উদ্বোধন
বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও
ভীম বজ্র-বিষাণে
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!
অগ্নি-তূর্য কাঁপাক সূর্য
বাজুক রুদ্রতালে ভৈরব –
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!
নট-মল্লার দীপক-রাগে
জ্বলুক তাড়িত-বহ্নি আগে
ভেরির রন্ধ্রে মেঘমন্দ্রে জাগাও বাণী জাগ্রত নব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!
দাসত্বের এ ঘৃণ্য তৃপ্তি
ভিক্ষুকের এ লজ্জা-বৃত্তি,
বিনাশো জাতির দারুণ এ লাজ, দাও তেজ দাও মুক্তি-গরব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!
খুন দাও নিশ্চল এ হস্তে
শক্তি-বজ্র দাও নিরস্ত্রে;
শীর্ষ তুলিয়া বিশ্বে মোদেরও দাঁড়াবার পুন দাও গৌরব –
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!
ঘুচাতে ভীরুর নীচতা দৈন্য
প্রেরো হে তোমার ন্যায়ের সৈন্য
শৃঙ্খলিতের টুটাতে বাঁধন আনো আঘাত প্রচণ্ড আহব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!
নির্বীর্য এ তেজঃ-সূর্যে
দীপ্ত করো হে বহ্নি-বীর্যে,
শৌর্য ধৈর্য মহাপ্রাণ দাও, দাও স্বাধীনতা সত্য বিভব!
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!
উৎসর্গ (বিষের বাঁশি)
বাংলার অগ্নি-নাগিনি মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কুল-গৌরব
আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা
মিসেস এম. রহমান সাহেবার
পবিত্র চরণারবিন্দে –
এমনই প্লাবন-দুন্দুভি-বাজা ব্যাকুল শ্রাবণ মাস –
সর্বনাশের ঝান্ডা দুলায়ে বিদ্রোহ-রাঙা-বাস
ছুটিতে আছিনু মাভৈঃ-মন্ত্র ঘোষি অভয়কর,
রণ-বিপ্লব-রক্ত-অশ্ব কশাঘাত-জর্জর!
সহসা থমকি দাঁড়ানু আমার সর্পিল-পথ-বাঁকে,
ওগো নাগমাতা, বিষ-জর্জর তব গরজন-ডাকে!
কোথা সে অন্ধ অতল পাতাল-বন্ধ গুহার তলে,
নির্জিত তব ফণা-নিঙড়ানো গরলের ধারা গলে;
পাতাল-প্রাচীর চিরিয়া তোমার জ্বালা-ক্রন্দন-চূর
আলোর জগতে এসে বাজে যেন বিষ-মদ-চিক্কুর!
আঁধার-পীড়িত রোষ-দোদুল সে তব ফণা-ছায়া-দোল
হানিছে গৃহীরে অশুভ শঙ্কা, কাঁপে ভয়ে সুখ-কোল।
ধূমকেতু-ধ্বজ বিপ্লব-রথ সম্ভ্রমে অচপল,
নোয়াইল শির শ্রদ্ধা-প্রণত রথের অশ্বদল!
ধূমকেতু-ধূম-গহ্বরে যত সাগ্নিক শিশু-ফণী
উল্লাসে ‘জয় জয় নাগমাতা’ হাঁকিল জয়-ধ্বনি!
বন্দিল, উর নাগ-নন্দিনী ভেদিয়া পাতাল-তল!
দুলিল গগনে অশুভ-অগ্নি পতাকা জ্বালা-উজল!
তারপর মা গো কোথা গেলে তুমি, আমি কোথা হনু হারা,
জাগিয়া দেখিনু, আমারে গ্রাসিয়া রাহু রাক্ষস-কারা!
শৃঙ্খলিতা সে জননীর ব্যথা বাজিয়া এ ক্ষীণ বুকে
অগ্নি হয়ে মা জ্বলেছিল খুন, বিষ উঠেছিল মুখে,
শৃঙ্খল-হানা অত্যাচারীর বুকে বাজপাখি সম
পড়িয়া তাহারে ছিঁড়িতে চেয়েছি হিংসা-নখরে মম, –
সে আক্রমণ ব্যর্থ কখন করেছে কারার ফাঁদ,
বন্দিনী দেশ-জননীর সাথে বেঁধেছে আমারে বাঁধ।
হাতে পায়ে কটি-গর্দানে মোর বাজে শত শৃঙ্খল,
অনাহারে তনু ক্ষুধা-বিশীর্ণ, তৃষায় মেলে না জল,
কত যুগ যেন এক অঞ্জলি পাইনিকো আলো বায়ু,
তারই মাঝে আসি রক্ষী-দানব বিদ্যুতে বেঁধে স্নায়ু –
এত যন্ত্রণা তবু সব যেন বুকে ক্ষীর হয়ে ওঠে,
শত্রুর হানা কণ্টক-ক্ষত প্রাণে ফুল হয়ে ফোটে!–
এরই মাঝে তুমি এলে নাগমাতা পাতাল-বন্ধ টুটি
অচেতন মম ক্ষত তনু পড়ে তব ফণা-তলে লুটি!
