- বইয়ের নামঃ বিষের বাঁশি
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অভিশাপ
আমি বিধির বিধান ভাঙিয়াছি, আমি এমনি শক্তিমান!
মম চরণের তলে, মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান।
আদি ও অন্তহীন
আজ মনে পড়ে সেই দিন –
প্রথম যেদিন আপনার মাঝে আপনি জাগিনু আমি,
আর চিৎকার করি কাঁদিয়া উঠিল তোদের জগৎ-স্বামী।
ভয়ে কালো হয়ে গেল আলো-মুখ তার।
ফরিয়াদ করি গুমরি উঠিল মহা-হাহাকার –
ছিন্ন-কণ্ঠে আর্ত কণ্ঠে তোমাদের ওই ভীরু বিধাতার –
আর্তনাদের মহা-হাহাকার –
যে, ‘বাঁচাও আমারে বাঁচাও হে মোর মহান, বিপুল আমি!
হে মোর সৃষ্টি! অভিশাপ মোর!
আজি হতে প্রভু তুমি হও মম স্বামী!’ –
শুনি খলখলখল অট্ট হাসিনু, আজিও সে হাসি বাজে
ওই অগ্ন্যুদ্গার-উল্লাসে আর নিদাঘ-দগ্ধ
বিনা-মেঘের ওই শুষ্ক বজ্র-মাঝে!
স্রষ্টার বুকে আমি সেই দিন প্রথম জাগানু ভীতি, –
সেই দিন হতে বাজিছে নিখিলে ব্যথা-ক্রন্দন গীতি!
জাপটি ধরিয়া বিধাতারে আজও পিষে মারি পলে পলে,
এই কালসাপ আমি, লোকে ভুল করে মোরে অভিশাপ বলে।
অভয়-মন্ত্র
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়!
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়!
কোরাস : বল, হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়।
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ পুরুষোত্তম জয়।
তুই নির্ভর কর আপনার পর,
আপন পতাকা কাঁধে তুলে ধর!
ওরে যে যায় যাক সে, তুই শুধু বল, ‘আমার হয়নি লয়’!
বল, ‘আমি আছি’, আমি পুরুষোত্তম, আমি চির-দুর্জয়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
তুই চেয়ে দেখ ভাই আপনার মাঝে,
সেথা জাগ্রত ভগবান রাজে,
নিজ বিধাতারে মান, আকাশ গলিয়া ক্ষরিবে রে বরাভয়!
তোর বিধাতার ধাতা বিধাতা, বিধাতা কারারুদ্ধ কি হয়?
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
আজ বক্ষের তোর ক্ষীরোদ-সাগরে
অচেতন নারায়ণ ঘুম-ঘোরে
শুধু লক্ষ্মীর ভোগ লক্ষ্য তাঁহার, নয় কিছুতেই নয়!
তোর অচেতন চিতে জাগারে চেতনা নারায়ণ চিন্ময়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
ওই নির্যাতকের বন্দি-কারায়
সত্য কি কভু শক্তি হারায়?
ক্ষীণ দুর্বল বলে খণ্ড ‘আমি’র হয় যদি পরাজয়,
ওরে অখণ্ড আমি চির-মুক্ত সে, অবিনাশী অক্ষয়!
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
ওরে সত্য যে চির-স্বয়ম্ প্রকাশ,
রোধিবে কি তারে কারাগার-ফাঁস?
ওই অত্যাচারীর সত্য পীড়ন? আছে তার আছে ক্ষয়!
সেই সত্য মোদের ভাগ্য-বিধাতা, যাঁর হাতে শুধু রয়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
যে গেল সে নিজেরে নিঃশেষ করি
তাদের পাত্র দিয়া গেল ভরি!
ওই বন্ধু মৃত্যু পারেনিকো তাঁরে পারেনি করিতে লয়!
তাই আমাদের মাঝে নিজেরে বিলায়ে সে আজ শান্তিময়!
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
ওরে রুদ্র তখনই ক্ষুদ্রেরে গ্রাসে
আগেই যবে সে মরে থাকে ত্রাসে,
ওরে আপনার মাঝে বিধাতা জাগিলে বিশ্বে সে নির্ভয়!
ওই শূদ্র-কারায় কভু কি ভয়াল ভৈরব বাঁধা রয়?
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
ওই টুটে-ফেটে-পড়া লোহার শিকল,
ভগবানে বেঁধে করিবে বিকল?
ওই কারা ওই বেড়ি কভু কি বিপুল বিধাতার ভার সয়?
ওরে যে হয় বন্দি হতে দে, শক্তি আত্মার আছে জয়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …
ওরে আত্ম-অবিশ্বাসী, ভয়-ভীত!
কেন হেন ঘন অবসাদচিত?
বল পর-বিশ্বাসে পর-মুখপানে চেয়ে কি স্বাধীন হয়?
তুই আত্মাকে চিন, বল ‘আমি আছি’, ‘সত্য আমার জয়’!
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়।
বল, হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়!
আত্মশক্তি
এসো বিদ্রোহী মিথ্যা-সূদন আত্মশক্তি বুদ্ধ বীর!
