর সূর্যোদয়,
কাকে তার টাকে ঠোকরাইবে না, হোক তার নখ চঞ্চু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলে না এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি,
তারা চাহে নাকো এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দুর্গতি।

তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে একসাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধূলির দুনিয়াতে।
সাত আশমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লাহ্‌ নিত্য মহাদানী প্রভু যে যাহা চায় সে তাহা পায়।

যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দ্যাখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই!
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মোরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ববিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সবাই।

মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভু মোদের!
শকুন শিবার মতো কাড়াকাড়ি করে শব লয়ে – শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভু,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভু।

পৃথিবীতে যত মন্দ আছে, তা ভালো হোক, ভালো হোক, ভালো
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো!
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।

দাঙ্গা বাধায়ে লুট করে যারা, তারা লোভী, তারা গুণ্ডাদল,
তারা দেখিবে না আল্লার পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ্ব চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!

তাড়াবে ওদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শস্য লুটে খায়, এরা চির-চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পোড়ো ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর-ঢেউ।

বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে ‘দুলদুল’ – আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন!

নিত্য সজীব যৌবন যার, এসো এসো সেই নওজোয়ান,
সর্বক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির-আত্মদান!
ওরা কাদা ছুঁড়ে বাধা দেবে ভাবে – ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছুঁড়ে মারিব ওদের, বলিব – ‘আল্লা জিন্দাবাদ।’

একি আল্লার কৃপা নয়?

একি আল্লার কৃপা নয়?
একি তাঁর সাহায্য নয়?
যেথা ছিল শুধু পরাজয় ভয়,
সেখানে পাইলে জয়!
রক্তের স্রোত বহাতে যাহারা এসেছিল এই দেশে,
ধরেছে তাদের টুঁটি টিপে আজ তাঁর অভিশাপ এসে!
আল্লার আশ্রয় চেয়ে, আল্লার শক্তিতে আজ
তোমরা পেয়েছ আশ্রয় আর তারা পাইতেছে লাজ।
লোভ আর ভোগ চাহে যারা, নাই তাদের ধর্ম জাতি,
তাদের শুধু এক নাম আছে, রাক্ষস বলে খ্যাতি!
হউক হিন্দু, হউক ক্রিশ্চান, হোক সে মুসলমান,
ক্ষমা নাই তার, যে আনে তাঁহার দুনিয়ায় অকল্যাণ!
জুলুম যে করে শক্তি পাইয়া, দানব সে, সে অসুর,
আল্লার মার পড়ে তারে করে দুনিয়া হইতে দূর।
তাহাদেরই তরে দোজখে নরকে ভীষণ অগ্নি জ্বলে,
দলিছে যাহারা তাঁহার সৃষ্টি মানুষেরে পদতলে!
সকল জাতির সব মানুষের এক আল্লাহ্‌ সেই,
তাঁর সৃষ্টির বিচার করার কারও অধিকার নেই!
আমরা নিত্য চেষ্টা করিব চলিতে তাঁহারই পথে,
করিব না ভয়, আসুক আঘাত শত শত দিক হতে!

নির্যাতিতের আল্লাহ্‌ তিনি, কোনো জাতি নাই তাঁর,
যুগে যুগে মারে উৎপীড়কেরে তাঁহার প্রবল মার।
তাঁর সৃষ্টিরে ভালোবাসে যারা, তারাই মুসলমান,
মুসলিম সেই, যে মানে এক সে আল্লার ফরমান।
দূর করো লোভ, ক্ষুদ্র অহংকার,
ফেলিয়া দিয়ো না, পাইয়াছ হাতে আল্লার তলোয়ার!
দূর করে দাও সন্দেহ, দুর্বলের অবিশ্বাস,
সমুখে জাগুক পরম সত্য আল্লার উল্লাস!
খানিক পেয়েছ, খানিক পাওনি, দেরি নাই , তাও পাবে,
তাঁর জ্যোতি চির-অভয়ের পথে নিত্য লইয়া যাবে!
চারিদিক হতে ঘিরিয়া আসিছে হেরো অগ্নির ঢেউ,
যারা তাঁর পথে রহিবে, তাঁদের মারিবে না কভু কেউ!
শুধু তাহারাই রক্ষা পাইবে! সাবধান! সাবধান!
মহাযুদ্ধের রূপে আসিয়াছে তাঁর শেষ ফরমান!
তাঁর শক্তিতে জয়ী হবে, লয়ে আল্লার নাম, জাগো!
ঘুমায়ো না আর, যতটুকু পার শুধু তাঁর কাজে লাগো!
অন্তরে তব উঠুক ঝলসি আল্লার তলোয়ার,
ভিতরের ভয় ঘুচিলে আসিবে এই হাতে আরবার!
কোনো ব্যক্তির করিয়ো না পূজা, এক তাঁর পূজা করো,
রাজনীতি নয় মুক্তির পথ, এক তাঁর পথ ধরো!
মানুষের লোভ বাড়ায়ে দিয়ো না, তার জয়ধ্বনি করে,
মানুষেরে ত্রাতা ভাবিলে অমনি আল্লাহ্‌ যান সরে!
তিনিই সর্বকল্যাণদাতা, সর্ববিপদত্রাতা,
তিনি দিশা দেন সহজ পথের, তিনিই সর্বজ্ঞতা!

তাঁর দেওয়া কৃপা-শক্তির চেয়ে, ভাই,
মানবের জ্ঞানে দানব মারার কোনো সে শক্তি নাই।
চুক্তিতে আর যুক্তিতে কভু মানুষ বদ্ধ হয়?
তিনি প্রেম দিলে ত্রিভুবন হয় সাম্য শান্তিময়!
আমি বুঝি নাকো কোনো সে ‘ইজম’ কোনোরূপ রাজনীতি,
আমি শুধু জানি, আমি শুধু মানি, এক আল্লার প্রীতি!
ভেদ-বিভেদের কথা বলে যারা, তারা শয়তানি চেলা,
আর বেশি দিন নাই, শেষ হয়ে এসেছে তাদের খেলা!
থাকি কি না থাকি এই দুনিয়ায়, তোমরা থাকিয়া দেখো,
সেদিন সিজদা করো আল্লারে, কাঁদিয়া তাঁহারে ডেকো!
সেদিন সত্য হয় যদি তাঁর এই বান্দার কথা,
ঘুচে যাবে মোর চিরজনমের সকল দুঃখ-ব্যথা।
মানুষ আবার তাঁর প্রেমে নেয়ে চিরপবিত্র হোক!
জিনের দুনিয়া লভুক আবার জান্নাতের আলোক!

কচুরিপানা

[গান]

ধ্বংস করো এই কচুরিপানা!
(এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুরছানা॥ (ধুয়া)
ইহাদের সবংশে করো করো নাশ,
এদের দগ্ধ করে করো ছাই পাঁশ,
(এরা) জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস,
(এরা) দৈত্যের দাঁত, রাক্ষসের ডানা।–
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(এরা) ম্যালেরিয়া আনে, আনে অভাব নরক,
(এরা) অমঙ্গলের দূত, ভীষণ মড়ক!
(এরা) একে একে গ্রাস করে নদী ও নালা।
(যত) বিল ঝিল মাঠ ঘাট ডোবা ও খানা।
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(এরা) বাংলার অভিশাপ, বিষ, এরা পাপ,
(এসো) সমূলে কচুরিপানা করে ফেলি সাফ!
(এরা) শ্যামল বাংলা দেশ করিল শ্মশান,
(এরা) শয়তানি দূত দুর্ভিক্ষ-আনা।
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(কাল) সাপের ফণা এর পাতায় পাতায়,
(এরা) রক্তবীজের ঝাড়, মরিতে না চায়,
(ভাই) এরা না মরিলে মোরা মরিব সবাই
(এরে) নির্মূল করে ফেলো, শুনো না মানা।
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)

 কবির মুক্তি

[আধুনিকী]

মিলের খিল খুলে গেছে!
কিলবিল করছিল, কাঁচুমাচু হয়েছিল –
কেঁচোর মতন –
পেটের পাঁকে কথার কাতুকুতু!
কথা কি ‘কথক’ নাচ নাচবে
চৌতালে ধামারে?
তালতলা দিয়ে যেতে হলে
কথাকে যেতে হয় কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে
তালের বাধাকে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে!
এই যাঃ! মিল হয়ে গেল!
ও তাল-তলার কেরদানি – দুত্তোর!
মুরগিছানার চিলের মতন
টেকো মাথায় ঢিলের মতন
পড়বে এইবার কথার বাণ্ডিল।
ছন্দ এবার কন্ধকাটা পাঁঠার মতন ছটফটাবে।
লটপটাবে লুচির লেচির আটার মতন!
অক্ষর আর যক্ষর টাকা গোনার মতো
গুনতে হবে না –

অঙ্কলক্ষ্মীর ভয়ে কাব্যলক্ষ্মী থাকতেন
কুঁকড়োর মতন কুঁকড়ে!
ভাবতেন, মিলের চিল কখন দেবে ঠুকরে!
আবার মিল!–
গঙ্গার দু-ধারে অনেক মিল,
কটন মিল, জুট মিল, পেপার মিল –
মিলের অভাব কী?
কাব্যলোকে মিল থাকবে কেন?
ওকে ধুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দাও!
ওখানেও যে মিল আছে!
ধুলো যদি কুলোয় যায় চুলোয় যায়,
হুলো ভুলোয় যদি ল্যাজে মাখে!
ল্যাজ কেটে বেঁড়ে করে দেব!
এঁড়ে দামড়া আছে যে!
আমার মিল আসছে! – মুশকিল আসান।

অঙ্কলক্ষ্মীকে মানা করেছিলাম,
মিলের শাড়ি কিনতে।
অঙ্কলক্ষ্মীর জ্বালায় পঙ্কলক্ষ্মী পদ্ম
আর ফোটে না!
তা বলতে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে।
এ কবিতা যদি পড়ে
গায়ে ধানি লংকা ঘষে দেবে! –
আজ যে বিনা প্রয়াসেই অনুপ্রাসের
পাল পেয়েছি দেখছি!
মিল আসছে – যেন মিলানের মেলায়
মেমের ভিড়!
নাঃ! – কবিতা লিখি।
তাকে দেখেছিলাম – আমার মানসীকে
ভেটকি মাছের মতো চেহারা!
আমাকে উড়ে বেহারা মনে করেছিল!
শাড়ির সঙ্গে যেন তার আড়ি।
কাঁখে হাঁড়ি – মাথায় ধামা।
জামা ব্লাউজ শেমিজ পরে না।
দরকার বা কি?
তরকারি বেচে!
সরকারি ষাঁড়ের মতন নাদুস-নুদুস!
চিচিঙ্গের মতন বেণি দুলছিল।

সে যে-দেশের, সে-দেশে আঁচলের চল নাই!
চলেন গজ-গমনে।
পায়ে আলতা নাই, চালতার রং।
নাম বললে – ‘আজুলি’
আমি বললাম – ‘ধ্যেৎ, তুমি কাজলি।’
হাতে চুড়ি নাই,
তুড়ি দেয় আর মুড়ি খায়।
গলায় হার নাই, ব্যাগ আছে।
পায়ে গোদ,
আমি বলি, ‘প্যাগোডা’ সুন্দরী!
গান গাই, ‘ওগো মরমিয়া!’
ও ভুল শোনে! ও গায় –
‘ওগো বড়ো মিয়াঁ!’
থাকত হাতে ‘এয়ার গান!’
ও গায় গেঁয়ো সুরে, চাঁপা ফুল কেয়ার গান। –
দাঁতে মিশি, মাঝে মাঝে পিসি বলতে ইচ্ছা করে।
ডাগর মেয়েরা আমাকে যে হাঙর ভাবে।
হৃদয়ে বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ!
ভিক্ষা চাই না, শিক্ষা দিয়ে দেবে।
তাই ধরেছি রক্ষাকালীর চেড়িকে।
নেংটির আবার বকেয়া সেলাই!
কবিতে লেখার মশলা পেলেই হল
তা না-ই হল গরম মশলা। –
নাঃ, ঘুম আসছে,
রান্নাঘরের ধূম আসছে।
বউ বলে, নাক বাজছে,
না শাঁখ বাজছে।
আবার মিল আসছে –
ঘুম আসছে –
দুম্বা ভেড়ার দুম আসছে!

কাবেরী-তীরে

কর্ণাটের গঙ্গা-পূত কাবেরীর নীরে
প্রভাতে সিনানে আসে শ্যামা বেণিবর্ণা
কর্ণাটকুমারী এক, নাম মেঘমালা।
সিনানের আগে নিতি কাহার উদ্দেশে
চামেলি চম্পক ফুল তরঙ্গে ভাসায়।

ভিনদেশি বুঝি এক বণিক কুমার
হেরিয়া সে এণাক্ষীরে তরণি ভিড়ায়ে
রহে সেই ঘাটে বসি,যেতে নাহি চায়।
স্নান-স্নিগ্ধা শ্যামলীর স্নিগ্ধতর রূপে
ডুবে যায় আঁখি তার, কন্ঠে ফোটে গান –

(কর্ণাটি সামন্ত – তেতালা)

কাবেরী নদীজলে কে গো বালিকা।
আনমনে ভাসাও চম্পা শেফালিকা॥
প্রভাত সিনানে আসি আলসে
কঙ্কণ তাল হানো কলসে,
খেলে সমীরণ লয়ে কবরীর মালিকা॥
দিগন্তে অনুরাগে নবারুণ জাগে
তব জল ঢলঢল করুণা মাগে।
ঝিলম রেবা নদীতীরে
মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে
তোমারেই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা॥

দ্বিধাহীনা মেঘমালা জানিত না লাজ
কুন্ঠাহীন মুখে তার ছিল না গুন্ঠন!
গান শুনি কুমারের কাছে আসি কহে –
কারে খোঁজে মেঘদূত? হে বিদেশি কহো!
কহিতে কহিতে চাহি কুমারের চোখে
কী যেন হেরিয়া মুখে বেধে যায় কথা।
সেদিন প্রথম যেন আপনারে হেরি,
আপনি সে উঠিল চমকি! দেহে তার
লজ্জা আসি টেনে দিল অরুণ আঙিয়া!
ভরা ঘট লয়ে ঘরে ফিরে! নিশি রাতে
সুরের সুতায় গাঁথে কথার মুকুল।–

(নাগ স্বরাবলী – তেতালা)

এসো চিরজনমের সাথি।
তোমারে খুঁজেছি দূর আকাশে জ্বালায়ে চাঁদের বাতি॥
খুঁজেছি প্রভাতে, গোধূলি-লগনে, মেঘ হয়ে আমি খুঁজেছি গগনে,
ঢেকেছে ধরণি আমার কাঁদনে অসীম তিমির রাতি॥
ফুল হয়ে আছে লতায় জড়ায়ে মোর অশ্রুর স্মৃতি
বেণুবনে বাজে বাদল নিশীথে আমারই করুণগীতি!
শত জনমের মুকুল ঝরায়ে ধরা দিতে এলে আজি মধুবায়ে
বসে আছি আশা-বকুলের ছায়ে বরণের মালা গাঁথি॥
গান গাহি চমকিয়া ওঠে মেঘমালা।
আপনারে ধিক্কারে সে মরিয়া মরমে –
যদি কেহ শুনে থাকে তাহার এ গান,
কী ভাবিবে যদি শোনে বিদেশি বণিক!
সেদিন কাবেরীতীরে এল মেঘমালা
বেলা করি। গাঁয়ের বধূরা একে একে
সিনান সারিয়া ফিরে গেছে গৃহকাজে।
বণিককুমার খোঁজে কী যেন মানিক!
নীল শাড়ি পরি তন্বী মেঘমালা আসে
শ্লথগতি মদালসা, বিলম্বিতা বেণি।
বণিককুমার চাহি ওপারের পানে,
গাহে গান, – না দেখার ভান করি যেন। –

(নীলাম্বরী – তেতালা)
নীলাম্বরী শাড়ি পরি, নীল যমুনায় কে যায়, কে যায়, কে যায়।
যেন জলে চলে থল-কমলিনী, ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥
কলসে কঙ্কণে রিনিঠিনি ঝনকে চমকায় উন্মন চম্পাবনকে,
দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥
অঙ্গের ছন্দে পলাশ, মাধবী, অশোক ফোটে,
নূপুর শুনি বনতুলসীর মঞ্জরি উলসিয়া ওঠে!
মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধূলি নামিয়া এল বুঝি পথ ভুলি।
তাহারই অঙ্গ-তরঙ্গ-বিভঙ্গে কূলে কূলে নদীজল উথলায়॥
মেঘমালা কুমারের আঁখি ফিরাইতে
কত রূপে শব্দ করে কলসে কঙ্কণে।
সাঁতারিয়া কাবেরীর শান্ত বক্ষ মাঝে
অশান্ত তরঙ্গ তোলে! বণিক কুমার
হাসি তীরে আসি কহে, ‘অঞ্চলের ফুল
অকারণে নদীজলে ভাসাও বালিকা।
ও ফুল আমারে দাও! দেবতা তোমার
প্রসন্ন হবেন, পাবে মনোমতো বর।’
মেঘমালা আঁচলের ফুলগুলি লয়ে
নদীজলে ভাসাইয়া – ঘটে জল ভরি
চলে এল ঘরপানে, চাহিল না ফিরে –
দেখিল না কার দুটি আঁখি আঁখিনীরে
ভরে গেছে কূলে কূলে। ঘরে ফিরে আসি
মেঘমালা আপনার মনে মনে কাঁদে –

(নারায়ণী–আদ্ধা-কাওয়ালি)
রহি রহি কেন সেই মুখ পড়ে মনে।
ফিরায়ে দিয়াছি যারে অনাদরে অকারণে॥
উদাস চৈতালি দুপুরে মন উড়ে যেতে চায় সুদূরে
যে বনপথে সে ভিখারি-বেশে করুণা জাগায়েছিল সকরুণ নয়নে॥
তার বুকে ছিল তৃষ্ণা, মোর ঘটে ছিল বারি।
পিয়াসি ফটিকজল জল পাইল না গো ঢলিয়া পড়িল হায় জলদ নেহারি॥
তার অঞ্জলির ফুল পথধূলিতে ছড়ায়েছি সেই ব্যথা নারি ভুলিতে।
অন্তরালে যারে রাখিনু চিরদিন অন্তর জুড়িয়া কেন কাঁদে সে গোপনে॥
জলে আর যায় নাকো কর্ণাট কুমারী
চলে গেল তরি বাহি বিদেশি কুমার
তরণি ভরিয়া তার নয়নের নীরে!
সেদিন নিশীথে ঝড় বাদলের খেলা,
মেঘমালা চেয়ে আছে বাতায়ন খুলি
কাবেরী নদীর পানে! ঘন অন্ধকারে
বিজলি-প্রদীপ জ্বালি কোন বিরহিণী
খুঁজে যেন তারই মতো দয়িতে তাহার।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কবে পড়ে যে ঘুমায়ে,
ঘুমায়ে স্বপন দেখে গাহিছে বিদেশি –

(মিশ্র নারায়ণী – তেতালা)
নিশি রাতে রিম-ঝিম-ঝিম বাদল নূপুর
বাজিল ঘুমের মাঝে সজল মধুর।
দেয়া গরজে বিজলি চমকে জাগাইল ঘুমন্ত প্রিয়তমকে
আধ ঘুম-ঘোরে চিনিতে নারি ওরে
কে এল, কে এল বলে ডাকিছে ময়ূর।
দ্বার খুলি পড়শি কৃষ্ণা মেয়ে আছে চেয়ে মেঘের পানে আছে চেয়ে।
কারে দেখি আমি কারে দেখি, মেঘলা আকাশ, না ওই মেঘলা মেয়ে।
ধায় নদীজল মহাসাগর পানে বাহিরে ঝড় কেন আমায় টানে
জমাট হয়ে আছে বুকের কাছে নিশিথ আকাশ যেন মেঘ-ভারাতুর॥
মেঘমালা চমকিয়া জাগি ছুটে যায়
পাগলিনিপ্রায় নদীতীরে। ডাকি ফেরে
ঝড় বাদলের সাথে কন্ঠ মিশাইয়া –
‘কুমার! কুমার! কোথা প্রিয়তম মোর!
লয়ে যাও মোরে তব সোনার তরিতে!’
হারাইয়া গেল তার ক্ষীণ কন্ঠস্বর
অনন্ত যুগের বিরহিণীর কাঁদন
যে পথে হারায়ে যায়। আজও মোরা শুনি
কাবেরীর জল-ছলছল অশ্রু-মাখা
কর্ণাটিকা রাগিণীতে তাহারই বেদনা॥

(মনোরঞ্জনী – তেতালা-ঢিমা)
ওগো বৈশাখী ঝড়! লয়ে যাও অবেলায়
ঝরা এ মুকুল।
লয়ে যাও আমার জীবন,– এই পায়ে দলা ফুল॥
ওগো নদীজল! লহো আমারে
বিরহের সেই মহা পাথারে
চাঁদের পানে চাহি যে পারাবার,
অনন্তকাল কাঁদে বেদনা-ব্যাকুল॥
ওরে মেঘ! মোরে সেই দেশে রেখে আয়
যে দেশে যায় না শ্যাম মথুরায়,
ভরে না বিষাদ-বিষে এ-জীবন
যে দেশের ক্ষণিকের ভুল॥

কেন আপনারে হানি হেলা?

