Site icon BnBoi.Com

নির্ঝর – কাজী নজরুল ইসলাম

নির্ঝর - কাজী নজরুল ইসলাম

অভিমানী

টুকরো মেঘে ঢাকা সে
ছোট্ট নেহাত তারার মতন সাঁঝবেলাকার আকাশে
সে ছিল ভাই ইরান দেশের পার্বতী এক মেয়ে।
রেখেছিল পাহাড়তলির কুটিরখানি ছেয়ে
ফুল-মুলুকের ফুলরানি তার এক ফোঁটা ওই রূপে;
সুদূর হাওয়া পথিক হাওয়া ওই সে পথে যেতে চুপে-চুপে
চমকে কেন থমকে যেত, শ্বাস ফেলত, তাকে দেখে দেখে
যাবার বেলায় বনের বুকে তার কামনার কাঁপন যেত রেখে।

দুলে দুলে ডাকত তারে বনের লতা-পাতা,
‘তোর তরে ভাই এই আমাদের সারাটি বুক পাতা,
আয় সজনি আয়!’
কইত সে, ‘সই! এমনি তো বেশ দিন-রজনি যায়,
তোদের বুক যে বড্ড কোমল, তোরা এখন কচি,
কাজ কী ভাই, এ কঠিন আমার সেথায় শয়ন রচি?’
বলেই চোখের জলকণাটির লাজে
মানিনী সে বন-বিহগী পালিয়ে যেত গহন বনের মাঝে।
কাঁদন-ভরা বিদ্রোহী সে-মেয়ের চপল চলায়,
শুকনো পাতা মরমরিয়ে কাঁদত পায়ের তলায়।
দোল-ঢিলা তার সোহাগ-বেণির জরিন ফিতার লোভে
হরিণগুলি ছুটত পাছে কি আগে তায় ছোঁবে।
আচমকা তার নয়না পানে চেয়ে সুদূর হতে
ভিরমি খেত হরিণ-বালা মূর্ছা যেত পথে।
বনের মেয়ে বনের সনে এমনি করে থাকে
একলাটি হায়, জানত না কেউ তাকে।

দিন-দুনিয়ায় সে ছাড়া আর কেউ ছিল না তার,
তবু কিন্তু ভাবত সে, ‘ভাই,
আর কী আমার চাই?
বনের হরিণ, তরুলতা এই তো সব আমার,
আকাশ, আলো, নিঝর, নদী, পাহাড়তলির বন,
এই তো আমার সবই ভালো সবাই আপন জন!
নাই বা দিল কেউ এসে গো একাকিনী আমার ব্যথায় সান্ত্বনা!’
বলেই কেন ঠোঁট ফুলাত; হায় অভাগি জানত না
পলে পলে আপনাকে সে দিচ্ছে ফাঁকি কতই –
অথই মনের থই মেলে না বুজতে সে চায় যতই।
দুষ্টু একটি দেবতা তখন ফুল-ধনুটি হাতে
বধূর বুকে পড়ত লুটি হেসে হেসে ফুল-কুঁড়িদের ছাতে।
বুঝত না তার কী ছিল না, কেন পিষছে বুকের তলা,
ভাবত আমার কাকে যেন অনেক কিছু বলার আছে
এখনও তার হয়নি কিছুই বলা।
এমনি করে ভার হল গো ক্রমেই বালার একাকিনী জীবন-পথে চলা।

কুঁড়ির বুকে প্রথম এবার কাঁদল সুরভি,
জাগল ব্যথা-অরুণ, যেন বেলা-শেষের করুণ পুরবি।
একটুখানি বুকটি তাহার অনেকখানি ভালোবাসার গন্ধ-বেদনাতে
টনটনিয়ে উঠল, ওগো, স্বস্তি নাই আর কোথাও দিনে রাতে।
কস্তুরী সে হরিণ-বালা উন্মনা আজ উদাস হয়ে ফিরে
নাম-হারা ক্ষীণ নিঝর-তীরে-তীরে।
বুঝল না হায়, কী তার ক্ষুধা, বুক যেন চায় কী,
সে বুঝি বা অনেক দূরের সুদূর পারের বাঁশির সুরের ঝি।

এমনি করে কাটে বেলা –
শুধু কেন হঠাৎ কখন যায় ভুলে সে খেলা,
চেয়ে থাকে অনেক দূরে, চোখ ভরে যায় জলে,
কে যেন তার দূরের পথিক বিদায়-বেলায় ‘আসি তবে’ বলে
গেছে চলে ওই অজানা অনেক দূরের পথে
আকাশ-পারে চড়ে কুসুম-রথে।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমিও পথ জানে না তার,
কতই সে পথ সুদূর ওগো কতই সে যে সাত-সমুদ্দুর তেরো-নদীর পার।
আজ সে ভাবে মনে,
(ভাবতে ভাবতে চমকে কেন ওঠে ক্ষণে ক্ষণে) –
পারিনিকো বাসতে অনেক ভালো সেবার তারে,
অভিমানে তাই সে চলে গেছে সুদূর পারে।
এবার এলে ছায়ার মতন ফিরব সাথে সাথে,
খুবই ভালো বড্ড ভালো বাসব তারে –
ভাবতে সে আর পারে নাকো
চমকে দেখে ছুটছে নিযুত পাগল-ঝোরা যুগল নয়ন-পাতে।
দিনের পরে দিন চলে যায়
এমনি করেই সুখে-দুঃখে, হায়!
এক দিন না সাঁঝবেলাতে ঝরনা-ধারে ঘর না গিয়ে সে –
কিশমিশ আর আঙুর খেতে ধন্না দিয়েছে।
গাচ্ছিল গান ঘুরিয়ে নয়ান সুরমা-টানা ডাগর-পানা,
শুনছিল গান ঘাসের বুকে এলিয়ে পড়ে বনের যত হরিণ-ছানা।
বীণ ছাপিয়ে উঠছিল মিড় নিবিড় গমকে –
আজ যেন সে আনবে ডেকে গানের সুরে সুদূরতমকে।

সুর-উদাসী ঘূর্ণি বায়ু নাচছিল তায় ঘিরে ঘিরে,
বুলবুলি সব ঘায়েল হয়েছিল সুরের তীরে।
সেদিন পথিক দেখলে তারে হঠাৎ সেই সে সাঁঝে,
বললে, ‘আমার চেনা কুসুম কেমন করে ফুটল ওগো
নামহারা এই সুদূর বনের মাঝে?’

অভিমানে অশ্রু এসে কণ্ঠ গেল চেপে,
রুধতে গিয়ে সে জল আরও নয়ন-জলে উঠল দু-চোখ ছেপে!
আজকে আবার পড়ল তাহার মনে
সেবার অকারণে
কেন দিয়েছিল আমায় অনাদরের বেদন
এই সে মেয়ে, সবার চেয়ে আপন আমার যে-জন।

সইতে সে গো পারেনিকো আমার ভালোবাসা,
তাই সেবারে মধ্যদিনেই শুকিয়েছিল আমার সকল আশা।
আজও কী হায় তবে
ভালোবেসে অবহেলা অনাদরেই সইতে শুধু হবে?
জাঁতা দিয়ে কে যেন তায় বিপুলভাবে পিষলে কলজে-তল,
দারুণ অভিমানে সে তাই বললে ‘ও মন, আবার দূরে আরও দূরে চল।’

আরেকটি দিন উষায়
বনের মেয়ে বাহির হল সেজে সবুজ ভূষায়।
আঙুর পাকার লাবণ্য আর ডালিম ফুলের লাল
রাঙিয়ে দিলে মৌনা মেয়ের দুইটি ঠোঁট আর গাল।
মউল ফুলের মন-মাতানো বাসে
শিশির-ভেজা খসখস আর ঘাসে
যৌবনে তার ঘনিয়ে দিল কেমন বেদনা সে।
সেদিন নিশি-ভোর
পথহারা সেই পথিক বেশে এল মনোচোর।
চোখভরা তার অভিমানের ঘোর।
অনেক দিনের অনেক কথাই উতল বাতাস লেগে।
হৃদ-পদ্মায় চড়ার মতন উঠল জেগে জেগে।

তাই সে আবার উঠল গেয়ে দূরে যাবার গান,
গভীর ব্যথায় বনের মেয়ের উঠল কেঁদে প্রাণ।
বললে, ‘প্রিয়তম,
ক্ষমো আমায় ক্ষমো!’
‘তোমায় আমি ভালোবাসি’ – এই কথাটি তবু
কনোমতেই কভু
বলতে নারে হতভাগি, বুক ফেটে যায় দুখে।
কইতে-নারার প্রাণ-পোড়ানি কণ্ঠ শুধু রুখে।
মূক হল গো মৌন ব্যথায় মুখর বনের বালা,
কাজের জ্বালা জ্বালিয়ে দিল অনেক আশার গাঁথা কুসুম-মালা।

আজ সকালে ফুল দেখে তার কেন
বুকের তলা মোচড়ে ওঠে যেন!
এক নিমিষের ভুলের তলে ফুলমালা আজ শূলের মতো বাজে।
মনে পড়ে, কখন সে এক ভুলে যাওয়া সাঁঝে
পথিক-প্রিয় চেয়েছিল তাহার হাতের মালা;
এতই কি রে পোড়া লাজের জ্বালা?
অভাগিনি পারেনিকো রাখতে সেদিন প্রিয়ের চাওয়ার মান!
অমনি তাহার দয়িত-হিয়ায় জাগল অভিমান –
হঠাৎ হল ছাড়াছাড়ি –
ভালোবাসা রইল চাপা বুকের তলায়, অভিমানটি নিয়ে শুধু
জীবন-ভরে চলল আড়াআড়ি।

আগুন-পাথার পেরিয়ে পথিক যখন অনেক দূরে
কাঁদল ব্যথার সুরে
বনের মেয়ের ভালোবাসা নামল তখন বাঁধনহারা শ্রাবণধারার মতো,
অ-বেলা হায় সময় তখন গত!

