ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা
তখ্তে তখ্তে দুনিয়ায় আজি কমবখ্তের মেলা,
শক্তি-মাতাল দৈত্যেরা সেথা করে মাতলামি খেলা।
ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা, ভাঙিয়া পোড়ো না দুখে,
পাতালের এই মাতাল রবে না আর পৃথিবীর বুকে।
তখ্তে তাহার কালি পড়িয়াছে অবিচারে আর পাপে,
তলোয়ারে তার মরিচা ধরেছে নির্যাতিতের শাপে।
ঘন গৈরিকে আকাশ রাঙায়ে বৈশাখী ঝড় আসে,
ভাবে লোভান্ধ মানব, তাহার গোধূলি-লগন হাসে!
যে আগুন ছড়ায়েছে এ বিশ্বে, তারই দাহ ফিরে এসে
ভীম দাবানল-রূপে জ্বলিতেছে তাহাদেরই দেশে দেশে।
সত্যপথের তীর্থ-পথিক! ভয় নাই, নাহি ভয়,
শান্তি যাদের লক্ষ্য, তাদের নাই নাই পরাজয়!
অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে,
অবশেষে চিরলাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে!
পথের ঊর্ধ্বে ওঠে ঝোড়ো বায়ে পথের আবর্জনা,
তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে উঠেছে – কেহ কভু ভাবিয়ো না!
ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরই পথে হয় ওরা বাধা,
পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় নাকো কাদা!
জয়ে পরাজয়ে সমান শান্ত রহিব আমরা সবে,
জয়ী যদি হই, এক আল্লার মহিমার জয় হবে!
লাঞ্ছিত হলে বাঞ্ছিত হব পরলোকে আল্লার,
রণভূমে যদি হত হই মোরা হব চির-প্রিয় তাঁর!
হয়তো কখনও জয়ী হবে ওরা, হটিব না মোরা তবু,
বুঝিব মোদের পরীক্ষা করে মোদের পরম প্রভু!
বিদ্বেষ লয়ে ডাকিলে কি প্রভু পথভ্রান্ত ফিরে?
ভালোবাসা দিয়ে তাদেরে ডাকিতে হয় বক্ষের নীড়ে।
সজ্ঞানে যারা করে নিপীড়ন, মানুষের অধিকার
কেড়ে নিতে চায়, তাহাদেরই তরে আল্লার তলোয়ার।
অজ্ঞান যারা ভুল পথে চলে, মারিয়ো না তাহাদেরে,
ভালোবাসা পেলে ভ্রান্ত মানুষ সত্যের পথে ফেরে।
সকল জাতির সকল মানুষে এক তাঁর নামে ডাকো,
বুকে রাখো তাঁর ভক্তি ও প্রেম, হাতে তলোয়ার রাখো।
সর্ববিশ্ব প্রসন্ন হয় তিনি প্রসন্ন হলে,
সত্যপথের সর্বশত্রু ছাই হয়ে যায় জ্বলে!
আমাদেরও মাঝে যার বুকে আছে লুকাইয়া প্রলোভন,
তারেও কঠিন সাজা দিতে হবে, আল্লার প্রয়োজন!
আগে চলো, আগে চলো দুর্জয় নব অভিযান-সেনা,
আমাদের গতি-প্রবাহ কাহারও কোনো বাধা মানিবে না।
বিশ্বাস আর ধৈর্য হউক আমাদের চির-সাথি,
নিত্য জ্বলিবে আমাদের পথে সূর্য চাঁদের বাতি।
ভয় নাহি, নাহি ভয়!
মিথ্যা হইবে ক্ষয়!
সত্য লভিবে জয়!
ভক্তে দেখায় রক্তচক্ষু যারা, তারা হবে লয়!
বলো, এ পৃথিবী মানুষের, ইহা কাহারও তখ্ত্ নয়!
পুণ্য তখ্তে বসিয়া যে করে তখ্তের অসম্মান,
রাজার রাজা যে, তাঁর হুকুমেই যায় তার গর্দান!
ভিস্তিওয়ালার রাজত্ব, ভাই, হয়ে এল ওই শেষ,
বিশ্বের যিনি সম্রাট তাঁরই হইবে সর্বদেশ!
রক্তচক্ষু রক্ষ যক্ষ, সাবধান! সাবধান!
ভুল বুঝাইয়া, বুঝেছ ভুলাবে আল্লার ফরমান?
এক আল্লারে ভয় করি মোরা, কারেও করি না ভয়,
মোদের পথের দিশারি এক সে সর্বশক্তিময়।
সাক্ষী থাকিবে আকাশ, পৃথিবী, রবি শশী গ্রহ তারা,
কাহারা সত্যপথের পথিক, পথভ্রষ্ট কারা!
