তুমি কি গিয়াছ ভুলে
তুমি কি গিয়াছ ভুলে? –
তোমার চরণ-স্মরণ-চিহ্ন আজও মোর নদীকূলে
মুছিল না প্রিয়, মুছিল না তার বুকে যে লিখিলে লেখা!
মাঝে বহে স্রোত, দু-কূল জুড়িয়া চরণ-স্মরণ-রেখা।
বন্যার ঢল, জোয়ার, উজান আসে যায় ফিরে ফিরে,
ও চরণ-লেখা মুছিল না মোর বালুচরে নদীতীরে!
ঊর্ধ্বে ধূসর সান্ধ্য আকাশে ক্ষীণ চন্দ্রের লেখা,
নিম্নে আমার শুনো বালুচরে তোমার চরণ-রেখা।
কূলে আসি একা বসি,
তব মুখ-মদ-গন্ধের ফুলবন ওঠে নিশ্বসি।
কূলে একা বসি ঢেউ গণি আর চাহি ওপারের তীরে –
প্রভাতে যে পাখি উড়িল সে সাঁঝে ফিরিল না আর নীড়ে।
এই বালুচর শূন্য ধূসর আমার এ মরুভূমি
কেন এ শূন্যে চরণ-চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলে তুমি?
হেরিনু, আকাশে ওঠেনিকো চাঁদ – শূন্য আকাশ কাঁদে,
ও বিরাট বুক ভরিয়া তোলে কি ওইটুকু ক্ষীণ চাঁদে?
চলে-যাওয়া দিনগুলি
মনের মানিক-মঞ্জুষা হতে খুলে দেখি, রাখি তুলি।
কতবার আসি ফিরে যাই বেয়ে তোমার দেশের নদী,
কত বধূ আসে জল নিতে সেথা তুমি সেথা আস যদি।
তোমার কলসি-হিল্লোল যদি মোর নায়ে এসে লাগে
দুটি চেনা চোখ সন্ধ্যা-দীপের মতো যদি সেথা জাগে!….
কতদিন সাঁঝে হইয়াছে মনে, তোমারে বা দেখিয়াছে,
তরণিতে কার চেনা বাঁশি শুনে আসিয়াছ কাছাকাছি।
আঁচল ভরিয়া জলে-ভেজা রাঙা হিজলের ফুলগুলি
কুড়াতে তোমার ঘোমটা খসেছে, এলোখোঁপা গেছে খুলি!
সর্পিল বাঁকা বেণি,
ওর সাথে ছিল মোর আঙুলের কতই না চেনাচেনি!
ওই সে বেণির বিনুনিতে মোর বাঁধা পড়েছিল হিয়া,
কতদিন তারে ছাড়াতে চেয়েছে আমার আঙুল দিয়া! –
দাঁড়ায়েছ আসি, সোনাগোধূলিতে আকাশ গিয়াছে ভরে,
পিছনের কালো-বেণিতে সন্ধ্যা বাঁধা পড়ে কেঁদে মরে!
বাঁশিতে কাঁদিয়া ফিরিয়া এসেছি তরণি বাহিয়া দূরে,
আমার নিশাসে নাহি নেভে যেন প্রদীপ তোমার পুরে।….
ছল করে যবে জল নিতে যাও – নদী-তরঙ্গে হায়!
তরঙ্গ কি গো দুলে ওঠে মনে, কলসি ভাসিয়া যায়?
নয়নের নীরে তুমি ডোব, ডোবে কলসি নদীর জলে?
অথবা কাঁখের কলসিই শুধু ডুবাতে শিখেছ ছলে?
যত চাই সব ভুলি,
আঁধার ভরিয়া ডাকে আঙনের তব ঝাউগাছগুলি।
তব অঙ্গুলি-ইঙ্গিত যেন ওদের শীর্ণ শাখা,
হাহাকার করে আকাশে চাহিয়া, বাতাসে ঝাপটে পাখা!
ভুলিবার কথা ভুলে যাই, হায় বন্দিনি মোর পাখি,
পিঞ্জর-পাশে আসি যাই ফিরে, আকাশে থাকিয়া ডাকি!
ফিরে আসি একা নীড়ে,
ক্লান্ত পক্ষ বসে বসে ভাবি ভাঙা মোর তরু-শিরে।
দশ দিক ভরে কলরব করে অচেনারা ছুটে আসে,
তুমি নাই তাই ঘিরিয়া সবাই বসে মোর আশে-পাশে।
না চাহিতে কেহ পাখায় আমার বাঁধে অসহায় পাখা,
তৃষিত অধরে নিয়ে যায় ভরে বেদনার বিষ মাখা।
আজ আমি অপরাধী,
অভিমান-জ্বালা নিবারিত নিতি অপরাধ করি – কাঁদি!
