- বইয়ের নামঃ ছায়ানট
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ নজরুল ইন্সটিটিউট
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অ-কেজোর গান
ওই ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে
আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে আজ মেতে।
ওই রোদ-সোহাগী পউষ-প্রাতে
অথির প্রজাপতির সাথে
বেড়াই কুঁড়ির পাতে পাতে
পুষ্পল মৌ খেতে।
আমি আমন ধানের বিদায়-কাঁদন শুনি মাঠে রেতে।
আজ কাশ-বনে কে শ্বাস ফেলে যায় মরা নদীর কূলে,
ও তার হলদে আঁচল চলতে জড়ায় অড়হরের ফুলে!
ওই বাবলা ফুলের নাকছবি তার,
গায় শাড়ি নীল অপরাজিতার,
চলেছি সেই অজানিতার
উদাস পরশ পেতে।
আমায় ডেকেছে সে চোখ-ইশারায় পথে যেতে যেতে।
ওই ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে
আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে তাই মেতে।
অ-বেলায়
বৃথাই ওগো কেঁদে আমার কাটল যামিনী।
অবেলাতেই পড়ল ঝরে কোলের কামিনী –
ও সে শিথিল কামিনী।
খেলার জীবন কাটিয়ে হেলায়
দিন না যেতেই সন্ধেবেলায়
মলিন হেসে চড়ল ভেলায়
মরণ-গামিনী।
আহা একটু আগে তোমার দ্বারে কেন নামিনি।
আমার অভিমানিনী।
ঝরার আগে যে কুসুমে দেখেও দেখি নাই
ও যে বৃথাই হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল, ছোট্ট বুকের একটু সুরভি
আজ তারই সেই শুকনো কাঁটা বিঁধচে বুকে ভাই –
আহা সেই সুরভি আকাশ কাঁদায় ব্যথায় যেন সাঁঝের পুরবি
জানলে না সে ব্যথাহতা
পাষাণ-হিয়ার গোপন কথা,
বাজের বুকেও কত ব্যথা
কত দামিনী!
আমার বুকের তলায় রইল জমা গো –
না-কওয়া সে অনেক দিনের অনেক কাহিনি।
আহা ডাক দিলি তুই যখন, তখন কেন থামিনি!
আমার অভিমানিনী।
দৌলতপুর, কুমিল্লা
বৈশাখ ১৩২৮
অকরুণ পিয়া
আমার পিয়াল বনের শ্যামল পিয়ার ওই বাজে গো বিদায়বাঁশি,
পথ-ঘুরানো সুর হেনে সে আবার হাসে নিদয় হাসি।
পথিক বলে পথের গেহ
বিলিয়েছিল একটু স্নেহ,
তাই দেখে তার ঈর্ষাভরা কান্নাতে চোখ গেল ভাসি।
তখন মোদের কিশোর বয়স যেদিন হঠাৎ টুটল বাঁধন,
সেই হতে কার বিদায়-বেণুর জগৎ জুড়ে শুনছি কাঁদন।
সেই কিশোরীর হারা মায়া
ভুবন ভরে নিল কায়া,
দুলে আজও তারই ছায়া আমার সকল পথে আসি।
অনাদৃতা
ওরে অভিমানিনী!
এমন করে বিদায় নিবি ভুলেও জানিনি।
পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দু-দিন এসেছিলি,
সকল সহা! সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি।
হেলায় বিদায় দিনু যারে
ভেবেছিনু ভুলব তারে হায়!
ভোলা কি তা যায়?
ওরে হারা-মণি! এখন কাঁদি দিবস-যামিনী।
অভাগি রে! হাসতে এসে কাঁদিয়ে গেলি,
নিজেও শেষে বিদায় নিলি কেঁদে,
ব্যথা দেওয়ার ছলে নিজেই সইলি ব্যথা রে,
বুকে সেই কথাটাই কাঁটার মতন বেঁধে!
যাবার দিনে গোপন ব্যথা বিদায়-বাঁশির সুরে
কইতে গিয়ে উঠল দু-চোখ নয়নজলে পুরে!
না কওয়া তোর সেই সে বাণী,
সেই হাসিগান সেই মু-খানি, হায়!
আজও খুঁজি সকল ঠাঁই।
তোরে যাবার দিনে কেঁদে কেন ফিরিয়ে আনিনি?
ওরে অভিমানিনী।
অমর-কানন
অমর কানন
মোদের অমর-কানন!