সকাল-সাঁঝে নিতুই এমনি করে
ভাবত এবার পথিক-বঁধু আসবে বুঝি ঘরে।
পথ-চাওয়া তার শেষ হল না, পথের হল শেষ,
হঠাৎ সেদিন লাগল বুকে যমের ছোঁয়ার রেশ।
সব হারিয়ে হতভাগি পাড়ি দিল, ‘সব-পেয়েছি’র দেশে
তৃপ্তি-হারা তৃষ্ণা-আতুর মলিন হাসি হেসে।
হায় রে ভালোবাসা!
এমনি সর্বনাশা
ভালোবাসার চেয়ে শেষে অভিমানই হয়ে ওঠে বড়ো,
ছাড়াছাড়ির বেলা দোঁহে দুইজনারই আঘাতগুলোই বুকে করে জড়ো!
এমনি তারা বোকা,
ভাবে নাকো এই বেদনাই সুখ হয়ে তার মনের খাতায় রইবে লেখা-জোকা।
জীবন-পথে ক্লান্ত পথিক ঘরের পানে চেয়ে
অনেক দিনের পরে এল বনের পানে ধেয়ে।
পড়ল সেদিন অভিমানের মস্ত দেয়াল ভেঙে,
দেখল আহা, উঠেছে কি লাল লালে লাল ব্যথায় হিয়া রেঙে!
নিজের উপর নিজের নিদয় নির্মমতার শাপে
কলজেতে সব ছিন্ন শিরা,
মর্ম-জোড়া ঘা শুধু আর বাঁধন-ছেঁড়ার গিরা,
আজ নিরাশায় মুহুর্মুহু বক্ষ শুধু কাঁপে!
ছুটে এল হাহা করে তাই,
আজ যে গো তার অ-পাওয়াকে বুকে পাওয়াই চাই।

ছুটে এল মানিনী সেই চপল বালার আঁধার কুটির-কোণে –
হায়, অভাগি গিয়েছিল চলে তখন যমের নিমন্ত্রণে!
ইরান দেশের ওপারে সে কোকাফ মুল্লুকে
নাসপাতি আর খোর্মা-খেজুর কুঞ্জে ঘুরল সে।
হায়, সে কোথাও নাই,
ঝরনাধারের কুটিরে তার ফিরে এল তাই।

আলবোরজের নীচে
বাঁধ-দেওয়া সে ক্ষীণ ঝরনার নীল শেওলা ছিঁচে।
বাঁধ মানে না, চোখ ছেপে জল ঝরে,
অভাগি আজ ফুটে আছে গোলাপ হয়ে ঘরে।
বনের মেয়ে কইতে নেরে বুকের চাপা ব্যথা,
রক্ত-রঙিন গোলাপ হয়ে ফুটে আছে সেথা।
আর ওই পাতা সবুজ –
ও বুঝি তার নতুন-পাওয়া মুক্তি-পুলক অবুঝ!
ভাগ্যহত পথিক-যু্বার শেষের নিশাস উঠল বাতাস ছিঁড়ে,
সে সুর আজও বাজে যেন সাঁঝের উদাস পুরবিটির মিড়ে।
নেইকো কোনো ইতিহাসে লেখা,
এই যে দুটি চির-অভিমানী
ওগো কোথায় আবার হবে এদের দেখা।

আশায়

নাই বা পেল নাগাল, শুধু সৌরভেরই আশে
অবুঝ, সবুজ দূর্বা যেমন জুঁই-কুড়িটির পাশে
বসেই আছে, তেমনি বিভোর থাক রে প্রিয়ার আশায়;
তার অলকের একটু সুবাস পশবে তোর এ নাসায়।
বরষ-শেষে একটি বারও প্রিয়ার হিয়ার পরশ
জাগাবে রে তোরও প্রাণে অমনি অবুঝ হরষ।

 গরিবের ব্যথা

এই যে মায়ের অনাদরে ক্লিষ্ট শিশুগুলি,
পরনে নেই ছেঁড়া কানি, সারা গায়ে ধূলি, −
সারাদিনের অনাহারে শুষ্ক বদনখানি,
খিদের জ্বালায় ক্ষুণ্ণ, তাতে জ্বরের ধুকধুকানি,
অযতনে বাছাদের হায়, গা গিয়েছে ফেটে,
খুদ-ঘাঁটা তাও জোটে নাকো সারাটি দিন খেটে, −
এদের ফেলে ওগো ধনী, ওগো দেশের রাজা,
কেমন করে রোচে মুখে মণ্ডা-মিঠাই-খাজা?
ক্ষুধায় কাতর যখন এরা দেখে তোমায় খেতে,
সে কী নীরব যাচ্‌ঞা করুণ ফোটে নয়নেতে!
তা দেখে ছিঃ, অকাতরে কেমনে গেলো অন্ন?
দাঁড়িয়ে পাশে ভুখা শিশু ধূলিধূসর বর্ণ।
রাখছ যে চাল মরাই বেঁধে, চারটি তারই পেলে,
আ-লোনা মাড়-ভাত খেয়ে যে বাঁচে এসব ছেলে।
পোশাক তোমার তর-বেতরের, নেইকো এদের তেনা,
যে কাপড়ে মোছ জুতো, এদের তাও মেলে না।
প্যাঁটরা-ভরা কাপড় তোমার, এরা মরে শীতে,
সারাটি রাত মায়ে-পোয়ে শুয়ে ছাঁচ-গলিতে।
তোমরা ছেলের চুমো খেয়ে হাস কতই সুখে,
এদের মা-রা কাঁদেই শুধু ধরে এদের বুকে।
ছেলের শখের কাকাতুয়া, তারও সোনার দাঁড়,
এরা যে মা পায় না গো হায় একটি চুমুক মাড়।
তোমাদের সব খোকাখুকির খেলনার অন্ত নাই,
খেলনা তো মা ফেলনা – এদের মায়ের মুখে ছাই –
তেলও দেয়নি একটু মাথায়, চুল হল তাই কটা;
এই বয়সে কচি শিশুর বাঁধল মাথায় জটা!
টোটো করে রোদে ঘুরে বর্ণ হল কালি,
অকারণে মারে ধরে লোকে দেয় আর গালি।
একটুকুতেই তোমাদের সব ছেলে কেঁদে খুন;
বুক ফাটলেও কষ্টে তারা মুখটি করে চুন,
এই অভাগা ছেলেরা মা দাঁড়িয়ে রয় একটেরে;
কে বোঝে ওই চাউনি সজল কী ব্যথা চাপছে রে!
তোমাদের মা খোকার একটু গাটি গরম হলে,
দশ ডাক্তার দেখে এসে; এরা জ্বরে মলে
দেয় না মা কেউ একটি চুমুক জলও এদের মুখে,
হাড়-চামড়া হয়ে মরে মায়ের বুকে ধুঁকে!
আনার আঙুর খায় না গো মা রুগ্‌ন তোমার ছেলে;
এরা ভাবে, রাজ্যি পেলুম মিছরি একটু পেলে।
তোমাদের মা খোকাখুকি ঘুমায় দোলায় দুলে,
এদের ছেলের ঘুম পেলে মা ঘুমায় তেঁতুল-তলে
একলাটি গে’ মাটির বুকে বাহুয় থুয়ে মাথা;
পাষাণ-বুকও ফাটবে তোমার দেখ যদি মা তা!
দুঃখ এদের দেউ বোঝে না, ঘেন্না সবাই করে,
ভাবে, এসব বালাই কেন পথেই ঘুরে মরে?
ওগো, বড়ো মুদ্দই যে পোড়া পেটের দায়,
দুশমনেরও শাস্তি যেন হয় না হেন, হায়!
এত দুখেও খোদার নাকি মঙ্গলেচ্ছা আছে,
এইটুকু যা সান্ত্বনা মা, এ গরিবদের কাছে।

 চিঠি

বিনু!
তোমায় আমায় ফুল পাতিয়েছিনু,
মনে কি তা পড়ে? –
যেদিন সাঁঝে নতুন দেখা বোশেখ মাসের ঝড়ে
আমবাগানের একটি গাছের তলায়
দুইটি প্রাণই দুলেছিল হিন্দোলেরই দোলায়?
তুমি তখন পা দিয়েছ তরুণ কৈশোরে!
দোয়েল-কোয়েল-ঘায়েল-করা করুণ ওই স্বরে
জিজ্ঞাসিলে আবছায়াতে আমায় দেখে – ‘কে?’
সে স্বরে মোর অশ্রুজল চক্ষু ছেপে যে!
বলতে গিয়ে কাঁপল আমার আওয়াজ, – ‘বিনু, আমি!’
চমকে তুমি লাল করে গাল পথেই গেলে থামি।
আঁখির ঘন কালো পল্লবে
চটুল তোমার চাউনি চোখের হঠাৎ নিবল যে!
পানের পিকে-রাঙা হিঙুল বরন
আকুল অধর আলতা-রাঙা চরণ,
শিউরে শিউরে উঠল কেঁপে অভিমানের ব্যথায়,
বরষ পরে এমন করে আজ যে দেখা হেথায়!
নলিন-নয়ান হয়ে মলিন সজল
মুছলে তোমার চোখের কালো কাজল!