ভয় নাহি, নাহি ভয়!
মিথ্যা হইবে ক্ষয়!
সত্য লভিবে জয়!
মহাত্মা মোহ্সিন
[গান]
সকল জাতির সব মানুষের বন্ধু হে মোহ্সিন!
এ যুগে তুমিই শোধ করিয়াছ এক আল্লার ঋণ॥
ভোগ করনিকো বিপুল বিত্ত পেয়ে,
ভিখারি হইলে শুধু আল্লারে চেয়ে,
মহাধনী হলে আল্লার কৃপা পেয়ে,
দুনিয়ায় তাই রহিলে কাঙাল দীন॥
মানুষের ভালোবাসায় পাইলে আল্লার ভালোবাসা,
সৃষ্টির তরে কাঁদিয়া, পুরালে তব স্রষ্টার আশা।
তব দান তাই ফুরায়ে নাহি ফুরায়,
বিত্ত হইল নিত্য এ দুনিয়ায়,
শিখাইয়া গেলে, মুসলিম তারে কয়
অর্থ যাহারে কিনিতে পারে না, যে নহে লোভ-মলিন॥
মোহররম
ওরে বাংলার মুসলিম, তোরা কাঁদ!
এনেছে এজিদি বিদ্বেষ পুন মোহররমের চাঁদ।
এক ধর্ম ও এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে
তখ্তের লোভে এসেছে এজিদ কমবখ্তের বেশে!
এসেছে ‘সীমার’, এসেছে ‘কুফা’র বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা!
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,
কাঁদে আশমান জমিন, কাঁদিছে মোহররমের চাঁদ।
একদিকে মাতা ফতেমার বীর দুলাল হোসেনি সেনা,
আর দিকে যত তখ্ত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।
মাঝে বহিতেছে শান্তিপ্রবাহ পুণ্য ফোরাত নদী,
শান্তিবারির তৃষাতুর মোরা, ওরা থাকে তাহা রোধি!
একদিকে ইসলামি ইমামের সিপাহি শান্তিব্রতী,
আর একদিকে স্বার্থান্বেষী হিংসুক ক্রোধমতি!
এই দুনিয়ার মৃত্তিকা ছিল তখ্ত সে খলিফার,
ভেঙে দিয়েছিল স্বর্ণ-সিংহাসনের যে অধিকার,
মদগর্বী ও ভোগী বর্বর এজিদি ধর্মী যত,
যুগে যুগে সেই সাম্য ধর্মে করিতে চেয়েছে হত।
এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,
‘আলীর’ সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান!
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসান হোসেনে গালি দিতে যেত মদিনা ও মক্কায়।
এরাই আত্মপ্রতিষ্ঠা-লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে।
ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য, এরা তাহা দেয় ভেঙে।
ফোরাত নদীর কূল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে
এই ভোগীদের জুলুমে! ইহারা এজিদি মুসলমান,
এরা ইসলামি সাম্যবাদেরে করিয়াছে খান খান!
এক বিন্দুও প্রেম-অমৃত নাই ইহাদের বুকে,
শিশু আসগরে তির হেনে হাসে পিশাচের মতো সুখে!
আপনার সুখ ভোগ ও বিলাস ছাড়া জানে নাকো কিছু,
একজন বড়ো হতে চায়, করে লক্ষ জনেরে নিচু।
আজন্ম রহি শ্বেতমর্মর-প্রাসাদে মদবিলাসী,
তখ্ত টলিলে বলে, ‘দরিদ্রে মোরা বড়ো ভালবাসি!’
দরিদ্রেরে ভালবেসে যার ভুঁড়ি ফেঁপে হল ধামা ঝুড়ি,
শীতের দিনেও চর্বি গলিয়া পড়ে চাপকান ফুঁড়ি,
যাদের চরণ পরশ করেনি কখনও ধরার ধূলি,
যাহারা মানুষে করেছে ভৃত্য মুটে মজুর ও কুলি,
অকল্যাণের দূত তারা আজ ভূত সেজে পথে পথে
মৃত্যুর ভয়ে ফিরিতেছে নেমে সোনার প্রাসাদ হতে।
সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, ইসলামের সাম্যবাদ
যুগে যুগে এই অসুর-সেনারা করিয়াছে বরবাদ।
ফোরাত নদীর স্রোত [ধারা]-সম ধনসম্পদ লয়ে
দেয় নাকো পিয়াসের এক ফোঁটা পানি। নির্মম হয়ে
মারে কাটে এরা বে-রহম, এরা টলে নাকো কোনোদিন,
এজিদি তখ্ত টুটেছে বলিয়া ছুটিছে শ্রান্তিহীন।
আল্লা রসুল মুখে বলে, তাঁর ক্ষমা পায়নিকো এরা,
দেখেছে শুষ্ক দামেস্ক শুধু, দেখেনি কাবা ও হেরা।
শোনেনি ইহারা আল-আরবির সাম্য প্রেমের বাণী।
আল্লা! এরাও মুসলিম, এরা রসুলের উম্মত,
কেন পায়নিকো প্রেম আর ক্ষমা শান্তি ও রহমত?