বন কে বলে রে ভাই, আমাদের তপোবন,
আমাদের তপোবন।
এর দক্ষিণে ‘শালী’ নদী কুলুকুলু বয়,
তার কূলে কূলে শালবীথি ফুলে ফুলময়,
হেথা ভেসে আসে জলে-ভেজা দখিনা মলয়,
হেথা মহুয়ার মউ খেয়ে মন উচাটন।
দূর প্রান্তর-ঘেরা আমাদের বাস,
দুধহাসি হাসে হেথা কচি দুব-ঘাস,
উপরে মায়ের মতো চাহিয়া আকাশ,
বেণু-বাজা মাঠে হেথা চরে ধেনুগণ
মোরা নিজ হাতে মাটি কাটি, নিজে ধরি হাল,
সদা খুশিভরা বুক হেথা হাসিভরা গাল,
মোরা বাতাস করি গো ভেঙে হরিতকি-ডাল,
হেথা শাখায় শাখায় শাখী, গানের মাতন।
প্রহরী মোদের ভাই ‘পুরবি’ পাহাড়,
‘শুশুনিয়া’ আগুলিয়া পশ্চিমি দ্বার,
ওড়ে উত্তরে উত্তরি কাননবিথার,
দূরে ক্ষণে ক্ষণে হাতছানি দেয় তালী-বন।
হেথা খেত-ভরা ধান নিয়ে আসে অঘ্রান,
হেথা প্রাণে ফোটে ফুল, হেথা ফুলে ফোটে প্রাণ,
ও রে রাখাল সাজিয়া হেথা আসে ভগবান,
মোরা নারায়ণ-সাথে খেলা খেলি অনুখন।
মোরা বটের ছায়ায় বসি করি গীতাপাঠ,
আমাদের পাঠশালা চাষি-ভরা মাঠ,
গাঁয়ে গাঁয়ে আমাদের মায়েদের হাট,
ঘরে ঘরে ভাইবোন বন্ধুস্বজন।
গঙ্গাজলঘাটি, বাঁকুড়া
আষাঢ় ১৩৩২
আপন-পিয়াসী
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনার,
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসী বাসনায়।।
আমারই মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে,
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।
আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম,
অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।
আমারই রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া,
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,
আপনারি গলে দোলে হায়।।
আলতা-স্মৃতি
ওই রাঙা পায়ে রাঙা আলতা প্রথম যেদিন পরেছিলে,
সেদিন তুমি আমায় কি গো ভুলেও মনে করেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে?
জানি, তোমার নারীর মনে নিত্য-নূতন পাওয়ার পিয়াস
হঠাৎ কেন জাগল সেদিন, কণ্ঠ ফেটে কাঁদল তিয়াস!
মোর আসনে সেদিন রানি
নূতন রাজায় বরলে আনি,
আমার রক্তে চরণ রেখে তাহার বুকে মরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
মর্মমূলে হানলে আমার অবিশ্বাসের তীক্ষ্ম ছুরি,
সে-খুন সখায় অর্ঘ্য দিলে যুগল চরণ-পদ্মে পুরি।
আমার প্রাণের রক্তকমল
নিঙড়ে হল লাল পদতল,
সেই শতদল দিয়ে তোমার নতুন রাজায় বরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
আমায় হেলায় হত্যা করে দাঁড়িয়ে আমার রক্ত-বুকে
অধর-আঙুর নিঙড়েছিলে সখার তৃষা-শুষ্ক মুখে।
আলতা সে নয়, সে যে খালি
আমার যত চুমোর লালি!
খেলতে হোরি তাইতে, গোরি, চরণতরি ভরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
জানি রানি, এমনি করে আমার বুকের রক্তধারায়
আমারই প্রেম জন্মে জন্মে তোমার পায়ে আলতা পরায়!
এবারও সেই আলতা-চরণ
দেখতে প্রথম পায়নি নয়ন!
মরণ-শোষা রক্ত আমার চরণ-ধারে ধরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
কাহার পুলক-অলক্তকের রক্তধারায় ডুবিয়ে চরণ
উদাসিনী! যেচেছিলে মনের মনে আমার মরণ?
আমার সকল দাবি দলে
লিখলে ‘বিদায়’ চরণতলে!
আমার মরণ দিয়ে তোমার সখার হৃদয় হরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
বহরমপুর জেল
অগ্রহায়ণ ১৩৩১ [১৩৩০]
আশা
হয়ত তোমার পাব’ দেখা,
যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা।।
ঐ সুদূরের গাঁয়ের মাঠে,
আ’লের পথে বিজন ঘাটে;
হয়ত এসে মুচকি হেসে
ধ’রবে আমার হাতটি একা।।
ঐ নীলের ঐ গহন-পারে ঘোম্টা-হারা তোমার চাওয়া,
আনলে খবর গোপন দূতী দিক্পারের ঐ দখিনা হাওয়া।।
বনের ফাঁকে দুষ্টু তুমি
আসে- যাবে নয়্না চুমি’
সেই সে কথা লিখছে হেতা
দিগ্বলয়ের অরুণ-লেখা।
কমল-কাঁটা
আজকে দেখি হিংসা-মদের মত্ত-বারণ-রণে
জাগ্ছে শুধু মৃণাল-কাঁটা আমার কমল-বনে।
উঠল কখন ভীম কোলাহল,
আমার বুকের রক্ত-কমল
কে ছিঁড়িল-বাঁধ-ভরা জল
শুধায় ক্ষণে ক্ষণে।
ঢেউ-এর দোলায় মরাল-তরী নাচ্বে না আন্মনে।।
কাঁটাও আমার যায় না কেন, কমল গেল যদি!