বন্ধুরা কহে, ‘হায় কবি, খেল এ কী নিষ্ঠুর খেলা,
কোন অকারণ অভিমানে আপনারে হান অবহেলা?’
হাসিয়া কহিনু – ‘হয়েছে কী?’ বন্ধুরা কহে – ‘চুলোর ছাই!
আপন সৃষ্টি করিছ নাশ, সেদিকে তোমার দৃষ্টি নাই?’
আমি কহিলাম – ‘জানি না তো সৃষ্টি করেছি কিছু আমি,
আমি শুধু জানি, নদীর প্রায় ছুটিয়া চলেছি দিবাযামী!
সাগরের তৃষা লয়ে নদী কেবল সুমুখে ছুটিয়া যায়,
পথে পথে যেতে ঢেউ তাহার কত কথা বলে, কত কী গায়!’

অকারণ কথাগুলিরে তার যদি কেহ বলে, ‘চমৎকার
মধুচ্ছন্দা কাব্যশ্লোক, বাজে তরঙ্গে সুরবাহার!’
কেউ বলে, ‘পাগলের প্রলাপ, কোনো মানে নাই ওর কথার,
এ নয় গোলাপ, লিশি-কলাপ, এ শুধু প্রকাশ মূর্খতার!’
শোনে না স্তুতি, নিন্দাবাদ-উন্মাদ বেগে প্রবল ঢেউ
আগে ছুটে চলে, কী গান গায় কী কথা কয় সে, বোঝে না কেউ।
জন্ম-শিখর হইতে মোর কোন সে অসীম মহাসাগর
টানিয়া আনিল, দিল সে ডাক, তারই পানে ছুটি ছাড়িয়া ঘর!

বন্ধু গো, সুর-স্রষ্টা নই, কবি নই, আমি সাগরজল,
কভু মেঘ হয়ে ঝরে পড়ি, কভু নদী হয়ে বহি কেবল।
মৌন উদার হিমালয়ে কভু জমে হই হিম-তুষার,
সহসা সে ধ্যান ভাঙে আমার গাঢ় চুম্বনে রাঙা উষার!
কেন সারা রাত জেগে কাঁদি, দিনে কাজ করি, হেসে বেড়াই,
আমিই জানি না! জানি না কী লিখেছি ; কী সুরে কী গান গাই!
পাগলের মতো বকি প্রলাপ, কেন যে ভিক্ষা চাই আমি,
হয়তো জানে পরমোন্মাদ পরম-ভিক্ষু মোর স্বামী।
কেউ বলে, আমি নদীর ঢেউ দু-কূলে ফুটাই ফুল-ফসল,
কেউ বলে, আমি কূল ভাঙি ধ্বংস-বিলাসী বন্যা-জল।

যার যাহা সাধ যায়, আমি মোর পথে তেমনই ধাই,
ওরা কূলে বসে আমারে কয়, ‘কার সাথে কহ কী কথা ছাই?’
বুঝিতে পারি না, কেন আসি, তোমারে কেন যে ভালোবাসি,
মনে হয়, বিনা প্রয়োজনের তব এ কান্না, তব হাসি।
আমি কহি, ‘প্রিয় সাথিরা মোর, ছিনু রংবেজ আশমানে,
যে তুলি আঁকিত রামধনু, বাশিঁ বাজিতে যে-গুলিস্তানে,
সে বাঁশি সে তুলি কোন সে চোর লয়ে গেছে চুরি করিয়া, হায়!
আমার মনের ছন্দিতা আর সে নূপুর পরে না পায়।’

রস-প্রমত্ত অশান্ত চলিতেছিলাম রাজপথে,
সম্মুখে এল ভিখারিনি মৃত ছেলে-কোলে কোথা হতে।
কহিল, ‘বিলাসী! পুত্র মোর, দুধ পায় নাই এক ঝিনুক,
শুকায়ে গিয়াছে অন্নহীন দেখো দেখো এই মায়ের বুক!
মাতৃস্তন্য পায়নি সে, দিয়াছে মৃত্যুস্তন্য তায়,
কাফন কেনার পয়সা নাই, কী পরায়ে গোরে দিব বাছায়?’
সাত আশমান যেন হঠাৎ দুলিতে লাগিল ঘোর বেগে,
ঝরিতে লাগিল গ্রহ-তারা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে!
কহিলাম – ‘মা গো, আমি কবি, দেশে ফিরি নাকি রস ঢেলে,
সে রসের কিছু পাওনি কি তুমি আর তব মৃত ছেলে?’

কহে ভিখারিনি আঁখিজলে, ‘রস পান? সে তো বিলাসীদের!
তেল মাখ তুমি তেলা মাথায়, হায়, কেহ নাই ভিক্ষুকের!’
মরা খোকা নিয়ে ভিখারিনি চলে গেল কোন পথে সুদূর,
জ্ঞান হলে আমি চেয়ে দেখি,- বুকে জাগে গোর মরা শিশুর! –
ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বিলাসের বেণু, রাঙা গেলাস,
পাঁশের স্তূপের পাশে পড়ে আতরদানি ও গোলাবপাশ!
যেতে যেতে দেখি, মোটরকার ধাক্কা মারিয়া অন্ধে হায়
ছুটে চলে গেল চার চাকায়, চার-পায়া চড়ে অন্ধ যায়!

বন্ধু, বিলাস-সৃষ্টি এই আমার কবিতা, আমার গান
অন্ধেরে আলো দিত যদি, অপঘাতে তার যেত না প্রাণ!
যেতে যেতে হেরি বস্তিতে শুয়ে আছে কারা ভাঙা কাচে?
গুদাম ঘরের বস্তা, এই বস্তির চেয়ে সুখে আছে!
রূপ দেখিয়াছি কল্পনায় এঁকেছি স্বপ্ন-গুলবাহার,
দেখিনি শ্রীহীন এই মানুষ জীর্ণ হাড্ডি-চামড়া সার!
নগ্ন ক্ষুধিত ছেলেমেয়ে কাঁদায় কাঁদিয়া মায়ের প্রাণ,
শুনিলাম আমি এই প্রথম শিশুর কাঁদনে আল-কোরান!

মোর বাণী ছিল রসলোকের আল্লার বাণী শুনিনু এই,
বিলাশের নেশা গেল টুটে, জেগে দেখি আর সে আমি নেই!
গাঁয়ে গাঁয়ে ফিরে দেখিয়াছি পায়ে-দলা কাদামাখা কুসুম,
বক্ষে লইয়া কাঁদিছে মা, চক্ষে পিতার নাহিকো ঘুম!
শিয়রের দীপে তৈল নাই, পীড়িত বালক কাঁদিয়া কয়,
‘দেখিতে পাই না মা তোর মুখ, বাবা কোথা, বড়ো লাগিছে ভয়!’
মাঠের ফসল, কাজলা মেঘ স্বপ্নে দেখিছে ঘুমায়ে বাপ,
মরো মরো পুত্রেরে বাঁচায় মা-র মমতার উষ্ণ তাপ!
জমিদার-মহাজনপাড়ায় মেয়ের বিয়ের বাজে সানাই,
ইহাদের ঘরে বার্লি নাই, ওদের গোয়ালে দুধাল গাই।

আগুন লাগুক রসলোকে, কত দূরে সেথা কারা থাকে?
অভিশাপ দিনু – নামিবে সব এই দুখে শোকে, এই পাঁকে!
প্রায়শ্চিত্ত করি আমি–বন্ধু, আমারে কোরো ক্ষমা!
বহু ভোগ বহু বিলাস পাপ, প্রভুজি জানেন, আছে জমা!
এই ক্ষুধিত ও ভিক্ষুকের আজীবন পদসেবা করি
প্রায়শ্চিত্ত মোর ভোগের পূর্ণ করিয়া যেন মরি!
ওরা যদি আত্মীয় নহে কেন এ আত্মা কাঁদে আমার?
উহাদের তরে কেন এমন বুকে ওঠে রোদনের জোয়ার?
মুক্তি চাহি না, চাহি না যশ, ভিক্ষার ঝুলি চাহি আমি,
এদেরই লাগিয়া মাগিব ভিখ দ্বারে দ্বারে কেঁদে দিবাযামী!

কোথা সে পূর্ণযোগী

কোথা সে পূর্ণ সিদ্ধ ও যোগী, দেখেছ কি কেউ তাঁরে,
দনুজ-দলনী শক্তিরে পুন ভারতে জাগাতে পারে?
কোথা সে শ্রীরাম, বশিষ্ঠ, কোথা তাপস কাত্যায়ন,
যাঁর সাধনায় হইবে কাত্যায়নীর অবতরণ!
ভারত জুড়িয়া শুধু সন্ন্যাসী সাধু ও গুরুর ভিড়,
তবু এ ভারত হইয়াছে কেন ক্লীব মানুষের নীড়?
‘প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী, নাহি বিশ্বম্‌’ বলি কেউ
আবার আনিতে পারে কি ভারতে মহাশক্তির ঢেউ?
পাতাল ফুঁড়িয়া দানব দৈত্য উঠিয়াছে পৃথিবীতে,
এল না তো কেউ শক্তি-সিদ্ধ তাদের সংহারিতে!
কোথা সেই মহাতান্ত্রিক, কোথা চিন্ময়ী মহাকালী?
মন্দিরে মন্দিরে মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা খালি!
শক্তিরে খুঁজি পটুয়ার পটে, মাটির মুরতি মাঝে
চিন্ময়ী শ্রীচণ্ডিকা তাই প্রকাশ হল না লাজে।
কোন দুর্গারে পূজিয়া শ্রীরাম হরিলেন দুর্গতি?
সেই শ্রীদুর্গা কোথা আজ, কেউ দেখেছ তাঁহার জ্যোতি?
শুম্ভ নিশুম্ভেরে যে মারিল, সে চণ্ডী কি গেছে মরে?
কুম্ভমেলায় শুধায়েছ কেউ সাধুদের জটা ধরে?
জটা তাহাদের কটা হয়ে গেল, কটাহ হইল চোখ,
আনিতে পারিল তবু কি তাহারা একটি ফোঁটা আলোক?
পরিশ্রমের ভয়ে আশ্রমে আশ্রমে ছেলেমেয়ে
আশ্রয় লয়ে বাঁচিয়াছে! মেদ বাড়িতেছে খেয়ে দেয়ে!
মহাপ্রভুর নাম রাখিয়াছে ভিক্ষুক নেড়া নেড়ি,
এরা কি ভাঙিবে অসুরের কারা, পায়ের শিকল বেড়ি?
ধর্মের নামে এই অধর্ম, তাই তো ধর্মরাজ
অভিশাপ দেন দারিদ্র্যব্যাধি দুর্গতিরূপে আজ।
গঙ্গায় নেয়ে তীর্থে গিয়ে কে শক্তি লভিয়া আসে?
মাংসের স্তূপ বেড়ে বেড়ে শুধু যায় মৃত্যুর গ্রাসে।
কে ঘুচাবে এই লজ্জা ও ঘৃণা, কোথা সে যুগাবতার?
জগন্নাথের রথ দেখিব না, পথ চেয়ে আছি তাঁর।

গোঁড়ামি ধর্ম নয়

শুধুগুণ্ডামি, ভণ্ডামি আর গোঁড়ামি ধর্ম নয়,
এই গোঁড়াদের সর্বশাস্ত্রে শয়তানি চেলা কয়।
এক সে স্রষ্টা সব সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু,
একের অধিক স্রষ্টা কোনো সে ধর্ম কহে না কভু।
তবু অজ্ঞানে যদি শয়তানে শরিকি স্বত্ব আনে,
তার বিচারক এক সে আল্লা –লিখিত আল-কোরানে।
মানুষ তাহার বিচার করিতে পারে না, নরকে তারে
অথবা স্বর্গে কোন মানুষের শক্তি পাঠাতে পারে?
‘উপদেশ শুধু দিবে অজ্ঞানে’ – আল্লার সে হুকুম,
নিষেধ কোরানে – বিধর্মীপরে করিতে কোনো জুলুম।
কেন পাপ করে, ভুল পথে যায় মানবজন্ম লয়ে,
কেন আসে এই ধরাতে জন্ম-অন্ধ পঙ্গু হয়ে,
কেন কেহ হয় চিরদরিদ্র, কেহ চিরধনী হয়,
কেন কেউ অভিশপ্ত, কাহারও জীবন শান্তিময়?
কোন শাস্ত্রী বা মৌলানা বলো, জেনেছে তাহার ভেদ?
গাধার মতন বয়েছে ইহারা শাস্ত্র কোরান বেদ!

জীবনে যে তাঁরে ডাকেনিকো, প্রভু ক্ষুধার অন্ন তার
কখনো বন্ধ করেননি কেন, কে করে তার বিচার?
তাঁর সৃষ্টির উদার আকাশ সকলেরে থাকে ঘিরে,
তাঁর বায়ু মসজিদে মন্দিরে সকলের ঘরে ফিরে।
তাঁহার চন্দ্র সূর্যের আলো করে না ধর্ম ভেদ,
সর্বজাতির ঘরে আসে, কই আনে না তো বিচ্ছেদ!
তাঁর মেঘবারি সব ধর্মীর মাঠে ঘাটে ঘরে ঝরে,
তাঁহার অগ্নি জ্বলে, বায়ু বহে সকলেরে সেবা করে।
তাঁর মৃত্তিকা ফল ফুল দেয় সর্বজাতির মাঠে,
কে করে প্রচার বিদ্বেষ তবু তাঁর এ প্রেমের হাটে?
কোনো ‘ওলি’ কোনো দরবেশ যোগী কোনো পয়গম্বর,
অন্য ধর্মে, দেয়নিকো গালি, – কে রাখে তার খবর?
যাহারা গুণ্ডা, ভণ্ড, তারাই ধর্মের আবরণে
স্বার্থের লোভে খ্যাপাইয়া তোলে অজ্ঞান জনগণে।
জাতিতে জাতিতে ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ এরা আনি
আপনার পেট ভরায়, তখ্‌ত চায় এরা শয়তানি।
ধর্ম-আন্দোলনের ছদ্মবেশে এরা কুৎসিত,
বলে এরা, হয়ে মন্ত্রী, করিবে স্বধর্মীদের হিত।
এরা জমিদার মহাজন ধনী নওয়াবি খেতাব পায়,
কারও কল্যাণ চাহে না ইহারা, নিজ কল্যাণ চায়।
ধনসম্পদ এত ইহাদের, করেছে কি কভু দান?
আশ্রয় দেয় গরিবে কি কভু এদের ঘর দালান?
ধর্ম জাতির নাম লয়ে এরা বিষাক্ত করে দেশ,
এরা বিষাক্ত সাপ, ইহাদেরে মেরে করো সব শেষ।
নাই পরমত-সহিষ্ণুতা সে কভু নহে ধার্মিক,
এরা রাক্ষস-গোষ্ঠী ভীষণ অসুর-দৈত্যাধিক।
উৎপীড়ন যে করে, নাই তার কোনো ধর্ম ও জাতি,
জ্যোতির্ময়েরে আড়াল করেছে, এরা আঁধারের সাথি!
মানবে মানবে আনে বিদ্বেষ, কলহ ও হানাহানি,
ইহারা দানব, কেড়ে খায় সব মানবের দানাপানি।
এই আক্ষেপ জেনো তাহাদের মৃত্যুর যন্ত্রণা,
মরণের আগে হতেছে তাদের দুর্গতি লাঞ্ছনা।
এক সে পরম বিচারক, তাঁর শরিক কেহই নাই,
কাহারে শাস্তি দেন তিনি, দেখো দুদিন পরে তা ভাই!
মোরা দরিদ্র কাঙাল নির্যাতিত ও সর্বহারা,
মোদের ভ্রান্ত দ্বন্দ্বের পথে নিতে চায় আজ যারা
আনে অশান্তি উৎপাত আর খোঁজে স্বার্থের দাঁও,
কোরানে আল্লা এদেরই কন – ‘শাখা-মৃগ হয়ে যাও।’

চির-বিদ্রোহী

হার মেনেছ বিদ্রোহীকে বাঁধতে তুমি পারবে না!
তোমার সর্বশক্তি আমায়,
বাঁধতে গিয়ে হার মেনে যায়!
হায়! হাসি পায়, হেরেও তুমি হারবে না?
হেরে গেলে! বিদ্রোহীকে বাঁধতে তুমি পারবে না।

অশান্ত এ ধূমকেতুকে ঘুম পাড়াবে কোন মায়া?
তোমার সর্বমায়ার কাঁদন,
মা-র মমতা প্রেমের বাঁধন
স্পর্শ করে বিদগ্ধ হয়, রুদ্রস্বরূপ মোর কায়া।
অশান্ত এ ধূমকেতুকে ঘুম পাড়াবে কোন মায়া?

ধরতে আমায় জাল পেতেছে জটিল তোমার সাত আকাশ!
সে জাল ছিঁড়ে এ ধূমকেতু
বিনাশ করে বাঁধার সেতু,
সপ্ত স্বর্গ পাতাল ঘিরে ভস্ম করে সকল বিঘ্ন সর্বনাশ।
এই ধূমকেতু ছিঁড়ে সে জাল
এই মহাকাল! রুদ্র দামাল
শূন্যে নাচে প্রলয়-নাচন সংহারিয়া সর্বনাশ।

শান্তি দিয়ে অশান্তকে ধরার ধুলায় আনতে চাও,
দুর্গে এনে দুরন্তকে –
অশ্রু চাহ রুক্ষ চোখে!
আমার আগুন নিভবে নাকো যতই গলায় মালা দাও!
শান্তি দিয়ে অশান্তকে ধরার ধুলায় আনতে চাও!

সংহার মোর ধর্ম, আমি বিপ্লব ও ঝঞ্ঝা ঝড়,
স্বধর্মে নিধন ভালো –
কেন আন প্রেমের আলো?
সতী-দেহত্যাগের পর শংকর কি বাঁধে ঘর?

আনন্দ আর অমৃত রস কার আগুনে যায় জ্বলে?
শান্তি সমাহিতের মাঝে
কেন রুদ্র বিষাণ বাজে?
কোন যাতনায় শিশু কাঁদে, শান্তি পায় না মা-র কোলে?

লক্ষ্মীছাড়ার হাতে তুমি ঐশ্বর্য চাও দিতে?
লোভী ভোগীলক্ষ্মী লয়ে
রাক্ষস আর দৈত্য হয়ে
কী নির্যাতন করছে তোমার সৃষ্টিতে।
লক্ষ্মীছাড়ার হাতে তুমি ঐশ্বর্য চাও দিতে?

করব আমি ধ্বংস সর্ব বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বকে।
মিথ্যা হল কোরান ও বেদ
এই অসাম্য অশান্তি ভেদ
প্রলয় কি বাঁধতে পারে বলয়-পরা নর্তকী!
এখানে সিংহ থাকে!
অসিংহ সব মহাত্মাকে
দাও গিয়ে ওই হরিনামের হরতকি!
রুদ্রকে কে শূদ্র করে
ক্ষুদ্র ধরায় রাখবে ধরে।
অহম শিকল কে পরাবে সোহম স্বয়ম্ভূকে!

