নারী
হায় ফিরদৌসের ফুল! ফুটিতে আসিলে ধূলির ধরায় কেন? সে কি মায়া? সে কি ভুল? কোন আনন্দধামে জড়াইয়া ছিলে কোন একাকীর বামে? তাঁহারই জ্যোতির্মণিকা-কণিকা এসেছে প্রকৃতি হয়ে সপ্ত আকাশ রসে ডুবাইয়া প্রেম ও মাধুরী লয়ে। পরম জ্যোতির্দীপ্তিরে নাহি ডরিলে পরম রুদ্রে প্রেম-চন্দন মাখায়ে স্নিগ্ধ করিলে! শুভ্র জ্যোতির্পুঞ্জ-ঘন অরূপে গলাইলে তুমি ময়ূরকন্ঠী নবীন নীরদ রূপে! নীল মেঘে হলে শক্তি বিজলি-লেখা শূন্যবিহারী একাকী পুরুষে রহিতে দিলে না একা। স্রষ্টা হইল প্রিয়-সুন্দর সৃষ্টিরে প্রিয়া বলি কল্পতরুতে ফুটিল প্রথম নারী আনন্দকলি! নিজ ফুলশরে যেদিন পুরুষ বিঁধিল আপন হিয়া, ফুটিল সেদিন শূন্য আকাশে আদিবাণী – ‘প্রিয়া, প্রিয়া!’ আকাশ ছাইল অনন্তদল শতদলে আর প্রেমে, শান্ত মৌনী এল যৌবন-চঞ্চল হয়ে নেমে। কে দেখিত সেই পরম শূন্য, অসীম পাষাণ-শিলা, সীমায় যদি না বাঁধিতে তাহারে না দেখাতে রূপ-লীলা! কোন সে গোপন পরমাশ্রী প্রকৃতি লুকায়ে ছিলে? ভুবনে ভুবনে ভবন রচিয়া রস-দীপ জ্বালাইলে! অনন্তশ্রী ঝরে পড়ে নিতি অনন্ত দিকে তব, তুমি এলে, তাই সম্ভাবনায় আসিল অসম্ভব! হে পবিত্রা চির-কল্যাণী, কে বলে তোমায় মায়া ? এই সুন্দর রবি শশী তারা গিরি প্রান্তর নদীজলধারা অসীম আকাশ সাগর ধরিতে পারে না তোমার কায়া, তব রূপে দেখি না-দেখা পরম সুন্দরের যে ছায়া, – কে বলে তোমায় মায়া? তুমি তাঁর তেজ, তব তেজে জ্বলে আমার এই জীবন, সূর্যের মতো চাঁদসম আকাশের কোলে অনুখন। মাতা হয়ে তুমি দিয়াছ এ মুখে প্রথম-স্তন্যরস, স্নেহ-অঞ্চলে বাঁধিয়া এ ঘর ছাড়ায়ে করেছ বশ। যখনই পালাতে চাহিয়াছি বনে, কে তুমি অশ্রুমতী, কাঁদিয়াছ মোর হৃদয়ে বসিয়া, রোধ করিয়াছ গতি? সুন্দর প্রকৃতিরে হেরি মোর তৃষ্ণা জাগিল প্রাণে, এত সুন্দর সৃষ্টি করে যে, সে থাকে সে-কোনখানে। আমার পূর্ণ সুন্দরের যে পথের দিশারি তুমি, তুমি ছায়া হয়ে সাথে চল যবে পার হই মরুভূমি? যতবার নিভে যায় আশা-দীপ, ততবার তুমি জ্বাল, শূন্য আঁধারে সম্মুখে জ্বলে তোমার আঁধারি-আলো! অনন্তধারা প্রেমের ঝরনা কোথা লুকাইয়া ছিলে? উদাসীন গিরি-পাষাণের হিয়া রসে ভাসাইয়া দিলে! পাথরের বিগ্রহ হয়েছিল নিস্তেজ আদি-নর, তেজোময়ী আদি-নারী সে পাষাণে কাঁপাইলে থরথর। নিষ্কাম ঘন অরণ্যে সেই প্রথম কামনা-জুঁই আঁখি মেলি যেন দেখিল সৃষ্টি, হেসে এক হল দুই! এই দুই হয়ে দ্বন্দ্ব আসিল, ছন্দ জাগিল পায়, সোনাতে কাঁকরে দুজনে মিলিয়া নূপুর বাজায়ে যায়! সালাম