মোর পাত্র মদ্য-রোশনায়ে কর রৌশন এয়্ সাকি! গাও বান্দা , “মোদের পুরবে সব আশ দুন্য়া নয় ফাঁকি!” মদ- পাত্রে মোর আজ বিম্বিত ছবি প্রিয়ার চাঁদ মুখের, শোন বঞ্চিত যত হরদমই মদ-টানার স্বাদ সুখের! ঝাউ ছিপছিপে তন-নাঙ্গীদে ‘নাজ নখরা’ সব ফুরোয়, ক্ষীণ দেবদারু-তনু মরালী পিয়ার যেই হয় অভ্যুদয়। সে যে মৃত্যুঞ্জয়ী শাশ্বত চির-জাগ্রত প্রেম যার; অবি- নশ্বর মম নাম তাই দোলে কাল-বুকে হেম-হার। মোর “দিল্রুবা” পিয়ার আঁখিয়ার বড়ো মিঠি দিঠি আধ-ঘোর, তাই চাউনির ওরই হাতে সঁপা মোর বাসনার বাগ-ডোর । রোজ কিয়ামতে ভাই, জিতবে না, - আহা, দুঃখে গাল খুঁটি! মোর হারাম মদকে ভণ্ড শেখের হালাল দাল-রুটি। কভু বন্ধুদের সে ফুলবাগে যদি যাও দখিন হাওয়া; মোর কান্তারও কাছে এই কথাটুকু জরুর চাই যাওয়া; বলো প্রিয়তম! স্মৃতি জোর করে ছি ছি ভোলা কি কখনও যায়? ওগো আপনি সেদিনও আসিবে, আর না দেখিবে স্বপ্ন তায়! ওই পাতলা ছুঁড়িরই প্রেম দাগ বুকে ‘লালা’ –ফুল-সম চিন্; মম জালে ধরা দেবে মিলন-বিহগ – বাকি আর কতদিন? ওই সব্জা দরিয়া আশমানের, আর চাঁদের নৌকা সেই, সব ডুব গিয়া ভায়া ‘কওয়াম হাজি’ র মাল এ মদ গ্লাসেই! ফেল অশ্রুবিন্দু – শস্য-কণিকা হাফিজ কাঁদ রে কাঁদ, ওরে মিলন-পক্ষী হয়তো লক্ষ করবে তা হলে ফাঁদ!
———————–
ছন্দসূত্র :–
সা কি ব-নুরে বা-দা বর্-অফ্ রোজে জা-ম্ এমা
মোর পাত্র মদ্য–রোশনায়ে কর রৌশন এয় সা – কি !
গজল ৫
কোথায় সুবোধ সংযমী, তার তুল্ এ-মাতাল অপাত্রে ছাই!
তাদের ফথ আর আমার এ-পথ বহুত বহুত তফাত যে ভাই!
ধরম শরম? চুলোয় সে যাক! প্রেম-শিরাজির প্রেমিক এ-জন,
নীতির নীরস ঠোঁট চেপে শোন রবাব -বীণের ঝিঁঝিট-বেদন?
মসজিদে গে শিখনু পরা ফেরেববাজির কুর্তি কালো;
ভাই রে, আমার আতশ -পূজা শরাব-শিরীর স্ফূর্তি ভালো।
মিলন-চুমুর শিরীন স্মৃতি আবছায়া তাও হয় না মনে!
হায় কোথা সেই জাদুর মায়া, মান করে জল নয়না-কোণে?
দোস্তের অরূপ রূপ-দরিয়ায় দুশমনে ছাই পায় না রতন,
রবির শিখায় স্তিমিত প্রদীপ জ্বালতে সে ছাই খাম্খা যতন!
সেবের মতন স-টোল চিবুক-কূপটি প্রিয়ার রাস্তাতে না?
আশেক পথিক, সামলে চলিস! আস্তে! পড়েই যাস তাতে বা!
সুরমা আঁখির অঞ্জন আমার, পিতম, তোমার চরণ-রেণু,
এই মদিনা-মক্কা, হেথাই বাজবে আমার মরণ-বেণু!