* * *

তারপর ঘেরে ঝড়ঝঞ্ঝা বৃষ্টি করকায়
অভিমান আর সংকোচেরই নিদয় ‘বোরকা’য়
উড়িয়ে দিল; কেউ জানিনি কখন দুজনে
অনেক আগের মতোই আবার আকুল কূজনে
উঠেছিনু মেতে!
তারপর হায়, ফিরে এনু আবার ঘরে রেতে,
আম বাগানের পাশের খেতে বদল করে মালা, –
ফের বিদায়ের পালা!
দুজনারই শুধু ফুলের মালার চুম্বনে
ছাড়াছাড়ি হল কেয়ার সেই নিঝুম বনে।

হয়নি তো আর দেখা,
আজও আশায় বসেই আছি একা
সেই মালাটির শুকনো ফুলের বুকনোগুলি ধরে
আমার বুকের পরে।

এ তিন বরষ বিনা কাজের সেবায় খেটে যে
কেউ জানে না, বিনু, আমার কেমন কেটেছে!
আজও তেমনি কান্না-ধোয়া সজল যে জ্যোৎস্না,
তেমনি ফুটেছে হেনা-হাসনা, –
তুমিই শুধু নাই!
সিন্ধুপারের মৌন-সজল ইন্দুকিরণ তাই
তোমার চলে যাওয়ার দেশে যেতে
অভিসারের গোপন কথা এনেছে এ রেতে!
সেবার এবার শেষ হয়েছে, আজ যে কাজের ছুটি,
তাইতে, বিনু, হেসে কেঁদে খাচ্ছি লুটোপুটি!
অচিন দেশে আগের স্মৃতি নাই বা যদি জাগে,
তাইতো বিনু চিঠি দিনু আগে।
এখন শুধু একটি কথা প্রিয়,
বিচ্ছেদেরও বেদন দিয়ো – বুকেও তুলে নিয়ো।
ব্যথায়-ভরা ছাড়াছাড়ি মিলন হবে নিতি,
সেথায় মোদের এমনি করে, প্রিয়তম! – ইতি।

জীবনে যাহারা বাঁচিল না

জীবন থাকিতে বাঁচিলি না তোরা
মৃত্যুর পরে রবি বেঁচে
বেহেশ্‌তে গিয়ে বাদশার হালে,
আছিস দিব্যি মনে এঁচে!
হাসি আর শুনি! – ওরে দুর্বল,
পৃথিবীতে যারা বাঁচিল না,
এই দুনিয়ার নিয়ামত হতে –
নিজেরে করিল বঞ্চনা,
কিয়ামতে তারা ফল পাবে গিয়ে?
ঝুড়ি ঝুড়ি পাবে হুরপরি?
পরির ভোগের শরীরই ওদের!
দেখি শুনি আর হেসে মরি!
জুতো গুঁতো লাথি ঝাঁটা খেয়ে খেয়ে
আরামসে যার কাটিল দিন,
পৃষ্ঠ যাদের বারোয়ারি ঢাক
যে চাহে বাজায় তাধিন ধিন,
আপনারা সয়ে অপমান যারা
করে অপমান মানবতার,
অমূল্য প্রাণ বহিয়াই মল,
মণি-মাণিক্য পিঠে গাধার!
তারা যদি মরে বেহেশ্‌তে যায়,
সে বেহেশ্‌ত তবে মজার ঠাঁই,
এই সব পশু রহিবে যথা, সে
চিড়িয়াখানার তুলনা নাই!

খোদারে নিত্য অপমান করে
করিছে খোদার অসম্মান,
আমি বলি – ওই গোরের ঢিবির
ঊর্ধ্বে তাদের নাহি স্থান!
বেহেশ্‌তে কেহ যায় না এদের,
এরা মরে হয় মামদো ভূত!
এইসব গোরু ছাগলে সেবিবে
হুরিপরি আর স্বর্গদূত?
এই পৃথিবীর মানুষের মুখে
উঠিল না যার জীবনে জয়,
ফেরেশ্‌তা তার দামামা বাজাবে,
ভাবিতেও ছিছি লজ্জা হয়!
মেড়াতেও যারা চড়িতে ডরায়,
দেখিল কেবল ঘোড়ার ডিম,
বোররাকে তারা হইবে সওয়ার, –
ছুটোইবে ঘোড়া! ততঃকিম!

সকলের নীচে পিছে থেকে, মুখে
পড়িল যাদের চুনকালি,
তাদেরই তরে কি করে প্রতীক্ষা
বেহেশ্‌ত শত দীপ জ্বালি?
জীবনে যাহারা চির-উপবাসী, –
চুপসিয়া গেল না খেয়ে পেট,
উহাদের গ্রাস কেড়ে খায় সবে,
ওরা সয় মাথা করিয়া হেঁট,
বেহে্‌শতে যাবে মাদল বাজায়ে
কুঁড়ের বাদশা এরাই সব?
খাইবে পোলাও কার্মা কাবাব!
আয় কে শুনিবি কথা আজব!
পৃথিবীতে পিঠে সয়ে গেল সব
বেহেশ্‌তে পেটে সহিলে হয়!
অত খেয়ে শেষে বাঁচিবে তো ওরা?
ফেসে যাবে পেট সুনিশ্চয়!

হাসিছ বন্ধু? হাসো হাসো আরও
এর চেয়ে বেশি হাসি আছে,
যখন দেখিবে বেহেশ্‌ত বলে
ওদেরে কোথায় আনিয়াছে!
শহরের বাসি আবর্জনা ও
ময়লা, চড়িয়া ‘ধাপামেলে’
ভাবে, চলিয়াছে দার্জিলিঙ্গে –
হাওয়া বদলাতে চড়ে রেলে!
বদলায় হাওয়া রেলেও তা চড়ে,
তার পরে দেখে চোখ খুলে
স্তূপ করে সব ধাপার মাঠেতে
আগুন দিয়াছে মুখে তুলে!