আনো উলঙ্গ সত্যকৃপাণ, বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির।
তূরীয়ানন্দে ঘোষো সে আজ
‘আমি আছি’– বাণী বিশ্ব-মাঝ,
পুরুষ-রাজ!
সেই স্বরাজ!
জাগ্রত করো নারায়ণ-নর নিদ্রিত বুকে মর-বাসীর;
আত্ম-ভীতু এ অচেতন-চিতে জাগো ‘আমি-স্বামী নাঙ্গা-শির’…
এসো প্রবুদ্ধ, এসো মহান
শিশু-ভগবান জ্যোতিষ্মান।
আত্মজ্ঞান-
দৃপ্ত-প্রাণ!
জানাও জানাও, ক্ষুদ্রেরও মাঝে রাজিছে রুদ্র তেজ রবির !!
উদয়-তোরণে উড়ুক আত্ম-চেতন-কেতন ‘আমি-আছি’-র
করহ শক্তি-সুপ্ত-মন
রুদ্র বেদনে উদ্বোধন,
হীন রোদন –
খিন্ন-জন
দেখুক আত্মা-সবিতার তেজ বক্ষে বিপুলা ক্রন্দসীর!
বলো, নাস্তিক হউক আপন মহিমা নেহারি শুদ্ধ ধীর!
কে করে কাহারে নির্যাতন
আত্ম-চেতন স্থির যখন?
ঈর্ষা-রণ
ভীম-মাতন
পদাঘাত হানে পঞ্জরে শুধু আত্ম-বল-অবিশ্বাসীর,
মহাপাপী সেই, সত্য যাহার পর-পদানত আনত শির।
জাগাও আদিম স্বাধীন প্রাণ,
আত্মা জাগিলে বিধাতা চান।
কে ভগবান? –
আত্ম-জ্ঞান!
গাহে উদ্গাতা ঋত্বিক গান অগ্নি-মন্ত্র শক্তি-শ্রীর।
না জাগিলে প্রাণে সত্য চেতনা, মানি না আদেশ কারও বাণীর !
এসো বিদ্রোহী তরুণ তাপস আত্মশক্তিবুদ্ধ বীর,
আনো উলঙ্গ সত্য-কৃপাণ বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির॥
আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!
আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!
গাইবি আবার কণ্ঠছেঁড়া বিষ-অভিশাপ-সিক্ত গান।
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
আয় রে আমার বাঁধন-ভাঙার তীব্র সুখ
জড়িয়ে হাতে কালকেউটে গোখরো নাগের
পীত চাবুক!
হাতের সুখে জ্বালিয়ে দে তোর সুখের বাসা ফুল-বাগান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
বুঝিসনি কি কাঁদায় তোরে তোরই প্রাণের সন্ন্যাসী!
তোর অভিমান হল শেষে তোরই গলার নীল ফাঁসি!
(তোর) হাসির বাঁশি আনলে বুকে যক্ষ্মা-রুগির রক্ত-বান,
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
ফানুস-ফাঁপা মানুষ দেখে, হায় অবোধ
ছুটে এলি ছায়ার আশায়,
মাথায় তেমনি জ্বলছে রোদ।
ফাঁকির ফানুস ছাই হল তোর,
খুঁজিস এখন রোদ-শ্মশান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
তুই যে আগুন, জল-ধারা চাস কার কাছে?
বাষ্প হয়ে যায় উড়ে জল সাগর-শোষা তোর আঁচে।
ফুলের মালার হুলের জ্বালায় জ্বলবি কত অগ্নি-ম্লান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
অগ্নি-ফণী! বিষ-রসানো জিহ্বা দিয়ে দিস চুমা,
পাহাড়-ভাঙা জাপটানি তোর – ভাবিস সোহাগ-সুখ-ছোঁওয়া!
মৃত্যুও যে সইতে নারে তোর সোহাগের মৃত্যু টান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
সুখের লালস শেষ করে দে, স্বার্থপর!
কাল-শ্মশানের প্রেত-আলেয়া! তুই কোথা বল
বাঁধবি ঘর?
ঘর-পোড়ানো ত্রাস-হানা তুই সর্বনাশের লাল-নিশান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
তোর তরে নয় শীতল ছায়া,
পান্থ-তরুর প্রেম-আসার,
তুই যে ঘরের শান্তি-শত্রু,
রুদ্র শিবের চণ্ড মার।
প্রেম-স্নেহ তোর হারাম যে রে
কসাই-কঠিন তুই পাষাণ!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
সাপ ধরে তুই চাপবি বুকে
সইবে না তোর ফুলের ঘা,
মারতে তোকে বাজ পাবে লাজ
চুমুর সোহাগ সইবে না!
ডাক-নামে ডাক তোর তরে নয়,
আহ্বান তোর ভীম কামান।
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!
ফণীমনসার কাঁটার পুরে
আয় ফিরে তুই কালফণী,
বিষের বাঁশি বাজিয়ে ডাকে নাগমাতা –
‘আয় নীলমণি!’
ক্ষুদ্র প্রেমের শূদ্রামি ছাড়,
ধর খ্যাপা তোর অগ্নি-বাণ!
আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!