ভুল পথে নিতে চায় অন্যেরে, ভুল পথে চলে, তবু
এরা মোর ভাই, এদেরে জ্ঞান ও প্রেম ক্ষমা দাও প্রভু!
লোভ ও অহংকার ইহাদেরে করিয়াছে অজ্ঞান,
সাম্য মৈত্রী মানে না, তবুও এরা যে মুসলমান।
এদের ভুলের, মিথ্যা মোহের করি শুধু প্রতিবাদ,
ইহাদেরই প্রেমে কাঁদি আমি, কেন এরা হল জল্লাদ?
আমাদের মাঝে যত দ্বন্দ্ব ও মন্দ হউক ভালো,
আল্লা! আবার জ্বালাও প্রেমে শান্ত মধুর আলো!
ভালোবাসাহীন এই পৃথিবীরে আর ভালো লাগে নাকো,
আমার পরম প্রেমময় প্রভু, প্রেম দিয়ে বেঁধে রাখো!
খলিফা হইয়া মুসলিম দুনিয়ার বাদশাহি করে,
ভৃত্যে চড়ায়ে উটের পৃষ্ঠে নিজে চলে রশি ধরে!
খোদার সৃষ্ট মানুষেরা ভালোবাসিতে পারে না যারা,
জানি না কেমনে জন-গণ-নেতা হতে চায় হায় তারা!
ত্যাগ করে নাকো ক্ষুধিতের তরে সঞ্চিত সম্পদ,
নওয়াব বাদশা জমিদার হয়ে, চায় প্রতিষ্ঠা-মদ।
ভোগের নওয়াব আমির ইহারা, ত্যাগের আমির কই?
মোহররমের বিষাদ-মলিন চাঁদ পানে চেয়ে রই!
মা ফাতেমা! কোন জন্নতে আছ? দুনিয়ার পানে চাহো,
প্রার্থনা করো, দূর হোক ভায়ে ভায়ে বিদ্বেষ দাহ!
আমাদের মাঝে যার লোভ আছে, তাহা দূর হয়ে যাক,
যাহারা ভ্রান্ত, আসুক তাদের সত্যপথের ডাক।
ফোরাতের পানি ধরার মরুতে শান্তিধারার মতো
না, না, তোমারই মাতৃস্নেহ-রূপে বহে অবিরত।
সেই পবিত্র স্নেহবন্যার দুই কূলে ভায়ে ভায়ে –
হানাহানি করে! তুমি কাঁদিতেছ কোন জন্নত-ছায়ে?
ফোরাতের পানি রক্তিম হল ; মা গো, বিদ্বেষ-বিষে,
কারা তির হানে কাবার শান্তি মিনারের কার্নিশে?
তুমি দাও মাগো ফিরদৌস হতে দুটি ফোঁটা আঁখিবারি,
তব স্নেহবিগলিত অশ্রু, মা, সর্বতৃষ্ণাহারী!
তুমি নবিজির নন্দিনী, নন্দন-আনন্দ দাও,
আল্লার কাছে ভায়ে ভায়ে পুন মিলন-ভিক্ষা চাও!
‘সীমার’ ‘এজিদ’ সকলের তরে কেয়ামতে ক্ষমা চাবে,
আজ দুনিয়ায় ভায়ে ভায়ে কী মা রবে দুশমনি ভাবে?
দূর হোক এই ভাবের অভাব, ভায়ে ভায়ে এই আড়ি,
সকলের ঘরে যাক আরবের খেজুর রসের হাঁড়ি!
অখণ্ড এক চাঁদ আজ বুঝি দু-খণ্ড হয়ে যায়,
শরিকি আসিল হায় যারা মানে লা-শরিক আল্লায়।
কারবালা যেন নাহি আসে আর মোহররমের চাঁদে,
তাজিয়া মিছিলে একী কাজিয়ার খেলা, দেখে প্রাণ কাঁদে
শান্তি, শান্তি, আল্লা শান্তি দাও।
সর্বদ্বন্দ্বাতীত তুমি, নাও তব প্রেমপথে নাও।