শোধ করো ঋণ
আগুন জ্বলে না মাসে কতদিন হায় ক্ষুধিতের ঘরে,
ক্ষুধার আগুনে জ্বলে কত প্রাণ তিলে তিলে যায় মরে।
বোঝে না ধনিক, হোক সে হিন্দু হোক সে মুসলমান,
আল্লা যাদের নিয়ামত দেন, পাষাণ তাদের প্রাণ!
কত ক্ষুধাতুর শিশুর রসনা খুদকণা নাহি পায়,
মা-র বুক ছেড়ে গোরস্তানের মাটিতে গিয়া ঘুমায়।
যত দৌলত হাশমতওয়ালা হেরে তাহা পাশে থেকে,
আতর মাখিয়া পাথরের দল যেন ছায়াছবি দেখে!
ভেবেছে এমনই নিজে খেয়ে দেয়ে হইয়া খোদার খাসি
দিন কেটে যাবে! এ সুখের দিন কভু হবে নাকো বাসি।
জগতের লোভী মরিতেছে আজ আল্লার অভিশাপে,
তবুও লোভের কাঁথা জড়াইয়া লোভী সব নিশি যাপে!
একটা খাসিরে ধরিয়া যখন জবাই করে কশাই,
আর একটা খাসি তখনও দিব্যি পাতা খায়, ভয় নাই।
ভেবেছ ওদেশে হতেছে শাস্তি, তোমাদের হইবে না,
তাই শোধ করিলে না আজও সেই পরম দানীর দেনা।
আর ক-টা দিন বেঁচে থাকো, যাঁর ঋণ করিয়াছ, তিনি
তোমাদের প্রাণ দৌলত নিয়ে খেলবেন ছিনিমিনি।
কী ভীষণ মার খাইবে সেদিন, বোঝ না অন্ধ জীব,
তোমাদের হাড়ে ভেলকি খেলিবে সেদিন এই গরিব।
বেতন চাহিলে শুনিতে পায় না, মনিবের রাগ হয়,
‘তিনদিন হাঁড়ি চড়েনিকো’ শুনে ভাবে একী কথা কয়!
ঘরের পার্শ্বে লেগেছে আগুন, বোঝে না স্বার্থপর,
আর দেরি নাই, পুড়িয়া যাইবে তাহারও সোনার ঘর।
বঞ্চিত রেখে দরিদ্রে, যারা করিয়াছে সঞ্চয়,
দেখিবে এবার, তার সঞ্চয় তার অধিকারে নয়।
অর্থের ফাঁদ পেতে দস্যুরে ডাকিয়া আনিছে যারা
তাহারাই আগে মরিবে, ভীষণ শাস্তি পাইবে তারা।
উপবাস যার দিনের সাধনা, নিশীথে শয়নসাথি,
যাহারা বাহিরে গাছতলে থাকে, ঘরে জ্বলে নাকো বাতি,
তাদের ধৈর্য সহিষ্ণুতা কি পাবে না পুরস্কার?
তারা তিলে তিলে মরে আনিয়াছে এবার খোদার মার!
তাদেরই করুণ মৃত্যু এনেছে ভয়াল মৃত্যু ডাকি,
তাদের আত্মা শান্তি পাইবে ভোগীর রক্ত মাখি।
মানুষের মার নয় এ রে দাদা, এ যে আল্লার মার,
এর ক্ষমা নাই, এ নয় ধরার ভাঁড়ামি রাজবিচার।
উৎপীড়ক আর ভোগীদের আসিয়াছে রোজ-কিয়ামত
ধূলি-রেণু হয়ে উড়ে যাবে সব ইহাদের নিয়ামত।
এদেরই হাতের অস্ত্র কাটিবে এদেরই স্কন্ধ, শির,
ইহারা মরিলে দুনিয়া হইবে স্নিগ্ধ, শান্ত, স্থির।
বাক্সের পানে চেয়ে চেয়ে চোখ ফ্যাকাশে হয়েছে বুঝি!
বাক্স ও চাবি নেবে না উহারা, কেড়ে নেবে শুধু পুঁজি।
খাবি খায় তবু চাবি ছাড়ে নাকো! উৎকট প্রলোভন
মরে না কিছুতে, আত্মঘাতী তা না হয় যতক্ষণ!
আমরা গরিব, শুকায়ে হয়েছি চামড়ার আমচুর,
খামচে ধরেছে মাংসওয়ালারে ক্ষুধিত বুনো কুকুর।
কোন বন থেকে কে জানে এসেছে নেকড়ে বাঘের দল,
আমাদের ভয় নাই, আমাদের নাইকো গোরু-ছাগল।
সামলাও মাল মালওয়ালা, দেখো পয়মাল হবে সব,
ঊর্ধ্বে নিত্য শুনিতেছ নাকি শকুনের কলরব?