হে মৌনী, উত্তর দাও সামনে এসে রূপ ধরে,
পূজা করে ক্ষমা করে
তোমায় মানুষ জনম ভরে,
কী দিয়েছ তাদের বলো, থেকো নাকো চুপ করে!

কেন দুর্বলেরে করে প্রবল নির্যাতন?
এই সুন্দর বসুন্ধরা
রাক্ষস আর দৈত্যভরা
কেমন করে করব তোমায় অভেদ বলে সম্ভাষণ।

লজ্জা তোমার হয় না যখন তোমায় বলে কৃপাময়!
পুত্র মরে, মা তবু হায়!
প্রেমভরে ডাকে তোমায়;
ওগো কৃপণ! বিশ্বে তোমার দাতা বলে পরিচয়!

কেন পাপ ও অপরাধের কথা তোমার শাস্ত্র কয়!
কে দিল মানবজন্ম,
কে দিল ধর্মাধর্ম,
মুক্ত তুমি, মানুষ কেন এ বন্ধন-জ্বালা সয়?

তুমি বল, ‘আমার একা তোমার উপর অধিকার।’
সেই অধিকার তোমার পরে
বলো কেন দাও না মোরে?
তোমার মতো পূর্ণ হব, এই ছিল মোর অহংকার!

মনের জ্বালা স্নিগ্ধ নাহি করে তোমার চন্দ্রালোক!
এত কুসুম এত বাতাস
কেন তবু এ হাহুতাশ,
কোন শোকে অশান্তিতে দেবতা হয় চণ্ডাশোক !

কেন সৃষ্টি করলে নরক, জন্মায়নি যখন মানব
কেন তাদের ভয় দেখাও?
ভয় দেখিয়ে ভক্তি চাও?
তোমার পরম ভক্তেরা তাই হয় শয়তান, হয় দানব!

বিদ্রোহী করেছে মোরে আমার গভীর অভিমান।
তোমার ধরার দুঃখ কেন
আমায় নিত্য কাঁদায় হেন?
বিশৃঙ্খল সৃষ্টি তোমার, তাই তো কাঁদে আমার প্রাণ!

বিদ্রোহী করেছে মোরে আমার গভীর অভিমান!
আমার কাছে শান্তি চায়
লুটিয়ে পড়ে আমার গায় –
শান্ত হব, আগে তারা সর্বদুঃখ-মুক্ত হোক!

ছন্দিতা

১। ‘স্বাগতা’ – ১৬ মাত্রা (তা – না তা – নাবাবা –
তা – নানা – তা – তা -)
স্বাগতা কনক-চম্পক-বর্ণা ছন্দিতা চপল নৃত্যের ঝরনা।
মঞ্জুলা বিধুর যৌবন-কুঞ্জে যেন ও চরণ-নূপুর গুঞ্জে,
মন্দিরা মুরলি-শোভিত হাতে এসো গো বিরহ-নীরস-রাতে
হে প্রিয়া কবির প্রাণ অপর্ণা॥

২। ‘প্রিয়া’ – ৭ মাত্রা (নাবা তা – না তা -)
‘মহুয়া’-বনে বন-পাপিয়া এখনও ঝুরে নিশি জাগিয়া।
ফিরিয়া কবে প্রিয় আসিবে ধরিয়া বুকে কহিবে প্রিয়া॥
শুনি, নীরবে গগনে বসি কহ যে-কথা বিরহী শশী,
তব রোদনে বঁধু এ মনে যমুনা বহে কূল-প্লাবিয়া॥

৩। ‘মধুমতী’ – ৮ মাত্রা (নাবাবাবা নানা তা – দু-বার)
বনকুসুম-তনু তুমি কি মধুমতী।
ঢলঢল নয়নে রস-ঘন মিনতি।
রুমুঝুমু ঘুমুরে ঘুমুঘুমু বিবশা,
নিথর বসুমতী, নিশিমদ-অলসা, মুরছিত চরণে শত মদন রতি॥
রস-ছলছল গো তব মধু-কলসে
ঝরঝর ঝরনা অনুখন বরষে, – অরুণিত-নয়না মধুর রসবতী॥

৪। ‘মত্তময়ূর’ – ২২ মাত্রা
মত্তময়ুরছন্দে নাচে কৃষ্ণ প্রেমানন্দে।
রুম ঝুম ঝুম মঞ্জীর বাজে কঙ্কণ মণিবন্ধে॥
রিমঝিম রিমঝিম ঝিম কেকা-বর্ণ ঘন বরষে,
তৃষ্ণা-তৃপ্ত আত্মা নাচে নন্দনলোকে হরষে,
ঝঞ্ঝার ঝাঁঝরতাল বাজে শূন্যে মেঘ-মন্দ্রে॥
পল্লব-ঘন-চক্ষে ঝরে অশ্রু-রসধারা
পুব-হাওয়াতে বংশী ডাকে আয় রে পথহারা।
বন্দে দামিনী-বর্ণা রাধা বৃন্দাবন-চন্দে॥

৫। ‘রুচিরা’ – ১৮ মাত্রা
ভ্রমর নূপুর-পরিহিতা কৃষ্ণ-কুন্তলা।
বলয়-কাঁকন-ঝনকিতা ছন্দ-চঞ্চলা॥
মলয়-সমীর ঝিরিঝিরি অঙ্গে গুঞ্জরে।
কদম কেশর ঝুরুঝুরু চম্পা মুঞ্জরে।
চটুলনয়ন চমকিতা জ্যোৎস্না-অঞ্চলা॥
বিধুর কোকিল-কুহরিত আম্রকুঞ্জে গো,
রূপের পরাগ ঝরে তব পুঞ্জে পুঞ্জে গো।
নিখিল-ভুবন তব রাস নৃত্য হিন্দোলা॥

৬।
‘দীপক-মালা’ – ১৬ মাত্রা (তা – নানা – তা – তা,
তা না তা নাতা)
দীপক-মালা গাঁথো গাঁথো গাঁথো সই।
আনত আঁখি তোলো তোলো গো!
বেদন-জ্বালা ভোলো ভোলো গো!
মান-ভুলানো এল রাত সই॥
কাজল আঁকো নীল আঁখিতে,
চেয়ো না লাজে আঁখি ঢাকিতে,
আসন প্রাণে পাতো পাতো সই॥

৭।
‘মন্দাকিনী’ – ১৬ মাত্রা (নানা নানা নানা
তা না তা তা নাতা)
জল-ছলছল এসো মন্দাকিনী।
রস-ঢলঢল বারি-সঞ্চারিণী॥
হৃদয়-গগন আজি তৃষ্ণাভরে
উতল হইল প্রেম-গঙ্গা তরে,
মুদিত নয়ন খোলো বৈরাগিনী॥
বিরস ভুবন রাখো সঞ্জীবিতা,
সজল সলিল আনো হিল্লোলিতা,
ঝর ঝর স্রোত-উন্মাদিনী॥

৮।
‘মঞ্জুভাষিণী’ – ১৮ মাত্রা (নানা তা – নাতা নানানা
তানা তানাতা)
আজও ফাল্গুনে বকুল কিংশুকের বনে,
কহে কোন কথা নিশীথ স্বপনে আনমনে॥
মৃদুমর্মরে পথের পল্লবের সাথে
গাহের কোন গীতি নিশীথে পানসে জ্যোৎস্নাতে,
খোঁজে কার স্মৃতি নীরস শুভ্র চন্দনে॥
গ্রহচন্দ্রে কয় – সে কি গো মৃত্যু-দ্বার খুলে
হয়ে সৃষ্টিপার গিয়াছে অমৃতের কূলে,
কাঁদে কোন শোকে পরম সুন্দরের সনে॥

৯। ‘মণিমালা’ – ২০ মাত্রা
মঞ্জু মধু-ছন্দা নিত্যা, তব সঙ্গী
সিন্ধুর তরঙ্গ নৃত্যের কুরঙ্গী॥
গুঞ্জা বেলা পদ্ম পুঞ্জীভূত বক্ষে,
অশ্রু-লাজ কুন্ঠা শঙ্কা-ঘন চক্ষে,
অঙ্গে শ্যামকান্তা মন্দাকিনী-ভঙ্গি॥
অঙ্গুলিতে বন্দী অঙ্কুরিত ছন্দ,
কণ্ঠে সুর-লক্ষ্মী বৃন্দাবনানন্দ,
গঙ্গা এলে বক্ষে সন্ধ্যারাগে রঙ্গি॥

১০। ‘ছন্দবৃষ্টিপ্রপাত’ – ৪৮ মাত্রা
তারকা-নূপুরে নীল নভে ছন্দ শোন ছন্দিতার
সৃষ্টিময় বৃষ্টি হয় নৃত্য সেই নন্দিতা
সাগরে নদীতে ঢেউ তোলে সেই দেবীর মুক্তকেশ,
সংগীতের হিন্দোলে তাঁর আঁখির প্রেম আবেশ,
পবনে পবনে হিল্লোলে নীল আঁচল চঞ্চলার
ছন্দোময় আনন্দময় চরণশ্রী বন্দি তাঁর॥

১১। সৌরাষ্ট্র ভৈরব – তেতালা (বাদী মধ্যম)
মদালস ময়ুর-বীণা কার বাজে
অরুণ-বিভাসিত অম্বর-মাঝে॥
কোন মহা-মৌনীর ধ্যান হল ভঙ্গ?
নেচে ফেরে অশান্ত মায়া-কুরঙ্গ
তপোবনে রঙ্গে অনঙ্গ বিরাজে॥
নিদ্রিত রুদ্রের ললাট-বহ্নি
পাশে তার হেসে ফেরে বনবালা-তন্বী।
বিজড়িত জটাজুটে খেলে শিশু শশী
দেয় মালা চন্দন ভীরু উর্বশী
শংকর সাজিল রে নটরাজ সাজে॥

জাগো সৈনিক-আত্মা

জাগো সৈনিক-আত্মা! জাগো রে দুর্দম যৌবন!
আকাশ পৃথিবী আলোড়ি আসিছে ভয়াল প্রভঞ্জন।
রক্ত রসনা বিস্ফারি আসে করাল ভয়ংকর!
অগ্নি উগারি ওড়ে আগ্নেয়ী জুড়িয়া নীলাম্বর।
এখনও তন্দ্রা নিদ্রা জড়তা ক্লৈব্য গেল না তোর?
ব্রজ দমকে দামিনী চমকে, এল ঘনঘটা ঘোর!
এখনও ঘুমাবে হে অমর মানবাত্মা অন্ধকারে
পরি দৈন্যের শৃঙ্খল হায় পাতালের কারাগারে!
গরজে কামান, তোপ, গোলাগুলি ছুটিছে দিগ্‌বিদিকে,
জড়াইয়া ধরে প্রিয়া-সম সৈনিক সেই বহ্নিকে।
গুলি ও গোলারে প্রিয়ার বুকের মালার ফুলের মতো
লইতেছে তুলি আজ জগতের বীর সৈনিক যত।
জাগো জাগো এদেশের দুর্বার দুরন্ত যৌবন!
আগুনের ফুল-সুরভি এনেছে চৈতালি সমীরণ।
সেই সুরভির নেশায় জেগেছে অঙ্গে অঙ্গে তেজ,
রক্তের রঙে রাঙায় ভুবন ভৈরব রংরেজ!
জাগো অনিদ্র অভয় মুক্ত মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ,
তোমাদের পদধ্বনি শুনি হোক অভিনব উত্থান
পরাধীন শৃঙ্খল-কবলিত পতিত এ ভারতের!
এসো যৌবন রণ-রস-ঘন হাতে লয়ে শমশের!
মৃত্যুর নয় – অমৃতের উৎসবের আমন্ত্রণ
আসিতেছে ওই রক্ত-রঙিন লিপি লয়ে যে মরণ–
বরণ করিয়া চলো সেই উৎসব-অভিযান-পথে,
মহাশক্তির তুষার গলিয়া ছুটুক প্রবল স্রোতে!
দঙ্গল বাঁধি এসো ময়দানে করিয়া কুচকাওয়াজ,
গর্জি উঠুক বক্ষে রণোন্মত্ত গোলন্দাজ!
রক্তে রক্তে এ কোন রুদ্র নটরাজ নাচে নাচে রে!
মৃত্যুরে খুঁজি মধুমাছি, মৃত্যুর মধু কোথা আছে রে!
সাইক্লোন নাচে শিরায় শিরায় মন সেথা চলে ছুটে
কোথায় বোমার ধূপদানি হতে বারুদের ধোঁয়া উঠে?
চলো জাগ্রত মানবাত্মা সামরিক সেনাদল,
যথা প্রাণ ঝরে-ঝরে পড়ে যেন বাদলের ফুলদল!
মাদল বাজিছে কামানের ওই শোনো মহা-আহ্বান!
জীবনের পথে চলো আর চলো – ‘অভিযান, অভিযান’!

জোর জমিয়াছে খেলা

জোর জমিয়াছে খেলা!
ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকালবেলা।
এই জনগণ-অরণ্যে যেন বহিত না প্রাণবায়ু,
শিথিল হইয়া ছিল যেন সব স্নায়ু!
সহসা মৌন-অরণ্যে আজ উঠেছে প্রবল ঝড়,
ভিড় করে পাখি নীড় ছেড়ে করে কোলাহল-মর্মর।
জমাট হইয়া ছিল সাগরের জল,
সহসা গলিয়া ছুটিল স্রোতের ঢল।
ময়দানে জোর ভিড় জমিয়াছে বড়ো ছোটো মাঝারির,
স্বদেশি বিদেশি লোভী নির্লোভ হেটো মেঠো বাজারির!
এই দিকে ‘রাজি’, ওদিকে ‘নারাজি’ দল,
সেন্টারে পড়ে আছে ‘ভারতের স্বাধীনতা’-ফুটবল!
‘রাজি’ জয়ী হবে বলে বাজি রাখে মজুর ও বিড়িওয়ালা,
কেল্লার ধারে জমায়েত হয়ে বাঁধা রেখে ঘটি থালা।
কাহার কেল্লা ফতে হবে সবে কয়,
‘রাজি’রা খেলিতে জানে, উহারাই জয়ী হবে নিশ্চয়।
‘গ্যালারি’ ভরতি মধ্যবিত্ত আধা-বড়োলোক যত,
ছাতা উঁচাইয়া ‘রাজি’দের জয়ধ্বনি করে অবিরত।
‘নারাজি’ দলের ‘সাপোর্টার’ যত কোট প্যান্ট চাপকান,
সংখ্যায় সাত কুড়ি, তবু তিন হাত তুড়িলাফ খান!
এরা খায় বিড়ি, ওরা খায় সিগারেট,
এরা খায় চানাচুর ও বাদাম, ওরা চপ কাটলেট!
জোর জমিয়াছে খেলা,
বুট-পরা পায়ে ফুটবলে লাথি মারে, হুল্লোড় মেলা!
খাইয়া ‘ফাউল-কারি’ ‘নারাজি’রা কেবল ফাউল করে,
রেফারিকে দেয় কাফেরি ফতোয়া যদি সে ফাউল ধরে!
‘শেম’ ‘শেম’ বলে জনগণ, হ্যাটুয়ারা দেয় হ্যাটে তালি,
খেলতে পারে না, ফেলিতে পারে না ঠেলা দিয়ে, দেয় গালি।
কোন দল জেতে কোন দল হারে, উঠিয়াছে কোন্দল,
‘নারাজি’র দিকে বুড়োরা, ‘রাজি’র জোয়ান নতুন দল।

উঠেছে হট্টগোল
ওই দিল – গোল, গোল!
মটরুর নানা দেড় চোখ কানা, ঝুড়ি তুলে মারে কিক,
লুঙ্গি ধরে চলে ‘রাজি’রা এবার গোল দিল দেখো ঠিক!
‘নারাজি’রা হল যেন আলু-ভাজি, করে শুধু হ্যান্ডবল,
যত গোল খায় তত গোলমাল করে তারা অবিরল!
কবুতর ওড়ে, মোগলি লম্ফ মারে বগলের ছাতা,
‘জয় রাজি’ বলে ওড়ায় রঙিন কুচি কাগজের পাতা।

খেলা জমিয়াছে জোর,
‘নারাজি’রা রাগে, ‘রাজি’রা ততই হাসিয়া করে স্কোর!
‘নারাজি’র দলে বিদেশি খেলুড়ি, ‘রাজি’র দেশের ছেলে,
‘রাজি’রা পায়ের জোরে খেলে ‘নারাজি’রা গা-র জোরে ঠেলে।
আজও খেলা শেষ হয় নাই ময়দানে,
‘হাফটাইমের’ আগেই কে গোল খেয়েছে সবাই জানে।

এরই মাঝে আসিয়াছে ঘনঘটা রুক্ষ আকাশ ঘিরে,
কারা যেন ক্রোধে নীল আশমান বিজলি-নখরে চিরে!
বাজে বাদলের মাদল ঝাঁজর মৃদঙ্গ গুরুগুরু,
মাথার উপরে ছাতার তাম্বু, বৃষ্টি হয়েছে শুরু!
দর্শক দ্যাখে, এঁকেবেঁকে পড়ে মাঠে কারা পিছলায়ে,
‘রাজি’ দল ছোটে তিরের মতন চাকা বাঁধা যেন পায়ে!

খেলা জোর জমিয়াছে,
দর্শক সব এবার এগিয়ে এসেছে দড়ির কাছে।
বৃষ্টি নেমেছে, এবার দৃষ্টি প্রখর করো রে দাদা,
কার দিকে কত হয় সে ফাউল, কে ছিটায় কত কাদা।

খেলা দ্যাখো, দ্যাখো খেলা,
‘রাজি’ কি ‘নারাজি’ জয়ী হল, বলো তোমরাই সাঁঝ-বেলা!
কবুতরগুলি ফেরে নাই ঘরে, ঘুরিছে মাথার পর,
কাহারা জিতিল, দেশে দেশে গিয়া শুনাবে খোশখবর!

টাকাওয়ালা

জলের সাগরে আসিনু বাহিতে তরি,
‘জল দাও’ বলে কাঁদে সর্বহারার দল –
চারিদিকে জল, জলের তৃষায় মরি!
টাকা নাই নাকি শুনি টাঁকশালে এসে,
টাকার সঙ্গে মাখামাখি, বলে – ‘টাকা থাকে কোন দেশে?’
লক্ষ্মী-বাহন প্যাঁচারা আসিয়া সারা দেশ ভরিয়াছে,
বিধাতার দেওয়া ঐশ্বর্যরে রক্ষিতা করিয়াছে!
টাকার সাকার আকার এসেই হয়ে যায় যেন পাখি,
এত টাকা আসে, উড়ে যায় সব, পাখা গজাইল নাকি?
কোথা বাসা বাঁধে এই সে টাকার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি?
কোথা ডিম পাড়ে, ছানা হয় তার কোন সে ব্যাংকে জমি?
মহাকাল-ব্যাধ দেখিতে পেয়েছে তাদের টাকার বাসা,
মৃত্যু-শায়ক লইয়া এসেছে– যত টাকা ট্যাঁকে ঠাসা!
এই চাকতির খাঁকতি ছিল না এ জীবনে কোনোদিন,
টাকার মহিমা বুঝিনু, যেদিন আকন্ঠ হল ঋণ।
যত শোধ করি, তত সুদ বাড়ে! ঋণ, না কচুরিপানা?
শিলমোহরের ভয়ে চাইনিকো মোহরের মিহি-দানা!
ধন্না দিইনি টাকাওয়ালাদের পাকা ইমারতে কভু,
আল্লাহ্ ছাড়া কারেও কখনও বলিনি হুজুর, প্রভু!
টাকাওয়ালাদের দেখে এই জ্ঞান হইয়াছে সঞ্চয়,
টাকাওয়ালাদের চেয়ে ঝাঁকাওয়ালা অনেক মহৎ হয়!