লহো গো প্রণাম লহো গো প্রকৃতি পুণ্যবতী, তব প্রেম দেখায়েছে গো চির আনন্দধামের জ্যোতি! প্রেমের প্রবাহ লইয়া যখন আস হয়ে উপনদী – মরুতে মরে না নরের তৃষ্ণানদী – সাগরের পানে ছুটে চলে নিরবধি! পুরুষের জ্ঞান রসায়িত হয় প্রকৃতির প্রেমরসে, তরবারি ধরে উদাসীন নর রণক্ষেত্রে পশে! যে দেশে নারীরা বন্দিনী, আদরের নন্দিনী নয়, সে দেশে পুরুষ ভীরু কাপুরুষ জড় অচেতন রয়! অভিশপ্ত সে দেশ পরাধীন, শৌর্য-শক্তিহীন, শোধ করেনি যে দেশ কল্যাণী সেবিকা নারীর ঋণ! নারী অমৃতময়ী, নারী কৃপা – করুণাময়ের দান, কল্যাণ কৃপা পায় না, যে করে নারীর অসম্মান! বেহেশ্ত’ স্বর্গ শুকাইয়া যায় প্রকৃতি না থাকে যদি, জ্বলে না আগুন, আসে না ফাগুন, বহে না বায়ু ও নদী! আজও রবি শশী ওঠে ফুল ফোটে নারীদের কল্যাণে, নামে সখ্য ও সাম্য শান্তি নারীর প্রেমের টানে। নারী আজও পথে চলে তাই ধূলিপথ হয় বিধৌত শুদ্ধ মেঘের জলে! নারীর পুণ্য প্রেম আনন্দ রূপ রস সৌরভ আজও সুন্দর করিয়া রেখেছে বিধাতার গৌরব!
নিত্য প্রবল হও
অন্তরে আর বাহিরে সমান নিত্য প্রবল হও!
যত দুর্দিন ঘিরে আসে, তত অটল হইয়া রও!
যত পরাজয়-ভয় আসে, তত দুর্জয় হয়ে ওঠো।
মৃত্যুর ভয়ে শিথিল যেন হয় তলোয়ার-মুঠো।
সত্যের তরে দৈত্যের সাথে করে যাও সংগ্রাম,
রণক্ষেত্রে মরিলে অমর হইয়া রহিবে নাম।
এই আল্লার হুকুম – ধরায় নিত্য প্রবল রবে,
প্রবলেই যুগে যুগে সম্ভব করেছে অসম্ভবে।
ভালোবাসেন না আল্লা, অবিশ্বাসী ও দুর্বলেরে,
‘শেরে-খোদা’ সেই হয়, যে পেয়েছে অটল বিশ্বাসেরে!
ধৈর্য ও বিশ্বাস হারায়, সে মুসলিম নয় কভু,
বিশ্বে কারেও করে নাকো ভয় আল্লাহ্ যার প্রভু!
নিন্দাবাদের মাঝে ‘আল্লাহ্ জিন্দাবাদ’-এর ধ্বনি
বীর শুধু শোনে, কোনো নিন্দায় কোনো ভয় নাহি গণি।
আল্লা পরম সত্য, ভয় সে ভ্রান্তির কারসাজি,
প্রচণ্ড হয় তত পৌরুষ, যত দেখে দাগাবাজি!
ভুলে কি গিয়াছ অসম সাহস নির্ভীক আরবির?
পারস্য আর রোমক সম্রাটের কাটিয়াছে শির!
কতজন ছিল সেনা তাহাদের? অস্ত্র্র কী ছিল হাতে?
তাদের পরম নির্ভর ছিল শুধু এক আল্লাতে।
জয় পরাজয় সমান গণিয়া করেছিল শুধু রণ,
তাদের দাপটে কেঁপে উঠেছিল পৃথিবীর প্রাঙ্গণ!
তারা দুনিয়ার বাদশাহি করেছিল ভিক্ষুক হয়ে,
তারা পরাজিত হয়নি কখনও ক্ষণিকের পরাজয়ে।
হাসিয়া মরেছে করেনি কখনও পৃষ্ঠপ্রদর্শন,
ইসলাম মানে বুঝেছিল তারা অসত্য সাথে রণ।
তারা জেনেছিল, দুনিয়ায় তারা আল্লার সৈনিক,
অর্জন করেছিল স্বাধীনতা নেয়নি মাগিয়া ভিখ!
