শহিদি-ঈদ
১
শহিদের ঈদ এসেছে আজ
শিরোপরি খুন-লোহিত তাজ,
আল্লার রাহে চাহে সে ভিখ:
জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে
আল্লার রাহে তাহারে দে,
চাহি না ফাঁকির মণিমানিক।
২
চাহি নাকো গাভি দুম্বা উট,
কতটুকু দান? ও দান ঝুট।
চাই কোরবানি, চাই না দান।
রাখিতে ইজ্জত ইসলামের
শির চাই তোর,তোর ছেলের,
দেবে কি? কে আছ মুসলমান?
৩
ওরে ফাঁকিবাজ, ফেরেব-বাজ,
আপনারে আর দিসনে লাজ—
গরু ঘুষ দিয়ে চাস সওয়াব?
যদিই রে তুই গরুর সাথ
পার হয়ে যাস পুলসেরাত,
কি দিবি মোহাম্মদে জওয়াব!
৪
শুধাবেন যবে— ওরে কাফের,
কি করেছ তুমি ইসলামের?
ইসলামে দিয়ে জাহান্নম
আপনি এসেছ বেহেশত ‘পর—
পুণ্য-পিশাচ! স্বার্থপর!
দেখাসনে মুখ, লাগে শরম!
৫
গরুরে করিলে সেরাত পার,
সন্তানে দিলে নরক-নার!
মায়া-দোষে ছেলে গেল দোজখ।
কোরবানি দিলি গরু-ছাগল,
তাদেরই জীবন হলো সফল
পেয়েছে তাহারা বেহেশ্ত্-লোক!
৬
শুধু আপনারে বাঁচায় যে,
মুসলিম নহে, ভণ্ড সে!
ইসলাম বলে—বাঁচো সবাই!
দাও কোরবানি জান্ ও মাল,
বেহেশত্ তোমার করো হালাল।
স্বার্থপরের বেহেশ্ত্ নাই।
৭
ইসলামে তুমি দিয়ে কবর
মুসলিম বলে করো ফখর!
মোনাফেক তুমি সেরা বে-দীন!
ইসলামে যারা করে জবেহ্,
তুমি তাহাদেরি হও তাঁবে।
তুমি জুতো-বওয়া তারি অধীন।
৮
নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং,
ইয়া উয়া পরে সেজেছ সং,
ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম!
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা করো জড়ো
ত্যাগের বেলাতে জড়সড়!
তোর নামাজের কি আছে দাম?
৯
খেয়ে খেয়ে গোশ্ত্ রুটি তো খুব
হয়েছ খোদার খাসি বেকুব,
নিজেদের দাও কোরবানি।
বেঁচে যাবে তুমি বাঁচিবে দ্বীন,
দাস ইসলাম হবে স্বাধীন,
গাহিছে কামাল এই গানই!
১০
বাঁচায়ে আপনা ছেলে-মেয়ে
জান্নাত পানে আছ চেয়ে
ভাবিছ সেরাত হবেই পার।
কেননা, দিয়েছ সাতজনের
তরে এক গরু! আর কি, ঢের!
সাতটি টাকায় গোনাহ্ কাবার!
১১
জানো না কি তুমি, রে বেঈমান!
আল্লা সর্বশক্তিমান
দেখিছেন তোর সব কিছু?
জাব্বা-জোব্বা দিয়ে ধোঁকা
দিবি আল্লারে, ওরে বোকা!
কেয়ামতে হবে মাথা নিচু!
১২
ডুবে ইসলাম, আসে আঁধার!
ইব্রাহিমের মতো আবার
কোরবানি দাও প্রেয় বিভব!
‘জবিহুল্লাহ্’ ছেলেরা হোক,
যাক সব কিছু—সত্য রোক!
মা হাজেরা হোক মায়েরা সব।
১৩
খা’বে দেখেছিলেন ইবরাহিম—
‘দাও কোরবানি মহামহিম!’
তোরা যে দেখিস দিবালোকে
কি যে দুর্গতি ইসলামের!
পরীক্ষা নেন খোদা তোদের
হবিবের সাথে বাজি রেখে!
১৪
যত দিন তোরা নিজেরা মেষ,
ভীরু দুর্বল, অধীন দেশ—
আল্লার রাহে ততটা দিন
দিও নাকো পশু কোরবানি,
বিফল হবে রে সবখানি!
(তুই) পশু চেয়ে যে রে অধম হীন!
১৫
মনের পশুরে করো জবাই,
পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।
কশাই-এর আবার কোরবানি!—
আমাদের নয়, তাদের ঈদ,
বীর-সুত যারা হলো শহীদ,
অমর যাদের বীরবাণী।
১৬
পশু কোরবানি দিস তখন
আজাদ-মুক্ত হবি যখন
জুলম-মুক্ত হবে রে দ্বীন।—
কোরবানির আজ এই যে খুন
শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন,
জালিমের যেন রাখে না চিন্॥
আমিন্ রাব্বিল্ আলমিন!
আমিন রাব্বিল্ আলমিন!!