সোনা যারা পায়, তাহারাই হয় সোনার পাথর-বাটি,
আশরফি পেয়ে আশরাফ হয় চালায়ে মদের ভাঁটি!
মানুষের রূপে এরা রাক্ষস রাবণ-বংশধর,
পৃথিবীতে আজ বড়ো হইয়াছে যত ভোগী বর্বর!
এদের ব্যাংক ‘রিভার-ব্যাংক’ হইবে দুদিন পরে,
বোঝে না লোভীরা, ভীষণ মৃত্যু আসিছে এদেরই তরে!
জমানো অর্থ যত অনর্থ আনিয়াছে পৃথিবীতে,
পরমার্থের প্রভু আসিয়াছে তাহার হিসাব নিতে!
রবে না এ টাকা, বংশেও বাতি দিতে রহিবে না কেউ,
তবু কমিল না নিত্য লোভীর ভুঁড়ির ঢেকুর-ঢেউ!
ইহাদের লোভ নিরন্ন দেশবাসী করিবে না ক্ষমা,
বহু আক্রোশ বহু ক্রোধ বহু প্রহরণ আছে জমা।
রুটি কাগজের হয়ে যায়, তবু কাগজের টাকা লয়ে,
পাতালের জীব পৃথিবীতে আজও বেড়ায় মাতাল হয়ে।
কোন অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করিতে আসিনু কোথা?
অক্টোপাসের মতো কেন মোরে জড়াল স্বর্ণলতা?
ভিখারি হওয়ার ভিক্ষা চাহিয়াছিনু আল্লার কাছে,
আজ দেখি মোর চারপাশে যত ভূত প্রেত যেন নাচে!
আল্লাহ্! মোরে এ শাস্তি হতে ফিরাইয়া লয়ে যাও!
টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে ফাঁকা আকাশের তলে নাও!

ডুবিবে না আশাতরি

তুমি ভাসাইলে আশাতরি, প্রভু, দুর্দিন ঘন ঝড়ে,
ততবার ঝড় থেমে যায়, তরি যতবার টলে পড়ে।
তুমি যে-তরির কাণ্ডারি তার ডুবিবার ভয় নাই,
তোমার আদেশে সে তরির দাঁড় বাহি, গুন টেনে যাই।
আসে বিরুদ্ধশক্তি ভীষণ প্রলয়-তুফান লয়ে
কাঁপে তরণির যাত্রীরা কেহ নিরাশায় কেহ ভয়ে।
নদীজল কাঁপে টলমল যেন আহত ফণীর ফণা,
দমকে অশনি চমকে দামিনী – ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা।
অন্ধ যামিনী, দেখিতে পাই না কাণ্ডারি তুমি কোথা?
তোমার জ্যোতিতে অগ্রপথের দূর করো অন্ধতা!
তোমার আলোরে আবৃত করে ভয়াল তিমির রাতি,
দূর করো ভয়, হে চির-অভয়, জ্বালায়ে আশার বাতি!
হে নবযুগের নব অভিযান-সেনাদল, শোনো সবে,
তোমরা টলিলে তুফানে তরণি আরও চঞ্চল হবে।
এ তরির কাণ্ডারি আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান,
বিশ্বাস রাখো তাঁর শক্তিতে, এ তাঁহার অভিযান।
ভয় যার মনে যুদ্ধ না করে তার পরাজয় হয়,
ভয় যার নাই মরিয়াও সেই শহিদের হয় জয়।
অগ্রপথের সেনারা করে না পৃষ্ঠপ্রদর্শন,
জয়ী হয় তারা জীবনে, অথবা মৃত্যু করে বরণ!
জীবন মৃত্যু সমান তাদের, ঘুম জাগরণ সম,
এক আল্লাহ্‌ ইহাদের প্রভু, বন্ধু ও প্রিয়তম।
আল্লার নামে অভিযান করি, আমাদের ভয় কোথা,
দুবার মরে না মানুষ, তবুও কেন এ দুর্বলতা।
ডুবে যদি তরি, বাঁচি কীবা মরি, আল্লা মোদের সাথি,
যেখানেই উঠি তাঁর আশ্রয় পাব মোরা দিবারাতি।
মোদের ভরসা একমাত্র সে নিত্য পরম প্রভু,
দুলুক তরণি, আমাদের মন নাহি দোলে যেন কভু।
পাব কূল মোরা পাব আশ্রয় – রাখো বিশ্বাস রাখো,
তাঁর কাছে করো শক্তি ভিক্ষা, তাঁরে প্রাণ দিয়া ডাকো।
পূর্ণ ধৈর্য ধারণ করিয়া থির করো প্রাণমন,
দূর হবে সব বাধা ও বিঘ্ন,আসিবে প্রভঞ্জন।
হয়তো প্রভুর পরীক্ষা ইহা, ভয় দেখাইয়া তিনি
ভয় করিবেন দূর আমাদের, জ্ঞাতা একক যিনি!
পার হইতেছি মোরা নিরাশা ও অবিশ্বাসের নদী,
ডুবিবে তরণি, যদি ভয় পাই অধৈর্য আসে যদি!
হে নবযুগের নৌসেনা, রণতরির নওজোয়ান!
আল্লারে নিবেদন করে দাও আল্লার দেওয়া প্রাণ।
পলাইয়া কেহ বাঁচিতে পারে না মৃত্যুর হাত হতে,
মরিতে হয় তো মরিব আমরা এক-আল্লার পথে।
পৃথিবীর চেয়ে সুন্দরতর কত যে জগৎ আছে,
সে জগৎ দেখে যাব আনন্দধামে আল্লার কাছে।
– আমাদের কীবা ভয় –
আমাদের চির চাওয়া-পাওয়া এক আল্লাহ্‌ প্রেমময়!
তাঁর প্রেমে মোরা উন্মাদ, তাঁর তেজ হাতে তলোয়ার,
মোদের লক্ষ্য চির-পূর্ণতা নিত্য সঙ্গ তাঁর।
দুলুক মোদের রণতরি, যেন মনতরি নাহি দোলে,
যেখানেই যাই মোরা জানি ঠাঁই পাব, পাব তাঁর কোলে।
থেমে যাবে এই দুর্যোগ-ঘন প্রলয় তুফান ঝড়,
‘কওসর-অমৃত’ পাব, করো আল্লাতে নির্ভর!
মোদের অপূর্ণতা ও অভাব পূরণ করিবে সে,
অসম্ভবের অভিযান-পথে সৈন্য করেছে যে!
তাঁরই নাম লয়ে বলি, বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো,
তাঁর সাথে ভাব হয় যার, তার অভাব থাকে না কোনো।
তাঁহারই কৃপায় তাঁরে ভালোবেসে, বলে আমি চলে যাই,
তাঁরে যে পেয়েছে, দুনিয়ায় তার কোন চাওয়া-পাওয়া নাই।
আর বলিব না। তাঁরে ভালোবেসে ফিরে এসে মোরে বলো,
কী হারাইয়া কী পাইয়াছ তুমি, কী দশা তোমার হল!

তোমারে ভিক্ষা দাও

বলো হে পরম প্রিয়-ঘন মোর স্বামী!
আমাতে কাহারও অধিকার নাই, এক সে তোমার আমি।
ভালো ও মন্দে মধুর দ্বন্দ্বে কী খেলা আমারে লয়ে
খেলিতেছ তুমি, কেহ জানিবে না, থাকুক গোপন হয়ে!
আমারেও তাহা জানিতে দিয়ো না শুধু এই জানাইয়ো,
আমার পূর্ণ পরম মধুর, মধুর তুমি হে প্রিয়!
আমার জানা ও না-জানা সর্ব অস্তিত্বের প্রভু
একা তুমি হও! সেথা কারও ছায়া পড়ে নাকো যেন কভু!
তোমার আমার পরমানন্দ ফোটে ছন্দ ও গানে,
তুমি শুনো তাহা, তুমি লঘু ; গুরুজন হাত দিক কানে!
লতার প্রলাপ গোলাপের মতো কথা মোর কেন ফোটে!
তুমি জান, কেন উষা আসে ভোরে, কেন শুকতারা ওঠে।
ঘুমে জাগরণে শয়নে স্বপনে সর্বকর্মে মম
তব স্মৃতি তব নাম যেন হয় সাথি মোর, প্রিয়তম!
নিবিড় বেদনা হইয়া আমার বক্ষে নিত্য থেকো,
ভুলিতে দিয়ো না, আমি যদি ভুলি অমনি আমারে ডেকো!
তুমি যারে ভোলো, ভাগ্যহীন সে তোমারে ভুলিয়া যায়,
তুমি কৃপা করে চাহ যার পানে, সেই তব প্রেম পায়।
তুমি যারে ডাক, পাগল হইয়া সেই ধায় তব পথে,
বাঁশি না শুনিলে বন-হরিণী কি ছুটে আসে বন হতে?
চাঁদ ওঠে আগে, দেখে অনুরাগে চকোরী ব্যাকুলা হয়,
এত পাখি আছে, চাতকীরই কেন মেঘের সাথে প্রণয়?
কে দিলে তাহারে মেঘের তৃষ্ণা, হে রস-মধুর, বলো!
তুমি রস দিলে আঁখির আকাশ হয় জল-ছলছল।
চাঁদ যবে ওঠে, চকোর তাহার চকোরীরে ভুলে যায়,
চকোরীও ভোলে চকোরে, যখন চাঁদের সে দেখা পায়।
চাঁদের স্বপন ভুলিয়া দুজন নীড়ে কেন ফিরে আসে?
তব লীলা ধরা পড়ে যায়, দেখে কেউ কাঁদে, কেউ হাসে।
তুমি নির্গুণ নাকি? আমি দেখি গুণের অন্ত নাই,
ভিক্ষা যাচ্ঞা করিতে আসিয়া শুধু তব গুণ গাই!
ভুলে যাই আমি কী ভিক্ষা চাই, পরান কাহারে যাচে,
খুঁজিয়া পাই না ভিক্ষার ঝুলি, চোরে চুরি করিয়াছে!
মন হাসে, প্রাণ কাঁদে! বলে, জানি চুরি করে কোন চোরে।
তোমারে যে চায় ভিক্ষা, তাহার ঝুলিটিও নাও হরে!
যে হাতে ভিক্ষা চায়, ভিখারির সে হাত কাড়িয়া লও,
হে মহামৌনী! কাঁদ কেন এত? কথা কও কথা কও!
কত যুগ গেল, কত সে জনম শুনিনি তোমার কথা,
এত অনুরাগ দিয়ে, বৈরাগী, কেন দিলে বধিরতা?
তোমারে দেখার দৃষ্টি দিলে না, দিলে শুধু আঁখিজল,
অশ্রু তোমার কৃপা ; তবু আঁখি হল নাকি নির্মল?
দৃষ্টিরে কেন ফিরাইয়া দাও – তব সৃষ্টির পানে?
বলো, বলো, কোথা লুকাইয়া আছ সৃষ্টির কোনখানে!
ঊর্ধ্বে যাব না, লহো হাত ধরে তব সৃষ্টির কাছে,
কোথা তুমি, সেথা লয়ে যাও, এই অন্ধ ভিখারি যাচে!
কী ভিক্ষা চায় ভিখারি তোমার, আগে থেকে রাখো জেনে,
চাহিব যখন, হে চোর, তখন পলায়ো না হার মেনে।
আর কিছু নয়, চির প্রেমময়, তোমারে ভিক্ষা চাই,
এক তুমি ছাড়া এই ভিখারির কিছুই চাওয়ার নাই!
তব দেওয়া এই তনুমনপ্রাণ মোর যাহা কিছু আছে,
তুমি জান, কেন নিবেদন করে দিয়াছি তোমার কাছে।
যা-কিছু পেয়েছি, পাইতেছি যাহা, পাইব যা কিছু পরে,
সে যে তব দান, তাই নিবেদিত থাক উহা তব তরে।
তোমার দানের সম্মান, প্রভু, আমি কি রাখিতে পারি?
তব দান দাও সকলে বিলায়ে, আমারে করো ভিখারি!
তব দান মোর কামনা ও লোভ সঞ্চিত করে রাখে,
বঞ্চিত করে তোমার মিলনে, ওই সবই ঘিরে থাকে!
দান দিয়ে মোরে দিয়ো না ফিরায়ে, হে দানী, তোমারে দাও,
তব দান নিয়ে তব ভিখারিরে চিরতরে চিনে নাও!
তোমারেই চাই জেনে করিয়াছ চুরি ভিক্ষার ঝুলি,
ধরা পড়িয়াছ মনোচোর, দাও চোখের বাঁধন খুলি।
সব ভুলে যাই, কিছু মনে নাই, খেলাতেছিলে কী খেলা,
আমারই মতন ঘুমাইতে কারে দাওনি?
তব নাম লয়ে সুদূর মিনারে কে ডাকিছে ভোরবেলা?

নবযুগ

-বিশ বৎসর আগে
তোমার স্বপ্ন অনাগত ‘নবযুগ’-এর রক্তরাগে
রেঙে উঠেছিল। স্বপ্ন সেদিন অকালে ভাঙিয়া গেল,
দৈবের দোষে সাধের স্বপ্ন পূর্ণতা নাহি পেল!
যে দেখায়েছিল সে মহৎ স্বপ্ন, তাঁরই ইঙ্গিতে বুঝি
পথ হতে হাত ধরে এনেছিলে এই সৈনিকে খুঁজি?
কোথা হতে এল লেখার জোয়ার তরবারি-ধরা হাতে
কারার দুয়ার ভাঙিতে চাহিনু নিদারুণ সংঘাতে।–
হাতের লেখনী, কাগজের পাতা নহে ঢাল তলোয়ার,
তবুও প্রবল কেড়ে নিল দুর্বলের সে অধিকার!
মোর লেখনীর বহ্নিস্রোত বাধা পেয়ে পথে তার
প্রলয়ংকর ধূমকেতু হয়ে ফিরিয়া এল আবার!
ধূমকেতু-সম্মার্জনী মোর করে নাই মার্জনা
কারও অপরাধ ; অসুরে নিত্য হানিয়াছে লাঞ্ছনা!-
হারাইয়া গেনু ধুমকেতু আমি দু-দিনের বিস্ময়,
মরা তারাসম ঘুরিয়া ফিরিনু শূন্য আকাশময়।

সে যুগের ওগো জগলুল! আমি ভুলিনি তোমার স্নেহ,
স্মরণে আসিত তোমার বিরাট হৃদয়, বিশাল দেহ।
কত সে ভুলের কাঁটা দলি, কত ফুল ছড়াইয়া তুমি,
ঘুরিয়া ফিরেছ আকুল তৃষায় জীবনের মরুভূমি।
আমি দেখিতাম, আমার নিরালা নীল আশমান থেকে
চাঁদের মতন উঠিতেছ, কভু যাইতেছ মেঘ ঢেকে।
সুদূরে থাকিয়া হেরিতাম তব ভুলের ফুলের খেলা,
কে যেন বলিত, এ চাঁদ একদা হইবে পারের ভেলা।

সহসা দেখিনু, এই ভেলা যাহাদের পার করে দিল,
যে ভেলার দৌলত ও সওদা দশ হাতে লুটে নিল,
বিশ্বাসঘাতকতা ও আঘাত-জীর্ণ সেই ভেলায়
উপহাস করে তাহারাই আজ কঠোর অবহেলায়!
মানুষের এই অকৃতজ্ঞতা দেখি উঠি শিহরিয়া,
দানীরে কি ঋণী স্বীকার করিল এই সম্মান দিয়া?
যত ভুল তুমি করিয়াছ, তার অনেক অধিক ফুল
দিয়াছ রিক্ত দেশের ডালায়, দেখিল না বুলবুল!
যে সূর্য আলো দেয়, যদি তার আঁচ একটুকু লাগে,
তাহারই আলোকে দাঁড়ায়ে অমনি গাল দেবে তারে রাগে?
নিত্য চন্দ্র সূর্য; তারাও গ্রহণে মলিন হয়;
তাই বলে তার নিন্দা করা কি বুদ্ধির পরিচয়?
এই কী বিচার লোভী মানুষের? বক্ষে বেদনা বাজে,
অর্থের তরে অপমান করে আপনার শির-তাজে!
দুঃখ কোরো না, ক্ষমা করো, ওগো প্রবীণ বনস্পতি!
যার ছায়া পায় তারই ডাল কাটে অভাগা মন্দমতি।

আমি দেখিয়াছি দুঃখীর তরে তোমার চোখের পানি,
এক আল্লাহ্ জানেন তোমারে, দিয়াছ কী কোরবানি!
এরা অজ্ঞান, এরা লোভী, তবু ইহাদেরে করো ক্ষমা,
আবার এদেরে ডেকে আল্লার ঈদ্গাহে করো জমা।
শপথ করিয়া কহে এ বান্দা তার আল্লার নামে,
কোনো লোভ কোনো স্বার্থ লইয়া দাঁড়াইনি আমি বামে।
যে আল্লা মোরে রেখেছেন দূরে সব চাওয়া পাওয়া হতে,
চলিতে দেননি যিনি বিদ্বেষ-গ্লানিময় রাজপথে,
যে পরম প্রভু মোর হাতে দিয়া তাঁহার নামের ঝুলি,
মসনদ হতে নামায়ে, দিলেন আমারে পথের ধূলি,
সেই আল্লার ইচ্ছায় তুমি ডেকেছ আমারে পাশে!–
অগ্নিগিরির আগুন আবার প্রলয়ের উল্লাসে
জাগিয়ে উঠেছে, তাই অনন্ত লেলিহান শিখা মেলি,
আসিতে চাহিছে কে যেন বিরাট পাতাল-দুয়ার ঠেলি,
অনাগত ভূমিকম্পের ভয়ে দুনিয়ায় দোলা লাগে,
দ্যাখো দ্যাখো শহিদান ছুটে আসে মৃত্যুর গুলবাগে!
কে যেন কহিছে, ‘বান্দা আর এক বান্দার হাত ধরো,
মোর ইচ্ছায় ওর ইচ্ছারে তুমি সাহায্য করো,’
তাই নবযুগ আসিল আবার। রুদ্ধ প্রাণের ধারা
নাচিছে মুক্ত গগনের তলে দুর্দম মাতোয়ারা।
এই নবযুগ ভুলাইবে ভেদ, ভায়ে ভায়ে হানাহানি,
এই নবযুগ ফেলিবে ক্লৈব্য ভীরুতারে দূরে টানি।
এই নবযুগ আনিবে জরার বুকে নবযৌবন,
প্রাণের প্রবাহ ছুটিবে, টুটিবে জড়তার বন্ধন।
এই নবযুগ সকলের, ইহা শুধু আমাদের নহে,
সাথে এসো নওজোয়ান! ভুলিয়া থেকো না মিথ্যা মোহে।
ইহা নহে কারও ব্যাবসার, স্বদেশের স্বজাতির এ যে,
শোনো আশমানে এক আল্লার ডঙ্কা উঠিছে বেজে।

মোরা জনগণ, শতকরা মোরা নিরানব্বই জন,
মোরাই বৃহৎ, সেই বৃহতের আজ নবজাগরণ।
ক্ষুদ্রের দলে কে যাবে তোমরা ভোগবিলাসের লোভে?
আর দেরি নাই, ওদের কুঞ্জ ধূলিলুন্ঠিত হবে!
আছে হাদের বৃহতের তৃষা, নির্ভয় যার প্রাণ,
সেই বীরসেনা লয়ে জয়ী হবে নবযুগ-অভিযান।
আল্লার রাহে ভিক্ষা চাহিতে নবযুগ আসিয়াছে,
মহাভিক্ষুরে ফিরায়ো না, দাও যার যাহা কিছু আছে।
জাগিছে বিরাট দেহ লয়ে পুন সুপ্ত অগ্নিগিরি,
তারই ধোঁয়া আজ ধোঁয়ায়ে উঠেছে আকাশভুবন ঘিরি।
একী এ নিবিড় বেদনা
একী এ বিরাট চেতনা
জাগে পাষাণের শিরায় শিরায়, সাথে জনগণ জাগে,
হুংকারে আজ বিরাট, ‘বক্ষে কার পা-র ছোঁয়া লাগে,
কোন মায়াঘুমে ঘুমায়ে ছিলাম, বুঝি সেই অবসরে
ক্ষুদ্রের দল বৃহতের বুকে বসে উৎপাত করে!
মোর অণুপরমাণু জনগণ জাগো, ভাঙো ভাঙো দ্বার,
রুদ্র এসেছে বিনাশিতে আজ ক্ষুদ্র অহংকার।’

নবাগত উৎপাত

মনে পড়ে আজ পলাশির প্রান্তর –
আসুরিক লোভে কামানের গোলা বারুদ লইয়া যথা
আগুন জ্বালিল স্বাধীন এ বাংলায়।
সেই আগুনের লেলিহান শিখা শ্মশানের চিতা সম
আজও জ্বলিতেছে ভারতের বুকে নিষ্ঠুর আক্রোশে।
দুই শতাব্দী নিপীড়িত এই দেশের নর ও নারী
আঁখিজল ঢালি নিভাতে নারিল সেই আগুনের শিখা।
এ কোন করালী রাক্ষুসি তার রক্তরসনা মেলি
মজ্জা অস্থি রক্ত শুষিয়া শক্তি হরিয়া যেন
চল্লিশ কোটি শবের উপরে নাচিছে তাথই থই!
অক্ষমা অভিশপ্তা শকতি তামসী ভয়ংকরী।
চল্লিশ কোটি নরকঙ্কাল লয়ে এই অকরুণা
জাদুকরি নিশিদিন খেলিতেছে জাদু ও ভেলকি, হায়!
যত যন্ত্রণা পাইয়াছি তত তার ভূত-প্রেত সেনা
হাসিয়া অট্টহাসি বিদ্রুপ করেছে শক্তিহীনে!