সিনান-বধূর শাপ শুধু আজ কুড়াই নিরবধি!
আস্বে কি আর পথিক-বালা?
প’রবে আমার মৃণাল-মালা?
আমার জলজ-কাঁটার জ্বালা
জ্ব’লবে মোরই মনে?
ফুল না পেয়েও কমল-কাঁটা বাঁধবে কে কঙ্কণে?
কার বাঁশি বাজিল?
কার বাঁশি বাজিল
নদীপারে আজি লো?
নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল –
কার বাঁশি বাজিল?
বনে বনে দূরে দূরে
ছল করে সুরে সুরে
এত করে ঝুরে ঝুরে
কে আমায় যাচিল?
পুলকে এ-তনুমন ঘন ঘন নাচিল।
ক্ষণে ক্ষণে আজি লো কার বাঁশি বাজিল?
কার হেন বুক ফাটে মুখ নাহি ফোটে লো!
না-কওয়া কী কথা যেন সুরে বেজে ওঠে লো!
মম নারী-হিয়া মাঝে
কেন এত ব্যথা বাজে?
কেন ফিরে এনু লাজে
নাহি দিয়ে যা ছিল?
যাচা-প্রাণ নিয়ে আমি কেমনে সে বাঁচি লো?
কেঁদে কেঁদে আজি লো কার বাঁশি বাজিল?
চাঁদমুকুর
চাঁদ হেরিতেছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে।
ছুটে তরঙ্গ বাসনাভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।
হেরিছে রজনি রজনি জাগিয়া
চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া,
কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া
কুমুদীরে কাঁদাইতে।
না জানি সজনি কত সে রজনি কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া,
হেরেছে শশীরে সরসী-মুকুরে ভীরু ছায়াতরু কাঁপিয়া।
কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরনি
চির-বিরহিণী রোহিণী ভরণী,
অবশ আকাশ বিবশা ধরণি
কাঁদানিয়া চাঁদনীতে।
হুগলি
ফাল্গুন ১৩৩১
চির-চেনা
নামহারা ওই গাঙের পারে বনের কিনারে
বেতস-বেণুর বনে কে ওই বাজায় বীণা রে।
লতায়-পাতায় সুনীল রাগে
সে-সুর সোহাগ-পুলক লাগে,
সে সুর ঘুমায় দিগঙ্গনার শয়নলীনা রে।
আমি কাঁদি, এ সুর আমার চিরচেনা রে।
ফাগুন-মাঠে শিস দিয়ে যায় উদাসী তার সুর,
শিউরে ওঠে আমের মুকুল ব্যথায় ভারাতুর।
সে সুর কাঁপে উতল হাওয়ায়,
কিশলয়ের কচি চাওয়ায়,
সে চায় ইশারায় অস্তাচলের প্রাসাদ-মিনারে।
আমি কাঁদি, এই তো আমার চিরচেনা রে।
কুমিল্লা
জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯
চিরন্তনী প্রিয়া
এসো এসো এসো আমার চির-পুরানো!
বুক জুড়ে আজ বসবে এসো হৃদয়-জুড়ানো!
আমার চির-পুরানো!
পথ বিপথে কতই আমার নিত্য নূতন বাঁধন এসে যাচে,
কাছে এসেই অমনি তারা পুড়ে মরে আমার আগুন আঁচে।
তারা এসে ভালোবাসার আশায়
একটুকুতেই কেঁদে ভাসায়,
ভীরু তাদের ভালোবাসা কেঁদেই ফুরানো।
বিজয়িনী চিরন্তনী মোর!
একা তুমিই হাস বিজয়-হাসি দীপ দেখিয়ে পথে ঘুরানো।
তুমি যেদিন মুক্তি দিলে হেসে বাঁধন কাটলে আপন হাতে,
প্রেম-গরবি আপন প্রেমের জোরে,
জানতে আমায় সইবে না কেউ বইবে না ভার
হার মেনে সে আসতে হবে আবার তোমার দোরে।
গরবিনি! গর্ব করে এই কপালে লিখলে জয়ের টিকা
‘চঞ্চল এই বাঁধন-হারায় বাঁধতে পারে এক এ সাহসিকা!’
প্রিয়! তাই কি আমার ভালোবাসা
সবাই বলে সর্বনাশা,
এই ধূমকেতু মোর আগুন-ছোঁয়া বিশ্ব-পোড়ানো?