ডুবুরি নামায়ে পেটেতে যাদের
খুঁজিয়া মেলে না ‘ক’ অক্ষর,
তারাই কি পাবে খোদার দিদার,
পুছিবে ‘মাআরফতি’ খবর!
পশু জগতেরে সভ্য করিয়া
নিজেরা আজিকে বুনো মহিষ,
বুকেতে নাহিকো জোশ তেজ রিশ,
মুখেতে কেবল বুলন্দ রীশ,
তারাই করিবে বেহেশ্‌তে গিয়ে
হুরপরিদের সাথে প্রণয়!
হুরি ভুলাবার মতোই চেহারা,
গাছে গাছে ভূত আঁতকে রয়!
দেহে মনে নাই যৌবন-তেজ
ঘূণ-ধরা বাঁশ হাড্ডিসার,
এইসব জরাজীর্ণেরা হবে
বেহেশ্‌ত-হুরির দখলিকার!
নেংটি পরিয়া পরম আরামে
যাহারা দিব্য দিন কাটায়,
জিজ্ঞাসে যারা পায়জামা দেখে –
‘কী করিয়া বাবা পর ইহায়?
পরিয়া ইহারে করেছ সেলাই
অথবা সেলাই করে পর?’
এরাই পরিবে বাদশাহি সাজ
বেহেশ্‌তে গিয়ে নবতর?
বন্ধু, একটা মজার গল্প
শুনিবে? এক যে ছিল বুনো!
পুণ্য করিতে করিতে একদা
তুলিল পটল হয়ে ঝুনো!
জগতের কোনো মানুষের কোনো
মঙ্গল কভু করেনি সে,
কেবলই খোদায় ডাকিত সে বনে
বুনো পশুদের দলে মিশে।
শিখেনিকো কভু সভ্যতা কোনো,
আদব-কায়দা কোনো দেশের,
বেহেশ্‌তে যাবে ভরসায় শুধু
ভুলিয়া পুণ্য করিল ঢের!
মরিল যখন, গেল বেহেশ্‌তে;
দলে দলে এল হুরপরি,
এল ফেরেশ্‌তা, বস্তা বস্তা
এল ডাঁসা ডাঁসা অপ্সরি।
রং-বেরঙের সাজপরা সব, −
বুকে বুকে রাঙা রামধনু;
চলিতে চলকি পড়িছে কাঁকাল
যৌবন-থরথর তনু।
সারা গায়ে যেন ফুটিয়া রয়েছে
চম্পা-চামেলি-জুঁই বাগান,
নয়নে সুরমা, ঠোঁটে তাম্বুল,
মুখ নয় যেন আতর-দান!
যেন আধ-পাকা আঙ্গুর, করে
টলমল মরি রূপ সবার,
পান খেলে – দেখা যায়, গলা দিয়ে
গলে গো যখন পিচ তাহার।
দলে দলে আসে দলমল করে
তরুণী হরিণী করিণী দল,
পান সাজে, খায়, ফাঁকে ফাঁকে মারে
চোখা-চোখা তির চোখে কেবল!
বুনো বেচারার ঝুনো মনও যেন
ডাঁসায়ে উঠিল এক ঠেলায়,
হ্যাঁকচ-প্যাঁকচ করে মন তার
চায় আর শুধু শ্বাস ফেলায়!
পড়িল ফাঁপরে, কেমন করিয়া
করিবে আলাপ সাথে এদের!
চাহিতেই ওরা হাসিয়া লুটায়,
হাসিলে কী জানি করিবে ফের!
উসখুস করে, চুলকায় দেহ,
তাই তো কী বলে কয় কথা,
ক্রমে তাতিয়া উঠিতেছে মন
আর কত সয় নীরবতা!
ফস করে বুনো আগাইয়া গিয়া
বসিল যেখানে পরিরা সব
হাসে আর শুধু চোখ মারে, সাজে
পান, আর করে গল্পগুজব।
পানের বাটাতে হঠাৎ হেঁচকা
টান মেরে বলে, ‘বোন রে বোন
আমারে দিস তো পানের বাটাটা,
মুইও দুটো পান খাই এখন।’
যত হুরিপরি অপ্সরিদল –
বেয়াদবি দেখে চটিয়া লাল!
বলে, ‘বে-তমিজ! কে পাঠাল তোরে,
জুতা মেরে তোর তুলিব খাল!
না শিখে আদব এলি বেহেশ্‌তে
কোন বন হতে রে মনহুশ?
এই কি প্রণয়-নিবেদন রীতি
জংলি বাঁদর অলম্ভুশ!
বলেই চালাল চটাপট জুতি;
বুনো কেঁদে কয়, ‘মাওই মাও,
আর বেহেশ্‌তে আসিব না আমি
চাহিব না পান, ছাড়িয়া দাও!’
আসিল বেহেশ্‌ত-ইনচার্জ ছুটে,
বলে পরিদেরে, ‘করিলে কী?
ও যে বেহেশ্‌তি!’ পরিদল বলে,
‘ওই জংলিটা? ছিছি ছিছি!
এখনই উহারে পাঠাও আবার
পৃথিবীতে, সেথা সভ্য হোক,
তারপর যেন ফিরে আসে এই
হুরিপরিদের স্বর্গলোক!’
সকল পুণ্য তপস্যা তার
হইল বিফল, আসিল ফের
নামিয়া ধুলার পৃথিবীতে, হায়,
দেখিয়া দোজখে হাসে কাফের!
বন্ধু, তেমনই স্বর্গ-ফেরতা
ভারতীয় মোরা জংলি ছাগ,
পৃথিবীরই নহি যোগ্য, কেমনে
চাহিতে যাই ও বেহেশ্‌ত বাগ!
পিষিয়া যাদেরে চরণের তলে
‘দেউ’ ‘জিন’ করে মাতামাতি,
দৈত্য পায়ের পুণ্যে তারাই
স্বর্গে যাবে কি রাতারাতি?
চার হাত মাটি খুঁড়িয়া কবরে
পুঁতিলে হবে না শাস্তি এর,
পৃথিবী হইতে রসাতল পানে
ধরে দিক ছুড়ে কেউ এদের!

আগাইয়া চলে নিত্য নূতন
সম্ভাবনার পথে জগৎ
ধুঁকে ধুঁকে চলে এরা ধরে সেই
বাবা আদমের আদিম পথ!
প্রাসাদের শিরে শূল চড়াইয়া
প্রতীচী বজ্রে দেখায় ভয়,
বিদ্যুৎ ওদের গৃহ-কিংকরী
নখ-দর্পণে বিশ্ব বয়।
তাদের জ্ঞানের আরশিতে দেখে
গ্রহ শশী তারা – বিশ্বরূপ,
মণ্ডুক মোরা চিনিয়াছি শুধু
গণ্ডুষ-জলবদ্ধ-কূপ! −
গ্রহ গ্রহান্তে উড়িবার ওরা
রচিতেছে পাখা, হেরে স্বপন,
গোরুর গাড়িতে চড়িয়া আমরা
চলেছি পিছনে কোটি যোজন।
পৃথিবী ফাড়িয়া সাগর সেঁচিয়া
আহরে মুক্তা-মণি ওরা,
ঊর্ধ্বে চাহিয়া আছি হাত তুলে
বলহীন মাজা-ভাঙা মোরা।
মোরা মুসলিম, ভারতীয় মোরা
এই সান্ত্বনা নিয়ে আছি
মরে বেহেশ্‌তে যাইব বেশক
জুতো খেয়ে হেথা থাকি বাঁচি!
অতীতের কোন বাপ-দাদা কবে
করেছিল কোন যুদ্ধ জয়,
মার খাই আর তাহারই ফখর
করি হরদম জগৎময়।
তাকাইয়া আছি মূঢ় ক্লীবদল
মেহেদি আসিবে কবে কখন,
মোদের বদলে লড়িবে সে-ই যে,
আমরা ঘুমায়ে দেখি স্বপন!
যত গুঁতো খাই, বলি, ‘আরও আরও,
দাদা রে আমার বড়োই সুখ!
মেরে নাও দাদা দুটো দিন আরও
আসিছে মেহেদি আগন্তুক!’
মেহেদি আসুক না আসুক, তবে
আমরা হয়েছি মেহেদি-লাল
মার খেয়ে খেয়ে খুন ঝরে ঝরে –
করেছে শত্রু হাসির হাল!
বিংশ শতাব্দীতে আছি বেঁচে
আমরা আদিম বন-মানুষ,
ঘরের বউঝি-সম ভয়ে মরি
দেখি পরদেশি পর-পুরুষ!
ওরে যৌবন-রাজার সেনানী
নয়া জমানার নওজোয়ান,
বন-মানুষের গুহা হতে তোরা
নতুন প্রাণের বন্যা আন!
যত পুরাতন সনাতন জরা –
জীর্ণেরে ভাঙ, ভাঙ রে আজ!
আমরা সৃজিব আমাদের মতো
করে আমাদের নব-সমাজ।
বুড়োদের মতো করে তো বুড়োরা
বাঁচিয়াছে, মোরা সাধিনি বাদ,
খাইয়া দাইয়া খোদার খাসিরা
এনেছে মুক্তি-ষাঁড়ের নাদ।
আমাদের পথে আজ যদি ওই
পুরানো পাথর-নুড়িরা সব
দাঁড়ায় আসিয়া, তবু কি দু-হাত
জুড়িয়া করিব তাদের স্তব?
ভাঙ ভাঙ কারা, রে বন্ধহারা
নব-জীবনের বন্যা-ঢল!
ওদেরে স্বর্গে পাঠায়ে, বাজা রে
মর্তে মোদের জয় মাদল!
চিরযৌবনা এই ধরণির
গন্ধ বর্ণ রূপ ও রস
আছে যতদিন, চাহি না স্বর্গ!
চাই ধন, মান, ভাগ্য, যশ!
জগতের খাস-দরবারে চাই –
শ্রেষ্ঠ আসন, শ্রেষ্ঠ মান,
হাতের কাছে যে রয়েছে অমৃত
তাই প্রাণ ভরে করিব পান।

তুমি কি গিয়াছ ভুলে

তুমি কি গিয়াছ ভুলে? –
তোমার চরণ-স্মরণ-চিহ্ন আজও মোর নদীকূলে
মুছিল না প্রিয়, মুছিল না তার বুকে যে লিখিলে লেখা!
মাঝে বহে স্রোত, দু-কূল জুড়িয়া চরণ-স্মরণ-রেখা।
বন্যার ঢল, জোয়ার, উজান আসে যায় ফিরে ফিরে,
ও চরণ-লেখা মুছিল না মোর বালুচরে নদীতীরে!
ঊর্ধ্বে ধূসর সান্ধ্য আকাশে ক্ষীণ চন্দ্রের লেখা,
নিম্নে আমার শুনো বালুচরে তোমার চরণ-রেখা।

কূলে আসি একা বসি,
তব মুখ-মদ-গন্ধের ফুলবন ওঠে নিশ্বসি।
কূলে একা বসি ঢেউ গণি আর চাহি ওপারের তীরে –
প্রভাতে যে পাখি উড়িল সে সাঁঝে ফিরিল না আর নীড়ে।
এই বালুচর শূন্য ধূসর আমার এ মরুভূমি
কেন এ শূন্যে চরণ-চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলে তুমি?
হেরিনু, আকাশে ওঠেনিকো চাঁদ – শূন্য আকাশ কাঁদে,
ও বিরাট বুক ভরিয়া তোলে কি ওইটুকু ক্ষীণ চাঁদে?

চলে-যাওয়া দিনগুলি
মনের মানিক-মঞ্জুষা হতে খুলে দেখি, রাখি তুলি।
কতবার আসি ফিরে যাই বেয়ে তোমার দেশের নদী,
কত বধূ আসে জল নিতে সেথা তুমি সেথা আস যদি।
তোমার কলসি-হিল্লোল যদি মোর নায়ে এসে লাগে
দুটি চেনা চোখ সন্ধ্যা-দীপের মতো যদি সেথা জাগে!….
কতদিন সাঁঝে হইয়াছে মনে, তোমারে বা দেখিয়াছে,
তরণিতে কার চেনা বাঁশি শুনে আসিয়াছ কাছাকাছি।
আঁচল ভরিয়া জলে-ভেজা রাঙা হিজলের ফুলগুলি
কুড়াতে তোমার ঘোমটা খসেছে, এলোখোঁপা গেছে খুলি!