তোমার মমতা-মানিক-আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,
তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্বজননী! তোমার আঁচল পাতা
নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে; বিষ শুধু তোমা দহে
ফণা তব মা গো পীড়িত নিখিল ধরণির ভার বহে ! –
আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে,
সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে,
নহে তার তরে, – সব সন্তানে তুমি যে বেসেছ ভালো,
তোমার মানিক সকলের মুখে দেয় যে সমান আলো,
শুধু মাতা নহ, জগন্মাতার আসনে বসেছ তুমি, –
সেই গৌরবে জননী আমার, তোমার চরণ চুমি!
তোমার নাগ-শিশু
নজরুল ইসলাম
হুগলি
১৬ শ্রাবণ, ১৩৩১
কৈফিয়ত (বিষের বাঁশি)
‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খণ্ড নাম দিয়ে তাতে যেসব কবিতা ও গান দেব বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেইসব কবিতা ও গান দিয়ে এই ‘বিষের বাঁশি’ প্রকাশ করলাম। নানা কারণে ‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খণ্ড নাম বদলে ‘বিষের বাঁশি’ নামকরণ করলাম। বিশেষ কারণে কয়েকটি কবিতা ও গান বাদ দিতে বাধ্য হলাম। কারণ ‘আইন’-রূপ ‘আয়ান ঘোষ’ যতক্ষণ তার বাঁশ উঁচিয়ে আছে, ততক্ষণ বাঁশিতে তথাকথিত ‘বিদ্রোহ’-রাধার নাম না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই ঘোষের পো-র বাঁশ বাঁশির চেয়ে অনেক শক্ত। বাঁশে ও বাঁশিতে বাঁশাবাঁশি লাগলে বাঁশিরই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা, বাঁশি হচ্ছে সুরের, আর বাঁশ হচ্ছে অসুরের।
এই বাঁশি তৈরির জন্য আমার অনেক বন্ধু নিঃস্বার্থভাবে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁরা সাহায্য না করলে এ বাঁশির গান আমার মনের বেণুবনেই গুমরে মরত। এঁরা সকলেই নিঃস্বার্থ নিষ্কলুষ প্রাণ-সুন্দর আনন্দ-পুরুষ। আমার নিখরচা কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ পাওয়ার লোভে এঁরা সাহায্য করেননি। এঁরা সকলেই জানেন, ওসব বিষয়ে আমি একেবারে অমানুষ বা পাষাণ। এঁরা যা করেছেন তা স্রেফ আনন্দের প্রেরণায় ও আমায় ভালোবেসে। সুতরাং আমি ভিক্ষাপ্রাপ্ত ভিক্ষুকের মতো তাঁদের কাছে চিরচলিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁদের আনন্দকে খর্ব ও ভালোবাসাকে অস্বীকার করব না। এঁরা যদি সাহায্য হিসাবে আমায় সাহায্য করতে আসতেন তাহলে আমি এঁদের কারুর সাহায্য নিতাম না। যাঁরা সাহায্য করে মনে মনে প্রতিদানের দাবি পোষণ করে আমায় দায়ী করে রাখেন, তাঁদের সাহায্য নিয়ে আমি নিজেকে অবমানিত করতে নারাজ। এতটুকু শ্রদ্ধা আমার নিজের উপর আছে। স্রেফ তাঁদের নাম ও কে কোন মালমশলা জুগিয়েছেন তাই জানাচ্ছি – নিজেকে হালকা করার আত্মপ্রসাদের লোভে।
এ ‘বিষের বাঁশি’র বিষ জুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশমাতা, আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।
বাঁশ জুগিয়েছেন সুলেখক ঔপন্যাসিক বন্ধু সনৎকুমার সেন। এ-বাঁশকে বাঁশি করে তুলেছেন – ‘বাণী’ যন্ত্র দিয়ে ওই যন্ত্রাধিকারী বিখ্যাত স্বদেশ-সেবক আমার অগ্রজ-প্রতিম পরম শ্রদ্ধাস্পদ ললিতদা ও পাঁচুদা। তাঁদের যন্ত্রের সাহায্য না পেলে এ-বাঁশি শুধু বাঁশই রয়ে যেত। এই বাঁশি গায়ের অদ্ভুত বিচিত্র নকশাটি কেটে দিয়েছেন প্রথিত-যশা কবি-শিল্পী – আমার ঝড়ের রাতের বন্ধু – ‘কল্লোল’-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। এই সবের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছিলেন দেশের-কাজে-উৎসর্গ-প্রাণ আমার পরম শ্রদ্ধার বন্ধু মৌলবি মঈনউদ্দিন হোসেন সাহেব বি. এ. (নূর লাইব্রেরি)। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ডি. এম. লাইব্রেরির গোপালদা এই গান শোনাবার জন্য ঢোল শোহরৎ দেওয়ার ভার নিয়েছেন।
এত বন্ধুর এত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক দোষত্রুটি রয়ে গেল আমার অবকাশ-হীনতা ও অভিমন্যুর মতো সপ্তরথী-পরিবেষ্টিত ক্ষতবিক্ষত অবস্থার জন্য। যাঁরা আমায় জানেন, তাঁরা জানেন, আমার বিনা কাজের হট্টমন্দিরে অবকাশের কীরকম অভাব এবং জীবনের কতখানি শক্তি ব্যয় করতে হয় দশ দিকের দশ আক্রমণ ব্যর্থ করবার জন্য। যদি অবকাশ ও শান্তি পাই, তাহলে দ্বিতীয় সংস্করণে এর দোষত্রুটি নিরাকরণের চেষ্টা করব। ইতি –
নজরুল ইসলাম
হুগলি
১৬ শ্রাবণ, ১৩৩১