আশ্ কোরো না বন্ধু আমার, হাফিজ হতে চুম-ভরা ঘুম,
শান্তি কী চিজ? আরাম কোথায়? কলজেতে মোর জ্বলছে আগুন।
গজল ৬
যদিই কান্তা শিরাজ সজ্নি ফেরত দেয় মোর চোরাই দিল্ ফের,
সমরখন্দ আর বোখারায় দিই বদল তার লাল গালের তিল্টের!
লে আও সাকি, শরাব শেষটুক! কোথাও নাই ভাই, বেহেশতেও সে,
নহর , ‘রোকনা-আবাদ’ -তীর আর এমন ঈদগাহ, এদেশ সেও সে।
বাঁচাও বন্ধু! নিলাজ চঞ্চল চটুল চুলবুল প্রিয়ার মুখচোখ,
তুর্কি সৈন্যের ‘লুটের খাঞ্চা’র মতোই বিলকুল লুটলে সুখ-লোক!
অপূর্ণই মোর এশ্ক্-গুলবাগ তাতেই মশগুল ভোমর চঞ্চল,
হুর যে চায় না স-টোল লাল গাল, হরিণ চোখ, মুখ কোমল ঢলঢল।
আগেই জানতাম, ব্যাকুল-দিন-দিন আকুল-যৌবন হাসিন ‘ইউসফ’ –
প্রেমের টান তার নাশবে হরবে ‘জুলায়খা’র সব নারীর গৌরব।
চলুক সেহলির শরাব-সংগীত, কালের কুঞ্জি নাই তলাশ তার,
না-হক কসরত গ্রন্থি খুলবার রহস্যের এই রশি ফাঁসটার!
নীতির গীত শোন পিতম চঞ্চল! শান্ত সুন্দর তারই ঠিক প্রাণ,
জ্ঞানের বৃদ্ধের নীতির বশ যে, সৎ কোথায় যার প্রাণ-অধিক জ্ঞান।
মন্দ কও? আহ্ তাতেই জান্ তর্ ! আবার গাল দাও হে মোর লক্ষ্মী;
গাল তো নয় ও, মিষ্টি শরবত ঢালছে পান্নার শিরীন ঠোঁটটি!
গজল-গীত নয়, মুক্তো গাঁথছিস, হাফিজ আয়, ফের মধুর তান ধর!
তারার লাখ হার ছুড়বে বারবার অধীর আশমান শুনলে গান তোর।
—————–
ছন্দসূত্র :–
আগন আঁ তুর কে শিরাজি বদসত আ-রদ দিলে মারা।
যদিই কান্তা শিরাজ সজ্নি ফেরত দেয় মোর চোরাই দিল্ ফের।
গজল ৭
ত্যজি মসজিদ কাল মুর্শিদ মম আস্তানা নিল মদশালা,
নেবে কোন পথ এবে পথ-রথ ওগো সুহৃদ সখী পথ-বালা!
আমি মুসাফির যত শারাবির ওই খারাবির পথ মঞ্জিলে,
সখীমাফ চাই, বিধি এই রায় ভালে লিখেছিল আমি জন্মিলে।
‘কাবা শরিফের’ পানে করি ফের মুখ কোন বলে আমি কও সখী,
পির শারাবের পথ-মদরত যবে, আন-পথে যাবে শিষ্য কি?
জ্ঞান বোঝে যদি কেন বাঁধি হৃদি পিয়া-কুন্তল-ফাঁদে সেধে সেধে,
যত জ্ঞানী পির ওই জিঞ্জির লাগি দিওয়ানা হবে গো কেঁদে কেঁদে।
মম ঠোঁটে ওগো বধূ ‘আয়েত’ -মধু যে ঢালে তব ও-মুখ ‘কোরআনে’,
তাই সুধা আর সীধু ফেটে পড়ে শুধু কবিতাতে আর মোর গানে।
মম অগ্নি-বর্ষী ‘আহা’-শ্বাস আর একা-রাতে-জাগা কাতরানি,
তব মর্মর-মোড়া মর্মে কি দিল ব্যথা আঁকি কোনো রাত-রানি!
মন- ময়ূরীর লাগি ‘বিরহ’-ভুজগী ফেঁসেছিল ভালো কেশ-জালে,
কেন খুলে দিয়ে বেণি ‘বিচ্ছেদ’-ফণী ছেড়ে দিলে প্রিয়া শেষ-কালে!