সর্বনাশী চপল প্রিয়া মোর!
তবে অভিশাপের বুকে তুমিই হাসবে এসো
নয়ন ঝুরানো॥
চিরশিশু
নাম-হারা তুই পথিক-শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে।
কোন্ নামের আজ প’রলি কাঁকনম বাঁধনহারায় কোন্ কারা এ।।
আবার মনের মতন ক’রে
কোন্ নামে বল ডাক্ব তোরে!
পথ-ভোলা তুই এই সে ঘরে
ছিলি ওরে এলি ওরে
বারে বারে নাম হারায়ে।।
ওরে যাদু ওরে মাণিক, আঁধার ঘরের রতণ-মাণি!
ক্ষুধিত ঘর ভ’রলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী।
আজ যে শুধু নিবিড় সুখে
কান্না-সায়র উথলে বুকে,
নতুন নামে ডাকতে তোকে
ওরে ও কে কন্ঠ র”খে’
উঠছে কেন মন ভারায়ে!
অস্ত হ’তে এলে পথিক উদয় পানে পা বাড়ায়ে।।
চৈতী হাওয়া
হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর,
আজ্কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!
আজ্কে তোমার জন্মদিন-
স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন
হাত্ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার!
এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!
শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল,
কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?
আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ,
নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,-
কোন্ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল
ঢেকেছে আজ কোন্ দেবতার কোন্ সে পাষাণ-তল?
অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’
আস্ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ
ঘাটে আমি রই ব’সে
আমার মাণিক কই গো সে?
পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্ছে বুকে ঘা!
আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!
বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্রে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এম্নি হাওয়ায় তোমার পরশন।
তেম্নি আবার মহুয়া-মউ
মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ
পান ক’রে ওই ঢুল্ছে নেশায়, দুল্ছে মহুল বন,
ফুল-সৌখিন্ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!
প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই,
মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্নি যেত নুই।
হাস্তে তুমি দুলিয়ে ডাল,
গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল
থর্কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই!
বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই!
চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব,
দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর!
ভুঁই- তারকা সুন্দরী
সজনে ফুলের দল ঝরি’
থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর।
ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!
পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ!
খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ!
লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই,
বলতে, ‘আমি অমনি চাই!
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”
ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল,
জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল
হঠাৎ জলে রাখত্ে পা,
কাজলা দীঘির শিউরে গা-
কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল!
ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল!
উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়,
ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়!
শঙ্খ বাজে মন্দিরে,
সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে,
ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়!
মাঠের বাঁশী বন্-উদাসী ভীম্পলাশী গায়অ
বাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে!
আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে?
ডাবের শীতল জল দিয়ে
মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে?
প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে
ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?
বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম,
রসের পীড়ায় টস্টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম!
কামরাঙারা রাঙল ফের
পীড়ন পেতে ঐ মুখের,
স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম-
জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!
ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর,
ভেবেছিলুম গাঁথ্ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর!
সেই চাহনি নীল-কমল
ভ’রল আমার মানস-জল,
কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর!
বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!
তরী আমার কোন্ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল,
স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল!
পাহাড়তলীর শালবনায়
বিষের মত নীল ঘনায়!
সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল!
হায় গো, আমার ভিন্ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল!
কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই,
কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই!
কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর-
কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর?
তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই?
কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’,
এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা!
আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায়
আকুল দোলা লাগবে না’য়,
এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।
ছলকুমারী
কত ছল করে সে বারে বারে দেখতে আসে আমায়।
কত বিনা-কাজের কাজের ছলে চরণ দুটি
আমার দোরেই থামায়।
জানলা-আড়ে চিকের পাশে
দাঁড়ায় এসে কীসের আশে,
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল গাল দুটিকে ঘামায়।
সবাই যখন ঘুমে মগন দুরুদুরু বুকে তখন
আমায় চুপে চুপে
দেখতে এসেই মল বাজিয়ে দৌড়ে পলায়,
রং খেলিয়ে চিবুক গালের কূপে!
দোর দিয়ে মোর জলকে চলে
কাঁকন হানে কলস-গলে!
অমনি চোখাচোখি হলে
চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়, চোখ দুটিকে নামায়।
সইরা হাসে দেখে তাহার দোর দিয়ে মোর
নিতুই নিতুই কাজ-অকাজে হাঁটা,
করবে কী ও? রোজ যে হারায় আমার দোরেই
শিথিল বেণির দুষ্টু মাথার কাঁটা!
একে ওকে ডাকার ভানে
আনমনা মোর মনটি টানে,
কী যে কথা সেই তা জানে
ছল-কুমারী নানান ছলে আমারে সে জানায়।
পিঠ ফিরিয়ে আমার পানে দাঁড়ায় দূরে
উদাস নয়ান যখন এলোকেশে,
জানি, তখন মনে মনে আমার কথাই ভাবতেছে সে,
মরেছে সে আমায় ভালোবেসে!