যে আসে এ বুকে তাহারই হৃদয়ে তোমার হৃদয় খুঁজি,
খুঁজিতে খুঁজিতে হারায়ে ফেলেছি মোর হৃদয়ের পুঁজি।
শূন্য আকাশে ওঠেনাকো চাঁদ, উল্কারা আসে ছুটে,
আগুনের তৃষা মিটাই তাদের অগ্নি-অধর-পুটে!
তুমি যাও নাই ভুলে?
মম পথ পানে চাহ কি আজিও সন্ধ্যা-প্রদীপ তুলে?
নিবাও নিবাও ও সন্ধ্যা-দীপ, চাহিয়ো না মোর পথে,
মরণের রথে উঠেছে, উঠিত যে তব সোনার রথে।
কুসুমের মালা দু-দিনে শুকায়, থাক অতীতের স্মৃতি –
শুকাবে না যাহা – আমার গাঁথা এ কাঁটার কথার গীতি!
দীওয়ান–ই–হাফিজ
গজল ১
হাঁ, এয় সাকি , শরাব ভর্ লাও বোলাও পেয়ালী চালাও হর্দম্!
প্রথম প্রেম-পথ সহজ-সুন্দর, শেষের দিক তা-র ঢালাও-কর্দম!
কসম তার ভাই ভোরের বায় ভায় অলক-গুচ্ছের যে-বাস কান্তার,
বহুত দিল্ খুন করলে কুন্তল কপোল-চুম্বী চপল ফাঁদদার।
যদিই ক-ন তোর সাগ্নিক ওই পির মুসল্লায় কর শরাব-রঙ্গিন,
পথেই রথ যার অচিন নয় তার কোথায় পথ-ঘাট খারাব সঙ্গিন
আরাম সুখ মোর হারাম বিলকুল পথের মঞ্জিল পিয়ার মুল্কের,
নকিব হরদম হাঁকায় হাম্দম্ – পথিক! দূরপথ গাঁঠারি তুল্ ফের!
অন্ধকার রাত, ঊর্মি-সংঘাত, ঘূর্ণাবর্তও তুমুল গর্জে,
বেলায় বাস যার বুঝবে ছাই তার পথের ক্লেশ মোর সমুন্দর যে!
তামাম মোর কাম শুধুই বদনাম, নিজের দোষ ভাই নিজের দোষ সে,
গোপন দূর ছাই রয় কি নাম তার রাজ-সভায় যার চর্চা জোর-সে।
প্রসাদ চাস? বাস, গাফিল হোসনে হাফিজ হরদম হাজির-মজলিস!
এ সব তঞ্চট ঝক্কি-ঝঞ্ঝট ছোড়্ দে, তারপর পিয়ার খোঁজ নিস।
—————
ছন্দসূত্র :–
“আলাইয়্যা আইয়োহাস্ সাকি আদির্ কা-সা ওয়ানা বিল্হা!”
হাঁ, এয়্ সাকি শরাব ভর্ লাও বোলাও পেয়ালী চালাও হরদম্।”
গজল ২
হে মোর সুন্দর! চাঁদের চাঁদমুখ তোমার রৌশন রূপ মেখেই,
রূপের জৌলুস তোমার টোলদার চিবুক-গন্ডের কূপ থেকেই।
ওষ্ঠে প্রাণ! হায়, দেখতে চাও তায় গোল-বদন ওই ঘোমটা-হীন,
জানাও ফরমান জ্বলবে আর না নিববে জান্টার মোমটা ক্ষীণ!
তোমার কেশপাশ আমার দিল্ বাস – জমবে জোট সেই এক জা-গায়, –
আরজ এই ক্ষীণ মিটবে কোন দিন? আর না বিচ্ছেদ – দেক লাগায়!
নার্গিস-অক্ষি! হরলে সব সুখ তোমার নয়নার অত্যাচার
মস্ত্ চাউনির হস্তে তাই কই যাক সতীত্বও হত্যা ছার!
খুলবে এইবার নয়ন-পাত তার বদ-নসিব মোর নিঁদ-আতুর,
আজ যে প্যারির উজ্লি স্মিরতি-য় আনলে নির্ঝর ক্ষীণ আঁসুর!
পাঠিয়ো ভোর বায় ফুল্ল ফুল তুল তোমার গণ্ডের ফুল-তোড়া!
যদিই পাই তায় তোমার বোঁস্তার খোশবুদা খাক ধুল থোড়া!
দে খবর দিল্-দার পিয়ায় সই বক্ষে আজ মোর জোর ব্যথা,
মাথার দিব্যি রইল সই লো, জরুর কস তায় মোর কথা!
