পার্থসারথি
হে পার্থসারথি
বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য-শঙ্খ।
চিত্তের অবসাদ দূর করো, করো দূর
ভয়-ভীত জনে করো হে নিঃশঙ্ক॥
জড়তা ও দৈন্য হানো হানো
গীতার মন্ত্রে জীবন দানো
ভোলাও ভোলাও মৃত্যু-আতঙ্ক॥
মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে,
শোনাও শোনাও, অনন্তকাল ধরি
অনন্ত জীবন-প্রবাহ বহে॥
দুরন্ত দুর্মদ যৌবন-চঞ্চল
ছাড়িয়া আসুক মা-র স্নেহ-অঞ্চল
বীর সন্তান দল
করুক সুশোভিত মাতৃ-অঙ্ক॥
পুরববঙ্গ
পদ্ম-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা-বিধৌত পূর্ব-দিগন্তে
তরুণ অরুণ বীণা বাজে তিমির বিভাবরী-অন্তে।
ব্রাহ্ম মুহুর্তের সেই পুরবাণী
জাগায় সুপ্ত প্রাণ জাগায় – নব চেতনা দানি
সেই সঞ্জীবনী বাণী শক্তি তার ছড়ায়
পশ্চিমে সুদূর অনন্তে॥
ঊর্মিছন্দা শত-নদীস্রোত-ধারায় নিত্য পবিত্র –
সিনান-শুদ্ধ-পুরববঙ্গ
ঘন-বন-কুন্তলা প্রকৃতির বক্ষে সরল সৌম্য
শক্তি-প্রবুদ্ধ পুরববঙ্গ
আজি শুভলগ্নে তারই বাণীর বলাকা
অলখ ব্যোমে মেলিল পাখা
ঝংকার হানি যায় তারই পুরবাণী
জীবন্ত হউক হিম-জর্জর ভারত
নবীন বসন্তে॥
বকরীদ
শহিদান’দের ঈদ এল বকরীদ!
অন্তরে চির-নওজোয়ান যে তারই তরে এই ঈদ।
আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান,
নির্লোভ নিরহংকার যারা, যাহারা নিরভিমান,
দানব-দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে,
ফিরদৌস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে,
অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাশ করিতে যারা
জন্ম লয়েছে চিরনির্ভীক যৌবন-মাতোয়ারা, –
তাহাদেরই শুধু আছে অধিকার ঈদ্গাহে ময়দানে,
তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান মাল কোরবানে।
বিভুতি, ‘মাজেজা’, যাহা পায় সব প্রভু আল্লার রাহে
কোরবানি দিয়ে নির্যাতিতেরে মুক্ত করিতে চাহে।
এরাই মানব-জাতির খাদেম, ইহারাই খাক্সার,
এরাই লোভীর সাম্রাজ্যেরে করে দেয় মিসমার!
ইহারাই ‘ফিরোদৌস-আল্লা’র প্রেম-ঘন অধিবাসী
তসবি ও তলোয়ার লয়ে আসি অসুরে যায় বিনাশি।
এরাই শহিদ, প্রাণ লয়ে এরা খেলে ছিনিমিনি খেলা,
ভীরুর বাজারে এরা আনে নিতি নব নওরোজ-মেলা!
প্রাণ-রঙ্গিলা করে ইহারাই ভীতি-ম্লান আত্মায়,
আপনার প্রাণ-প্রদীপ নিভায়ে সবার প্রাণ জাগায়।
কল্পবৃক্ষ পবিত্র ‘জৈতুন’ গাছ যথা থাকে,
এরা সেই আশমান থেকে এসে, সদা তারই ধ্যান রাখে!
এরা আল্লার সৈনিক, এরা ‘জবীহুল্লা’-র সাথি,
এদেরই আত্মত্যাগ যুগে যুগে জ্বালায় আশার বাতি।
ইহারা, সর্বত্যাগী বৈরাগী প্রভু আল্লার রাহে,
ভয় করে নাকো কোনো দুনিয়ার কোনো সে শাহানশাহে।
এরাই কাবার হজের যাত্রী, এদেরই দস্ত চুমি!
কওসর আনে নিঙাড়িয়া রণক্ষেত্রের মরুভূমি!
‘জবীহুল্লা’র দোস্ত ইহারা, এদেরই চরণাঘাতে,
‘আব-জমজম’ প্রবাহিত হয় হৃদয়ের মক্কাতে।
ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ?
আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম করি তারে,
ঈদ্গাহে গিয়া তারই সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।
অন্তরে ভোগী, বাইরে যে রোগী, মুসলমান সে নয়,
চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য যে পরিচয়!
লাখো ‘বকরা’র বদলে সে পার হবে না পুলসেরাত
সোনার বলদ ধনসম্পদ দিতে পার খুলে হাত?
কোরান মজিদে আল্লার এই ফরমান দেখো পড়ে,
আল্লার রাহে কোরবানি দাও সোনার বলদ ধরে।
ইব্রাহিমের মতো পুত্রেরে আল্লার রাহে দাও,
নইলে কখনও মুসলিম নও, মিছে শাফায়ৎ চাও!
নির্যাতিতের লাগি পুত্রেরে দাও না শহিদ হতে,
চাকরিতে দিয়া মিছে কথা কও– ‘যাও আল্লার পথে’!
বকরীদি চাঁদ করে ফরয়্যাদ, দাও দাও কোরবানি,
আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাঁহার না-ফরমানি!