সুপার (জেলের) বন্দনা
সুপার (জেলের) বন্দনা*
* হুগলি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন জেলের সকল প্রকার জুলুম আমাদের উপর দিয়ে পরখ করে নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় জেলের মূর্তিমান ‘জুলুম’ বড়-কর্তাকে দেখে এই গেয়ে আমরা অভিনন্দন জানাতাম।
তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে।
আমার এ গান তোমারি ধ্যান, তুমি ধন্য ধন্য হে॥
রেখেছে সান্ত্রী পাহারা দোরে
আঁধার-কক্ষে জামাই-আদরে
বেঁধেছ শিকল-প্রণয়-ডোরে।
তুমি ধন্য ধন্য হে॥
আ-কাঁড়া চালের অন্ন-লবণ
করেছে আমার রসনা-লোভন,
বুড়ো ডাটা-ঘাঁটা লাপসি শোভন,
তুমি ধন্য ধন্য হে॥
ধরো ধরো খুড়ো চপেটা মুষ্টি,
খেয়ে গয়া পাবে সোজা স-গুষ্টি,
ওল-ছোলা দেহ ধবল-কুষ্টি
তুমি ধন্য ধন্য হে॥
০০ গ্রন্থ পরিচিতি
বাংলা একাডেমী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)-এর পাঠানুসারে নিচের গ্রন্থপরিচয় তুলে ধরা হল।
‘ভাঙার গান’ ১৩৩১ শ্রাবণে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থখানি বাজেয়াফত করেন।
‘ভাঙার গান’ শীর্ষক গানটি সম্বন্ধে জনাব মুজ্জফর আহমদ লিখিয়াছেন :
“আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রীকুমাররঞ্জন দাশ ‘বাঙ্গলার কথার জন্যে একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে।… অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক’রে দিল। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।…নজরুল ‘ভাঙার গান’ লিখেছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক তারিখে। ‘ভাঙার গান’ বাঙ্গালার কথা’য় ছাপা হয়েছিল।”
—[কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা]
‘জাগরণী’ শীর্ষক কোরাস গানটি সম্পর্কে জনাব আফতাব-উল ইসলাম লিখিয়াছেন :
“১৯২১ সনে শ্রীযুত ধীরেন সেন (কাজীর এবং আমাদের সকলের ‘রাঙা দা’) তখন কুমিল্লা জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কাজী নজরুল কান্দিরপাড় তাঁরই বাড়ীতে থাকেন। প্রিন্স্ অব ওয়েল্সের ভারত-ভ্রমণ উপলক্ষে কংগ্রেস-ঘোষিত হরতাল-পালনের জন্য (২১শে নভেম্বর) একটি গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ নিয়েই প্রথম তাঁর সাথে দেখা করি ‘রাঙা দা’র বাড়ীতে। তিনি তা তো দিলেনই, অধিকন্তু কাঁধে হারমোনিয়াম বেঁধে মিছিলের সঙ্গে তিনি নিজেও গাইলেন :
ভিক্ষা দাও। ভিক্ষা দাও
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,
সন্তান দ্বারে উপবাসী,
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও।”
—[গুলিস্তাঁ, নজরুল-সংখ্যা]
‘মোহান্তের মোহ—অন্তের গান’ সম্বন্ধে ডক্টর সুশীলকুমার গুপ্ত বলেন :
“অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হবার পর তারেকশ্বরের দুর্নীতিপরায়ণ অসচ্চরিত্র ধর্মব্যবসায়ী মোহান্তকে তাড়াবার নিমিত্ত একটি আন্দোলন উপস্থিত হয়। নজরুল এই সময় ‘মোহান্তের মোহঅন্তের গান’ লিখে এই আন্দোলনকে সমর্থন ও শক্তিশালী করেন।”
—[নজরুল-চরিত-মানস, ১৫৭ পৃষ্ঠা
‘আশু-প্রয়াণ-গীতি; ১৩৩১ আষাঢ়ে ৩য় বর্ষের ৫ম সংখ্যক ‘বঙ্গবাণী’তে বাহির হইয়াছিল।
‘দুঃশাসনের রক্তপান’ ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১০ই কার্তিক শুক্রবার ১ম বর্ষের ১৭শ সংখ্যক ‘ধূমকেতু’তে ‘দুঃশাসনের রক্ত’ শিরোনামে প্রকাশিত হইয়াছিল।
‘শহিদী ঈদ’ সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’তে ছাপা হইয়াছিল।
পুনশ্চ
ভাঙার গান প্রকাশিত হয় ১৩৩১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণে (আগষ্ট ১৯২৪)। ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ব্রিটিশ সরকার কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেননি। ভাঙার গানের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পায় ১৯৪৯এ। প্রকাশ : সুরেন দত্ত, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলিকাতা-১২। পৃ ৪+৩৬; দাম এক টাকা। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় রবার স্ট্যাম্পের লেখা : “সম্পূর্ণ লভ্যাংশ কবির সাহায্যে দেওয়া হইবে।” বর্তমান গ্রন্থে সংস্করণের পাঠ ও ক্রম অনুসৃত হয়েছে।