খোশ আমদেদ
আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি।
ও চরণ ছুঁই কেমন হাতে মোর মাখা যে কালি॥
দখিনের হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতি
শবে-রাত আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥
তালিবান ঝুমকি বাজায়, গায় মোবারক-বাদ৪ কোয়েলা।
উলসি উপচে পলো পলাশ অশোক ডালের ওই ডালি॥
প্রাচীন ওই বটের ঝুরির দোলনাতে হায় দুলিছে শিশু।
ভাঙা ওই দেউল-চূড়ে উঠল বুঝি নৌ-চাঁদের ফালি॥
এল কি অলখ-আকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ।
এল কি আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েস গাজ্জালি৫॥
সানাইয়াঁ ভয়রোঁ বাজায়, নিদ-মহলায় জাগল শাহজাদি।
কারুণের রুপার পুরে নূপুর-পায়ে আসল রূপ-ওয়ালি।
খুশির এ বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরীঁ।
লাল এ লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি॥
বাসি ফুল কুড়িয়ে মালা না-ই গাঁথিলি, রে ফুল-মালি!
নবীনের আসার পথে উজাড় করে দে ফুল ডালি॥
পদ্মা
২৭.২.২৭
জীবন
জাগরণের লাগল ছোঁয়াচ মাঠে মাঠে তেপান্তরে,
এমন বাদল ব্যর্থ হবে তন্দ্রাকাতর কাহার ঘরে?
তড়িৎ ত্বরা দেয় ইশারা, বজ্র হেঁকে যায় দরজায়,
জাগে আকাশ, জাগে ধরা−ধরার মানুষ কে সে ঘুমায়?
মাটির নীচে পায়ের তলায় সেদিন যারা ছিল মরি,
শ্যামল তৃণাঙ্কুরে তারা উঠল বেঁচে নতুন করি;
সবুজ ধরা দেখছে স্বপন আসবে কখন ফাগুন-হোলি,
বজ্রাঘাতে ফুটল না যে, ফুটবে আনন্দে সে কলি!
নওরোজ
রূপেরে সওদা কে করিবি তোরা আয় রে আয়,
নওরোজের এই মেলায়!
ডামাডোল আজি চাঁদের হাট
লুট হল রূপ হল লোপাট!
খুলে ফেলে লাজ শরম-টাট
রূপসিরা সব রূপ বিলায়
বিনি-কিম্মতে হাসি-ইঙ্গিতে হেলাফেলায়
নওরোজের এই মেলায়!
শা-জাদা উজির নওয়াব-জাদারা – রূপকুমার
এই মেলার খরিদ-দার!
নও-জোয়ানীর জহুরি ঢের
খুঁজিছে বিপণি জহরতের,
জহরত নিতে – টেড়া আঁখের
জহর কিনিছে নির্বিকার!
বাহানা করিয়া ছোঁয় গো পিরান জাহানারার
নওরোজের রূপকুমার!
ফিরি করে ফেরে শা-জাদি বিবি ও বেগম সাব
চাঁদ-মুখের নাই নেকাব?
শূন্য দোকানে পসারিনি
কে জানে কী করে বিকি-কিনি!
চুড়ি-কঙ্কণে রিনিঠিনি
কাঁদিছে কোমল কড়ি রেখাব।
অধরে অধরে দর-কষাকষি–নাই হিসাব!
হেম-কপোল লাল গোলাব।
হেরেম-বাঁদিরা দেরেম১ ফেলিয়া মাগিছে দিল,
নওরোজের নও-মফিল!
সাহেব গোলাম, খুনি আশেক,
বিবি বাঁদি, –সব আজিকে এক!
চোখে চোখে পেশ দাখিলা চেক
দিলে দিলে মিল এক সামিল।
বে-পরওয়া আজ বিলায় বাগিচা ফুল-তবিল!
নওরোজের নও-মফিল!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ মিঠি শরবত ঢাল উপুড়,
রণ-ঝনায় পায় নূপুর।
কিসমিস-ছেঁচা আজ অধর,
আজিকে আলাপ ‘মোখতসর’!
কার পায়ে পড়ে কার চাদর,
কাহারে জড়ায় কার কেয়ূর,
প্রলাপ বকে গো কলাপ মেলিয়া মন-ময়ূর,
আজ দিলের নাই সবুর।
আঁখির নিক্তি করিছে ওজন প্রেম দেদার
ভার কাহারা অশ্রু-হার।
চোখে চোখে আজ চেনাচেনি,
বিনি মূলে আজ কেনাকেনি,
নিকাশ করিয়া লেনাদেনি
‘ফাজিল কিছুতে কমে না আর!
পানের বদলে মুন্না মাগিছে পান্না-হার!
দিল সবার ‘বে-কারার৩!
সাধ করে আজ বরবাদ করে দিল সবাই
নিমখুন কেউ কেউ জবাই!
লিকপিক করে ক্ষীণ কাঁকাল,
পেশোয়াজ কাঁপে টালমাটাল,
গুরু ঊরু-ভারে তনু নাকাল,
টলমল আঁখি জল-বোঝাই!