এ কাহার অভিশাপ সর্পিণী হয়ে জড়াইয়া আছে,
সারা দেহ মন প্রাণ জরজর করি কালকূট বিষে
লয়ে যায় যমলোকে! – হায়, যথা গঙ্গা যমুনা বহে –
যথায় অমৃত-মধুরসধারা বর্ষণ হত নিতি,
যে ভারতে ছিল নিত্য শান্তি সাম্য প্রেম ও প্রীতি,
যে ভারতের এই আকাশ হইতে ঝরিত স্নিগ্ধ জ্যোতি
সে আকাশ আজ মলিন হয়েছে বোমা বারুদের ধূমে।
যে দেশে জ্বলিত হোমাগ্নি, সেথা বোমার আগুন এল,
ক্ষুধিত দৈত্য-শক্তি শকুনি হয়ে আজ ঝাঁকে ঝাঁকে
উড়িয়া বেড়ায় আমাদের পচা গলা মাংসের লোভে।

হে পরম পুরুষোত্তম! বলো, বলো, আর কতদিন
উদাসীন হয়ে রহিবে? – তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নর
নিদারুণ যাতনায় নিশিদিন করিছে আর্তনাদ!
নিরস্ত্র দেশে লয়ে তব জ্যোতি সুন্দর তরবারি
দুর্বল নিপীড়িতের বন্ধু হইয়া প্রকাশ হও!
বন্দি আত্মা কাঁদে কারাগারে, ‘দ্বার খোলো, খোলো দ্বার!
পরাধীনতার এই শৃঙ্খল খুলে দাও, খুলে দাও!
নিপীড়িত যেন নতুন পীড়ার যন্ত্রণা নাহি পায়,
প্রভু হয়ে নয়, বন্ধু হইয়া এসো বন্দির দেশে।’

 নারী

হায় ফিরদৌসের ফুল! ফুটিতে আসিলে ধূলির ধরায় কেন? সে কি মায়া? সে কি ভুল? কোন আনন্দধামে জড়াইয়া ছিলে কোন একাকীর বামে? তাঁহারই জ্যোতির্মণিকা-কণিকা এসেছে প্রকৃতি হয়ে সপ্ত আকাশ রসে ডুবাইয়া প্রেম ও মাধুরী লয়ে। পরম জ্যোতির্দীপ্তিরে নাহি ডরিলে পরম রুদ্রে প্রেম-চন্দন মাখায়ে স্নিগ্ধ করিলে! শুভ্র জ্যোতির্পুঞ্জ-ঘন অরূপে গলাইলে তুমি ময়ূরকন্ঠী নবীন নীরদ রূপে! নীল মেঘে হলে শক্তি বিজলি-লেখা শূন্যবিহারী একাকী পুরুষে রহিতে দিলে না একা। স্রষ্টা হইল প্রিয়-সুন্দর সৃষ্টিরে প্রিয়া বলি কল্পতরুতে ফুটিল প্রথম নারী আনন্দকলি! নিজ ফুলশরে যেদিন পুরুষ বিঁধিল আপন হিয়া, ফুটিল সেদিন শূন্য আকাশে আদিবাণী – ‘প্রিয়া, প্রিয়া!’ আকাশ ছাইল অনন্তদল শতদলে আর প্রেমে, শান্ত মৌনী এল যৌবন-চঞ্চল হয়ে নেমে। কে দেখিত সেই পরম শূন্য, অসীম পাষাণ-শিলা, সীমায় যদি না বাঁধিতে তাহারে না দেখাতে রূপ-লীলা! কোন সে গোপন পরমাশ্রী প্রকৃতি লুকায়ে ছিলে? ভুবনে ভুবনে ভবন রচিয়া রস-দীপ জ্বালাইলে! অনন্তশ্রী ঝরে পড়ে নিতি অনন্ত দিকে তব, তুমি এলে, তাই সম্ভাবনায় আসিল অসম্ভব! হে পবিত্রা চির-কল্যাণী, কে বলে তোমায় মায়া ? এই সুন্দর রবি শশী তারা গিরি প্রান্তর নদীজলধারা অসীম আকাশ সাগর ধরিতে পারে না তোমার কায়া, তব রূপে দেখি না-দেখা পরম সুন্দরের যে ছায়া, – কে বলে তোমায় মায়া? তুমি তাঁর তেজ, তব তেজে জ্বলে আমার এই জীবন, সূর্যের মতো চাঁদসম আকাশের কোলে অনুখন। মাতা হয়ে তুমি দিয়াছ এ মুখে প্রথম-স্তন্যরস, স্নেহ-অঞ্চলে বাঁধিয়া এ ঘর ছাড়ায়ে করেছ বশ। যখনই পালাতে চাহিয়াছি বনে, কে তুমি অশ্রুমতী, কাঁদিয়াছ মোর হৃদয়ে বসিয়া, রোধ করিয়াছ গতি? সুন্দর প্রকৃতিরে হেরি মোর তৃষ্ণা জাগিল প্রাণে, এত সুন্দর সৃষ্টি করে যে, সে থাকে সে-কোনখানে। আমার পূর্ণ সুন্দরের যে পথের দিশারি তুমি, তুমি ছায়া হয়ে সাথে চল যবে পার হই মরুভূমি? যতবার নিভে যায় আশা-দীপ, ততবার তুমি জ্বাল, শূন্য আঁধারে সম্মুখে জ্বলে তোমার আঁধারি-আলো! অনন্তধারা প্রেমের ঝরনা কোথা লুকাইয়া ছিলে? উদাসীন গিরি-পাষাণের হিয়া রসে ভাসাইয়া দিলে! পাথরের বিগ্রহ হয়েছিল নিস্তেজ আদি-নর, তেজোময়ী আদি-নারী সে পাষাণে কাঁপাইলে থরথর। নিষ্কাম ঘন অরণ্যে সেই প্রথম কামনা-জুঁই আঁখি মেলি যেন দেখিল সৃষ্টি, হেসে এক হল দুই! এই দুই হয়ে দ্বন্দ্ব আসিল, ছন্দ জাগিল পায়, সোনাতে কাঁকরে দুজনে মিলিয়া নূপুর বাজায়ে যায়! সালাম লহো গো প্রণাম লহো গো প্রকৃতি পুণ্যবতী, তব প্রেম দেখায়েছে গো চির আনন্দধামের জ্যোতি! প্রেমের প্রবাহ লইয়া যখন আস হয়ে উপনদী – মরুতে মরে না নরের তৃষ্ণানদী – সাগরের পানে ছুটে চলে নিরবধি! পুরুষের জ্ঞান রসায়িত হয় প্রকৃতির প্রেমরসে, তরবারি ধরে উদাসীন নর রণক্ষেত্রে পশে! যে দেশে নারীরা বন্দিনী, আদরের নন্দিনী নয়, সে দেশে পুরুষ ভীরু কাপুরুষ জড় অচেতন রয়! অভিশপ্ত সে দেশ পরাধীন, শৌর্য-শক্তিহীন, শোধ করেনি যে দেশ কল্যাণী সেবিকা নারীর ঋণ! নারী অমৃতময়ী, নারী কৃপা – করুণাময়ের দান, কল্যাণ কৃপা পায় না, যে করে নারীর অসম্মান! বেহেশ্‌ত’ স্বর্গ শুকাইয়া যায় প্রকৃতি না থাকে যদি, জ্বলে না আগুন, আসে না ফাগুন, বহে না বায়ু ও নদী! আজও রবি শশী ওঠে ফুল ফোটে নারীদের কল্যাণে, নামে সখ্য ও সাম্য শান্তি নারীর প্রেমের টানে। নারী আজও পথে চলে তাই ধূলিপথ হয় বিধৌত শুদ্ধ মেঘের জলে! নারীর পুণ্য প্রেম আনন্দ রূপ রস সৌরভ আজও সুন্দর করিয়া রেখেছে বিধাতার গৌরব!

নিত্য প্রবল হও

অন্তরে আর বাহিরে সমান নিত্য প্রবল হও!
যত দুর্দিন ঘিরে আসে, তত অটল হইয়া রও!
যত পরাজয়-ভয় আসে, তত দুর্জয় হয়ে ওঠো।
মৃত্যুর ভয়ে শিথিল যেন হয় তলোয়ার-মুঠো।
সত্যের তরে দৈত্যের সাথে করে যাও সংগ্রাম,
রণক্ষেত্রে মরিলে অমর হইয়া রহিবে নাম।
এই আল্লার হুকুম – ধরায় নিত্য প্রবল রবে,
প্রবলেই যুগে যুগে সম্ভব করেছে অসম্ভবে।
ভালোবাসেন না আল্লা, অবিশ্বাসী ও দুর্বলেরে,
‘শেরে-খোদা’ সেই হয়, যে পেয়েছে অটল বিশ্বাসেরে!
ধৈর্য ও বিশ্বাস হারায়, সে মুসলিম নয় কভু,
বিশ্বে কারেও করে নাকো ভয় আল্লাহ্‌ যার প্রভু!
নিন্দাবাদের মাঝে ‘আল্লাহ্ জিন্দাবাদ’-এর ধ্বনি
বীর শুধু শোনে, কোনো নিন্দায় কোনো ভয় নাহি গণি।
আল্লা পরম সত্য, ভয় সে ভ্রান্তির কারসাজি,
প্রচণ্ড হয় তত পৌরুষ, যত দেখে দাগাবাজি!
ভুলে কি গিয়াছ অসম সাহস নির্ভীক আরবির?
পারস্য আর রোমক সম্রাটের কাটিয়াছে শির!
কতজন ছিল সেনা তাহাদের? অস্ত্র্র কী ছিল হাতে?
তাদের পরম নির্ভর ছিল শুধু এক আল্লাতে।
জয় পরাজয় সমান গণিয়া করেছিল শুধু রণ,
তাদের দাপটে কেঁপে উঠেছিল পৃথিবীর প্রাঙ্গণ!
তারা দুনিয়ার বাদশাহি করেছিল ভিক্ষুক হয়ে,
তারা পরাজিত হয়নি কখনও ক্ষণিকের পরাজয়ে।
হাসিয়া মরেছে করেনি কখনও পৃষ্ঠপ্রদর্শন,
ইসলাম মানে বুঝেছিল তারা অসত্য সাথে রণ।
তারা জেনেছিল, দুনিয়ায় তারা আল্লার সৈনিক,
অর্জন করেছিল স্বাধীনতা নেয়নি মাগিয়া ভিখ!
জয়ী হতে হলে মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ হইতে হয়,
শত্রু-সৈন্য দেখে কাঁপে ভয়ে, সে তো সেনাপতি নয়!
শত্রু-সৈন্য যত দেখে তত রণ-তৃষ্ণা তার বাড়ে,
দাবানল সম তেজ জ্বলে ওঠে শিরায় শিরায় হাড়ে!
তলোয়ার তার তত তেজ ফোটে যত সে আঘাত খায়,
তত বধ করে শত্রুর সেনা, রসদ যত ফুরায়।
নিরাশ হোয়ো না! নিরাশা ও অদৃষ্টবাদীরা যত
যুদ্ধ না করে হয়ে আছে কেউ আহত ও কেউ হত!

যে মাথা নোয়ায়ে সিজদা করেছ এক প্রভু আল্লারে,
নত করিয়ো না সে মাথা কখনও কোনো ভয়ে কোনো মারে!
আল্লার নামে নিবেদিত শির নোয়ায় সাধ্য কার।
আল্লা সে শির বুকে তুলে নেন, কাটে যদি তলোয়ার!
ভীরু মানবেরে প্রবল করিতে চাহেন যে দুনিয়াতে
তাঁরেই ইমাম নেতা বলি আমি, প্রেম মোর তারই সাথে।
আড়ষ্ট নরে বলিষ্ঠ করে যাঁর কথা যাঁর কাজ,
তাঁরই তরে সেনা সংগ্রহ করি, গড়ি তাঁরই শির-তাজ!
গরিবের ঈদ আসিবে বলিয়া যে আত্মা রোজা রাখে,
পরমাত্মার পরমাত্মীয় বলে আমি মানি তাঁকে।
অকল্যাণের দূত যারা, যারা মানুষের দুশমন,
তাদের সঙ্গে যে দুরন্তেরা করিবে ভীষণ রণ –
মোর আল্লার আদেশে তাদেরে ডাক দিই জমায়েতে,
অচেতন ছিল যারা, তারা আসিতেছে সে তীর্থপথে।
আমি তকবীর-ধ্বনি করি শুধু কর্ম-বধির কানে,
সত্যের যারা সৈনিক তারা জমা হবে ময়দানে!
অনাগত ‘নবযুগ’-সূর্যের তুর্য বাজায়ে যাই,
মৃত্যু বা কারাগারের কোনো ভয় দ্বিধা নাই।
একা ‘নবযুগ’-মিনারে দাঁড়ায়ে কাঁদিয়া সকলে ডাকি,
দরমার হাঁস না আসে, আসিবে মুক্তপক্ষ পাখি।
এ পথে ভীষণ বাজপাখি আর নিঠুর ব্যাধের ভীতি,
আলোক-পিয়াসি পাখিরা তবুও আসিছে গাহিয়া গীতি।

মৃত্যু-ভয়াক্রান্ত আজিকে বাংলার নরনারী,
তাদের অভয় দিতেই আমরা ধরিয়াছি তরবারি।
আমরা শুনেছি ভীত আত্মার সকরুণ ফরয়্যাদ,
আমরা তাদেরে রক্ষা করিব, এ যে আল্লার সাধ!
আমরা হুকুম-বর্দার তাঁর পাইয়াছি ফরমান,
ভীত নর-নারী তরে অকাতরে দানিব মোদের প্রাণ!
বাজাই বিষাণ উড়াই নিশান ঈশান-কোণের মেঘে,
প্রেম-বৃষ্টি ও বজ্র-প্রহারে আত্মা উঠিবে জেগে!
রাজনীতি করে তৈরি মোদের কুচকাওয়াজের পথ,
এই পথ দিয়ে আসিবে দেখিয়ো আবার বিজয়-রথ।
প্রবল হওয়ার সাধ ও সাধনা যাহাদের প্রাণে আছে,
তাদেরই দুয়ারে হানা দিই আমি, আসি তাহাদেরই কাছে।
সঙ্ঘবদ্ধ হতেছে তাহারা বঙ্গভূমির কোলে,
আমি দেখিয়াছি পূর্ণচন্দ্র তাদেরই ঊর্ধ্বে দোলে!

পার্থসারথি

হে পার্থসারথি
বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য-শঙ্খ।
চিত্তের অবসাদ দূর করো, করো দূর
ভয়-ভীত জনে করো হে নিঃশঙ্ক॥
জড়তা ও দৈন্য হানো হানো
গীতার মন্ত্রে জীবন দানো
ভোলাও ভোলাও মৃত্যু-আতঙ্ক॥

মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে,
শোনাও শোনাও, অনন্তকাল ধরি
অনন্ত জীবন-প্রবাহ বহে॥
দুরন্ত দুর্মদ যৌবন-চঞ্চল
ছাড়িয়া আসুক মা-র স্নেহ-অঞ্চল
বীর সন্তান দল
করুক সুশোভিত মাতৃ-অঙ্ক॥

পুরববঙ্গ

পদ্ম-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা-বিধৌত পূর্ব-দিগন্তে
তরুণ অরুণ বীণা বাজে তিমির বিভাবরী-অন্তে।
ব্রাহ্ম মুহুর্তের সেই পুরবাণী
জাগায় সুপ্ত প্রাণ জাগায় – নব চেতনা দানি
সেই সঞ্জীবনী বাণী শক্তি তার ছড়ায়
পশ্চিমে সুদূর অনন্তে॥
ঊর্মিছন্দা শত-নদীস্রোত-ধারায় নিত্য পবিত্র –
সিনান-শুদ্ধ-পুরববঙ্গ
ঘন-বন-কুন্তলা প্রকৃতির বক্ষে সরল সৌম্য
শক্তি-প্রবুদ্ধ পুরববঙ্গ
আজি শুভলগ্নে তারই বাণীর বলাকা
অলখ ব্যোমে মেলিল পাখা
ঝংকার হানি যায় তারই পুরবাণী
জীবন্ত হউক হিম-জর্জর ভারত
নবীন বসন্তে॥

বকরীদ

শহিদান’দের ঈদ এল বকরীদ!
অন্তরে চির-নওজোয়ান যে তারই তরে এই ঈদ।
আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান,
নির্লোভ নিরহংকার যারা, যাহারা নিরভিমান,
দানব-দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে,
ফিরদৌস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে,
অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাশ করিতে যারা
জন্ম লয়েছে চিরনির্ভীক যৌবন-মাতোয়ারা, –
তাহাদেরই শুধু আছে অধিকার ঈদ্গাহে ময়দানে,
তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান মাল কোরবানে।
বিভুতি, ‘মাজেজা’, যাহা পায় সব প্রভু আল্লার রাহে
কোরবানি দিয়ে নির্যাতিতেরে মুক্ত করিতে চাহে।
এরাই মানব-জাতির খাদেম, ইহারাই খাক্‌সার,
এরাই লোভীর সাম্রাজ্যেরে করে দেয় মিসমার!
ইহারাই ‘ফিরোদৌস-আল্লা’র প্রেম-ঘন অধিবাসী
তসবি ও তলোয়ার লয়ে আসি অসুরে যায় বিনাশি।
এরাই শহিদ, প্রাণ লয়ে এরা খেলে ছিনিমিনি খেলা,
ভীরুর বাজারে এরা আনে নিতি নব নওরোজ-মেলা!
প্রাণ-রঙ্গিলা করে ইহারাই ভীতি-ম্লান আত্মায়,
আপনার প্রাণ-প্রদীপ নিভায়ে সবার প্রাণ জাগায়।
কল্পবৃক্ষ পবিত্র ‘জৈতুন’ গাছ যথা থাকে,
এরা সেই আশমান থেকে এসে, সদা তারই ধ্যান রাখে!
এরা আল্লার সৈনিক, এরা ‘জবীহুল্লা’-র সাথি,
এদেরই আত্মত্যাগ যুগে যুগে জ্বালায় আশার বাতি।
ইহারা, সর্বত্যাগী বৈরাগী প্রভু আল্লার রাহে,
ভয় করে নাকো কোনো দুনিয়ার কোনো সে শাহানশাহে।
এরাই কাবার হজের যাত্রী, এদেরই দস্ত চুমি!
কওসর আনে নিঙাড়িয়া রণক্ষেত্রের মরুভূমি!
‘জবীহুল্লা’র দোস্ত ইহারা, এদেরই চরণাঘাতে,
‘আব-জমজম’ প্রবাহিত হয় হৃদয়ের মক্কাতে।
ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ?
আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম করি তারে,
ঈদ্গাহে গিয়া তারই সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।
অন্তরে ভোগী, বাইরে যে রোগী, মুসলমান সে নয়,
চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য যে পরিচয়!
লাখো ‘বকরা’র বদলে সে পার হবে না পুলসেরাত
সোনার বলদ ধনসম্পদ দিতে পার খুলে হাত?
কোরান মজিদে আল্লার এই ফরমান দেখো পড়ে,
আল্লার রাহে কোরবানি দাও সোনার বলদ ধরে।
ইব্রাহিমের মতো পুত্রেরে আল্লার রাহে দাও,
নইলে কখনও মুসলিম নও, মিছে শাফায়ৎ চাও!
নির্যাতিতের লাগি পুত্রেরে দাও না শহিদ হতে,
চাকরিতে দিয়া মিছে কথা কও– ‘যাও আল্লার পথে’!
বকরীদি চাঁদ করে ফরয়্যাদ, দাও দাও কোরবানি,
আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাঁহার না-ফরমানি!
পিছন হইতে বুকে ছুরি মেরে, গলায় গলায় মেলো,
কোরো না আত্ম-প্রতারণা আর, খেলকা খুলিয়া ফেলো!
উমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদে মনে কর,
শুধু সালওয়ার পরিয়ো না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো!
কোথায় আমার প্রিয় শহিদল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ?
এসো ঈদের নামাজ পড়িব, আলাদা আমাদের ময়দান!

