চরকার গান
ঘোর –
ঘোর রে ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর
ওই স্বরাজ-রথের আগমনি শুনি চাকার শব্দে তোর॥
১
তোর ঘোরার শব্দে ভাই
সদাই শুনতে যেন পাই
ওই খুলল স্বরাজ-সিংহদুয়ার, আর বিলম্ব নাই।
ঘুরে আসল ভারত-ভাগ্য-রবি, কাটল দুখের রাত্রি ঘোর॥
২
ঘর ঘর তুই ঘোর রে জোরে
ঘর্ঘরঘর ঘূর্ণিতে তোর
ঘুচুক ঘুমের ঘোর
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
তোর ঘুর-চাকাতে বল-দর্পীর তোপ কামানের টুটুক জোর॥
৩
তুই ভারত-বিধির দান,
এই কাঙাল দেশের প্রাণ,
আবার ঘরের লক্ষ্মী আসবে ঘরে শুনে তোর ওই গান।
আর লুটতে নারবে সিন্ধু-ডাকাত বৎসরে পঁয়ষট্টি ক্রোড়॥
৪
হিন্দু-মুসলিম দুই সোদর,
তাদের মিলন-সূত্র-ডোর রে
রচলি চক্রে তোর,
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
আবার তোর মহিমায় বুঝল দু-ভাই মধুর কেমন মায়ের ক্রোড়॥
৫
ভারত বস্ত্রহীন যখন
কেঁদে ডাকল – নারায়ণ!
তুমি লজ্জা-হারী করলে এসে লজ্জা নিবারণ,
তাই দেশ-দ্রৌপদীর বস্ত্র হরতে পারল না দুঃশাসন-চোর॥
৬
এই সুদর্শন-চক্রে তোর
অত্যাচারীর টুটল জোর রে ছুটল সব গুমোর
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
তুই জোর জুলুমের দশম গ্রহ, বিষ্ণু-চক্র ভীম কঠোর॥
৭
হয়ে অন্নবস্ত্রহীন
আর ধর্মে কর্মে ক্ষীণ
দেশ ডুবছিল ঘোর পাপের ভারে যখন দিনকে দিন,
তখন আনলে অন্ন পুণ্য-সুধা, খুললে স্বর্গ মুক্তি-দোর॥
৮
শাসতে জুলুম নাশতে জোর
খদ্দর-বাস বর্ম তোর রে অস্ত্র সত্যডোর,
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
মোরা ঘুমিয়ে ছিলাম, জেগে দেখি চলছে চরকা, রাত্রি ভোর॥
৯
তুই সাত রাজারই ধন,
দেশ- মা-র পরশ-রতন,
তোর স্পর্শে মেলে স্বর্গ অর্থ কাম মোক্ষ ধন।
তুই মায়ের আশিস, মাথার মানিক, চোখ ছেপে বয় অশ্রু-লোর॥
জাগৃহি
জাগৃহি
[তোটক ছন্দ]
‘হর হর হর শংকর হর হর ব্যোম’ –
একী ঘন রণ-রোল ছায়া চরাচর ব্যোম!
হানে ক্ষিপ্ত মহেশ্বর রুদ্র পিনাক,
ঘন প্রণব-নিনাদ হাঁকে ভৈরব-হাঁক
ধু ধু দাউ দাউ জ্বলে কোটি নর-মেধ-যাগ,
হানে কাল-বিষ বিশ্বে রে মহাকাল-নাগ!
আজ ধূর্জটি ব্যোমকেশ নৃত্য-পাগল,
ওই ভাঙল আগল ওরে ভাঙল আগল!
বোলে অম্বুদ-ডম্বুর কম্বু বিষাণ,
নাচে থই-তাতা থই-তাতা পাগলা ঈশান!
দোলে হিন্দোলে ভীম-তালে সৃষ্টি ধাতার,
বুকে বিশ্বপাতার বহে রক্ত-পাথার!
ঘোর মার’ দৈত্য, অসুর,
প্রেত, রক্ত-পিশাচ, রণ-দুর্মদ সুর।
করে ক্রন্দসী-ক্রন্দন অম্বর রোধ –
ত্রাহি ত্রাহি মহেশ হে সম্বরো ক্রোধ!
সুত মৃত্যু-কাতর, হাহা অট্টহাসি
হাসে চণ্ডী চামুণ্ডা মা সর্বনাশী।
কাল- বৈশাখী ঝঞ্ঝারে সঙ্গে করি –
রণ- উন্মাদিনী নাচে রঙ্গে মরি!
উর- হার দোলে নরমুণ্ড-মালা,
করে খড়্গ ভয়াল, আঁখে বহ্নি-জ্বালা!
নিয়া রক্তপানের কী অগস্ত্য-তৃষা
নাচে ছিন্ন সে মস্তা মা, নাইকো দিশা!
‘দে রে রক্ত দে রক্ত দে’ রণে ক্রন্দন,
বুঝি থেমে যায় সৃষ্টির হৃৎ-স্পন্দন!
জ্বলে বৈশ্বানরের ধু ধু লক্ষ শিখা,
আজ বিষ্ণু-ভালে লাল রক্ত-টিকা!
শুধু অগ্নি-শিখা ধু ধু অগ্নি-শিখা,
শোভে করুণার ভালে লাল রক্ত-টিকা!
