জোর জমিয়াছে খেলা
জোর জমিয়াছে খেলা!
ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকালবেলা।
এই জনগণ-অরণ্যে যেন বহিত না প্রাণবায়ু,
শিথিল হইয়া ছিল যেন সব স্নায়ু!
সহসা মৌন-অরণ্যে আজ উঠেছে প্রবল ঝড়,
ভিড় করে পাখি নীড় ছেড়ে করে কোলাহল-মর্মর।
জমাট হইয়া ছিল সাগরের জল,
সহসা গলিয়া ছুটিল স্রোতের ঢল।
ময়দানে জোর ভিড় জমিয়াছে বড়ো ছোটো মাঝারির,
স্বদেশি বিদেশি লোভী নির্লোভ হেটো মেঠো বাজারির!
এই দিকে ‘রাজি’, ওদিকে ‘নারাজি’ দল,
সেন্টারে পড়ে আছে ‘ভারতের স্বাধীনতা’-ফুটবল!
‘রাজি’ জয়ী হবে বলে বাজি রাখে মজুর ও বিড়িওয়ালা,
কেল্লার ধারে জমায়েত হয়ে বাঁধা রেখে ঘটি থালা।
কাহার কেল্লা ফতে হবে সবে কয়,
‘রাজি’রা খেলিতে জানে, উহারাই জয়ী হবে নিশ্চয়।
‘গ্যালারি’ ভরতি মধ্যবিত্ত আধা-বড়োলোক যত,
ছাতা উঁচাইয়া ‘রাজি’দের জয়ধ্বনি করে অবিরত।
‘নারাজি’ দলের ‘সাপোর্টার’ যত কোট প্যান্ট চাপকান,
সংখ্যায় সাত কুড়ি, তবু তিন হাত তুড়িলাফ খান!
এরা খায় বিড়ি, ওরা খায় সিগারেট,
এরা খায় চানাচুর ও বাদাম, ওরা চপ কাটলেট!
জোর জমিয়াছে খেলা,
বুট-পরা পায়ে ফুটবলে লাথি মারে, হুল্লোড় মেলা!
খাইয়া ‘ফাউল-কারি’ ‘নারাজি’রা কেবল ফাউল করে,
রেফারিকে দেয় কাফেরি ফতোয়া যদি সে ফাউল ধরে!
‘শেম’ ‘শেম’ বলে জনগণ, হ্যাটুয়ারা দেয় হ্যাটে তালি,
খেলতে পারে না, ফেলিতে পারে না ঠেলা দিয়ে, দেয় গালি।
কোন দল জেতে কোন দল হারে, উঠিয়াছে কোন্দল,
‘নারাজি’র দিকে বুড়োরা, ‘রাজি’র জোয়ান নতুন দল।
উঠেছে হট্টগোল
ওই দিল – গোল, গোল!
মটরুর নানা দেড় চোখ কানা, ঝুড়ি তুলে মারে কিক,
লুঙ্গি ধরে চলে ‘রাজি’রা এবার গোল দিল দেখো ঠিক!
‘নারাজি’রা হল যেন আলু-ভাজি, করে শুধু হ্যান্ডবল,
যত গোল খায় তত গোলমাল করে তারা অবিরল!
কবুতর ওড়ে, মোগলি লম্ফ মারে বগলের ছাতা,
‘জয় রাজি’ বলে ওড়ায় রঙিন কুচি কাগজের পাতা।
খেলা জমিয়াছে জোর,
‘নারাজি’রা রাগে, ‘রাজি’রা ততই হাসিয়া করে স্কোর!
‘নারাজি’র দলে বিদেশি খেলুড়ি, ‘রাজি’র দেশের ছেলে,
‘রাজি’রা পায়ের জোরে খেলে ‘নারাজি’রা গা-র জোরে ঠেলে।
আজও খেলা শেষ হয় নাই ময়দানে,
‘হাফটাইমের’ আগেই কে গোল খেয়েছে সবাই জানে।
এরই মাঝে আসিয়াছে ঘনঘটা রুক্ষ আকাশ ঘিরে,
কারা যেন ক্রোধে নীল আশমান বিজলি-নখরে চিরে!
বাজে বাদলের মাদল ঝাঁজর মৃদঙ্গ গুরুগুরু,
মাথার উপরে ছাতার তাম্বু, বৃষ্টি হয়েছে শুরু!
দর্শক দ্যাখে, এঁকেবেঁকে পড়ে মাঠে কারা পিছলায়ে,
‘রাজি’ দল ছোটে তিরের মতন চাকা বাঁধা যেন পায়ে!