বিশ্বাস ও আশা

বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে,
নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্ত সে মরিয়াছে ।
শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে,
পরান গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে!

থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রোগ শোক লাঞ্ছনা,
যুদ্ধ না করে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিয়ো না।
ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি, মিথ্যা ও অহেতুক
নিরাশায় হয় পরাজয় যার, তাহার নিত্য দুখ।

‘হয়তো কী হবে’ এই ভেবে যারা ঘরে বসে কাঁপে ভয়ে,
জীবনের রণে নিত্য তারাই আছে পরাজিত হয়ে।
তারাই বন্দি হয়ে আছে গ্লানি-অধীনতা কারাগারে;
তারাই নিত্য জ্বালায় পিত্ত অসহায় অবিচারে!

এরা অকারণ ভয়ে ভীত, এরা দুর্বল নির্বোধ,
ইহাদের দেখে দুঃখের চেয়ে জাগে মনে বেশি ক্রোধ।
এরা নির্বোধ, না করে কিছুই জিভ মেলে পড়ে আছে
গোরস্তানেও ফুল ফোটে, ফুল ফোটে না এ মরা গাছে।

এদের যুক্তি অদৃষ্টবাদ, বসে বসে ভাবে একা,
‘এ মোর নিয়তি, বদলানো নাহি যায় কপালের লেখা!’
পৌরুষ এরা মানে না, নিজেরে দেয় শুধু ধিক্কার,
দুর্ভাগ্যের সাথে নাহি লড়ে মেনেছে ইহারা হার।

এরা জড়, এরা ব্যাধিগ্রস্ত, মিশো না এদের সাথে,
মৃত্যুর উচ্ছিষ্ট আবর্জনা এরা দুনিয়াতে।
এদের ভিতরে ব্যাধি, ইহাদের দশদিক তমোময়,
চোখ বুজে থাকে, আলো দেখিয়াও বলে, ‘ইহা আলো নয়’।

প্রবল অটল বিশ্বাস যার নিশ্বাস প্রশ্বাসে,
যৌবন আর জীবনের ঢেউ কল-তরঙ্গে আসে,
মরা মৃত্তিকা করে প্রাণায়িত শস্যে কুসুমে ফলে,
কোনো বাধা তার রুধে নাকো পথ, কেবল সুমুখে চলে,
চির-নির্ভয়; পরাজয় তার জয়ের স্বর্গ-সিঁড়ি,
আশার আলোক দেখে তত, যত আসে দুর্দিন ঘিরি।
সেই পাইয়াছে পরম আশার আলো, যেয়ো তারই কাছে,
তাহারই নিকটে মৃত্যুঞ্জয়ী অভয়-কবচ আছে।

যারা বৃহতের কল্পনা করে, মহৎ স্বপ্ন দেখে,
তারাই মহৎ কল্যাণ এই ধরায় এনেছে ডেকে।
অসম্ভবের অভিযান-পথ তারাই দেখায় নরে,
সর্বসৃষ্টি ফেরেশ্‌তারেও তারা বশীভূত করে।

আত্মা থাকিতে দেহে যারা সহে আত্ম-নির্যাতন,
নির্যাতকেরে বধিতে যাহারা করে না পরান-পণ,
তাহারা বদ্ধ জীব পশু সম, তাহারা মানুষ নয়,
তাদেরই নিরাশা মানুষের আসা ভরসা করিছে লয়।

হাত-পা পাইয়া কর্ম করে না কূর্মধর্মী হয়ে,
রহে কাদা-জলে মুখ লুকাইয়া আঁধার বিবরে ভয়ে,
তাহারা মানব-ধর্ম ত্যজিয়া জড়ের ধর্ম লয়,
তাহারা গোরস্তান, শ্মশানের, আমাদের কেহ নয়!

আমি বলি, শোনো মানুষ! পূর্ণ হওয়ার সাধনা করো,
দেখিবে তাহারই প্রতাপে বিশ্ব কাঁপিতেছে থরথর।
ইহা আল্লার বাণী যে, মানুষ যাহা চায় তাহা পায়,
এই মানুষের হাত পা চক্ষু আল্লার হয়ে যায়!

চাওয়া যদি হয় বৃহৎ, বৃহৎ সাধনাও তার হয়,
তাহারই দুয়ারে প্রতীক্ষা করে নিত্য সর্বজয়।
অধৈর্য নাহি আসে কোনো মহাবিপদে সে সেনানীর,
অটল শান্ত সমাহিত সেই অগ্রনায়ক বীর।

নিরানন্দের মাঝে আল্লার আনন্দ সেই আনে,
চাঁদের মতন তার প্রেম জনগণ-সমুদ্রে টানে।
অসম সাহস আসে বুকে তার অভয় সঙ্গ করে,
নিত্য জয়ের পথে চলো সেই পথিকের হাত ধরে!

পূর্ণ পরম বিশ্বাসী হও, যাহা চাও পাবে তাই,
তাহারে ছুঁয়ো না, সেই মরিয়াছে, বিশ্বাস যার নাই!

বোমার ভয়

বোমার ভয়ে বউ, মা, বোন, নেড়রি গেঁড়রি লয়ে
দিগ্‌বিদিকে পলায় ভীরু মানুষ মৃত্যু ভয়ে!
কোনখানে হায় পলায় মানুষ, মৃত্যু কোথায় নাই?
পলাতকের দল! বলে যাও সে-দেশ কোথায় ভাই?
মানুষ মরে একবার, সে দুবার মরে নাকো,
হায় রে মানুষ! তবু কেন মৃত্যুর ভয় রাখ।
আরেক দেশে পালিয়া তোমার মৃত্যুভয় কি যাবে?
মৃত্যু – ভ্রান্তি দিবানিশি তোমায় ভয় দেখাবে।
না মরিয়া বীরের মতো মৃত্যু আলিঙ্গিয়া,
তিলে তিলে মরে ভীরু যে যন্ত্রণা নিয়া,
সে যাতনার চেয়ে বোমার আগুন স্নিগ্ধ আরও!
মরণ আসে বন্ধু হয়ে, মরতে যদি পার
তেমন মরণ। দেখবে সেদিন সবে,
পৃথ্বী হবে নতুন আবার মৃত্যু-মহোৎসবে।

আল্লাহ্‌ ভগবানের আমরা যদি আশ্রয় পাই,
সেই সে পরম অভয়াশ্রমে মৃত্যুর ভয় নাই!
যেতে পার তাঁর কাছে ছুটে তুমি প্রবল তৃষ্ণা লয়ে?
তাঁহারে ছুঁইলে ছোঁবে না তোমারে কখনও মৃত্যুভয়ে!
সেখানে যাওয়ার ট্রেন কোন ইস্টিশনে সে পাওয়া যায়?
সে প্ল্যাটফর্ম দেখেছ কি কভু? দেখনিকো তুমি হায়!
যেখানেই তুমি পালাও, মৃত্যু সাথে সাথে দৌড়াবে!
জানিয়াও কেন অকারণে মৃত্যুর ভয়ে খাবি খাবে?
দেখেছি ভীষণ মানুষের স্রোত ভীষণ শাস্তি সয়ে,
চলেছে অজানা অরণ্যে যেন ভীতি-উন্মাদ হয়ে!
পুরুষের রূপে দেখাছি বউমা করে কোণ ঠাসাঠাসি,
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া বাক্স বোঁচকা পোঁটলা রাশি।
যাহারা যাইতে পারিল না, পড়ে রহিল অর্থাভাবে
সঞ্চিত নাই অর্থ, কোথায় ক্ষুধার অন্ন পাবে?
তাহাদের কথা ভাবিল না কেউ, ধরিল না কেহ হাতে,
কেহ বলিল না, ‘মরিতে হয়তো এসো মরি এক সাথে!’
কেহ বলিল না, ‘কেন পলাইব, এসো দল বেঁধে রই,
সংঘবদ্ধ হইয়া আমরা এসো সৈনিক হই।’
ক্ষুদ্র অস্ত্র লয়ে কি করিয়া যুদ্ধ করিছে চীন?
অস্ত্র ধরিতে পারে না, যাহারা অন্তরে বলহীন।
যাহারা নির্যাতিত মানবেরে রক্ষা করিতে চায়,
আকাশ হইতে নেমে আসে, হাতে অস্ত্র তারাই পায়!
বোমার ভয় এ নহে, ইহা ক্লীব ভীরুর মৃত্যুভয়,
ইহারা ধরার বোঝা হয়ে আছে, ইহারা মানুষ নয়।

যে দেশে তাদের জন্ম সে দেশ ছেড়ে এরা পরদেশে,
কেমন করিয়া খায় দায়, মুখ দেখায়, বেড়ায় হেসে?
অর্থের চাকচিক্য দেখায়, হায় রে লজ্জাহীন,
ইহাদেরই শিরে বোমা যেন পড়ে, ইহারা হোক বিলীন!
বোমা দেখেনিকো, শব্দ শোনেনি, শুধু তার নামে প্রেমে
এদের সর্ব অঙ্গ ব্যাকুল হইয়া উঠেছে ঘেমে!
জীবন আর যৌবন যার আছে, সেই সে মৃত্যুহীন,
গোরস্তানের শ্মশানের ভূত যারা ভীরু যারা দীন!
কেন বেঁচে আছে এরা পৃথিবীরে ভারাক্রান্ত করে?
ইহাদেরই শিরে পড়ে যেন যদি বোমা কোনোদিন পড়ে!

নওজোয়ানরা এসো দলে দলে বীর শহিদান সেনা;
তোমরা লভিবে অমর-মৃত্যু, কোনো দিন মরিবে না!
ইতিহাসে আর মানবস্মৃতিতে আছে তাহাদেরই নাম,
যারা সৈনিক, দৈত্যের সাথে করেছিল সংগ্রাম!
যারা ভীরু, তারা কীটের মতন কখন গিয়েছে মরে,
তাদের কি কোনো স্মৃতি আছে, কেউ তাদের কি মনে করে?
ক্ষুদ্র-আত্মা নিষ্প্রাণ এরা, ইহারা গেলেই ভালো,
ভিড় করেছিল নিরাশা-আঁধার, এবার আসিবে আলো!
দেশের জাতির সৈনিক যদি কোনো দিন জয় আনে,
এই আঁধারের জীব যদি ফিরে আসে আলোকের পানে,
ইহাদের কাঁধে লাঙল বাঁধিয়া জমি করাইয়ো চাষ,
তবে যদি হয় চেতনা এদের, হয় যদি ভয় হ্রাস!
চল্লিশ কোটি মানুষ ভারতে, এক কোটি হোক সেনা,
কোনো পরদেশি আসিবে না, কোনো বিদেশিরা রহিবে না!
বিরাট বিপুল দেশ আমাদের, কার এত সেনা আছে,
ভারত জুড়িয়া যু্দ্ধ করিবে? পরাজয় লভিয়াছে,
এই মৃত্যুর ভয় শুধু, এরা রোগে ভুগে পচে মরে,
তবু লভিবে না অমৃত ইহারা মৃত্যুর হাত ধরে!
সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা ভাই শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ভবে,
এই অস্ত্রেই সর্ব অসুর দানব বিনাশ হবে,
চল্লিশ কোটি মানুষ মারিতে কোথা পাবে গোলাগুলি,
সর্বভয়ের রাক্ষস পশু পালাবে লাঙ্গুল তুলি।
বোমা যদি আসে, দেখে যাব মোরা বোমা সে কেমন চিজ,
তাহারই ধ্বনিতে ধ্বংস হইবে সর্ব ক্লৈব্য-বীজ!
যাহারা জন্ম-সৈনিক, তারা ছুটে এসো দলে দলে,
শক্তি আসিবে পৃথিবী কাঁপিবে আমাদের পদতলে।
আমরা যুঝিয়া মরি যদি সব ভীরুতা হইবে লয়,
পৃথিবীতে শুধু বীর-সেনাদের জয় হোক, হোক জয়।

বড়োদিন

বড়োলোকদের ‘বড়োদিন’ গেল, আমাদের দিন ছোটো,
আমাদের রাত কাটিতে চায় না, ক্ষিদে বলে, ‘নিধে! ওঠো!’
খেটে খুটে শুতে খাটিয়া পাই না, ঘরে নাই ছেঁড়া কাঁথা,
বড়োদের ঘরে কত আসবাব, বালিশ বিছানা পাতা!
অর্ধনগ্ন-নৃত্য করিয়া বড়োদের রাত কাটে,
মোদের রক্ত খেয়ে মশা বাড়ে, গায়ে আরশুলা হাঁটে।
আঁচিলের মতো ছারপোকা লয়ে পাঁচিল ধরিয়া নাচি,
মাল খেয়ে ওরা বেসামাল হয়, মোরা কাশি আর হাঁচি!
নানারূপ খানা খেতেছে, ষণ্ড অণ্ড ভেড়ার টোস্ট,
কুলুকুলু করে আমাদের পেট, যেন ‘হনলুলু কোস্ট’।
চৌরঙ্গিতে বড়োদিন হইয়াছে কী চমৎকার,
গৌরজাতির ক্ষৌরকর্ম করেছে! অমত কার?
মদ খেয়ে বদহজম হইয়া বাঙালির মেয়ে ধরে,
শিক্ষাও পায় শিখ-বাঙালির থাপ্পড় লাথি চড়ে!
এ কি সৈনিক-ধর্ম, এরাই রক্ষী কি এদেশের?
সর্বলোকের ঘৃণ্য ইহারা, কলঙ্ক ব্রিটিশের।
যে সৈনিকের হাত চাহে অসহায় নারী পরশিতে,

চাহে নারীর ধর্ম নিতে,
বীর ব্রিটিশের কামান যে নাই সেই হাত উড়াইতে।
হায় রে বাঙালি, হায় রে বাংলা, ভাত-কাঙালের দেশ,
মারের বদলে মার দেয় নাকো, তারা বলদ ও মেষ!
মান বাঁচাইতে প্রাণ দিতে নারে, পলাইয়া যায় ঘরে,
ঊর্ধ্বের মার আগুন আসিছে সেই ভীরুদের তরে!
পলাইয়া এরা বাঁচিবে না কেউ! হাড় খাবে, মাস খাবে,
শেষে ইহাদের চামড়ায় দেখো ডুগডুগিও বাজাবে!
পথের মাতাল মাতা-ভগ্নীর সম্মান নেয় কেড়ে,
শাস্তি না দিয়ে মাতালের, এরা পলায় সে পথ ছেড়ে।
কোন ফিল্মের দর্শক ওরা, ঝোপের ইঁদুর বেজি,
ইহাদের চেয়ে ঘরের কুকুর, সেও কত বেশি তেজি!
মানবজাতির ঘৃণ্য ভীরুরা, কাঁপে মৃত্যুর ডরে,
প্রাণ লয়ে ঢুকে খোপের ভিতর, দিনে দশবার মরে!
বড়োদিন দেখে ছোটো মন হায় হতে চাহে নাকো বড়ো,
হ্যাট কোট দেখে পথ ছেড়ে দেয় ভয়ে হয়ে জড়সড়!
পচে মরে হায় মানুষ, হায় রে পঁচিশে ডিসেম্বর!
কত সম্মান দিতেছে প্রেমিক খ্রিস্টে ধরার নর!
ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষশিশু?
আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছ জিশু!

ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা

তখ্‌তে তখ্‌তে দুনিয়ায় আজি কমবখ্‌তের মেলা,
শক্তি-মাতাল দৈত্যেরা সেথা করে মাতলামি খেলা।
ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা, ভাঙিয়া পোড়ো না দুখে,
পাতালের এই মাতাল রবে না আর পৃথিবীর বুকে।
তখ্‌তে তাহার কালি পড়িয়াছে অবিচারে আর পাপে,
তলোয়ারে তার মরিচা ধরেছে নির্যাতিতের শাপে।
ঘন গৈরিকে আকাশ রাঙায়ে বৈশাখী ঝড় আসে,
ভাবে লোভান্ধ মানব, তাহার গোধূলি-লগন হাসে!
যে আগুন ছড়ায়েছে এ বিশ্বে, তারই দাহ ফিরে এসে
ভীম দাবানল-রূপে জ্বলিতেছে তাহাদেরই দেশে দেশে।

সত্যপথের তীর্থ-পথিক! ভয় নাই, নাহি ভয়,
শান্তি যাদের লক্ষ্য, তাদের নাই নাই পরাজয়!
অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে,
অবশেষে চিরলাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে!
পথের ঊর্ধ্বে ওঠে ঝোড়ো বায়ে পথের আবর্জনা,
তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে উঠেছে – কেহ কভু ভাবিয়ো না!
ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরই পথে হয় ওরা বাধা,
পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় নাকো কাদা!

জয়ে পরাজয়ে সমান শান্ত রহিব আমরা সবে,
জয়ী যদি হই, এক আল্লার মহিমার জয় হবে!
লাঞ্ছিত হলে বাঞ্ছিত হব পরলোকে আল্লার,
রণভূমে যদি হত হই মোরা হব চির-প্রিয় তাঁর!
হয়তো কখনও জয়ী হবে ওরা, হটিব না মোরা তবু,
বুঝিব মোদের পরীক্ষা করে মোদের পরম প্রভু!

বিদ্বেষ লয়ে ডাকিলে কি প্রভু পথভ্রান্ত ফিরে?
ভালোবাসা দিয়ে তাদেরে ডাকিতে হয় বক্ষের নীড়ে।
সজ্ঞানে যারা করে নিপীড়ন, মানুষের অধিকার
কেড়ে নিতে চায়, তাহাদেরই তরে আল্লার তলোয়ার।
অজ্ঞান যারা ভুল পথে চলে, মারিয়ো না তাহাদেরে,
ভালোবাসা পেলে ভ্রান্ত মানুষ সত্যের পথে ফেরে।
সকল জাতির সকল মানুষে এক তাঁর নামে ডাকো,
বুকে রাখো তাঁর ভক্তি ও প্রেম, হাতে তলোয়ার রাখো।
সর্ববিশ্ব প্রসন্ন হয় তিনি প্রসন্ন হলে,
সত্যপথের সর্বশত্রু ছাই হয়ে যায় জ্বলে!
আমাদেরও মাঝে যার বুকে আছে লুকাইয়া প্রলোভন,
তারেও কঠিন সাজা দিতে হবে, আল্লার প্রয়োজন!

আগে চলো, আগে চলো দুর্জয় নব অভিযান-সেনা,
আমাদের গতি-প্রবাহ কাহারও কোনো বাধা মানিবে না।
বিশ্বাস আর ধৈর্য হউক আমাদের চির-সাথি,
নিত্য জ্বলিবে আমাদের পথে সূর্য চাঁদের বাতি।
ভয় নাহি, নাহি ভয়!
মিথ্যা হইবে ক্ষয়!
সত্য লভিবে জয়!
ভক্তে দেখায় রক্তচক্ষু যারা, তারা হবে লয়!
বলো, এ পৃথিবী মানুষের, ইহা কাহারও তখ্‌ত্ নয়!