সর্পিল বাঁকা বেণি,
ওর সাথে ছিল মোর আঙুলের কতই না চেনাচেনি!
ওই সে বেণির বিনুনিতে মোর বাঁধা পড়েছিল হিয়া,
কতদিন তারে ছাড়াতে চেয়েছে আমার আঙুল দিয়া! –
দাঁড়ায়েছ আসি, সোনাগোধূলিতে আকাশ গিয়াছে ভরে,
পিছনের কালো-বেণিতে সন্ধ্যা বাঁধা পড়ে কেঁদে মরে!
বাঁশিতে কাঁদিয়া ফিরিয়া এসেছি তরণি বাহিয়া দূরে,
আমার নিশাসে নাহি নেভে যেন প্রদীপ তোমার পুরে।….
ছল করে যবে জল নিতে যাও – নদী-তরঙ্গে হায়!
তরঙ্গ কি গো দুলে ওঠে মনে, কলসি ভাসিয়া যায়?
নয়নের নীরে তুমি ডোব, ডোবে কলসি নদীর জলে?
অথবা কাঁখের কলসিই শুধু ডুবাতে শিখেছ ছলে?

যত চাই সব ভুলি,
আঁধার ভরিয়া ডাকে আঙনের তব ঝাউগাছগুলি।
তব অঙ্গুলি-ইঙ্গিত যেন ওদের শীর্ণ শাখা,
হাহাকার করে আকাশে চাহিয়া, বাতাসে ঝাপটে পাখা!
ভুলিবার কথা ভুলে যাই, হায় বন্দিনি মোর পাখি,
পিঞ্জর-পাশে আসি যাই ফিরে, আকাশে থাকিয়া ডাকি!

ফিরে আসি একা নীড়ে,
ক্লান্ত পক্ষ বসে বসে ভাবি ভাঙা মোর তরু-শিরে।
দশ দিক ভরে কলরব করে অচেনারা ছুটে আসে,
তুমি নাই তাই ঘিরিয়া সবাই বসে মোর আশে-পাশে।
না চাহিতে কেহ পাখায় আমার বাঁধে অসহায় পাখা,
তৃষিত অধরে নিয়ে যায় ভরে বেদনার বিষ মাখা।

আজ আমি অপরাধী,
অভিমান-জ্বালা নিবারিত নিতি অপরাধ করি – কাঁদি!
যে আসে এ বুকে তাহারই হৃদয়ে তোমার হৃদয় খুঁজি,
খুঁজিতে খুঁজিতে হারায়ে ফেলেছি মোর হৃদয়ের পুঁজি।
শূন্য আকাশে ওঠেনাকো চাঁদ, উল্কারা আসে ছুটে,
আগুনের তৃষা মিটাই তাদের অগ্নি-অধর-পুটে!

তুমি যাও নাই ভুলে?
মম পথ পানে চাহ কি আজিও সন্ধ্যা-প্রদীপ তুলে?
নিবাও নিবাও ও সন্ধ্যা-দীপ, চাহিয়ো না মোর পথে,
মরণের রথে উঠেছে, উঠিত যে তব সোনার রথে।
কুসুমের মালা দু-দিনে শুকায়, থাক অতীতের স্মৃতি –
শুকাবে না যাহা – আমার গাঁথা এ কাঁটার কথার গীতি!

দীওয়ান–ই–হাফিজ

গজল ১

হাঁ, এয় সাকি , শরাব ভর্ লাও বোলাও পেয়ালী চালাও হর্‌দম্!
প্রথম প্রেম-পথ সহজ-সুন্দর, শেষের দিক তা-র ঢালাও-কর্দম!

কসম তার ভাই ভোরের বায় ভায় অলক-গুচ্ছের যে-বাস কান্তার,
বহুত দিল্ খুন করলে কুন্তল কপোল-চুম্বী চপল ফাঁদদার।

যদিই ক-ন তোর সাগ্নিক ওই পির মুসল্লায় কর শরাব-রঙ্গিন,
পথেই রথ যার অচিন নয় তার কোথায় পথ-ঘাট খারাব সঙ্গিন

আরাম সুখ মোর হারাম বিলকুল পথের মঞ্জিল পিয়ার মুল্‌কের,
নকিব হরদম হাঁকায় হাম্‌দম্ – পথিক! দূরপথ গাঁঠারি তুল্ ফের!

অন্ধকার রাত, ঊর্মি-সংঘাত, ঘূর্ণাবর্তও তুমুল গর্জে,
বেলায় বাস যার বুঝবে ছাই তার পথের ক্লেশ মোর সমুন্দর যে!

তামাম মোর কাম শুধুই বদনাম, নিজের দোষ ভাই নিজের দোষ সে,
গোপন দূর ছাই রয় কি নাম তার রাজ-সভায় যার চর্চা জোর-সে।

প্রসাদ চাস? বাস, গাফিল হোসনে হাফিজ হরদম হাজির-মজলিস!
এ সব তঞ্চট ঝক্কি-ঝঞ্‌ঝট ছোড়্ দে, তারপর পিয়ার খোঁজ নিস।

—————
ছন্দসূত্র :–
“আলাইয়্যা আইয়োহাস্ সাকি আদির্ কা-সা ওয়ানা বিল্‌হা!”
হাঁ, এয়্ সাকি শরাব ভর্ লাও বোলাও পেয়ালী চালাও হরদম্।”

গজল ২

হে মোর সুন্দর! চাঁদের চাঁদমুখ তোমার রৌশন রূপ মেখেই,
রূপের জৌলুস তোমার টোলদার চিবুক-গন্ডের কূপ থেকেই।

ওষ্ঠে প্রাণ! হায়, দেখতে চাও তায় গোল-বদন ওই ঘোমটা-হীন,
জানাও ফরমান জ্বলবে আর না নিববে জান্‌টার মোমটা ক্ষীণ!

তোমার কেশপাশ আমার দিল্ বাস – জমবে জোট সেই এক জা-গায়, –
আরজ এই ক্ষীণ মিটবে কোন দিন? আর না বিচ্ছেদ – দেক লাগায়!

নার্গিস-অক্ষি! হরলে সব সুখ তোমার নয়নার অত্যাচার
মস্ত্ চাউনির হস্তে তাই কই যাক সতীত্বও হত্যা ছার!

খুলবে এইবার নয়ন-পাত তার বদ-নসিব মোর নিঁদ-আতুর,
আজ যে প্যারির উজ্‌লি স্মিরতি-য় আনলে নির্ঝর ক্ষীণ আঁসুর!

পাঠিয়ো ভোর বায় ফুল্ল ফুল তুল তোমার গণ্ডের ফুল-তোড়া!
যদিই পাই তায় তোমার বোঁস্তার খোশবুদা খাক ধুল থোড়া!

দে খবর দিল্-দার পিয়ায় সই বক্ষে আজ মোর জোর ব্যথা,
মাথার দিব্যি রইল সই লো, জরুর কস তায় মোর কথা!

জামশেদের দর্-বারের সাকি! বাড়ুক পরমাই মদ্য-পিয়ো!
তোমার হস্তে এ-মদের ভাঁড় মোর পুরল নাই ভাই যদ্যপিও!

‘য়্যাজদ্’ মুল্‌কের বাসিন্দায় সব বলবে, বন্ধু ভোর-সমীর!
ভরুক ময়দান লুটাক পায়-পায় অকৃতজ্ঞের খণ্ড শির!

“বহুত দূর পথ বহুত বিচ্ছেদ স্মৃতির ভুল হায় হয়নি তায়,
তাদের বাদশার গোলাম আজকেও তাদের খোশনাম কয় সদাই।”

চলতে মোর পথ সামলো প্যারি, আঁচর, খাক আর খুন হতে;
তোমার এশ্‌কের নিরাশ খুন-দিল্ লোহুয় পথ এ পূর্ণ যে!

এয়্ শাহানশা্‌হ! ওয়াস্তে আল্লার শক্তি দাও এই, অহর্নিশ্-
আশমানের ন্যায় চুম্বি অমনি তোমার খাস রং-মহল শীষ!

আশিস চায় এই ‘হাফিজ’ হরদম, কও ‘আমিন’ সব খুব মনে –
“লাল শিরীন ঠোঁট পিয়ার রোজ পাই, ভরাই লাখ লাখ চুম্বনে!”

——————–
ছন্দসূত্র :–
এয়্ ফরোগে মাহে হোসন আজ রূয়ে রোখ্‌শা নে শুমা
আবরূয়ে খূবি আজ চা- হো জনখদা নে শুমা।

গজল ৩

হাত হতে মোর হৃদয় যায় দোহাই বাঁচাও হৃদয়-বান!
আপশোশ! আমার গোপন সব ফসকে যে দেয় নিদয় প্রাণ।

দশ দিনের এই দুন্‌য়া ভাই, স্বপ্ন-কুহক কল্পলোক;
করতে ভালোই বন্ধুদের, বন্ধু, তোমার লক্ষ্য হোক!