তব এলোচুলে বায়ু গেল বুলে মম আলো নিভে গেল আঁধিয়ারে,
ওই কালোকেশে আমি ভালোবেসে শেষে দেশে দেশে ফিরি কাঁদিয়া রে!
মোর বুক-ফাটা ‘উহু’-চিৎকার-বাণ চক্কর মারে নভ চিরে,
দেখো হুশিয়ার মম প্রিয়তম, তির-বাজপাখি উড়ে তব শিরে!
মোর জ্ঞানী পির আজ খারাবির পথে, এসো মোর সাথি পথ-বালা,
ওই হাফিজের মতো আমাদেরও পথ প্রেম-শিরাজিরই মদশালা।
গজল ৮
বুক-ব্যথানো বেণুর বেদন বাজিয়েছিল কাল রাতে
বনশিওয়ালা – আল্লাতালা রাখুন তারে আহ্লাদে!
করলে আমায় ক্লান্ত এতই তার সে মুরজ মুরঝা সুর –
বোধ হল মোর বিশ্ব-নিখিল কেবল কান্না-বেদনাতুর!
পার্শ্বে ছিল ছুকরি সাকি ঠোঁট-কূপে যার ‘আব-হায়াত’
মুখ আলো আর কেশ কালো যার খেলায় সদাই দিন ও রাত।
বিহ্বল আমার তৃষ্ণা দেখে পাত্রে আরও ঢালল মদ,
মদ-মদালস কইনু আমি চুম্বি সাকির পুণ্য পদ –
“মুক্তি দিলে আমার ‘অহম’-দুঃখ থেকে আজ তুমি,
মদ ঢেলে যেই করলে অধর কাচ-পেয়ালার নাচ-ভূমি।
আল্লা তোমায় আগলে রাখুন আলাই-বালাই আপনি নে,
সাকি! তোমার সর্বলোকে কল্যাণ হোক সব দিনে।”
হাফিজ যখন আপন-হারা কোথায় বা তোর ‘কায়কাউস’,
কায়কোবাদের কুল-মুলুক? এক তিল বরাবর তখত্তাউস।
গজল ৯
জাগো সাকি হামদরদি, জাম-বাটিতে দাও শরাব,
চুলোয় যাক এই দুঃখ-ব্যথা, ধুলোয় ঢাকুক সব অভাব!
ভর পিয়ালা হস্তে দে দোস্ত, মস্ত হয়ে বুঁদ সেই নেশায়
দিই ফেলে এই শির হতে ওই সুনীল আকাশ-গাঁঠরিটায়!
ভয় কী সখি? করবে নিন্দা শাস্ত্র-শকুন বন্ধুরা?
বদনামে মোর পরোয়া থোড়াই! চালাও পানসি, দাও সুরা।
নেশার দারু জরুরি ভাই, খোদ-দেমাকির নাশতে জাত,
ঢালো শরাব, আত্ম ভোলাও, চেতন আমার হোক নিপাত!
দহন-দারুণ দিল্ ছেপে মোর উঠছে যে শ্বাস বহ্নি-শিস,
কতই কাঁচা শুষ্ক হৃদয় পুড়ছে তাতে অহর্নিশ!
সব অজানা জানার মাঝে প্রেম-দেওয়ানা ফিরনু ভাই,
দুনিয়া জুড়ে দেখনু ঢুঁড়ে দিল্-দরদি বন্ধু নাই।
তারই তরে জান কাঁদে মোর, সেই জানি মোর দিল্-আরাম,
করল যে মোর এই জীবনের সকল সোয়াদ-সুখ হারাম!
গুলবাগে আর দেবদারুকে দেখতে কারুর রয় না সাধ,
দেখলে প্রিয়ার সরল ছাঁদ আর চাঁদনি-সফেদ বদন-চাঁদ!
মাটির ভাঁটির রস ছিল যা, সব পিয়েছিস, কীসের দুখ?
খাও পিয়ো আর স্ফূর্তি চালাও, চালাও – মউজে দিন কাটুক।
দিবানিশি পাস যে ব্যথা, ওরে হাফিজ, দু-দিন থাম!
আসবে প্রিয়া দিল্-জানিয়া, পূর্ণ হবে মনস্কাম!