রণ- শ্রান্ত অসুর-সুর-যোদ্ধৃ-সেনা,
শুধু রক্ত-পাথার, শুধু রক্ত-ফেনা!
একী বিশ্ব-বিধ্বংস নৃশংস খেলা,
কিছু নাই কিছু নাই প্রেত-পিশাচে মেলা।
আজ ঘরে ঘরে জ্বলে ধু ধু শ্মশান মশান –
হোক রোষ অবসান, ত্রাহি ত্রাহি ভগবান!
আজি বন্ধ সবার পূতি-গন্ধে নিশাস,
বিষে বিশ্ব-নিসাড়, বহে জোর নাভিশ্বাস!
দেহো ক্ষান্ত রণে, ফেলো রঙ্গিণী বেশ,
খোলো রক্তাম্বর মাতা সম্বরো কেশ!
এ তো নয় মাতা রক্তোন্মত্তা ভীমা!
আজ জাগৃহি মা, আজ জাগৃহি মা।
তব চরণাবলুণ্ঠিত মহিষ-অসুর,
হল ধ্বংস অসুর, লীন শক্তি পশুর।
তবে সম্বরো রণ, হোক ক্ষান্ত রোদন–
হোক সত্য-বোধন আজ মুক্তি-বোধন!
এসো শুদ্ধা মাতা এই কাল-শ্মশানে
আজ প্রলয়-শেষে এই রণাবসানে!
জাগো জাগো মানব-মাতা দেবী নারী!
আনো হৈম ঝারি, আনো শান্তি-বারি!
এসো কৈলাস হতে মা গো মানস-সরে,
নীল উৎপল-দলে রাঙা আঁচল-ভরে।
এসো কন্যা উমা, এসো গৌরী রূপে,–
বাজো শঙ্খ শুভ, জ্বালো গন্ধ ধূপে!
আজ মুক্ত-বেণি মেয়ে একাকী চলে,
ওই শেফালি-তলে হেরো শেফালি-তলে।
ওড়ে এলোমেলো অঞ্চল আশ্বিন-বায়,
হানে চঞ্চল নীল চাওয়া আকাশের গায়!
ঘোষে হিমালয় তার মহা হর্ষ-বাণী, –
এল হৈমবতী, এল গৌরী রানি।
বাজো মঙ্গল শাঁখ, হোক শুভ-আরতি,
এল লক্ষ্মী-কমলা, এল বাণী-ভারতী।
এল সুন্দর সৈনিক সুর কার্তিক,
এল সিদ্ধি-দাতা, হেরো হাসে চারিদিক!
ভরা ফুল-খুকি ফুল-হাসি শিউলির তল,
আজ চোখে আসে জল, শুধু চোখে আসে জল!
নিয়া মাতৃ-হিয়া নিয়া কল্যাণী-রূপ
এল শক্তি স্বাহা, বাজো শাঁখ, জ্বালো ধূপ!
ভাঁজো মোহিনী সানাই, বাজো আগমনি-সুর,
বড়ো কেঁদে ওঠে আজ হিয়া মাতৃ-বিধুর।
ওঠে কণ্ঠ ছাপি বাণী সত্য পরম –
বন্- দে মাতরম্। বন্দে মাতরম্!
জাতের বজ্জাতি
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া॥
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাই তো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশো-খান!
এখন দেখিস ভারত-জোড়া
পচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া॥
জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল,
তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।
যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত,
আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো,
যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া॥
দিন-কানা সব দেখতে পাসনে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে
কেমন করে পিষছে তোদের পিশাচ জাতের জাঁতাকলে।
(তোরা) জাতের চাপে মারলি জাতি,
সূর্য ত্যজি নিলি বাতি,
তোদের জাত-ভগীরথ এনেছে জল জাত-বিজাতের জুতো-ধোয়া॥
মনু ঋষি অণুসমান বিপুল বিশ্বে যে বিধির,
বুঝলি না সেই বিধির বিধি, মনুর পায়েই নোয়াস শির।
ওরে মূর্খ ওরে জড়,
শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়ো,
(তোরা) চিনলিনে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥
সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এই বিশ্ব মায়ের বিশ্ব-ঘর,
মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম-পর।
(তোরা) সৃষ্টিকে তাঁর ঘৃণা করে
স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে
ভস্মে ঘৃত ঢালা সে যে বাছুর মেরে গাভি দোওয়া॥
বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই,
তোদের কেন জাতের বালাই?
(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া॥
ভগবানের ফৌজদারি-কোর্ট নাই সেখানে জাতবিচার,
(তোর) পইতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার।
জাত সে শিকেয় তোলা রবে,
কর্ম নিয়ে বিচার হবে,
(তা-পর) বামুন চাঁড়াল এক গোয়ালে, নরক কিংবা স্বর্গে থোয়া॥
(এই) আচার-বিচার বড়ো করে প্রাণ দেবতায় ক্ষুদ্র ভাবা,
(বাবা) এই পাপেই আজ উঠতে বসতে সিঙ্গি-মামার খাচ্ছ থাবা।
তাই নাইকো অন্ন নাইকো বস্ত্র,
নাইকো সম্মান, নাইকো অস্ত্র,
(এই) জাত-জুয়াড়ির ভাগ্যে আছে আরও অশেষ দুঃখ-সওয়া॥