পিছন হইতে বুকে ছুরি মেরে, গলায় গলায় মেলো,
কোরো না আত্ম-প্রতারণা আর, খেলকা খুলিয়া ফেলো!
উমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদে মনে কর,
শুধু সালওয়ার পরিয়ো না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো!
কোথায় আমার প্রিয় শহিদল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ?
এসো ঈদের নামাজ পড়িব, আলাদা আমাদের ময়দান!
বিশ্বাস ও আশা
বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে,
নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্ত সে মরিয়াছে ।
শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে,
পরান গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে!
থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রোগ শোক লাঞ্ছনা,
যুদ্ধ না করে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিয়ো না।
ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি, মিথ্যা ও অহেতুক
নিরাশায় হয় পরাজয় যার, তাহার নিত্য দুখ।
‘হয়তো কী হবে’ এই ভেবে যারা ঘরে বসে কাঁপে ভয়ে,
জীবনের রণে নিত্য তারাই আছে পরাজিত হয়ে।
তারাই বন্দি হয়ে আছে গ্লানি-অধীনতা কারাগারে;
তারাই নিত্য জ্বালায় পিত্ত অসহায় অবিচারে!
এরা অকারণ ভয়ে ভীত, এরা দুর্বল নির্বোধ,
ইহাদের দেখে দুঃখের চেয়ে জাগে মনে বেশি ক্রোধ।
এরা নির্বোধ, না করে কিছুই জিভ মেলে পড়ে আছে
গোরস্তানেও ফুল ফোটে, ফুল ফোটে না এ মরা গাছে।
এদের যুক্তি অদৃষ্টবাদ, বসে বসে ভাবে একা,
‘এ মোর নিয়তি, বদলানো নাহি যায় কপালের লেখা!’
পৌরুষ এরা মানে না, নিজেরে দেয় শুধু ধিক্কার,
দুর্ভাগ্যের সাথে নাহি লড়ে মেনেছে ইহারা হার।
এরা জড়, এরা ব্যাধিগ্রস্ত, মিশো না এদের সাথে,
মৃত্যুর উচ্ছিষ্ট আবর্জনা এরা দুনিয়াতে।
এদের ভিতরে ব্যাধি, ইহাদের দশদিক তমোময়,
চোখ বুজে থাকে, আলো দেখিয়াও বলে, ‘ইহা আলো নয়’।
প্রবল অটল বিশ্বাস যার নিশ্বাস প্রশ্বাসে,
যৌবন আর জীবনের ঢেউ কল-তরঙ্গে আসে,
মরা মৃত্তিকা করে প্রাণায়িত শস্যে কুসুমে ফলে,
কোনো বাধা তার রুধে নাকো পথ, কেবল সুমুখে চলে,
চির-নির্ভয়; পরাজয় তার জয়ের স্বর্গ-সিঁড়ি,
আশার আলোক দেখে তত, যত আসে দুর্দিন ঘিরি।
সেই পাইয়াছে পরম আশার আলো, যেয়ো তারই কাছে,
তাহারই নিকটে মৃত্যুঞ্জয়ী অভয়-কবচ আছে।
যারা বৃহতের কল্পনা করে, মহৎ স্বপ্ন দেখে,
তারাই মহৎ কল্যাণ এই ধরায় এনেছে ডেকে।
অসম্ভবের অভিযান-পথ তারাই দেখায় নরে,
সর্বসৃষ্টি ফেরেশ্তারেও তারা বশীভূত করে।
আত্মা থাকিতে দেহে যারা সহে আত্ম-নির্যাতন,
নির্যাতকেরে বধিতে যাহারা করে না পরান-পণ,
তাহারা বদ্ধ জীব পশু সম, তাহারা মানুষ নয়,
তাদেরই নিরাশা মানুষের আসা ভরসা করিছে লয়।
হাত-পা পাইয়া কর্ম করে না কূর্মধর্মী হয়ে,
রহে কাদা-জলে মুখ লুকাইয়া আঁধার বিবরে ভয়ে,
তাহারা মানব-ধর্ম ত্যজিয়া জড়ের ধর্ম লয়,
তাহারা গোরস্তান, শ্মশানের, আমাদের কেহ নয়!
আমি বলি, শোনো মানুষ! পূর্ণ হওয়ার সাধনা করো,
দেখিবে তাহারই প্রতাপে বিশ্ব কাঁপিতেছে থরথর।
ইহা আল্লার বাণী যে, মানুষ যাহা চায় তাহা পায়,
এই মানুষের হাত পা চক্ষু আল্লার হয়ে যায়!
চাওয়া যদি হয় বৃহৎ, বৃহৎ সাধনাও তার হয়,
তাহারই দুয়ারে প্রতীক্ষা করে নিত্য সর্বজয়।
অধৈর্য নাহি আসে কোনো মহাবিপদে সে সেনানীর,
অটল শান্ত সমাহিত সেই অগ্রনায়ক বীর।
নিরানন্দের মাঝে আল্লার আনন্দ সেই আনে,
চাঁদের মতন তার প্রেম জনগণ-সমুদ্রে টানে।
অসম সাহস আসে বুকে তার অভয় সঙ্গ করে,
নিত্য জয়ের পথে চলো সেই পথিকের হাত ধরে!
পূর্ণ পরম বিশ্বাসী হও, যাহা চাও পাবে তাই,
তাহারে ছুঁয়ো না, সেই মরিয়াছে, বিশ্বাস যার নাই!