বও অনুখূল বায়, এ নাও ভগ্ন, মনেও শ্রান্তি, হায়!
হয় তো দু-বার দেখব ফের সেই হারা মোর প্রাণ-প্রিয়ায়।

শরাব-সভায় কুঞ্জে আজ বুলবুলি বাঃ বোল বিলায় –
লাও প্রভাতের মদের ভাঁড়, মস্তানা সব জলদি আয়!

হাজার লাখ হে মহান-প্রাণ, সালাম সালাম ধন্যবাদ!
দরবেশ এ দীন একটি দিন প্রসাদ চায়, নাই অন্য সাধ।

‘দুই দুনিয়ার আরাম’ সব ব্যাখ্যা ভাই এই এক কথায়, –
দোস্তে মধুর স্নিগ্ধ ভাষ, শত্রু যে – দাও বক্ষ তায়।

সুনাম সুযশ লাভের পথ করলে হারাম , হে দুর্বোধ!
মন্দ বোধ হয় কু-নাম আজ? বদলে দাও, বাস এ দূর পথ।

জমশেদের এই মদের গ্লাস সিকান্দারের আয়না ভাই;
দারার দেশের সকল হাল ওই হের বাঃ, ভায় না তায়?

শির ঝোঁকা, নয় মোমের ন্যায় জ্বালবে – সে কি শরম কম? –
ওই পিয়া যার – পরশ ঘায় কঠিন শিলা ও নরম মোম।

বন্ধু দে সব বৈতালিক গায় যদি এই ফারসি-গীত
সন্ন্যাসী পির ভাব-মোহিত নাচবে; এ-গান সার-নিহিত।

ওই খাঁটি মদ – সুফির দল পাপের মা কয়? – আ দুত্তোর!
আইবুড়ো সব ছুকরিদের ঠোঁট-চুমোরও মধুরতর!

হাতখালি? বাস, আয়াস কর আয়েস করার, শেখ সুখেও;
পরশ-পাথর মত্ততার ‘কারুন’ বানায় ভিক্ষুকেও।

পর্‌মায়ু দেয় মুমুর্ষুরে ফারেস দেশের দিল্-পিয়ায়,
এয়্ সাকি, এই খোশখবর জ্ঞান-বুড়োদের বলবি ভাই!

খাম্‌খা হাফিজ দেয়নি গা-য় শরাব-রঙিন কুর্তি এই,
আলখেলা পাক গায় হে শেখ! লাচার, সব এই ফুর্তিতেই!

———————
ছন্দসূত্র :–
“দিল্ নি রওদ যে দস্তম সাহিব দিলাঁ খোদা রা”
হাত হতে মোর হৃদয় যায় দোহাই বাঁচাও হৃদয়-বান্ !

গজল ৪

 মোর   পাত্র মদ্য-রোশনায়ে কর রৌশন এয়্ সাকি!
 গাও    বান্দা , “মোদের পুরবে সব আশ দুন্‌য়া নয় ফাঁকি!”
 মদ-    পাত্রে মোর আজ বিম্বিত ছবি প্রিয়ার চাঁদ মুখের,
 শোন    বঞ্চিত যত হরদমই মদ-টানার স্বাদ সুখের!
 ঝাউ    ছিপছিপে তন-নাঙ্গীদে ‘নাজ নখরা’ সব ফুরোয়,
 ক্ষীণ    দেবদারু-তনু মরালী পিয়ার যেই হয় অভ্যুদয়।
সে যে    মৃত্যুঞ্জয়ী শাশ্বত চির-জাগ্রত প্রেম যার;
 অবি-    নশ্বর মম নাম তাই দোলে কাল-বুকে হেম-হার।
 মোর    “দিল্‌রুবা” পিয়ার আঁখিয়ার বড়ো মিঠি দিঠি আধ-ঘোর,
 তাই    চাউনির ওরই হাতে সঁপা মোর বাসনার বাগ-ডোর ।
 রোজ    কিয়ামতে ভাই, জিতবে না, - আহা, দুঃখে গাল খুঁটি!
 মোর    হারাম মদকে ভণ্ড শেখের হালাল দাল-রুটি।
 কভু    বন্ধুদের সে ফুলবাগে যদি যাও দখিন হাওয়া;
 মোর    কান্তারও কাছে এই কথাটুকু জরুর চাই যাওয়া;
 বলো    প্রিয়তম! স্মৃতি জোর করে ছি ছি ভোলা কি কখনও যায়?
 ওগো    আপনি সেদিনও আসিবে, আর না দেখিবে স্বপ্ন তায়!
  ওই    পাতলা ছুঁড়িরই প্রেম দাগ বুকে ‘লালা’ –ফুল-সম চিন্;
  মম    জালে ধরা দেবে মিলন-বিহগ – বাকি আর কতদিন?
  ওই    সব্‌জা দরিয়া আশমানের, আর চাঁদের নৌকা সেই,
  সব    ডুব গিয়া ভায়া ‘কওয়াম হাজি’ র মাল এ মদ গ্লাসেই!
 ফেল    অশ্রুবিন্দু – শস্য-কণিকা হাফিজ কাঁদ রে কাঁদ,
 ওরে    মিলন-পক্ষী হয়তো লক্ষ করবে তা হলে ফাঁদ!

———————–
ছন্দসূত্র :–
সা   কি ব-নুরে  বা-দা বর্-অফ্  রোজে জা-ম্ এমা
মোর পাত্র মদ্য–রোশনায়ে কর রৌশন এয় সা – কি !

গজল ৫

কোথায় সুবোধ সংযমী, তার তুল্ এ-মাতাল অপাত্রে ছাই!
তাদের ফথ আর আমার এ-পথ বহুত বহুত তফাত যে ভাই!

ধরম শরম? চুলোয় সে যাক! প্রেম-শিরাজির প্রেমিক এ-জন,
নীতির নীরস ঠোঁট চেপে শোন রবাব -বীণের ঝিঁঝিট-বেদন?

মসজিদে গে শিখনু পরা ফেরেববাজির কুর্তি কালো;
ভাই রে, আমার আতশ -পূজা শরাব-শিরীর স্ফূর্তি ভালো।

মিলন-চুমুর শিরীন স্মৃতি আবছায়া তাও হয় না মনে!
হায় কোথা সেই জাদুর মায়া, মান করে জল নয়না-কোণে?

দোস্তের অরূপ রূপ-দরিয়ায় দুশমনে ছাই পায় না রতন,
রবির শিখায় স্তিমিত প্রদীপ জ্বালতে সে ছাই খাম্‌খা যতন!

সেবের মতন স-টোল চিবুক-কূপটি প্রিয়ার রাস্তাতে না?
আশেক পথিক, সামলে চলিস! আস্তে! পড়েই যাস তাতে বা!

সুরমা আঁখির অঞ্জন আমার, পিতম, তোমার চরণ-রেণু,
এই মদিনা-মক্কা, হেথাই বাজবে আমার মরণ-বেণু!

আশ্ কোরো না বন্ধু আমার, হাফিজ হতে চুম-ভরা ঘুম,
শান্তি কী চিজ? আরাম কোথায়? কলজেতে মোর জ্বলছে আগুন।

গজল ৬

যদিই কান্তা শিরাজ সজ্‌নি ফেরত দেয় মোর চোরাই দিল্ ফের,
সমরখন্দ আর বোখারায় দিই বদল তার লাল গালের তিল্‌টের!

লে আও সাকি, শরাব শেষটুক! কোথাও নাই ভাই, বেহেশতেও সে,
নহর , ‘রোকনা-আবাদ’ -তীর আর এমন ঈদগাহ, এদেশ সেও সে।

বাঁচাও বন্ধু! নিলাজ চঞ্চল চটুল চুলবুল প্রিয়ার মুখচোখ,
তুর্কি সৈন্যের ‘লুটের খাঞ্চা’র মতোই বিলকুল লুটলে সুখ-লোক!

অপূর্ণই মোর এশ্‌ক্-গুলবাগ তাতেই মশগুল ভোমর চঞ্চল,
হুর যে চায় না স-টোল লাল গাল, হরিণ চোখ, মুখ কোমল ঢলঢল।

আগেই জানতাম, ব্যাকুল-দিন-দিন আকুল-যৌবন হাসিন ‘ইউসফ’ –
প্রেমের টান তার নাশবে হরবে ‘জুলায়খা’র সব নারীর গৌরব।

চলুক সেহলির শরাব-সংগীত, কালের কুঞ্জি নাই তলাশ তার,
না-হক কসরত গ্রন্থি খুলবার রহস্যের এই রশি ফাঁসটার!

নীতির গীত শোন পিতম চঞ্চল! শান্ত সুন্দর তারই ঠিক প্রাণ,
জ্ঞানের বৃদ্ধের নীতির বশ যে, সৎ কোথায় যার প্রাণ-অধিক জ্ঞান।

মন্দ কও? আহ্ তাতেই জান্ তর্ ! আবার গাল দাও হে মোর লক্ষ্মী;
গাল তো নয় ও, মিষ্টি শরবত ঢালছে পান্নার শিরীন ঠোঁটটি!