বই-হাতে সে ঘরের কোণে
জানি আমার বাঁশিই শোনে,
ডাকলে রোষে আমার পানে,
নয়না হেনেই রক্তকমল-কুঁড়ির সম চিবুকটি তার নামায়।
দহনমালা
হায় অভাগি! আমায় দেবে তোমার মোহন মালা?
বদল দিয়ে মালা, নেবে আমার দহন-জ্বালা?
কোন ঘরে আজ প্রদীপ জ্বেলে
ঘরছাড়াকে সাধতে এলে
গগনঘন শান্তি মেলে, হায়!
দু-হাত পুরে আনলে ও কি সোহাগ-ক্ষীরের থালা
আহা দুখের বরণ ডালা?
পথহারা এই লক্ষ্মীছাড়ার
পথের ব্যথা পারবে নিতে? করবে বহন, বালা?
লক্ষ্মীমণি! তোমার দিকে চাইতে আমি নারি,
দু-চোখ আমার নয়ন জলে পুরে,
বুক ফেটে যায় তবু এ-হার ছিঁড়তে নাহি পারি,
ব্যথাও দিতে নারি, – নারী! তাই যেতে চাই দূরে।
ডাকতে তোমায় প্রিয়তমা
দু-হাত জুড়ে চাইছি ক্ষমা,
চাইছি ক্ষমা চাইছি ক্ষমা গো!
নয়ন-বাঁশির চাওয়ার সুরে
বনের হরিণ বাঁধবে বৃথা লক্ষ্মী গহনবালা।
কল্যাণী! হায় কেমনে তোমায় দেব
যে-বিষ পান করেছি নীলের নয়ন-গালা।
দুপুর-অভিসার
যাস কোথা সই একলা ও তুই অলস বৈশাখে?
জল নিতে যে যাবি ওলো কলস কই কাঁখে?
সাঁঝ ভেবে তুই ভর-দুপুরেই দু-কূল নাচায়ে
পুকুরপানে ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজায়ে
যাসনে একা হাবা ছুঁড়ি,
অফুট জবা চাঁপা-কুঁড়ি তুই!
দ্যাখ্ রং দেখে তোর লাল গালে যায়
দিগ্বধূ ফাগ থাবা থাবা ছুঁড়ি,
পিক-বধূ সব টিটকিরি দেয় বুলবুলি চুমকুড়ি –
ওলো বউল-ব্যাকুল রসাল তরুর সরস ওই শাখে॥
দুপুর বেলায় পুকুর গিয়ে একূল ওকূল গেল দুকূল তোর,
ওই চেয়ে দ্যাখ পিয়াল-বনের দিয়াল ডিঙে এল মুকুল-চোর।
সারং রাগে বাজায় বাঁশি নাম ধরে তোর ওই,
রোদের বুকে লাগল কাঁপন সুর শুনে ওর সই।
পলাশ অশোক শিমূল-ডালে
বুলাস কি লো হিঙুল গালে তোর?
আ – আ মলো যা! তাইতে হা দ্যাখ,
শ্যাম চুমু খায় সব সে কুসুম লালে
পাগলি মেয়ে! রাগলি নাকি? ছি ছি দুপুর-কালে
বল কেমনে দিবি সরস অধর-পরশ সই তাকে?
দূরের বন্ধু
বন্ধু আমার! থেকে থেকে কোন্ সুদূরের বিজন পুরে
ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে?
আমার অনেক দুখের পথের বাসা বারে বারে ঝড়ে উড়ে,
ঘর-ছাড়া তাই বেড়াই ঘুরে।।
তোমার বাঁশীর উদাস কাঁদন
শিথিল করে সকল বাঁধন
কাজ হ’ল তাই পথিক সাধন,
খুঁজে ফেরা পথ-বঁধরে,
ঘুরে’ ঘুরে’ দূরে দূরে।।
হে মোর প্রিয়! তোমার বুকে একটুকুতেই হিংসা জাগে,
তাই তো পথে হয় না থামা-তোমার ব্যথা বক্ষে লাগে!
বাঁধতে বাসা পথের পাশে
তোমার চোখে কান্না আসে
উত্তরী বায় ভেজা ঘাসে
শ্বাস ওঠে আর নয়ন বুঝে,
বন্ধু, তোমার সুরে সুরে।।
নিরুদ্দেশের যাত্রী
নিরুদ্দেশের পথে যেদিন প্রথম আমার যাত্রা হল শুরু।
নিবিড় সে-কোন্ বেদনাতে ভয়-আতুর এ বুক কাঁপল দুরু-দুরু।
মিটল না ভাই চেনার দেনা, অমনি মু্হুর্মুহু
ঘরছাড়া ডাক করলে শুরু অথির বিদায়-কুহু
উহু উহু উহু!
