- বইয়ের নামঃ ভাঙার গান
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ নজরুল ইন্সটিটিউট
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আশু-প্রয়াণ গীতি
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
বাংলার ঋষি বাংলার জ্ঞান বঙ্গবাণীর শ্বেতকমল,
শ্যাম বাংলার বিদ্যা-গঙ্গা অবিদ্যা-নাশী তীর্থ-জল!
মহামহিমার বিরাট পুরুষ শক্তি-ইন্দ্র তেজ-তপন—
রক্ত-উদয় হেরিতে সহসা হেরিনু সে-রবি মেঘ-মগন।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
মদ-গর্বীর গর্ব-খর্ব বল-দর্পীর দর্প-নাশ
শ্বেত-ভিতুদের শ্যাম বরাভয় রক্তাসুরের কৃষ্ণ ত্রাস।
নব ভারতের নব আশা-রবি প্রাচী’র উদার অভ্যুদয়
হেরিতে হেরিতে হেরিনু সহসা বিদায়-গোধূলি গগনময়।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
পড়িল ধসিয়া গৌরীশঙ্কর হিমালয়-শির স্বর্গচূড়,
গিরি কাঞ্চন-জঙ্ঘা গিরিল—বাংলার যবে দিন-দুপুর।
শিশুক-হাঙর শোষিছে রক্ত, মৃত্যু শোষিছে সাগর-প্রাণ—
পরাধীনা মা’র স্বাধীন সুতের মেদ-ধূমে কালো দেশ-শ্মশান।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
অরাজক মারি মড়া-কান্নায় দেশ-জননীর বদ্ধ শ্বাস,
হে দেব-আত্মা! স্বর্গ হইতে দাও কল্যাণ, দাও আভাস,
কেমন করিয়া মৃত্যু মথিয়া মৃত্যুঞ্জয় হয় মানব;
শব হয়ে গেছ, শিব হয়ে এস দেবকী-কারার নীল কেশব।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
জাগরণী
কোরাস্:—
ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,
সন্তান দ্বারে উপবাসী,
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!
জাগো গো, জাগো গো,
তন্দ্রা-অলস জাগো গো,
জাগো রে! জাগো রে!
১
মুক্ত করিতে বন্দিনী মা’য়
কোটি বীরসুত ঐ হেরো ধায়
মৃত্যু-তোরণ-দ্বার-পানে—
কার টানে?
দ্বার খোলো দ্বার খোলো!
একবার ভুলে ফিরিয়া চাও।
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
২
জননী আমার ফিরিয়া চাও!
ভাইরা আমার ফিরিয়া চাও!
চাই মানবতা, তাই দ্বারে
কর হানি মা গো বারেবারে—
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!
পুরুষ-সিংহ জাগো রে!
সত্যমানব জাগো রে।
বাধা-বন্ধন-ভয়-হারা হও
সত্য-মুক্তি-মন্ত্র গাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৩
লক্ষ্য যাদের উৎপীড়ন আর অত্যাচার,
নর-নারায়ণে হানে পদাঘাত
জেনেছে সত্য-হত্যা সার।
অত্যাচার! অত্যাচার!!
ত্রিশ কোটি নর-আত্মার যারা অপমান হেলা
করেছে রে
শৃঙ্খল গলে দিয়েছে মা’র—
সেই আজ ভগবান তোমার!
অত্যাচার! অত্যাচার!!
ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-নাই কি লাজ—
নাই কি আত্মসম্মান ওরে নাই জাগ্রত
ভগবান কি রে
আমাদেরো এই বক্ষোমাঝ?
অপমান বড় অপমান ভাই
মিথ্যার যদি মহিমা গাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৪
আল্লায় ওরে হকতা’লায়
পায়ে ঠেলে যারা অবহেলায়,
আজাদ-মুক্ত আত্মারে যারা শিখায়ে ভীরুতা
করেছে দাস—
সেই আজ ভগবান তোমার!
সেই আজ ভগবান তোমার!
সর্বনাশ! সর্বনাশ!
ছি-ছি নির্জীব পুরবাসী আর খুলো না দ্বার!
জননী গো! জননী গো!
কার তরে জ্বালো উৎসব-দীপ?
দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!!
মঙ্গল-ঘট ভেঙে ফেলো,
সব গেল মা গো সব গেল!
অন্ধকার! অন্ধকার!
ঢাকুক এ মুখ অন্ধকার!
দীপ নেবাও! দীপ নেবাও।
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৫
ছি ছি ছি ছি
এ কি দেখি
গাহিস তাদেরি বন্দনা-গান,
দাস সম নিস হাত পেতে দান!
ছি-ছি-ছি ছি-ছি-ছি
ওরে তরুণ ওরে অরুণ!
নরসুত তুমি দাসত্বের এ ঘৃণ্য চিহ্ন
মুছিয়া দাও!
ভাঙিয়া দাও,
এ-কারা এ-বেড়ি ভাঙিয়া দাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৬
পরাধীন বলে নাই তোমাদের
সত্য-তেজের নিষ্ঠা কি!
অপমান সয়ে মুখ পেতে নেবে বিষ্ঠা ছি?
মরি লাজে, লাজে মরি!
এক হাতে তোরে ‘পয়জার’ মারে
আর হাতে ক্ষীর সর ধরি!
অপমান সে যে অপমান!
জাগো জাগো ওরে হতমান!
কেটে ফেলো লোভী লুব্ধ রসনা,
আঁধারে এ হীন মুখ লুকাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৭
ঘরের বাহির হয়ো না আর,
ঝেড়ে ফেলো হীন বোঝার ভার,
কাপুরুষ হীন মানবের মুখ
ঢাকুক লজ্জা অন্ধকার।
পরিহাস ভাই পরিহাস সে যে,
পরাজিতে দিতে মনোব্যথা—যদি
জয়ী আসে রাজ-রাজ সেজে।
পরিহাস এ যে নির্দয় পরিহাস!
ওরে কোথা যাস
বল কোথা যাস ছি ছি
পরিয়া ভীরুর দীন বাস?
অপমান এত সহিবার আগে
হে ক্লীব, হে জড়, মরিয়া যাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৮
পুরুষসিংহ জাগো রে!
নির্ভীক বীর জাগো রে!
দীপ জ্বালি কেন আপনারি হীন কালো অন্তর
কালামুখ হেন হেসে দেখাও!
নির্লজ্জ রে ফিরিয়া চাও!
আপনার পানে ফিরিয়া চাও!
অন্ধকার! অন্ধকার!
নিশ্বাস আজি বন্ধ মা’র
অপমানে নির্মম লাজে,
তাই দিকে দিকে ক্রন্দন বাজে—
দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!
আপনার পানে ফিরিয়া চাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…