খেলা জোর জমিয়াছে,
দর্শক সব এবার এগিয়ে এসেছে দড়ির কাছে।
বৃষ্টি নেমেছে, এবার দৃষ্টি প্রখর করো রে দাদা,
কার দিকে কত হয় সে ফাউল, কে ছিটায় কত কাদা।
খেলা দ্যাখো, দ্যাখো খেলা,
‘রাজি’ কি ‘নারাজি’ জয়ী হল, বলো তোমরাই সাঁঝ-বেলা!
কবুতরগুলি ফেরে নাই ঘরে, ঘুরিছে মাথার পর,
কাহারা জিতিল, দেশে দেশে গিয়া শুনাবে খোশখবর!
টাকাওয়ালা
জলের সাগরে আসিনু বাহিতে তরি,
‘জল দাও’ বলে কাঁদে সর্বহারার দল –
চারিদিকে জল, জলের তৃষায় মরি!
টাকা নাই নাকি শুনি টাঁকশালে এসে,
টাকার সঙ্গে মাখামাখি, বলে – ‘টাকা থাকে কোন দেশে?’
লক্ষ্মী-বাহন প্যাঁচারা আসিয়া সারা দেশ ভরিয়াছে,
বিধাতার দেওয়া ঐশ্বর্যরে রক্ষিতা করিয়াছে!
টাকার সাকার আকার এসেই হয়ে যায় যেন পাখি,
এত টাকা আসে, উড়ে যায় সব, পাখা গজাইল নাকি?
কোথা বাসা বাঁধে এই সে টাকার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি?
কোথা ডিম পাড়ে, ছানা হয় তার কোন সে ব্যাংকে জমি?
মহাকাল-ব্যাধ দেখিতে পেয়েছে তাদের টাকার বাসা,
মৃত্যু-শায়ক লইয়া এসেছে– যত টাকা ট্যাঁকে ঠাসা!
এই চাকতির খাঁকতি ছিল না এ জীবনে কোনোদিন,
টাকার মহিমা বুঝিনু, যেদিন আকন্ঠ হল ঋণ।
যত শোধ করি, তত সুদ বাড়ে! ঋণ, না কচুরিপানা?
শিলমোহরের ভয়ে চাইনিকো মোহরের মিহি-দানা!
ধন্না দিইনি টাকাওয়ালাদের পাকা ইমারতে কভু,
আল্লাহ্ ছাড়া কারেও কখনও বলিনি হুজুর, প্রভু!
টাকাওয়ালাদের দেখে এই জ্ঞান হইয়াছে সঞ্চয়,
টাকাওয়ালাদের চেয়ে ঝাঁকাওয়ালা অনেক মহৎ হয়!
সোনা যারা পায়, তাহারাই হয় সোনার পাথর-বাটি,
আশরফি পেয়ে আশরাফ হয় চালায়ে মদের ভাঁটি!
মানুষের রূপে এরা রাক্ষস রাবণ-বংশধর,
পৃথিবীতে আজ বড়ো হইয়াছে যত ভোগী বর্বর!
এদের ব্যাংক ‘রিভার-ব্যাংক’ হইবে দুদিন পরে,
বোঝে না লোভীরা, ভীষণ মৃত্যু আসিছে এদেরই তরে!
জমানো অর্থ যত অনর্থ আনিয়াছে পৃথিবীতে,
পরমার্থের প্রভু আসিয়াছে তাহার হিসাব নিতে!
রবে না এ টাকা, বংশেও বাতি দিতে রহিবে না কেউ,
তবু কমিল না নিত্য লোভীর ভুঁড়ির ঢেকুর-ঢেউ!
ইহাদের লোভ নিরন্ন দেশবাসী করিবে না ক্ষমা,
বহু আক্রোশ বহু ক্রোধ বহু প্রহরণ আছে জমা।
রুটি কাগজের হয়ে যায়, তবু কাগজের টাকা লয়ে,
পাতালের জীব পৃথিবীতে আজও বেড়ায় মাতাল হয়ে।
কোন অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করিতে আসিনু কোথা?
অক্টোপাসের মতো কেন মোরে জড়াল স্বর্ণলতা?
ভিখারি হওয়ার ভিক্ষা চাহিয়াছিনু আল্লার কাছে,
আজ দেখি মোর চারপাশে যত ভূত প্রেত যেন নাচে!
আল্লাহ্! মোরে এ শাস্তি হতে ফিরাইয়া লয়ে যাও!
টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে ফাঁকা আকাশের তলে নাও!