হাতছানি দেয় রাতের শাঙন,
অমনি বাঁধে ধরল ভাঙন –
ফেলিয়ে বিয়ের হাতের কাঙন –
খুঁজে বেড়াই কোন আঙনে কাঁকন বাজে গো!
বেরিয়ে দেখি ছুটছে কেঁদে বাদলি হাওয়া হু হু!
মাথার ওপর দৌড়ে টাঙন, ঝড়ের মাতন, দেয়ার গুরু গুরু।
পথ হারিয়ে কেঁদে ফিরি, ‘আর বাঁচিনে! কোথায় প্রিয়,
কোথায় নিরুদ্দেশ?’
কেউ আসে না, মুখে শুধু ঝাপটা মারে নিশীথ-মেঘের
আকুল চাঁচর কেশ।
‘তাল-বনা’তে ঝঞ্ঝা তাথই হাততালি দেয় বজ্রে বাজে তূরী,
মেখলা ছিঁড়ি পাগলি মেয়ে বিজলি-বালা নাচায় হিরের চুড়ি
ঘুরি ঘুরি ঘুরি
ও সে সকল আকাশ জুড়ি!
থামল বাদল রাতের কাঁদা,
হাসল, আমার টুটল ধাঁধা,
হঠাৎ ও কার নূপুর শুনি গো?
থামল নূপুর, ভোরের তারা বিদায় নিল ঝুরি।
আমি এখন চলি সাঁঝের বধূ সন্ধ্যাতারার চলার পথে গো!
আজ অস্তপারের শীতের বায়ু কানের কাছে বইছে ঝুরু-ঝুরু।
কলিকাতা
চৈত্র ১৩২৭
নিশীথ-প্রীতম
হে মোর প্রিয়,
হে মোর নিশীথ-রাতের গোপন সাথি!
মোদের দুইজনারেই জনম ভরে কাঁদতে হবে গো –
শুধু এমনি করে সুদূর থেকে, একলা জেগে রাতি।
যখন ভুবন-ছাওয়া আঁচল পেতে নিশীথ যাবে ঘুম,
আকাশ বাতাস থমথমাবে সব হবে নিঝঝুম,
তখন দেব দুঁহু দোঁহার চিঠির নাম-সহিতে চুম!
আর কাঁপবে শুধু গো,
মোদের তরুণ বুকের করুণ কথা আর শিয়রে বাতি।
মোরা কে যে কত ভালোবাসি কোনোদিনই হবে না তা বলা,
কভু সাহস করে চিঠির বুকেও আঁকব না সে কথা;
শুধু কইতে-নারার প্রাণপোড়ানি রইবে দোঁহার ভরে বুকের তলা।
শুধু চোখে চোখে চেয়ে থাকার –
বুকের তলায় জড়িয়ে রাখার
ব্যাকুল কাঁপন নীরব কেঁদে কইবে কি তার ব্যথা!
কভু কী কথা সে কইতে গিয়ে হঠাৎ যাব থেমে,
অভিমানে চারটি চোখেই আসবে বাদল নেমে।
কত চুমুর তৃষায় কাঁপবে অধর, উঠবে কপোল ঘেমে।
হেথা পুরবে নাকো ভালোবাসার আশা অভাগিনি,
তাই দলবে বলে কলজেখানা রইনু পথে পাতি।
কুমিল্লা
অগ্রহায়ণ ১৩২৮
নীল পরি
ওই সর্ষে ফুলে লুটাল কার
হলুদ-রাঙা উত্তরি।
উত্তরি-বায় গো –
ওই আকাশ-গাঙে পাল তুলে যায়
নীল সে পরির দূর তরি॥
তার অবুঝ বীণার সবুজ সুরে
মাঠের নাটে পুলক পুরে,
ওই গহন বনের পথটি ঘুরে
আসছে দূরে কচিপাতা দূত ওরই॥
মাঠঘাট তার উদাস চাওয়ায়
হুতাশ কাঁদে গগন মগন
বেণুর বনে কাঁপচে গো তার
দীঘল শ্বাসের রেশটি সঘন।
তার বেতস-লতায় লুটায় তনু,
দিগ্বলয়ে ভুরুর ধনু,
সে পাকা ধানের হীরক-রেণু
নীল নলিনীর নীলিম-অণু
মেখেছে মুখ বুক ভরি॥
ট্রেনে কুমিল্লার পথে
চৈত্র ১৩২৭
পরশ পূজা
আমি এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম,
আর কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম,
তখন মুকুর পাশে একলা গেহে
আমারই এই সকল দেহে
চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো,
আহা পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম।
তখন তুমি নাইবা প্রিয় নাই বা রলে কাছে।
জানব আমার এই সে দেহে এই সে দেহে গো
তোমার বাহুর বুকের শরম-ছোঁয়ার কাঁপন লেগে আছে।
তখন নাই বা আমার রইল মনে
কোনখানে মোর দেহের বনে
জড়িয়ে ছিলে লতার মতন আলিঙ্গনে গো,
আমি চুমোয় চুমোয় ডুবাব এই সকল দেহ মম,
এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম।
পলাতকা
কোন্ সুদূরের চেনা বাঁশীর ডাক শুনেছিস্ ওরে চখা?