পুণ্য তখ্‌তে বসিয়া যে করে তখ্‌তের অসম্মান,
রাজার রাজা যে, তাঁর হুকুমেই যায় তার গর্দান!
ভিস্তিওয়ালার রাজত্ব, ভাই, হয়ে এল ওই শেষ,
বিশ্বের যিনি সম্রাট তাঁরই হইবে সর্বদেশ!
রক্তচক্ষু রক্ষ যক্ষ, সাবধান! সাবধান!
ভুল বুঝাইয়া, বুঝেছ ভুলাবে আল্লার ফরমান?
এক আল্লারে ভয় করি মোরা, কারেও করি না ভয়,
মোদের পথের দিশারি এক সে সর্বশক্তিময়।
সাক্ষী থাকিবে আকাশ, পৃথিবী, রবি শশী গ্রহ তারা,
কাহারা সত্যপথের পথিক, পথভ্রষ্ট কারা!
ভয় নাহি, নাহি ভয়!
মিথ্যা হইবে ক্ষয়!
সত্য লভিবে জয়!

 মহাত্মা মোহ্‌সিন

[গান]

সকল জাতির সব মানুষের বন্ধু হে মোহ্‌সিন!
এ যুগে তুমিই শোধ করিয়াছ এক আল্লার ঋণ॥
ভোগ করনিকো বিপুল বিত্ত পেয়ে,
ভিখারি হইলে শুধু আল্লারে চেয়ে,
মহাধনী হলে আল্লার কৃপা পেয়ে,
দুনিয়ায় তাই রহিলে কাঙাল দীন॥

মানুষের ভালোবাসায় পাইলে আল্লার ভালোবাসা,
সৃষ্টির তরে কাঁদিয়া, পুরালে তব স্রষ্টার আশা।
তব দান তাই ফুরায়ে নাহি ফুরায়,
বিত্ত হইল নিত্য এ দুনিয়ায়,
শিখাইয়া গেলে, মুসলিম তারে কয়
অর্থ যাহারে কিনিতে পারে না, যে নহে লোভ-মলিন॥

 মোহররম

ওরে বাংলার মুসলিম, তোরা কাঁদ!
এনেছে এজিদি বিদ্বেষ পুন মোহররমের চাঁদ।
এক ধর্ম ও এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে
তখ্‍তের লোভে এসেছে এজিদ কমবখ্‌তের বেশে!
এসেছে ‘সীমার’, এসেছে ‘কুফা’র বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা!
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,
কাঁদে আশমান জমিন, কাঁদিছে মোহররমের চাঁদ।
একদিকে মাতা ফতেমার বীর দুলাল হোসেনি সেনা,
আর দিকে যত তখ্‌ত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।
মাঝে বহিতেছে শান্তিপ্রবাহ পুণ্য ফোরাত নদী,
শান্তিবারির তৃষাতুর মোরা, ওরা থাকে তাহা রোধি!
একদিকে ইসলামি ইমামের সিপাহি শান্তিব্রতী,
আর একদিকে স্বার্থান্বেষী হিংসুক ক্রোধমতি!
এই দুনিয়ার মৃত্তিকা ছিল তখ্‌ত সে খলিফার,
ভেঙে দিয়েছিল স্বর্ণ-সিংহাসনের যে অধিকার,
মদগর্বী ও ভোগী বর্বর এজিদি ধর্মী যত,
যুগে যুগে সেই সাম্য ধর্মে করিতে চেয়েছে হত।
এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,
‘আলীর’ সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান!
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসান হোসেনে গালি দিতে যেত মদিনা ও মক্কায়।
এরাই আত্মপ্রতিষ্ঠা-লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে।
ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য, এরা তাহা দেয় ভেঙে।
ফোরাত নদীর কূল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে
এই ভোগীদের জুলুমে! ইহারা এজিদি মুসলমান,
এরা ইসলামি সাম্যবাদেরে করিয়াছে খান খান!
এক বিন্দুও প্রেম-অমৃত নাই ইহাদের বুকে,
শিশু আসগরে তির হেনে হাসে পিশাচের মতো সুখে!
আপনার সুখ ভোগ ও বিলাস ছাড়া জানে নাকো কিছু,
একজন বড়ো হতে চায়, করে লক্ষ জনেরে নিচু।

আজন্ম রহি শ্বেতমর্মর-প্রাসাদে মদবিলাসী,
তখ্‌ত টলিলে বলে, ‘দরিদ্রে মোরা বড়ো ভালবাসি!’
দরিদ্রেরে ভালবেসে যার ভুঁড়ি ফেঁপে হল ধামা ঝুড়ি,
শীতের দিনেও চর্বি গলিয়া পড়ে চাপকান ফুঁড়ি,
যাদের চরণ পরশ করেনি কখনও ধরার ধূলি,
যাহারা মানুষে করেছে ভৃত্য মুটে মজুর ও কুলি,
অকল্যাণের দূত তারা আজ ভূত সেজে পথে পথে
মৃত্যুর ভয়ে ফিরিতেছে নেমে সোনার প্রাসাদ হতে।
সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, ইসলামের সাম্যবাদ
যুগে যুগে এই অসুর-সেনারা করিয়াছে বরবাদ।
ফোরাত নদীর স্রোত [ধারা]-সম ধনসম্পদ লয়ে
দেয় নাকো পিয়াসের এক ফোঁটা পানি। নির্মম হয়ে
মারে কাটে এরা বে-রহম, এরা টলে নাকো কোনোদিন,
এজিদি তখ্‌ত টুটেছে বলিয়া ছুটিছে শ্রান্তিহীন।
আল্লা রসুল মুখে বলে, তাঁর ক্ষমা পায়নিকো এরা,
দেখেছে শুষ্ক দামেস্ক শুধু, দেখেনি কাবা ও হেরা।
শোনেনি ইহারা আল-আরবির সাম্য প্রেমের বাণী।

আল্লা! এরাও মুসলিম, এরা রসুলের উম্মত,
কেন পায়নিকো প্রেম আর ক্ষমা শান্তি ও রহমত?
ভুল পথে নিতে চায় অন্যেরে, ভুল পথে চলে, তবু
এরা মোর ভাই, এদেরে জ্ঞান ও প্রেম ক্ষমা দাও প্রভু!
লোভ ও অহংকার ইহাদেরে করিয়াছে অজ্ঞান,
সাম্য মৈত্রী মানে না, তবুও এরা যে মুসলমান।
এদের ভুলের, মিথ্যা মোহের করি শুধু প্রতিবাদ,
ইহাদেরই প্রেমে কাঁদি আমি, কেন এরা হল জল্লাদ?
আমাদের মাঝে যত দ্বন্দ্ব ও মন্দ হউক ভালো,
আল্লা! আবার জ্বালাও প্রেমে শান্ত মধুর আলো!
ভালোবাসাহীন এই পৃথিবীরে আর ভালো লাগে নাকো,
আমার পরম প্রেমময় প্রভু, প্রেম দিয়ে বেঁধে রাখো!
খলিফা হইয়া মুসলিম দুনিয়ার বাদশাহি করে,
ভৃত্যে চড়ায়ে উটের পৃষ্ঠে নিজে চলে রশি ধরে!

খোদার সৃষ্ট মানুষেরা ভালোবাসিতে পারে না যারা,
জানি না কেমনে জন-গণ-নেতা হতে চায় হায় তারা!
ত্যাগ করে নাকো ক্ষুধিতের তরে সঞ্চিত সম্পদ,
নওয়াব বাদশা জমিদার হয়ে, চায় প্রতিষ্ঠা-মদ।
ভোগের নওয়াব আমির ইহারা, ত্যাগের আমির কই?
মোহররমের বিষাদ-মলিন চাঁদ পানে চেয়ে রই!
মা ফাতেমা! কোন জন্নতে আছ? দুনিয়ার পানে চাহো,
প্রার্থনা করো, দূর হোক ভায়ে ভায়ে বিদ্বেষ দাহ!
আমাদের মাঝে যার লোভ আছে, তাহা দূর হয়ে যাক,
যাহারা ভ্রান্ত, আসুক তাদের সত্যপথের ডাক।
ফোরাতের পানি ধরার মরুতে শান্তিধারার মতো
না, না, তোমারই মাতৃস্নেহ-রূপে বহে অবিরত।
সেই পবিত্র স্নেহবন্যার দুই কূলে ভায়ে ভায়ে –
হানাহানি করে! তুমি কাঁদিতেছ কোন জন্নত-ছায়ে?
ফোরাতের পানি রক্তিম হল ; মা গো, বিদ্বেষ-বিষে,
কারা তির হানে কাবার শান্তি মিনারের কার্নিশে?
তুমি দাও মাগো ফিরদৌস হতে দুটি ফোঁটা আঁখিবারি,
তব স্নেহবিগলিত অশ্রু, মা, সর্বতৃষ্ণাহারী!
তুমি নবিজির নন্দিনী, নন্দন-আনন্দ দাও,
আল্লার কাছে ভায়ে ভায়ে পুন মিলন-ভিক্ষা চাও!
‘সীমার’ ‘এজিদ’ সকলের তরে কেয়ামতে ক্ষমা চাবে,
আজ দুনিয়ায় ভায়ে ভায়ে কী মা রবে দুশমনি ভাবে?
দূর হোক এই ভাবের অভাব, ভায়ে ভায়ে এই আড়ি,
সকলের ঘরে যাক আরবের খেজুর রসের হাঁড়ি!
অখণ্ড এক চাঁদ আজ বুঝি দু-খণ্ড হয়ে যায়,
শরিকি আসিল হায় যারা মানে লা-শরিক আল্লায়।
কারবালা যেন নাহি আসে আর মোহররমের চাঁদে,
তাজিয়া মিছিলে একী কাজিয়ার খেলা, দেখে প্রাণ কাঁদে
শান্তি, শান্তি, আল্লা শান্তি দাও।
সর্বদ্বন্দ্বাতীত তুমি, নাও তব প্রেমপথে নাও।

রবির জন্মতিথি

রবির জন্মতিথি কয়জন জানে?
অঙ্ক কষিয়া পেয়েছ কি বিজ্ঞানে?
ধ্যানী যোগী দেখেছে কি? জ্ঞানী দেখিয়াছে?
ঠিকুজি আছে কি কোনো জ্যোতিষীর কাছে?
নাই – নাই ! কত কোটি যুগ মহাব্যোমে
আলো অমৃত দিয়ে ধ্রুব রবি ভ্রমে!
জানে না জানে না। উদয় ও অস্ত তাঁর
সে শুধু লীলাবিলাস, গোপন বিহার।
রবি কি অস্ত যায়? অন্ধ মানব
রবি ডুবে গেল বলে করে কলরব।
রবি শাশ্বত, তাঁর নিত্য প্রকাশ
রূপ ধরি পৃথিবীতে ক্ষণিক বিলাস
করিয়া চলিয়া যায় জ্যোতির্লোকে,
এখনও দ্রষ্টা নেহারে তাঁর চোখে।
এই সুরভির ফুল রস-ভরা ফল
রবির গলিত প্রেমবৃষ্টির জল
কবিতা ও গান সুর-নদী হয়ে বয়
রবি যদি মরে যায় পৃথিবী কি রয়!
জন্ম হয়নি যাহার জ্যোতির্লোকে,
তন্দ্রা টুটেনি যাহার অন্ধ চোখে,
রবির জন্মতিথি দেখেনি সে-জন
আজও তার কাছে রবি অপ্রয়োজন।
কবি হয়ে এল রবি এই বাংলায়
দেখিল বুঝিল বলো কতজন তাঁয়?
রবি দেখে পেয়েছে যে আলোক প্রথম
তাঁরই মাঝে লভে রবি প্রথম জনম।
নিরক্ষর ও নিস্তেজ বাংলায়
অক্ষরজ্ঞান যদি সকলেই পায়,
অ-ক্ষর অব্যয় রবি সেই দিন
সহস্র করে বাজাবেন তাঁর বীণ।
সেদিন নিত্য রবির জন্মতিথি
হইবে। মানুষ দিবে তাঁরে প্রেমপ্রীতি।

শাখ-ই-নবাত

[‘শাখ-ই-নবাত’ বুলবুল-ই-শিরাজ কবি হাফিজের মানসীপ্রিয়া ছিলেন।]

শাখ-ই-নবাত শাখ-ই-নবাত! মিষ্টি রসাল ‘ইক্ষু-শাখা’।
বুলবুলিরে গান শেখাল তোমার আঁখি সুরমা-মাখা।
বুলবুল-ই-শিরাজ হল গো হাফিজ গেয়ে তোমার স্তুতি,
আদর করে ‘শাখ-ই-নবাত’ নাম দিল তাই তোমার তুতি।
তার আদরের নাম নিয়ে আজ তুমি নিখিল-গরবিনি,
তোমার কবির চেয়ে তোমায় কবির গানে অধিক চিনি।
মধুর চেয়ে মধুরতর হল তোমার বঁধুর গীতি,
তোমার রস-সুধা পিয়ে, তাহার সে-গান তোমার স্মৃতি।
তোমার কবির – তোমার তুতির ঠোঁট ভিজালে শহদ দিয়ে,
নিখিল হিয়া সরস হল তোমার শিরিন সে রস পিয়ে।
কল্পনারই রঙিন পাখায় ইরান দেশে উড়ে চলি,
অনেক শত বছর পিছের আঁকাবাঁকা অনেক গলি –
তোমার সাথে প্রথম দেখা কবির যেদিন গোধূলিতে,
আঙুর-খেতে গান ধরেছে, কুলায়-ভোলা বুলবুলিতে।
দাঁড়িয়েছিলে একাকিনী ‘রোকনাবাদের নহর’ তীরে,
রঙিন ছিল আকাশ যেন কুসুম-ভরা ডালিম-শাখা
তোমার চোখের কোনায় ছিল আকাশ-ছানা কাজল আঁকা।
সন্ধ্যা ছিল বন্দি তোমার খোঁপায়, বেণির বন্ধনীতে ;
তরুণ হিয়ার শরম ছিল জমাট বেঁধে বুকের ভিতে!
সোনার কিরণ পড়েছিল তোমার দেহের দেউল চূড়ে,
ডাঁসা আঙুর ভেবে এল মউ-পিয়াসি ভ্রমর উড়ে।
তিল হয়ে সে রইল বসে তোমার গালের গুলদানিতে,
লহর বয়ে গেল সুখে রোকনাবাদের নীল পানিতে।
চাঁদ তখনও লুকিয়ে ছিল তোমার চিবুক গালের টোলে,
অস্তরবির লাগল গো রং শূন্য তোমার সিঁথির কোলে।
ওপারেতে একলা তুমি নহর-তীরে লহর তোলো,
এপারেতে বাজল বাঁশি, ‘এসেছি গো নয়ন খোলো!’

… … …
তুললে নয়ন এপার পানে – মেলল কি দল নার্গিস তার?
দুটি কালো কাজল আখর – আকাশ ভুবন রঙিন বিথার!
কালো দুটি চোখের তারা, দুটি আখর, নয়কো বেশি ;
হয়তো ‘প্রিয়া’, কিংবা ‘বঁধু’ – তারও অধিক মেশামেশি!
কী জানি কী ছিল লেখা – তরুণ ইরান-কবিই জানে,
সাধা বাঁশি বেসুর বোলে সেদিন প্রথম কবির কানে।
কবির সুখের দিনের রবি অস্ত গেল সেদিন হতে,
ঘিরল চাঁদের স্বপন-মায়া মনের বনের কুঞ্জপথে।
হয়তো তুমি শোননি আর বাঁশুরিয়ার বংশীধ্বনি,
স্বপন-সম বিদায় তাহার স্বপন-সম আগমনি।
রোকনাবাদের নহর নীরের সকল লহর কবির বুকে,
ঢেউ তোলে গো সেদিন হতে রাত্রি দিবা গভীর দুখে।
সেই যে দুটি কাজল হরফ দুটি কালো আঁখির পাতে,
তাই নিয়ে সে গান রচে তার ; সুরের নেশায় বিশ্ব মাতে!
অরুণ আঁখি তন্বী সাকি পাত্র এবং শারাব ভুলে,
চেয়ে থাকে কবির মুখে করুণ তাহার নয়ন তুলে।
শারাব হাতে সাকির কোলে শিরাজ কবির রঙিন নেশা
যায় গো টুটে ক্ষণে ক্ষণে – মদ মনে হয় অশ্রু মেশা।

অধর-কোণে হাসির ফালি ঈদের পহিল চাঁদের মতো –
উঠেই ডুবে যায় নিমেষে, সুর যেন তার হৃদয়-ক্ষত।
এপার ঘুরে কবির সে গান ফুলের বাসে দখিন হাওয়ায়
কেঁদে ফিরেছিল কি গো তোমার কানন-কুঞ্জ ছায়ায়?
যার তরে সে গান রচিল, তারই শোনা রইল বাকি?
শুনল শুধু নিমেষ-সুখের শারাব-সাথি বে-দিল্ সাকি?

শাখ-ই-নবাত! শাখ-ই-নবাত! পায়নি তুতি তোমার শাখা,
উধাও হল তাইতে গো তার উদাস বাণী হতাশ-মাখা।
অনেক সাকির আঁখির লেখা, অনেক শারাব পাত্র-ভরা,
অনেক লালা নার্গিস গুল বুলবুলিস্তান গোলাব-ঝোরা
ব্যর্থ হল, মিটল না গো শিরাজ কবির বুকের তৃষা,
হয়তো আখের শাখায় ছিল সুধার সাথে বিষও মিশা!
নইলে এ গান গাইত কে আর, বইত না এ সুরধুনী;
তোমার হয়ে আমরা নিখিল বিরহীরা সে গান শুনি।
আঙুর-লতায় গোটা আঙুর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবারি,
শিরাজ-কবির সাকির শারাব রঙিন হল তাই নিঙাড়ি।
তোমায় আড়াল করার ছলে সাকির লাগি যে গান রচে,
তাতেই তোমায় পড়ায় মনে, শুনে সাকি অশ্রু মোছে!
তোমার চেয়ে মোদের অনেক নসিব ভালো, হায় ইরানি!
শুনলে নাকো তোমায় নিয়ে রচা তোমার কবির বাণী।
তোমার কবির রচা গানে মোদের প্রিয়ার মান ভাঙাতে
তোমার কথা পড়ে মনে, অশ্রু ঘনায় নয়ন-পাতে!

ঘুমায় হাফিজ ‘হাফেজিয়া’য়, ঘুমাও তুমি নহর-পারে,
দিওয়ানার সে দিওয়ান-গীতি একলা জাগে কবর-ধারে।
তেমনি আজও আঙুর-খেতে গেয়ে বেড়ায় বুলবুলিরা,
তুতির ঠোঁটে মিষ্টি ঠেকে তেমনি আজও চিনির সিরা।
তেমনি আজও জাগে সাকি পাত্র হাতে পানশালাতে –
তেমনি করে সুরমা-লেখা লেখে ডাগর নয়ন-পাতে।
তেমনি যখন গুলজার হয় শারাব-খানা, ‘মুশায়েরা’,
মনে পড়ে রোকনাবাদের কুটির তোমার পাহাড়-ঘেরা।
গোধূলি সে লগ্ন আসে, সন্ধ্যা আসে ডালিম-ফুলি,
ইরান মুলুক বিরান ঠেকে, নাই সেই গান, সেই বুলবুলি।
হাফেজিয়ায় কাঁদন ওঠে আজও যেন সন্ধ্যা প্রভাত –
‘কোথায় আমার গোপন প্রিয়া কোথায় কোথায় শাখ-ই-নবাত!’
দন্তে কেটে খেজুর-মেতি আপেল-শাখায় অঙ্গ রেখে
হয়তো আজও দাঁড়াও এসে পেশোয়াজে নীল আকাশ মেখে,
শারাব-খানায় গজল শোনো তোমার কবির বন্দনা-গান;
তেমনি করে সূর্য ডোবে, নহর- নীরে বহে তুফান।
অথবা তা শোন না গো, শুনিবে না কোনো কালেই;
জীবনে যে এল না তা কোনো লোকের কোথাও সে নাই!