হাফিজ উমর শিরাজ পালায়ে লেখে ‘রুবাই’!
নিমখুন কেউ কেউ জবাই!
শিরী লায়লিরে খোঁজ ফরহাদ খোঁজে কায়েস
নওরোজের এই সে দেশ!
ঢুড়েঁ ফেরে হেথা যুবা সেলিম
নূরজাহানের দূর সাকিম,
আরংজিব আজ হইয়া ঝিম
হিয়ায় হিয়ায় চাহে আয়েস!
তখ্ত-তাউস কোহিনূর কারও নাই খায়েশ,
নওরোজের এই সে দেশ!
গুলে-বকৌলি ঊর্বশীর এ চাঁদনি-চক,
চাও হেথায় রূপ নিছক।
শারাব সাকি ও রঙে রূপে
আতর লোবান ধুনা ধূপে
সয়লাব সব যাক ডুবে,
আঁখি-তারা হোক নিষ্পলক।
চাঁদো মুখে আঁকো কালো কলঙ্ক তিল-তিলক।
চাও হেথায় রূপ নিছক!
হাসিস-নেশায় ঝিম মেরে আছে আজ সকল
লাল পানির রংমহল।
চাঁদ-বাজারে এ নওরোজের
দোকান বসেছে মোমতাজের
সওদা করিতে এসেছে ফের
শাজাহান হেথা রূপ-পাগল।
হেরিতেছে কবি সুদূরের ছবি
ভবিষ্যতের তাজমহল–
নওরোজের স্বপ্ন-ফল!
নাকিব
নব-জীবনের নব-উত্থান-আজান ফুকারি এসো নকিব।
জাগাও জড়! জাগাও জীব!
জাগে দুর্বল, জাগে ক্ষুধা-ক্ষীণ,
জাগিছে কৃষাণ ধুলায়-মলিন,
জাগে গৃহহীন, জাগে পরাধীন
জাগে মজলুম বদ-নসিব!
মিনারে মিনারে বাজে আহ্বান –
‘আজ জীবনের নব উত্থান!’
শঙ্কাহরণ জাগিছে জোয়ান
জাগে বলহীন জাগিছে ক্লীব,
নব জীবনের নব উত্থান –
আজান ফুকারি এসো নকিব!
হুগলি,
১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
বার্ষিক সওগাত
বন্ধু গো সাকি আনিয়াছ নাকি বরষের সওগাত –
দীর্ঘ দিনের বিরহের পরে প্রিয়-মিলনের রাত।
রঙিন রাখি, শিরীন শারাব, মুরলী, রবাব, বীণ,
গুলিস্তানের বুলবুল পাখি, সোনালি রুপালি দিন।
লালা-ফুল সম দাগ-খাওয়া দিল, নার্গিস-ফুলি আঁখ,
ইস্পাহানির হেনা-মাখা হাত, পাতলি কাঁখ!
নৈশাপুরের গুলবদনির চিবুক গালের টোল,
রাঙা লেড়কির ভাঙা ভাঙা হাসি, শিরীন শিরীন বোল।
সুরমা-কাজল স্তাম্বুলি চোখ, বসোরা গুলের লালি,
নব বোগাদাদি আলিফ-লায়লা, শাজাদি জুলফ-ওয়ালি।
পাকা খর্জুর, ডাঁশা আঙ্গুর, টোকো-মিঠে কিসমিস,
মরু-মঞ্জীর আব-জমজম,যবের ফিরোজা শিস।
আশা-ভরা মুখ,তাজা তাজা বুক, নৌ-জোয়ানির গান,
দুঃসাহসীর মরণ-সাধনা, জেহাদের অভিযান।
আরবের প্রাণ, ফারেসের বাজু নৌ-তুর্কির,
দারাজ দিলীর আফগানি দিল, মূরের জখমি শির।
নীল দরিয়ায় মেসেরের আঁসু, ইরাকের টুটা তখ্ত,
বন্দী শামের জিন্দান-খানা, হিন্দের বদবখ্ত! –
তাঞ্জাম-ভরা আঞ্জাম এ যে কিছুই রাখনি বাকি,
পুরানো দিনের হাতে বাঁধিয়াছ নতুন দিনের রাখি।…
চোখের পানির ঝালর-ঝুলানো হাসির খাঞ্চাপোশ
– যেন অশ্রুর গড়খাই-ঘেরা দিল্খোস ফেরদৌস –
ঢাকিয়ো বন্ধু তব সওগাতি-রেকাবি তাহাই দিয়ে,
দিবসের জ্বালা ভুলে যেতে চাই রাতের শিশির পিয়ে !
বেদনার বানে সয়লাব সব, পাইনে সাথির হাত,
আনো গো বন্ধু নূহের কিশতি– ‘বার্ষিকী সওগাত!’
[কৃষ্ণনগর
২৫ অগ্রহায়ণ,১৩৩৩]