ওরে আমার পলাতকা!
তোর প’ড়লো মনে কোন্ হারা-ঘর,
স্বপন-পারের কোন্ অলকা?
ওরে আমার পলাতকা!
তোর জল ভ’রেছে চপল চোখে,
বল্ কোন্ হারা-মা ডাকলো তোকে রে?
ঐ গগন-সীমায় সাঁঝের ছায়ায়
হাতছানি দেয় নিবিড় মায়ায়-
উতল পাগল! চিনিস্ কি তুই চিনিস্ ওকে রে?
যেন বুক-ভরা ও গভীর স্নেহে ডাক দিয়ে যায়, “আয়,
ওরে আয় আয় আয়,
কেবল আয় যে আমার দুষ্টু খোকা!
ওরে আমার পলাতকা!’’
দখিন্ হাওয়ায় বনের কাঁপনে-
দুলাল আমার! হাত-ইশারায় মা কি রে তোর
ডাক দিয়েছে আজ?
এতকদিনে চিন্লি কি রে পর ও আপনে!
নিশিভোরেই তাই কি আমার নামলো ঘরে সাঁঝ!
ধানের শীষে, শ্যামার শিসে-
যাদুমণি! বল্ সে কিসে রে,
তুই শিউরে চেয়ে ছিঁড়লি বাঁধন!
চোখ-ভরা তোর উছলে কাঁদন রে!
তোরে কে পিয়ালো সবুজ স্নেহের কাঁচা বিষে রে!
যেন আচম্কা কোন্ শশক-শিশু চ’ম্কে ডাকে হায়,
“ওরে আয় আয় আয়
আয় রে খোকন আয়,
বনে আয় ফিরে আয় বনের চখা!
ওরে চপল পলাতকা’’।।
পাপড়ি-খোলা
রেশমি চুড়ির শিঞ্জিনীতে রিমঝিমিয়ে মরমকথা
পথের মাঝে চমকে কে গো থমকে যায় ওই শরম-নতা।
কাঁখচুমা তার কলসি-ঠোঁটে
উল্লাসে জল উলসি ওঠে,
অঙ্গে নিলাজ পুলক ছোটে
বায় যেন হায় নরম লতা।
অ-চকিতে পথের মাঝে পথ-ভুলানো পরদেশী কে
হানলে দিঠি পিয়াস-জাগা পথবালা এই উর্বশীকে!
শূন্য তাহার কন্যা-হিয়া
ভরল বধূর বেদন নিয়া,
জাগিয়ে গেল পরদেশিয়া
বিধুর বধূর মধুর ব্যথা।
পাহাড়ি গান
মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম,
মোরা ঝরনার মতো চঞ্চল।
মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়,
মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।
মোরা আকাশের মতো বাধাহীন,
মোরা মরু-সঞ্চর বেদুইন,
মোরা জানি নাকো রাজা রাজ-আইন,
মোরা পরি না শাসন-উদুখল!