জয়ী হতে হলে মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ হইতে হয়,
শত্রু-সৈন্য দেখে কাঁপে ভয়ে, সে তো সেনাপতি নয়!
শত্রু-সৈন্য যত দেখে তত রণ-তৃষ্ণা তার বাড়ে,
দাবানল সম তেজ জ্বলে ওঠে শিরায় শিরায় হাড়ে!
তলোয়ার তার তত তেজ ফোটে যত সে আঘাত খায়,
তত বধ করে শত্রুর সেনা, রসদ যত ফুরায়।
নিরাশ হোয়ো না! নিরাশা ও অদৃষ্টবাদীরা যত
যুদ্ধ না করে হয়ে আছে কেউ আহত ও কেউ হত!
যে মাথা নোয়ায়ে সিজদা করেছ এক প্রভু আল্লারে,
নত করিয়ো না সে মাথা কখনও কোনো ভয়ে কোনো মারে!
আল্লার নামে নিবেদিত শির নোয়ায় সাধ্য কার।
আল্লা সে শির বুকে তুলে নেন, কাটে যদি তলোয়ার!
ভীরু মানবেরে প্রবল করিতে চাহেন যে দুনিয়াতে
তাঁরেই ইমাম নেতা বলি আমি, প্রেম মোর তারই সাথে।
আড়ষ্ট নরে বলিষ্ঠ করে যাঁর কথা যাঁর কাজ,
তাঁরই তরে সেনা সংগ্রহ করি, গড়ি তাঁরই শির-তাজ!
গরিবের ঈদ আসিবে বলিয়া যে আত্মা রোজা রাখে,
পরমাত্মার পরমাত্মীয় বলে আমি মানি তাঁকে।
অকল্যাণের দূত যারা, যারা মানুষের দুশমন,
তাদের সঙ্গে যে দুরন্তেরা করিবে ভীষণ রণ –
মোর আল্লার আদেশে তাদেরে ডাক দিই জমায়েতে,
অচেতন ছিল যারা, তারা আসিতেছে সে তীর্থপথে।
আমি তকবীর-ধ্বনি করি শুধু কর্ম-বধির কানে,
সত্যের যারা সৈনিক তারা জমা হবে ময়দানে!
অনাগত ‘নবযুগ’-সূর্যের তুর্য বাজায়ে যাই,
মৃত্যু বা কারাগারের কোনো ভয় দ্বিধা নাই।
একা ‘নবযুগ’-মিনারে দাঁড়ায়ে কাঁদিয়া সকলে ডাকি,
দরমার হাঁস না আসে, আসিবে মুক্তপক্ষ পাখি।
এ পথে ভীষণ বাজপাখি আর নিঠুর ব্যাধের ভীতি,
আলোক-পিয়াসি পাখিরা তবুও আসিছে গাহিয়া গীতি।
মৃত্যু-ভয়াক্রান্ত আজিকে বাংলার নরনারী,
তাদের অভয় দিতেই আমরা ধরিয়াছি তরবারি।
আমরা শুনেছি ভীত আত্মার সকরুণ ফরয়্যাদ,
আমরা তাদেরে রক্ষা করিব, এ যে আল্লার সাধ!
আমরা হুকুম-বর্দার তাঁর পাইয়াছি ফরমান,
ভীত নর-নারী তরে অকাতরে দানিব মোদের প্রাণ!
বাজাই বিষাণ উড়াই নিশান ঈশান-কোণের মেঘে,
প্রেম-বৃষ্টি ও বজ্র-প্রহারে আত্মা উঠিবে জেগে!
রাজনীতি করে তৈরি মোদের কুচকাওয়াজের পথ,
এই পথ দিয়ে আসিবে দেখিয়ো আবার বিজয়-রথ।
প্রবল হওয়ার সাধ ও সাধনা যাহাদের প্রাণে আছে,
তাদেরই দুয়ারে হানা দিই আমি, আসি তাহাদেরই কাছে।
সঙ্ঘবদ্ধ হতেছে তাহারা বঙ্গভূমির কোলে,
আমি দেখিয়াছি পূর্ণচন্দ্র তাদেরই ঊর্ধ্বে দোলে!