অসীম যেন জিজ্ঞাসা ওই ইরান-মরুর মরীচিকা,
জ্বালনি কি শিরাজ-কবির লোকে তোমার প্রদীপ-শিখা?
বিদায় সেদিন নিল কবি শূন্য শারাব পাত্র করে,
নিঙ্‌ড়ে অধর দাওনি সুধা তৃষিত কবির তৃষ্ণা হরে!
পাঁচশো বছর খুঁজেছে গো, তেমনি আজও খুঁজে ফিরে
কবির গীতি তেমনি তোমায় রোকনাবাদের নহর-তীরে!

শোধ করো ঋণ

আগুন জ্বলে না মাসে কতদিন হায় ক্ষুধিতের ঘরে,
ক্ষুধার আগুনে জ্বলে কত প্রাণ তিলে তিলে যায় মরে।
বোঝে না ধনিক, হোক সে হিন্দু হোক সে মুসলমান,
আল্লা যাদের নিয়ামত দেন, পাষাণ তাদের প্রাণ!

কত ক্ষুধাতুর শিশুর রসনা খুদকণা নাহি পায়,
মা-র বুক ছেড়ে গোরস্তানের মাটিতে গিয়া ঘুমায়।
যত দৌলত হাশমতওয়ালা হেরে তাহা পাশে থেকে,
আতর মাখিয়া পাথরের দল যেন ছায়াছবি দেখে!

ভেবেছে এমনই নিজে খেয়ে দেয়ে হইয়া খোদার খাসি
দিন কেটে যাবে! এ সুখের দিন কভু হবে নাকো বাসি।
জগতের লোভী মরিতেছে আজ আল্লার অভিশাপে,
তবুও লোভের কাঁথা জড়াইয়া লোভী সব নিশি যাপে!

একটা খাসিরে ধরিয়া যখন জবাই করে কশাই,
আর একটা খাসি তখনও দিব্যি পাতা খায়, ভয় নাই।
ভেবেছ ওদেশে হতেছে শাস্তি, তোমাদের হইবে না,
তাই শোধ করিলে না আজও সেই পরম দানীর দেনা।

আর ক-টা দিন বেঁচে থাকো, যাঁর ঋণ করিয়াছ, তিনি
তোমাদের প্রাণ দৌলত নিয়ে খেলবেন ছিনিমিনি।
কী ভীষণ মার খাইবে সেদিন, বোঝ না অন্ধ জীব,
তোমাদের হাড়ে ভেলকি খেলিবে সেদিন এই গরিব।

বেতন চাহিলে শুনিতে পায় না, মনিবের রাগ হয়,
‘তিনদিন হাঁড়ি চড়েনিকো’ শুনে ভাবে একী কথা কয়!
ঘরের পার্শ্বে লেগেছে আগুন, বোঝে না স্বার্থপর,
আর দেরি নাই, পুড়িয়া যাইবে তাহারও সোনার ঘর।

বঞ্চিত রেখে দরিদ্রে, যারা করিয়াছে সঞ্চয়,
দেখিবে এবার, তার সঞ্চয় তার অধিকারে নয়।
অর্থের ফাঁদ পেতে দস্যুরে ডাকিয়া আনিছে যারা
তাহারাই আগে মরিবে, ভীষণ শাস্তি পাইবে তারা।

উপবাস যার দিনের সাধনা, নিশীথে শয়নসাথি,
যাহারা বাহিরে গাছতলে থাকে, ঘরে জ্বলে নাকো বাতি,
তাদের ধৈর্য সহিষ্ণুতা কি পাবে না পুরস্কার?
তারা তিলে তিলে মরে আনিয়াছে এবার খোদার মার!

তাদেরই করুণ মৃত্যু এনেছে ভয়াল মৃত্যু ডাকি,
তাদের আত্মা শান্তি পাইবে ভোগীর রক্ত মাখি।
মানুষের মার নয় এ রে দাদা, এ যে আল্লার মার,
এর ক্ষমা নাই, এ নয় ধরার ভাঁড়ামি রাজবিচার।

উৎপীড়ক আর ভোগীদের আসিয়াছে রোজ-কিয়ামত
ধূলি-রেণু হয়ে উড়ে যাবে সব ইহাদের নিয়ামত।
এদেরই হাতের অস্ত্র কাটিবে এদেরই স্কন্ধ, শির,
ইহারা মরিলে দুনিয়া হইবে স্নিগ্ধ, শান্ত, স্থির।

বাক্সের পানে চেয়ে চেয়ে চোখ ফ্যাকাশে হয়েছে বুঝি!
বাক্স ও চাবি নেবে না উহারা, কেড়ে নেবে শুধু পুঁজি।
খাবি খায় তবু চাবি ছাড়ে নাকো! উৎকট প্রলোভন
মরে না কিছুতে, আত্মঘাতী তা না হয় যতক্ষণ!

আমরা গরিব, শুকায়ে হয়েছি চামড়ার আমচুর,
খামচে ধরেছে মাংসওয়ালারে ক্ষুধিত বুনো কুকুর।
কোন বন থেকে কে জানে এসেছে নেকড়ে বাঘের দল,
আমাদের ভয় নাই, আমাদের নাইকো গোরু-ছাগল।

সামলাও মাল মালওয়ালা, দেখো পয়মাল হবে সব,
ঊর্ধ্বে নিত্য শুনিতেছ নাকি শকুনের কলরব?
ধূমকেতু নয়, কোন মেথরানি হাতে মুড়ো ঝ্যাঁটা লয়ে
এসেছে আকাশে; পৃথিবী উঠেছে ভীষণ নোংরা হয়ে!

নোংরা, লোভী ও ভোগী রহিবে না শুদ্ধ এ পৃথিবীতে,
এ আবর্জনা পুড়ে ছাই হবে নরকের চুল্লিতে।
আসিছে ফিরিয়া এই বাংলায় কাঙালের শুভদিন,
আজিও সময় আছে ধনী, শোধ করো তাহাদের ঋণ!

সকল পথের বন্ধু

হে আনন্দ-প্রেম-রসঘন, মধুরম, মনোহর!
একী মদিরার আবেশে নেশায় কাঁপে তনু থরথর!
হৃদি-পদ্মিনী নিঙাড়িয়া বঁধু –
আনিতে চাও কি অমৃতমধু,
উদাসীন মনে আন একী সুরভিত বন-মর্মর!
ঘন অরণ্য-আড়ালে কে হাস প্রিয় জ্যোতিসুন্দর!

কৃষ্ণা তিথির আড়ালে আমার চাঁদ লুকাইয়াছিলে!
আমি ভেবেছিনু, আমি কালো, তুমি তাই প্রেম নাহি দিলে।
বুঝি নাই, রসময়, তব খেলা
ভয় হত, যদি কর অবহেলা।
বেণুকা বাজায়ে পথে এনে হায় কোথা তুমি লুকাইলে?
দেখেছ কি দেহে কাদা, অন্তরে রাধারে নাহি দেখিলে?

তব অভিসার-পথ রুধিয়াছে কে যেন ভয়ংকর!
দিগ্‌দিগন্তে অন্ধ করেছে বাধার তুফান ঝড়।
সীতার মতন কে যেন গো কেশ ধরে
আঁধার পাতালে লইয়া গিয়াছে মোরে।
জড়াইয়া যেন শত শত নাগ বিষাক্ত অজগর
দংশেছে মোরে, বিষে জরজর! – তবু, ওগো মনোহর –

ডাকিনি তোমায়, যদি এই বিষ তব শ্রীঅঙ্গে লাগে!
এই পঙ্ক, এ মালিন্য যদি বাধা আনে অনুরাগে।
বলেছি, ‘বন্ধু, সরে যাও, সরে যাও,
আমার এ ক্লেশে আমারে কাঁদিতে দাও।’
আমার দুখ ‘লু’ হাওয়ার জ্বালা না আনে গোলাপ-বাগে!
ক্ষমা কোরো মোরে, ভুল বুঝিয়ো না, যদি অভিমান জাগে!

জানি তুমি মোরে জড়ায়ে ধরেছ প্রকাশ-ব্রহ্মরূপে,
আমার বক্ষে চেতনানন্দ হয়ে কাঁদ চুপে চুপে!
হৃদি-শতদল কাঁপে মোর টলমল,
মোর চোখে ঝরে তোমার অশ্রুজল!
বক্ষে জড়ায়ে আন প্রেমলোকে, নামিয়া অন্ধকূপে,
অমৃত স্বরূপে হে প্রিয়তম আনন্দ-স্বরূপে!

আঁধারে আলোকে যখন যে পথ টানে, তুমি থাক কাছে।
অরণ্যপথে তব আনন্দ কুরঙ্গ হয়ে নাচে!
আমার তীর্থ-মরুপথে ছায়া হয়ে
সাথে সাথে চলো আঙুরের রস লয়ে,
পথের বালুকা পাখির পালক ফুল হয়ে ফুটিয়াছে!
চোখে জল, বুকে মধু বলে – ‘বঁধু, আছে আছে, সাথে আছে!’

সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি

রৌদ্রোজ্জ্বল দিবসে তোমার আসিনি সজল মেঘের ছায়া,
তৃষ্ণা-আতুর হরিণী চোখে কী হবে হানিয়া মরীচি-মায়া!
আমি কালো মেঘ – নামি যদি তব বাতায়ন-পাশে বৃষ্টিধারে,
বন্ধ করিয়া দিবে বাতায়ন, যদি ভিজে যাও নয়নাসারে!
সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি, বাদল রাতের পাপিয়া নহ,
তব তরে নয় বাদলের ব্যথা – নয়নের জল দুর্বিষহ।
ফাল্গুন-বনে মাধবী-বিতানে যে পিক নিয়ত ফুকারি ওঠে,
তুমি চাও সেই কোকিলের ভাষা তোমার রৌদ্রতপ্ত ঠোঁটে।
জানি না সে ভাষা, হয়তো বা জানি, ছল করে তাই হাসিতে চাহি,
সহসা নিরখি – নেমেছে বাদল রৌদ্রোজ্জ্বল গগন বাহি।
ইরানি-গোলাব-আভা আনিয়াছ চুরি করি ভরি ও রাঙা তনু,
আমি ভাবি বুঝি আমারই বাদল-মেঘশেষে এল ইন্দ্রধনু।
ফণীর ডেরায় কাঁটার কুঞ্জে ফোটে যে কেতকী, তাহার ব্যথা
বুঝিবে না তুমি, ধরণি তো তব ঘর নহে, এলে ভ্রমিতে হেথা।
ভ্রম করে তুমি ভ্রমিতে ধরায় এসেছ, ফুলের দেশের পরি,
জানিতে না হেথা সুখদিন শেষে আসে দুখ-রাতি আঁধার করি।
রাঙা প্রজাপতি উড়িয়া এসেছ, চপলতা-ভরা চিত্র-পাখা,
জানিতে না হেথা ফুল ফুটে ফুল ঝরে যায়, কাঁদে কানন ফাঁকা।
যে লোনা জলের সাত সমুদ্র গ্রাস করিয়াছে বিপুল ধরা,
সেই সমুদ্রে জনম আমার, আমি সেই মেঘ সলিল ভরা।
ভাসিতে যে আসে আমার সলিলে, তাহারে ভাসায়ে লইয়া চলি
সেই অশ্রুর সপ্ত পাথারে, পারায়ে ব্যথার শতেক গলি।
ভুল করে প্রিয়া এ ফুল-কাননে এসেছিলে, জানা ছিল না তব
এ বন-বেদনা অশ্রুমুখীরে; এ নহে মাধবীকুঞ্জ নব।
মাটির করুণাসিক্ত এ মন, হেথা নিশিদিন যে ফুল ঝরে
তারই বেদনায় ভরে আছে মন, হাসিতে তাদেরই অশ্রু ক্ষরে।
সেই বেদনায় এসেছিলে তুমি ক্ষণিক স্বপন, ভুলের মেলা,
জাগিয়া তাহারই স্মৃতি লয়ে কাটে আমার সকাল সন্ধ্যাবেলা।
এ মোর নিয়তি, অপরাধ নহে আমারও তোমারও – স্বপন-রানি!
আমার বাণীতে তোমার মুরতি বীণাপাণি নয় বেদনাপাণি।
তোমার নদীতে নিতি কত তরি এপার হইতে ওপারে চলে;
কাণ্ডারিহীন ভাঙা তরি মোর ডুবে গেল তব অতল তলে।
ওরা শুধু তব মুখ চেয়ে যায়, সুখের আশার বণিক ওরা,
আমি ডুবে তব দেখিলাম তল জলশেষে চোরা বালুতে ভরা।
ভয় নাই প্রিয়, মগ্ন এ তরি তব বিস্মৃতি-বালুকাতলে
দু-দিনে পড়িবে ঢাকা, উদাসীন, তুমি বয়ে যাবে চলার ছলে।
কুড়াতে এসেছে দুখের ঝিনুক ব্যথার আকুল সিন্ধুকূলে,
আঁচল ভরিয়া কুড়ায়ে হয়তো ফেলে দেবে কোথা মনের ভুলে।
তোমাদের ব্যথা-কাঁদন যেটুকু, সে শুধু বিলাস, পুতুলখেলা,
পুতুল লইয়া কাটে চিরদিন, আদর করিয়া ভাঙিয়া ফেলা।
মোর দেহমনে নয়নে ও প্রেমে অশ্রুজল নীরদ মাখা,
কী হবে ভিজিয়া এ বাদলে, রানি, তব ধ্যান ওই চন্দ্র তারকা।
সে চাঁদ উঠেছে গগনে তোমার-আমার সন্ধ্যাতিমির শেষে,
আমি যাই সেই নিশীথিনী-পারে যেথায় সকল আঁধার মেশে।
আমার প্রেমের বরষায় ধুয়ে তব হৃদি হল সুনীলতর –
সে গগনে যবে উঠিবে গো চাঁদ উজ্জ্বলতর তাহারে করো।
যদি সে-চন্দ্রহসিত নিশীথে বিস্বাদ লাগে তোমার চোখে,
তোমার অতীত তোমারে খুঁজিয়ো আমার বিধুর গানের লোকে।
সেথা ব্যথা রবে, রবে সান্তনা, রবে চন্দন-সুশীতলতা,
যে-ফুল জীবনে ঝরে না সে-ফুল হইয়া ফুটিবে তোমার ব্যথা।
আমার গানের চির-দাহ যাহা সে আছে গো নীলকন্ঠে মম,
চিরশেষে এল যে অমৃতবাণী, দিনু তা তোমারে হে প্রিয়তম!
আমার শাখায় কন্টক থাক, কাঁটার ঊর্ধ্বে তুমি যে ফুল –
আমি ফুটায়েছি তোমারে কুসুম করিয়া, সে মোর সুখ অতুল।
বিদায়-বেলায় এই শুধু চাই, হে মোর মানস-কানন-পরি,
তোমার চেয়েও তব বন্ধুরে ভালোবাসি যেন অধিক করি।

 হুল ও ফুল

ওরা কয়, ‘আগে ফুল ফুটাইতে, এখন ফুটাও হুল!’
আমি কই, ‘যদি হুল না ফুটাই ফুটিবে কি তবে fool?’
বন্ধু, মিথ্যা অপত্য-স্নেহে আপত্তি নাহি করি
ধর্ম লয়েছে অধর্ম নাম, সত্য গিয়াছে মরি!
গাঁয়ের বউঝি জল নিতে যায় মেছুড়ে বুঝিতে নারে,
গাল দেয় রেগে – ইহাদেরই দোষে মাছ বসে নাকো চারে!
ভোগী বলে, ‘বাবা, কেন কাঁদ তুমি, মামা নহে তব চাষা,
ধনীর দুঃখ দেখ নাকো, একী একঘেয়ে ভালোবাসা!’
‘আল্লা বলান’ বলি। ওরা বলে – ‘দালানে তা আসে কেন?
টাকাওয়ালাদের কী করে চিনিলে, তুমি তো আল্লা চেন!’
ওরা বলে, ‘মোরা টাকার পুকুর দুয়ারে খুঁড়িয়া রাখি,
উহারাই তার দু-এক কলশি জল ভরে নেয় নাকি?’
আরও বলে, ‘দিই কলশিতে জল দিই না তো সাথে দড়ি,
আমরা কী জানি, কেন এ পুকুরে ওরা ডুবে যায় মরি?’
ওরা বলে, ‘চাষা খাইতে পায় না– আর জন্মের পাপ,
পাওনা সুদের নালিশ করিলে ওরা কেন দেয় শাপ?’
মোরা যত দিই উত্তর তার ওরা ‘দুত্তোর’ কহে,
বলে ‘জমিদারি স্বত্ব আমার, তোমার মামার নহে।’
মোরা বলি, ‘কত ইম্পিরিয়াল ব্যাংকে তোমার টাকা!’
ওরা বলে, ‘কোনো কাজে তা লাগে না, (বাবা) ফিক্‌স্‌ড ডিপোজিটে রাখা!’
মোরা বলি, ‘মোরা যাব না, মোদের প্রাপ্য যা তা না পেলে!’
ওরা বলে, ‘কেন জেলে যাবে, বাবা, ভদ্রলোকের ছেলে!’
আমি বলি, ‘জাগ, দৈত্যরে মার, দা নিয়ে দুয়ার খুল।’
ওরা বলে, ‘বাঘ হলে কেন বন- বাগিচার বুলবুল?’
আমি বলি, ‘কেন অসত্য বল, ভ্রান্ত পথ দেখাও?’
ওরা বলে, ‘আহ্‌‌, চুপ করো কবি, ফুল শোঁকো, মধু খাও!’
আমি বলি, ‘চোর ঢুকিয়াছে ঘরে, মারো তারে পায়ে দলে!’
ওরা বলে, ‘বাঁশুরিয়া! বাঁশি কেন বংশদণ্ড হলে!’
ওরা বলে, ‘দাদা, এতদিন তুমি বেশ তো ঘুমায়ে ছিলে!
কখন হইল ‘ইনসমনিয়া’? সারা দেশ জাগাইলে!’
আমি বলি, ‘দেশ জাগে যদি, কেন তোমাদের ডর লাগে?’
ওরা বলে, ‘আসে রাম-দা লইয়া। রামদা বলিত আগে!’
কে যে বলে ঠিক, কে বলে বেঠিক, ঠিকে ভুল হয় কার?
চাষা ও মজুরে ঠকাইয়া খায় দুনিয়ার ঠিকাদার!
‘ওরা তো বলে না, তুমি কেন বল, কেন তব মাথাব্যথা?’
জিজ্ঞাসে সাধু। – আমি বলি, ‘কহে ওদেরই আত্মা কথা!’
হায় রে দুনিয়া দেখি মৌলানা মৌলবিতে একাকার,
আমি একা হেথা কাফের রে দাদা আমি একা গুনাগার!
গুনাগারি দেয় বণিকেরা নাকি, চাষারাই করে লাভ,
ধনী যেন সদা তৃষিত, এবং চাষা সদা কচি ডাব!
শুনেছি সেদিন ধনিক-সভায়– নতুন আইন হবে,
চাষাদের দা, দাঁত আর নখ খেঁটে লাঠি নাহি রবে।
আমি বলি, ‘হয়ে অভাবে স্বভাব নষ্ট, হয়েছে চোর!’
ওরা বলে, ‘তাই বল, তাই চুরি হয় না বাড়িতে তোর!’
আমি বলি, ‘খেয়ো না এ কদন্ন, হালালি অন্ন খাও!’
ওরা বলে, ‘তুমি এদেরই দালালি করে বুঝি টাকা পাও?’
‘যার যত তলা দালান, সে তত আল্লা-তালার প্রিয়–’
ওরা কয়। আমি বলি, ‘বেশ করে সে তালায় তালা দিয়ো!’
আমি ভিক্ষুক কাঙালের দলে – কে বলে ওদের নীচ?
ভোগীরা স্বর্গে যাবে, যদি খায় ওদের পানের পিচ!
ওরা হাসে, ‘এ কি কবিতার ভাষা? বস্তিতে থাক বুঝি?’
আমি কই, ‘আজও পাইনি পুণ্য- বস্তির পথ খুঁজি!
দোওয়া করো, যেন ওই গরিবের কর্দমাক্ত পথে
যেতে পারি, এই ভোগ-বিলাসীর পাপ-নর্দমা হতে!’

Exit mobile version