জামশেদের দর্-বারের সাকি! বাড়ুক পরমাই মদ্য-পিয়ো!
তোমার হস্তে এ-মদের ভাঁড় মোর পুরল নাই ভাই যদ্যপিও!
‘য়্যাজদ্’ মুল্কের বাসিন্দায় সব বলবে, বন্ধু ভোর-সমীর!
ভরুক ময়দান লুটাক পায়-পায় অকৃতজ্ঞের খণ্ড শির!
“বহুত দূর পথ বহুত বিচ্ছেদ স্মৃতির ভুল হায় হয়নি তায়,
তাদের বাদশার গোলাম আজকেও তাদের খোশনাম কয় সদাই।”
চলতে মোর পথ সামলো প্যারি, আঁচর, খাক আর খুন হতে;
তোমার এশ্কের নিরাশ খুন-দিল্ লোহুয় পথ এ পূর্ণ যে!
এয়্ শাহানশা্হ! ওয়াস্তে আল্লার শক্তি দাও এই, অহর্নিশ্-
আশমানের ন্যায় চুম্বি অমনি তোমার খাস রং-মহল শীষ!
আশিস চায় এই ‘হাফিজ’ হরদম, কও ‘আমিন’ সব খুব মনে –
“লাল শিরীন ঠোঁট পিয়ার রোজ পাই, ভরাই লাখ লাখ চুম্বনে!”
——————–
ছন্দসূত্র :–
এয়্ ফরোগে মাহে হোসন আজ রূয়ে রোখ্শা নে শুমা
আবরূয়ে খূবি আজ চা- হো জনখদা নে শুমা।
গজল ৩
হাত হতে মোর হৃদয় যায় দোহাই বাঁচাও হৃদয়-বান!
আপশোশ! আমার গোপন সব ফসকে যে দেয় নিদয় প্রাণ।
দশ দিনের এই দুন্য়া ভাই, স্বপ্ন-কুহক কল্পলোক;
করতে ভালোই বন্ধুদের, বন্ধু, তোমার লক্ষ্য হোক!
বও অনুখূল বায়, এ নাও ভগ্ন, মনেও শ্রান্তি, হায়!
হয় তো দু-বার দেখব ফের সেই হারা মোর প্রাণ-প্রিয়ায়।
শরাব-সভায় কুঞ্জে আজ বুলবুলি বাঃ বোল বিলায় –
লাও প্রভাতের মদের ভাঁড়, মস্তানা সব জলদি আয়!
হাজার লাখ হে মহান-প্রাণ, সালাম সালাম ধন্যবাদ!
দরবেশ এ দীন একটি দিন প্রসাদ চায়, নাই অন্য সাধ।
‘দুই দুনিয়ার আরাম’ সব ব্যাখ্যা ভাই এই এক কথায়, –
দোস্তে মধুর স্নিগ্ধ ভাষ, শত্রু যে – দাও বক্ষ তায়।
সুনাম সুযশ লাভের পথ করলে হারাম , হে দুর্বোধ!
মন্দ বোধ হয় কু-নাম আজ? বদলে দাও, বাস এ দূর পথ।
জমশেদের এই মদের গ্লাস সিকান্দারের আয়না ভাই;
দারার দেশের সকল হাল ওই হের বাঃ, ভায় না তায়?
শির ঝোঁকা, নয় মোমের ন্যায় জ্বালবে – সে কি শরম কম? –
ওই পিয়া যার – পরশ ঘায় কঠিন শিলা ও নরম মোম।
বন্ধু দে সব বৈতালিক গায় যদি এই ফারসি-গীত
সন্ন্যাসী পির ভাব-মোহিত নাচবে; এ-গান সার-নিহিত।
ওই খাঁটি মদ – সুফির দল পাপের মা কয়? – আ দুত্তোর!
আইবুড়ো সব ছুকরিদের ঠোঁট-চুমোরও মধুরতর!
হাতখালি? বাস, আয়াস কর আয়েস করার, শেখ সুখেও;
পরশ-পাথর মত্ততার ‘কারুন’ বানায় ভিক্ষুকেও।
পর্মায়ু দেয় মুমুর্ষুরে ফারেস দেশের দিল্-পিয়ায়,
এয়্ সাকি, এই খোশখবর জ্ঞান-বুড়োদের বলবি ভাই!
খাম্খা হাফিজ দেয়নি গা-য় শরাব-রঙিন কুর্তি এই,
আলখেলা পাক গায় হে শেখ! লাচার, সব এই ফুর্তিতেই!
———————
ছন্দসূত্র :–
“দিল্ নি রওদ যে দস্তম সাহিব দিলাঁ খোদা রা”
হাত হতে মোর হৃদয় যায় দোহাই বাঁচাও হৃদয়-বান্ !
গজল ৪