গজল-গীত নয়, মুক্তো গাঁথছিস, হাফিজ আয়, ফের মধুর তান ধর!
তারার লাখ হার ছুড়বে বারবার অধীর আশমান শুনলে গান তোর।

—————–
ছন্দসূত্র :–
আগন আঁ তুর কে শিরাজি বদসত আ-রদ দিলে মারা।
যদিই কান্তা শিরাজ সজ্‌নি ফেরত দেয় মোর চোরাই দিল্ ফের।

গজল ৭

ত্যজি মসজিদ কাল মুর্শিদ মম আস্তানা নিল মদশালা,
নেবে কোন পথ এবে পথ-রথ ওগো সুহৃদ সখী পথ-বালা!

আমি মুসাফির যত শারাবির ওই খারাবির পথ মঞ্জিলে,
সখীমাফ চাই, বিধি এই রায় ভালে লিখেছিল আমি জন্মিলে।

‘কাবা শরিফের’ পানে করি ফের মুখ কোন বলে আমি কও সখী,
পির শারাবের পথ-মদরত যবে, আন-পথে যাবে শিষ্য কি?

জ্ঞান বোঝে যদি কেন বাঁধি হৃদি পিয়া-কুন্তল-ফাঁদে সেধে সেধে,
যত জ্ঞানী পির ওই জিঞ্জির লাগি দিওয়ানা হবে গো কেঁদে কেঁদে।

মম ঠোঁটে ওগো বধূ ‘আয়েত’ -মধু যে ঢালে তব ও-মুখ ‘কোরআনে’,
তাই সুধা আর সীধু ফেটে পড়ে শুধু কবিতাতে আর মোর গানে।

মম অগ্নি-বর্ষী ‘আহা’-শ্বাস আর একা-রাতে-জাগা কাতরানি,
তব মর্মর-মোড়া মর্মে কি দিল ব্যথা আঁকি কোনো রাত-রানি!

মন- ময়ূরীর লাগি ‘বিরহ’-ভুজগী ফেঁসেছিল ভালো কেশ-জালে,
কেন খুলে দিয়ে বেণি ‘বিচ্ছেদ’-ফণী ছেড়ে দিলে প্রিয়া শেষ-কালে!

তব এলোচুলে বায়ু গেল বুলে মম আলো নিভে গেল আঁধিয়ারে,
ওই কালোকেশে আমি ভালোবেসে শেষে দেশে দেশে ফিরি কাঁদিয়া রে!

মোর বুক-ফাটা ‘উহু’-চিৎকার-বাণ চক্কর মারে নভ চিরে,
দেখো হুশিয়ার মম প্রিয়তম, তির-বাজপাখি উড়ে তব শিরে!

মোর জ্ঞানী পির আজ খারাবির পথে, এসো মোর সাথি পথ-বালা,
ওই হাফিজের মতো আমাদেরও পথ প্রেম-শিরাজিরই মদশালা।

গজল ৮

বুক-ব্যথানো বেণুর বেদন বাজিয়েছিল কাল রাতে
বনশিওয়ালা – আল্লাতালা রাখুন তারে আহ্লাদে!

করলে আমায় ক্লান্ত এতই তার সে মুরজ মুরঝা সুর –
বোধ হল মোর বিশ্ব-নিখিল কেবল কান্না-বেদনাতুর!

পার্শ্বে ছিল ছুকরি সাকি ঠোঁট-কূপে যার ‘আব-হায়াত’
মুখ আলো আর কেশ কালো যার খেলায় সদাই দিন ও রাত।

বিহ্বল আমার তৃষ্ণা দেখে পাত্রে আরও ঢালল মদ,
মদ-মদালস কইনু আমি চুম্বি সাকির পুণ্য পদ –

“মুক্তি দিলে আমার ‘অহম’-দুঃখ থেকে আজ তুমি,
মদ ঢেলে যেই করলে অধর কাচ-পেয়ালার নাচ-ভূমি।

আল্লা তোমায় আগলে রাখুন আলাই-বালাই আপনি নে,
সাকি! তোমার সর্বলোকে কল্যাণ হোক সব দিনে।”

হাফিজ যখন আপন-হারা কোথায় বা তোর ‘কায়কাউস’,
কায়কোবাদের কুল-মুলুক? এক তিল বরাবর তখত্‌তাউস।

গজল ৯

জাগো সাকি হামদরদি, জাম-বাটিতে দাও শরাব,
চুলোয় যাক এই দুঃখ-ব্যথা, ধুলোয় ঢাকুক সব অভাব!

ভর পিয়ালা হস্তে দে দোস্ত, মস্ত হয়ে বুঁদ সেই নেশায়
দিই ফেলে এই শির হতে ওই সুনীল আকাশ-গাঁঠরিটায়!

ভয় কী সখি? করবে নিন্দা শাস্ত্র-শকুন বন্ধুরা?
বদনামে মোর পরোয়া থোড়াই! চালাও পানসি, দাও সুরা।

নেশার দারু জরুরি ভাই, খোদ-দেমাকির নাশতে জাত,
ঢালো শরাব, আত্ম ভোলাও, চেতন আমার হোক নিপাত!

দহন-দারুণ দিল্ ছেপে মোর উঠছে যে শ্বাস বহ্নি-শিস,
কতই কাঁচা শুষ্ক হৃদয় পুড়ছে তাতে অহর্নিশ!

সব অজানা জানার মাঝে প্রেম-দেওয়ানা ফিরনু ভাই,
দুনিয়া জুড়ে দেখনু ঢুঁড়ে দিল্-দরদি বন্ধু নাই।

তারই তরে জান কাঁদে মোর, সেই জানি মোর দিল্-আরাম,
করল যে মোর এই জীবনের সকল সোয়াদ-সুখ হারাম!

গুলবাগে আর দেবদারুকে দেখতে কারুর রয় না সাধ,
দেখলে প্রিয়ার সরল ছাঁদ আর চাঁদনি-সফেদ বদন-চাঁদ!

মাটির ভাঁটির রস ছিল যা, সব পিয়েছিস, কীসের দুখ?
খাও পিয়ো আর স্ফূর্তি চালাও, চালাও – মউজে দিন কাটুক।

দিবানিশি পাস যে ব্যথা, ওরে হাফিজ, দু-দিন থাম!
আসবে প্রিয়া দিল্-জানিয়া, পূর্ণ হবে মনস্কাম!

প্রিয়ার দেওয়া শরাব

কোঁকড়া অলক মূর্ছেছিল ঘাম-ভেজা লাল গাল ছুঁয়ে,
কাঁপছিল, সে যায় যেন বায় ঝাউ-এর কচি ডাল নুয়ে।
কম্পিত তার আকুল অধর-পিষ্ট ক্লেশে সামলে নে
শরাব-ভরা সোরাই হাতে গভীর রাতে নামলে সে।
দরদ-ভিজা মিহিন সুরে গাইল গজল আপশোশের,
চোখ দুটি নীর-সিক্ত যেন ফাগুন-বুকে ছাপ পোষের!
কোন বেদনার কন্টকে গো বুকের বসন দীর্ণতার,
ছিন্ন-তারের সেতার-সম কণ্ঠে বাণী খিন্নতার!
এলিয়ে দেয়ে আমার পাশে ব্যথায় বিবশ ম্লান তনু
কইল ক্লেশে, ‘কান্ত আমার আমার চেয়েও ক্লান্ত, উঃ!’
শঙ্কা-আকুল মুখটি শেষে কানের কাছে চুমিয়ে সে
জিজ্ঞাসিল, ‘আজ কি তবে শ্রান্ত আশেক ঘুমিয়েছে?’
ঘুমিয়ে সে কে রইতে পারে কান্তা এসে ডাক দিলে,
নিঝুম ঘুমে ঘুমন্তেরও মুখ ফোটে যে – বাক মিলে!
কম্পিত বাম হাতটি থুয়ে স্পন্দিত মোর বুকটিতে
শরাব নিয়ে আরেক হাতে কইল চুমুক এক দিতে।
বেহেশতি সে শরাব, না তা আঙুর-গলা রস ছিল,
জিজ্ঞাসি নাই – কানে শুধু মিনতি তার পশছিল।
এমনি বেশে মুক্ত কেশে এমনি নিশুত রাত্তিরে
শরাব নিয়ে এসে প্রিয়া রাখলে বুকে হাত ধীরে;
প্রেমের এমন বেদিল কাফের কে আছে গো বিশ্বে সে
শরাব সোরাই এক নিশেষে পান করে না নিঃশেষে?
ওগো কাজি, কামখা নীরস শাস্ত্রবাণী কও কাকে?
ভাঙতে পারে পিয়ার ঈষৎ চাওয়া লাখো তৌবাকে!

