মুক্ত-বন্দি
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!
অগ্রে তোমার নিনাদে শঙ্খ, পশ্চাতে কাঁদে ছয়-বছর,
অম্বরে শোনো ডম্বরু বাজে–‘অগ্রসর হও, অগ্রসর!’
কারাগার ভেদি নিশ্বাস ওঠে বন্দিনী কোন্ ক্রন্দসীর,
ডান-আঁখে আজ ঝলকে অগ্নি, বাম-আঁখে ঝরে অশ্রু-নীর।
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডি-মুক্ত বন্দি-বীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!
পথতরুছায় ডাকে ‘আয় আয়’ তব জননীর আর্ত স্বর,
এ আগুন-ঘরে কাঁপিল সহসা ‘সপ্তদশ সে বৈশ্বানর’।
আগমনি তব রণদুন্দুভি বাজিছে বিজয়-ভৈরবীর,
জয় অবিনাশী উল্কা-পথিক চিরসৈনিক উচ্চশির।
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!
রুদ্ধ-প্রতাপ হে যুদ্ধবীর, আজি প্রবুদ্ধ নব বলে।
ভুলো না বন্ধু, দলেছ দানব যুগে যুগে তব পদতলে!
এ নহে বিদায়, পুন হবে দেখা অমর-সমর-সিন্ধুতীর,
এসো বীর এসো, ললাটে এঁকে দি অশ্রুতপ্ত লাল রুধির।
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দি-বীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!
মুক্তি-সেবকের গান
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!
তোদের কোন্ ভায়ের আজ বিদায়-ব্যথায় নয়ান ছল-ছল?
ওই কারা-ঘর তো নয় হারা-ঘর,
হোথাই মেলে মা-র-দেওয়া বর রে!
ওরে হোথাই মেলে বন্দিনী মা-র বুক-জড়ানো কোল!
তবে কীসের রোদনরোল?
তোরা মোছ রে আঁখির জল।
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!।
আজ কারায় যারা, তাদের তরে।
গৌরবে বুক উঠুক ভরে রে!
মোরা ওদের মতোই বেদনা ব্যথা মৃত্যু আঘাত হেসে
বরণ যেন করতে পারি মাকে ভালোবেসে।
ওরে স্বাধীনকে কে বাঁধতে পারে বল?
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!
ও ভাই প্রাণে যদি সত্য থাকে তোর
মরবে নিজেই মিথ্যা, ভীরু চোর।
মোরা কাঁদব না আজ যতই ব্যথায় পিষুক কলজে-তল।
মুক্তকে কি রুখতে পারে অসুর পশুর দল?
মোরা কাঁদব যেদিন আসবে তারা আবার ফিরে রে,
কাঙালিনি মায়ের আমার এই আঙিনা-তল।
ও ভাই মুক্তিসেবক দল॥
যুগান্তরের গান
বলো ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ
নবযুগ ওই এল ওই
এল ওই রক্ত-যুগান্তর রে।
বলো জয় সত্যের জয়
আসে ভৈরব-বরাভয়
শোনো অভয় ওই রথ-ঘর্ঘর রে॥
রে বধির! শোন পেতে কান
ওঠে ওই কোন্ মহা-গান
হাঁকছে বিষাণ ডাকছে ভগবান রে।
জগতে জাগল সাড়া
জেগে ওঠ উঠে দাঁড়া
ভাঙ পাহারা মায়ার কারা-ঘর রে।
যা আছে যাক না চুলায়
নেমে পড় পথের ধুলায়
নিশান দুলায় ওই প্রলয়ের ঝড় রে।
সে ঝড়ের ঝাপটা লেগে
ভীম আবেগে উঠনু জেগে
পাষাণ ভেঙে প্রাণ-ঝরা নির্ঝর রে।
ভুলেছি পর ও আপন
ছিঁড়েছি ঘরের বাঁধন
স্বদেশ স্বজন স্বদেশ মোদের ঘর রে।
যারা ভাই বদ্ধ কুয়ায়
খেয়ে মার জীবন গোঁয়ায়
তাদের শোনাই প্রাণ-জাগা মন্তর রে।
ঝড়ের ঝাঁটার ঝাণ্ডার নেড়ে
মাভৈঃ-বাণীর ডঙ্কা মেরে
শঙ্কা ছেড়ে হাঁক প্রলয়ংকর রে।
তোদের ওই চরণ-চাপে
যেন ভাই মরণ কাঁপে,
মিথ্যা পাপের কণ্ঠ চেপে ধর রে।
শোনা তোর বুক-ভরা গান,
জাগা ফের দেশ-জোড়া প্রাণ,
যে বলিদান প্রাণ ও আত্মপর রে॥
মোরা ভাই বাউল চারণ,
মানি না শাসন বারণ
জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।
দেখে ওই ভয়ের ফাঁসি
হাসি জোর জয়ের হাসি,
অ-বিনাশী নাইকো মোদের ডর রে!
গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই,
মরা-প্রাণ উটকে দেখাই
ছাই-চাপা ভাই অগ্নি ভয়ংকর রে॥
খুঁড়ব কবর তুড়ব শ্মশান
মড়ার হাড়ে নাচাব প্রাণ
আনব বিধান নিদান কালের বর রে।
শুধু এই ভরসা রাখিস
মরিসনি ভিরমি গেছিস
ওই শুনেছিস ভারত-বিধির স্বর রে।
ধর হাত ওঠ রে আবার
দুর্যোগের রাত্রি কাবার,
ওই হাসে মা-র মূর্তি মনোহর রে॥
শিকল-পরার গান
এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥
তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দি হতে নয়,
ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।
এই বাঁধন পরেই বাঁধন-ভয়কে করব মোরা জয়,
এই শিকলবাঁধা পা নয় এ শিকলভাঙা কল॥
তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্ব গ্রাস,
আর ত্রাস দেখিয়েই করবে ভাবছ বিধির শক্তি হ্রাস।
সেই ভয়-দেখানো ভূতের মোরা করব সর্বনাশ,
এবার আনব মাভৈঃ-বিজয়মন্ত্র বলহীনের বল॥
তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়;
সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়।
মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়,
মোরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল॥
ওরে ক্রন্দন নয়, বন্ধন এই শিকল-ঝঞ্ঝনা,
এ যে মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা।
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্ছনা,
মোদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্রানল॥
সত্য-মন্ত্র
পুথির বিধান যাক পুড়ে তোর,
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
(এই) খোদার উপর খোদকারি তোর
মানবে না আর সর্বলোক!
মানবে না আর সর্বলোক!!
(তোর) ঘরের প্রদীপ নিবেই যদি,
নিবুক না রে, কীসের ভয়?
আঁধারকে তোর কীসের ভয়?
(ওই) ভুবন জুড়ে জ্বলছে আলো,
ভবনটাই সে সত্য নয়।
ঘরটাই তোর সত্য নয়।
(ওই) বাইরে জ্বলছে চন্দ্র সূর্য
নিত্যকালের তাঁর আলোক।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
লোক-সমাজের শাসক রাজা,
(আর) রাজার শাসক মালিক যেই,
বিরাট যাঁহার সৃষ্টি এই,
তাঁর শাসনকে অগ্রে মান
তার বড়ো আর শাস্ত্র নেই,
তার বড়ো আর সত্য নেই!
সেই খোদা খোদ সহায় তোর,
ভয় কী? নিখিল মন্দ ক’ক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
বিধির বিধি মানতে গিয়ে
নিষেধ যদি দেয় আগল
বিশ্ব যদি কয় পাগল,
আছেন সত্য মাথার পর, –
বেপরোয়া তুই সত্য বল।
বুক ঠুকে তুই সত্য বল!
(তখন) তোর পথেরই মশাল হয়ে
জ্বলবে বিধির রুদ্র-চোখ!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
মনুর শাস্ত্র রাজার অস্ত্র
আজ আছে কাল নাইকো আশ,
কাল তারে কাল করবে গ্রাস।
হাতের খেলা সৃষ্টি যাঁর
তাঁর শুধু ভাই নাই বিনাশ,
স্রষ্টার সেই নাই বিনাশ!
সেই বিধাতায় মাথায় করে
বিপুল গর্বে বক্ষ ঠোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
সত্যতে নাই ধানাই পানাই
সত্য যাহা সহজ তাই,
সত্য যাহা সহজ তাই;
আপনি তাতে বিশ্বাস আসে,
আপনি তাতে শক্তি পায়
সত্যের জোর-জুলুম নাই
সেই সে মহান সত্যকে মান –
রইবে না আর দুঃখ-শোক।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
নানান মুনির নানান মত যে,
মানবি বল সে কার শাসন?
কয় জনার বা রাখবি মন?
এক সমাজকে মানলে করবে
আরেক সমাজ নির্বাসন,
চারিদিকে শৃঙ্খল বাঁধন!
সকল পথের লক্ষ্য যিনি
চোখ পুরে নে তাঁর আলোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
সত্য যদি হয় ধ্রুব তোর,
কর্মে যদি না রয় ছল,
ধর্ম-দুগ্ধে না রয় জল,
সত্যের জয় হবেই হবে,
আজ নয় কাল মিলবে ফল,
আজ নয় কাল মিলবে ফল।
(আর)প্রাণের ভিতর পাপ যদি রয়
চুষবে রক্ত মিথ্যা-জোঁক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
জাতের চেয়ে মানুষ সত্য,
অধিক সত্য প্রাণের টান,
প্রাণ-ঘরে সব এক সমান।
বিশ্বপিতার সিংহ-আসন
প্রাণবেদিতেই অধিষ্ঠান,
আত্মার আসন তাইতো প্রাণ।
জাত-সমাজের নাই সেথা ঠাঁই
জগন্নাথের সাম্য-লোক
জগন্নাথের তীর্থ-লোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
চিনেছিলেন খ্রিস্ট বুদ্ধ
কৃষ্ণ মোহম্মদ ও রাম –
মানুষ কী আর কী তার দাম।
(তাই) মানুষ যাদের করত ঘৃণা,
তাদের বুকে দিলেন স্থান
গান্ধি আবার গান সে গান।
(তোরা) মানব-শত্রু তোদেরই হায়
ফুটল না সেই জ্ঞানের চোখ।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!