ধূমকেতু নয়, কোন মেথরানি হাতে মুড়ো ঝ্যাঁটা লয়ে
এসেছে আকাশে; পৃথিবী উঠেছে ভীষণ নোংরা হয়ে!
নোংরা, লোভী ও ভোগী রহিবে না শুদ্ধ এ পৃথিবীতে,
এ আবর্জনা পুড়ে ছাই হবে নরকের চুল্লিতে।
আসিছে ফিরিয়া এই বাংলায় কাঙালের শুভদিন,
আজিও সময় আছে ধনী, শোধ করো তাহাদের ঋণ!
সকল পথের বন্ধু
হে আনন্দ-প্রেম-রসঘন, মধুরম, মনোহর!
একী মদিরার আবেশে নেশায় কাঁপে তনু থরথর!
হৃদি-পদ্মিনী নিঙাড়িয়া বঁধু –
আনিতে চাও কি অমৃতমধু,
উদাসীন মনে আন একী সুরভিত বন-মর্মর!
ঘন অরণ্য-আড়ালে কে হাস প্রিয় জ্যোতিসুন্দর!
কৃষ্ণা তিথির আড়ালে আমার চাঁদ লুকাইয়াছিলে!
আমি ভেবেছিনু, আমি কালো, তুমি তাই প্রেম নাহি দিলে।
বুঝি নাই, রসময়, তব খেলা
ভয় হত, যদি কর অবহেলা।
বেণুকা বাজায়ে পথে এনে হায় কোথা তুমি লুকাইলে?
দেখেছ কি দেহে কাদা, অন্তরে রাধারে নাহি দেখিলে?
তব অভিসার-পথ রুধিয়াছে কে যেন ভয়ংকর!
দিগ্দিগন্তে অন্ধ করেছে বাধার তুফান ঝড়।
সীতার মতন কে যেন গো কেশ ধরে
আঁধার পাতালে লইয়া গিয়াছে মোরে।
জড়াইয়া যেন শত শত নাগ বিষাক্ত অজগর
দংশেছে মোরে, বিষে জরজর! – তবু, ওগো মনোহর –
ডাকিনি তোমায়, যদি এই বিষ তব শ্রীঅঙ্গে লাগে!
এই পঙ্ক, এ মালিন্য যদি বাধা আনে অনুরাগে।
বলেছি, ‘বন্ধু, সরে যাও, সরে যাও,
আমার এ ক্লেশে আমারে কাঁদিতে দাও।’
আমার দুখ ‘লু’ হাওয়ার জ্বালা না আনে গোলাপ-বাগে!
ক্ষমা কোরো মোরে, ভুল বুঝিয়ো না, যদি অভিমান জাগে!
জানি তুমি মোরে জড়ায়ে ধরেছ প্রকাশ-ব্রহ্মরূপে,
আমার বক্ষে চেতনানন্দ হয়ে কাঁদ চুপে চুপে!
হৃদি-শতদল কাঁপে মোর টলমল,
মোর চোখে ঝরে তোমার অশ্রুজল!
বক্ষে জড়ায়ে আন প্রেমলোকে, নামিয়া অন্ধকূপে,
অমৃত স্বরূপে হে প্রিয়তম আনন্দ-স্বরূপে!
আঁধারে আলোকে যখন যে পথ টানে, তুমি থাক কাছে।
অরণ্যপথে তব আনন্দ কুরঙ্গ হয়ে নাচে!
আমার তীর্থ-মরুপথে ছায়া হয়ে
সাথে সাথে চলো আঙুরের রস লয়ে,
পথের বালুকা পাখির পালক ফুল হয়ে ফুটিয়াছে!
চোখে জল, বুকে মধু বলে – ‘বঁধু, আছে আছে, সাথে আছে!’
সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি
রৌদ্রোজ্জ্বল দিবসে তোমার আসিনি সজল মেঘের ছায়া,
তৃষ্ণা-আতুর হরিণী চোখে কী হবে হানিয়া মরীচি-মায়া!
আমি কালো মেঘ – নামি যদি তব বাতায়ন-পাশে বৃষ্টিধারে,
বন্ধ করিয়া দিবে বাতায়ন, যদি ভিজে যাও নয়নাসারে!
সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি, বাদল রাতের পাপিয়া নহ,
তব তরে নয় বাদলের ব্যথা – নয়নের জল দুর্বিষহ।
ফাল্গুন-বনে মাধবী-বিতানে যে পিক নিয়ত ফুকারি ওঠে,
তুমি চাও সেই কোকিলের ভাষা তোমার রৌদ্রতপ্ত ঠোঁটে।
জানি না সে ভাষা, হয়তো বা জানি, ছল করে তাই হাসিতে চাহি,
সহসা নিরখি – নেমেছে বাদল রৌদ্রোজ্জ্বল গগন বাহি।
ইরানি-গোলাব-আভা আনিয়াছ চুরি করি ভরি ও রাঙা তনু,
আমি ভাবি বুঝি আমারই বাদল-মেঘশেষে এল ইন্দ্রধনু।
ফণীর ডেরায় কাঁটার কুঞ্জে ফোটে যে কেতকী, তাহার ব্যথা
বুঝিবে না তুমি, ধরণি তো তব ঘর নহে, এলে ভ্রমিতে হেথা।
ভ্রম করে তুমি ভ্রমিতে ধরায় এসেছ, ফুলের দেশের পরি,
জানিতে না হেথা সুখদিন শেষে আসে দুখ-রাতি আঁধার করি।
রাঙা প্রজাপতি উড়িয়া এসেছ, চপলতা-ভরা চিত্র-পাখা,
জানিতে না হেথা ফুল ফুটে ফুল ঝরে যায়, কাঁদে কানন ফাঁকা।
যে লোনা জলের সাত সমুদ্র গ্রাস করিয়াছে বিপুল ধরা,
সেই সমুদ্রে জনম আমার, আমি সেই মেঘ সলিল ভরা।
ভাসিতে যে আসে আমার সলিলে, তাহারে ভাসায়ে লইয়া চলি
সেই অশ্রুর সপ্ত পাথারে, পারায়ে ব্যথার শতেক গলি।
ভুল করে প্রিয়া এ ফুল-কাননে এসেছিলে, জানা ছিল না তব
এ বন-বেদনা অশ্রুমুখীরে; এ নহে মাধবীকুঞ্জ নব।
মাটির করুণাসিক্ত এ মন, হেথা নিশিদিন যে ফুল ঝরে
তারই বেদনায় ভরে আছে মন, হাসিতে তাদেরই অশ্রু ক্ষরে।
সেই বেদনায় এসেছিলে তুমি ক্ষণিক স্বপন, ভুলের মেলা,
জাগিয়া তাহারই স্মৃতি লয়ে কাটে আমার সকাল সন্ধ্যাবেলা।
এ মোর নিয়তি, অপরাধ নহে আমারও তোমারও – স্বপন-রানি!
আমার বাণীতে তোমার মুরতি বীণাপাণি নয় বেদনাপাণি।
তোমার নদীতে নিতি কত তরি এপার হইতে ওপারে চলে;
কাণ্ডারিহীন ভাঙা তরি মোর ডুবে গেল তব অতল তলে।
ওরা শুধু তব মুখ চেয়ে যায়, সুখের আশার বণিক ওরা,
আমি ডুবে তব দেখিলাম তল জলশেষে চোরা বালুতে ভরা।
ভয় নাই প্রিয়, মগ্ন এ তরি তব বিস্মৃতি-বালুকাতলে
দু-দিনে পড়িবে ঢাকা, উদাসীন, তুমি বয়ে যাবে চলার ছলে।
কুড়াতে এসেছে দুখের ঝিনুক ব্যথার আকুল সিন্ধুকূলে,
আঁচল ভরিয়া কুড়ায়ে হয়তো ফেলে দেবে কোথা মনের ভুলে।
তোমাদের ব্যথা-কাঁদন যেটুকু, সে শুধু বিলাস, পুতুলখেলা,
পুতুল লইয়া কাটে চিরদিন, আদর করিয়া ভাঙিয়া ফেলা।
মোর দেহমনে নয়নে ও প্রেমে অশ্রুজল নীরদ মাখা,
কী হবে ভিজিয়া এ বাদলে, রানি, তব ধ্যান ওই চন্দ্র তারকা।
সে চাঁদ উঠেছে গগনে তোমার-আমার সন্ধ্যাতিমির শেষে,
আমি যাই সেই নিশীথিনী-পারে যেথায় সকল আঁধার মেশে।
আমার প্রেমের বরষায় ধুয়ে তব হৃদি হল সুনীলতর –
সে গগনে যবে উঠিবে গো চাঁদ উজ্জ্বলতর তাহারে করো।
যদি সে-চন্দ্রহসিত নিশীথে বিস্বাদ লাগে তোমার চোখে,
তোমার অতীত তোমারে খুঁজিয়ো আমার বিধুর গানের লোকে।
সেথা ব্যথা রবে, রবে সান্তনা, রবে চন্দন-সুশীতলতা,
যে-ফুল জীবনে ঝরে না সে-ফুল হইয়া ফুটিবে তোমার ব্যথা।
আমার গানের চির-দাহ যাহা সে আছে গো নীলকন্ঠে মম,
চিরশেষে এল যে অমৃতবাণী, দিনু তা তোমারে হে প্রিয়তম!
আমার শাখায় কন্টক থাক, কাঁটার ঊর্ধ্বে তুমি যে ফুল –
আমি ফুটায়েছি তোমারে কুসুম করিয়া, সে মোর সুখ অতুল।
বিদায়-বেলায় এই শুধু চাই, হে মোর মানস-কানন-পরি,
তোমার চেয়েও তব বন্ধুরে ভালোবাসি যেন অধিক করি।