বাঁশির ব্যথা

শোন দেখি মন বাঁশের বাঁশির বুক ব্যেপে কী উঠছে সুর,
সুর তো নয় ও, কাঁদছে যে রে বাঁশরি বিচ্ছেদ-বিধুর॥
কোন অসীমের মায়াতে
সসীম তার এই কায়াতে,
এই যে আমার দেহ-বাঁশি, কান্না সুরে গুমরে তায়,
হায়রে, সে যে সুদূর আমার অচিন-প্রিয়ায় চুমতে চায়।
প্রিয়ায় পাবার ইচ্ছে যে,
উড়ছে সুরের বিচ্ছেদে।

মুক্তি

রানিগঞ্জের অর্জুনপটির বাঁকে
যেখান দিয়ে নিতুই সাঁঝে ঝাঁকে ঝাঁকে
রাজার বাঁধে জল নিতে যায় শহুরে বউ কলস কাঁখে –
সেই সে বাঁকের শেষে
তিন দিক হতে তিনটে রাস্তা এসে
ত্রিবেণির ত্রিধারার মতো গেছে একেই মিশে।
তেমাথার সেই ‘দেখাশুনা’ স্থলে
বিরাট একটা নিম্ব গাছের তলে,
জটওয়ালা সে সন্ন্যাসীদের জটলা বাঁধত সেথা,
গাঁজার ধুঁয়ায় পথের লোকের আঁতে হত ব্যাথা।
বাবাজিদের ‘ধুনি’ দেওয়ার তাপে –
না সে তপের প্রতাপে –
গাছে মোটেই ছিল নাকো পাতা,
উলঙ্গ এক প্রেত সে যেন কঙ্কালসার তুলেছিল মাথা।
ভুলে যাওয়ার সে কোন নিশিভোর,
‘আজান’ যখন শহুরেদের ভাঙলে ঘুমের ঘোর,
অবাক হয়ে দেখলে সবাই চেয়ে,
শুকনো নিমের গাছটা গেছে ফলে-ফুলে ছেয়ে!
বাবাজিরাও তল্পি বেঁধে রাতেই
সটকেছেন সব; বোধ হয় পড়েছিলেন বেজায় কাতেই।

অত ভোরেও হোথা
হট্টগোলের লাগল একটা বিষম জনতা।
কিন্তু দেখে লাগল সবার তাক,
একোন মহাব্যাধিগ্রস্ত অবধূত নির্বাক?
সে কী ভীষণ মূর্তি!
ঈষৎ তার এক চাহনিতে থেমে গেল গোলমাল সব স্ফূর্তি।
জট-পাকানো বিপুল জটা,
মেদিনী-চুম্বিত শ্মশ্রু, গুম্ফগুলো কটা,
সে এক যেন জটিলতার সৃষ্টি –
অনায়াসে সইতে পারে ঝড় ঝঞ্ঝা বৃষ্টি।

পা দুটো তার বেজায় খাটো – বিঘত খানিক মোটে,
দন্ত-প্রাচীর লঙ্ঘি অধর ছুঁতেই পায় না ঠোঁটে,
চক্ষু ডাগর, নাকটা বেজায় খাঁদা,
মস্ত দুটো লোহার শিকল দিয়ে
হাত দুটো তার সব সময়ই বাঁধা,
ভাষাটা তার এতই বাধো-বাধো,
কইলে কথা বোঝাই যায় না আদৌ।
ও পথ বেয়ে যেতে
দুষ্টু ছেলে যা-তা দেয় খেতে,
ফকিরও সে এমনই সোজা নেবেই তা মুখ পেতে
বিষ হোক চাই অমৃত হোক।
দেখে অবাক লোক!
শহরে সে কতই কানাঘুষি, –
কেউ বলে, ‘চাঁদ তল্পি বাঁধো, তুমি শুধুই ভুসি।‘
কেউ বলে, ‘ভাই, কাজ কী বকাবকির?
হতেও পারে জবরদস্ত ফকির!’
এই রকম নানান কথা বলে যার যা খুশি!
মৌন ফকির হাসে মুচকি হাসি।

* * *

দেখতে দেখতে এমনি করে
নিম গাছটার দুবার পাতা গেল ঝরে।
ফকির তেমনি থাকে, –
হঠাৎ সেদিন সেই পথেরই বাঁকে
নিশি – ভোরেই
বোঝাই গোরুর গাড়ি হেঁকে যাচ্ছিল খুব জোরেই
খোট্টা গাড়োয়ান
ভৈরবীতে গেয়ে গজল-গান।
‘হোহো’ করে হঠাৎ ফকির উঠল বিষম হেসে।
গাড়ি-সুদ্ধ দামড়া বলদ চমকে উঠে এসে
পড়ল হঠাৎ ফকিরেরই ঘাড়ে,
চাকা দুটো চলে গেল একেবারে বুকের হাড়ে,
মড়মড়িয়ে উঠল পাঁজর যত! –
গাড়োয়ান তো বুদ্ধিহত
খ্যাপার মতো ছুটোছুটি করছে থতমত!
পুলিশ ছিল কাছেই
গাড়োয়ানেরে ধরে বাঁধলে ওই নিম্ব গাছেই।
লাগল হুড়োহুড়ি –
তেমন ভোরেও লোক জমল সারাটা পথ জুড়ি।
রক্তাক্ত সে চূর্ণ বক্ষে বদ্ধ দুটি হাত
থুয়ে ফকির পড়ছে শুধু কোরানের আয়াত,
হয়নি মুখে আদৌ ব্যাথার কোমল কিরণ-পাত,
স্নিগ্ধ দীপ্তি সে কোন জ্যোতির আলোয়
ফেললে ছেয়ে বাইরের সব কুৎসিত আর কালোয়,
সে কোন দেশের আনন্দ-গীত বাজল তারই কানে,
সেই-ই জানে, –
শিশুর মতো উঠল হেসে চেয়ে শূন্য পানে।
ধ্যানমগ্ন ফকির হঠাৎ চমকে উঠে চায়,
কুণ্ঠিত সে গাড়িওয়ালা গাছে বাঁধা, হায়!
প্রহার-ক্ষতে রক্ত বয়ে যায়!
আকুল কণ্ঠে উঠল ফকির কেঁদে, –
ও গো, আমার মুক্তিদাতায় কে রেখেছে বেঁধে?
এ কোন জনার ফন্দি, –
বাঁধন যে মোর খুলে দিলে তায় করেছে বন্দি?
ভোরের সারা আকাশ-আলো ব্যেপে
উঠল কেঁপে কেঁপে
দরবেশের সে ব্যাকুল বাণী অমৃত-নিষ্যন্দী!
চিরবদ্ধ হাতের শিকল অমনি গেল খুলে,
ঝুলি হতে দশটি টাকা তুলে
লাল-পাগড়ির হাতে গুঁজে বললে, ‘শুনো ভাই,
কোনো দোষ এর নাই,
নির্দোষ এ অবোধ গাড়োয়ান,
এ মলে যে মরবে সাথে তিনটি ছোট্ট জান!’
নিমের ডালে হাজার পাখি উঠল গেয়ে গান!
পায়ে ধরে কেঁদে পুলিশ কয়,
‘এও কখনও হয়?
ও গো সাধু, অর্থ-লালসায়
আমি শুধু হব কি আজ বঞ্চিত দয়ায়?
তা হবে না কভু,
পরশমণির বিনিময়ে পাথর নেব প্রভু?’
বুক বেয়ে তার ঝরে অশ্রুনীর –
দু-হাত ধরে তুলে তায় ফকির
বলে, ‘বাবা, মোছ এ অশ্রুলোর,
মুক্তি হবে তোর।
ওই যে মুদ্রাগুলি
গাড়োয়ানে দে তুলি!’ –
নিম্ব গাছের সকল পাতা
ঝরঝরিয়ে পড়ল ঝরে – আর হল না কথা।

 সুন্দরী

সুন্দরী গো সুন্দরী!
ঘরটি তোমার কোন-দোরি?
সুন্দরী গো সুন্দরী!

কোন সে পথের বাঁকটিতে
কলসি নিয়ে কাঁখটিতে,
থমকে যাও আর চমকে চাও
দুলিয়ে বাহু কুন্দরি?
সুন্দরী গো সুন্দরী!

কুঞ্জি কই সে কুঞ্জরী –
যার হিয়াটি চঞ্চলে
আকুল তোমার অঞ্চলে?
সাতনরি আর পাঁচনরি হার
কোন পথে যায় গুঞ্জরি?
সুন্দরী গো সুন্দরী!

কোন মন ওঠে মু্ঞ্জরি –
কেশের তোমার সৌরভে,
পরশ পাওয়ার গৌরবে?
তূণ ভরি ভ্রু-র গুণ ধরি
করছ শিকার কোন পরি?
সুন্দরী গো সুন্দরী!

কোথায় সে বাও কোন তরি?
উত্তরীয় সঞ্চারি
করছে হওয়ার মন চুরি,
অপ্সরি আর হুরপরি
চলছে তরির গুণ ধরি,
সুন্দরী গো সুন্দরী!

শাড়ির পাড়ে কোন জরি?
কর্ণে দোদুল দুল দুলে,
গাল দেখে পারুল ভুলে,
চুমচে ছলে বুলবুলে গো
মুখ ভুলে ফুলপুঞ্জরি।
সুন্দরী গো সুন্দরী!

ভার কেন আজ মন তোরই?
কিন্নরী ও হুরপরি
তুল্য তোমার কোন গোরী?
কোন জনে দেয় মন-বেদন এ –
খায় কাঁচা খুন ঘুণ ধরি?
সুন্দরী গো সুন্দরী!

করল সে কে মন চুরি?
মনটি তোমার উন্মনা,
মন-চোরা সে কোন জনা?
আপশোশ উঁহু! আর নেই আঁশু!
উঠছে আঁখে খুন ভরি!
আর কেঁদো না সুন্দরী!
সুন্দরী গো সুন্দরী
ঘর তোমার ভাই কোন দোরি?

Exit mobile version