মোরা বন্ধনহীন জন্মস্বাধীন, চিত্ত মুক্ত শতদল।
মোরা সিন্ধু-জোয়ার কলকলমোরাপাগল-ঝোরার ঝরা-জল
কল-কলকল ছল-ছলছল কল-কলকল ছল-ছলছল।
মোরা দিল-খোলা খোলা প্রান্তর,
মোরা শক্তি-অটল মহীধর,
মোরা মুক্ত-পক্ষ নভ-চর,
মোরা হাসি-গানসম উচ্ছল।
মোরা বৃষ্টির জল বনফল খাই, শয্যা শ্যামল বন-তল,
মোরা প্রাণ দরিয়ার কল-কল,
মোরা মুক্ত-ধারার ঝরা-জল
চল-চঞ্চল কল-কলকল ছল-ছলছল ছল-ছলছল।
পুবের হাওয়া
আমি ঝড় পশ্চিমের প্রলয়-পথিক –
অসহ যৌবন-দাহে লেলিহান-শিখ
দারুণ দাবাগ্নি-সম নৃত্য-ছায়ানটে
মাতিয়া ছুটিতেছিনু, চলার দাপটে
ব্রহ্মাণ্ড ভণ্ডুল করি। অগ্রে সহচরী
ঘূর্ণা-হাতছানি দিয়া চলে ঘূর্ণি-পরি
গ্রীষ্মের গজল গেয়ে পিলু-বারোয়াঁয়
উশীরের তার-বাঁধা প্রান্তর-বীণায়।
করতালি-ঠেকা দেয় মত্ত তালিবন
কাহারবা-দ্রুততালে। – আমি উচাটন
মন্মথ-উম্মদ আঁখি রাগরক্ত ঘোর
ঘূর্ণিয়া পশ্চাতে ছুটি, প্রমত্ত চকোর
প্রথম-কামনা-ভিতু চকোরিণী পানে
ধায় যেন দুরন্ত বাসনা-বেগ-টানে।
সহসা শুনিনু কার বিদায়-মন্থর
শ্রান্ত শ্লথ গতি-ব্যথা, পাতা-থরথর
পথিক-পদাঙ্ক-আঁকা পুব-পথশেষে।
দিগন্তের পর্দা ঠেলি হিমমরুদেশে
মাগিছে বিদায় মোর প্রিয়া ঘূর্ণি-পরি,
দিগন্ত ঝাপসা তার অশ্রুহিমে ভরি।
গোলে-বকৌলির দেশে মেরু-পরিস্থানে
মিশে গেল হাওয়া-পরি।
অযথা সন্ধানে
দিকচক্ররেখা ধরি কেঁদে কেঁদে চলি
শ্রান্ত অশ্বশ্বসা-গতি। চম্পা-একাবলী
ছিন্ন ম্লান ছেয়ে আছে দিগন্ত ব্যাপিয়া, –
সেই চম্পা চোখে চাপি ডাকি, ‘পিয়া পিয়া’!
বিদায়-দিগন্ত ছানি নীল হলাহল
আকণ্ঠ লইনু পিয়া, তরল গরল –
সাগরে ডুবিল মোর আলোক-কমলা,
আঁখি মোর ঢুলে আসে – শেষ হল চলা!
জাগিলাম জন্মান্তর-জাগরণ-পারে
যেন কোন্ দাহ-অন্ত ছায়া-পারাবারে
বিচ্ছেদ-বিশীর্ণ তনু, শীতল-শিহর!
প্রতি রোমকূপে মোর কাঁপে থরথর।
কাজল-সুস্নিগ্ধ কার অঙ্গুলি-পরশ
বুলায় নয়ন মোর, দুলায়ে অবশ
ভার-শ্লথ তনু মোর ডাকে – ‘জাগো পিয়া।
জাগো রে সুন্দর মোরি রাজা শাঁবলিয়া।’
জল-নীলা ইন্দ্রনীলকান্তমণি-শ্যামা
এ কোন মোহিনী তন্বী জাদুকরী বামা
জাগাল উদয়-দেশে নব মন্ত্র দিয়া
ভয়াল-আমারে ডাকি – ‘হে সুন্দর পিয়া!’
– আমি ঝড় বিশ্ব-ত্রাস মহামৃত্যুক্ষুধা,
ত্র্যম্বকের ছিন্নজটা – ওগো এত সুধা,
কোথা ছিল অগ্নিকুণ্ড মোর দাবদাহে?
এত প্রেমতৃষা সাধ গরল প্রবাহে? –
আবার ডাকিল শ্যামা, ‘জাগো মোরি পিয়া!’
এতক্ষণ আপনার পানে নিরখিয়া
হেরিলাম আমি ঝড় অনন্ত সুন্দর
পুরুষ-কেশরী বীর! প্রলয়কেশর
স্কন্ধে মোর পৌরুষের প্রকাশে মহিমা!
চোখে মোর ভাস্বরের দীপ্তি-অরুণিমা
ঠিকরে প্রদীপ্ত তেজে! মুক্ত ঝোড়ো কেশে
বিশ্বলক্ষ্মী মালা তার বেঁধে দেন হেসে!
এ কথা হয়নি মনে আগে, – আমি বীর
পরুষ পুরুষ-সিংহ, জয়লক্ষ্মী-শ্রীর
স্নেহের দুলাল আমি; আমারেও নারী
ভালোবাসে, ভালোবাসে রক্ত-তরবারি
ফুল-মালা চেয়ে! চাহে তারা নর
অটল-পৌরুষ বীর্যবন্ত শক্তিধর!
জানিনু যেদিন আমি এ সত্য মহান –
হাসিল সেদিন মোর মুখে ভগবান
মদনমোহন-রূপে! সেই সে প্রথম
হেরিনু, সুন্দর আমি সৃষ্টি-অনুপম!
যাহা কিছু ছিল মোর মাঝে অসুন্দর
অশিব ভয়াল মিথ্যা অকল্যাণকর
আত্ম-অভিমান হিংসা দ্বেষ-তিক্ত ক্ষোভ –
নিমেষে লুকাল কোথা, স্নিগ্ধশ্যাম ছোপ
সুন্দরের নয়নের মণি লাগি মোর প্রাণে!
পুবের পরিরে নিয়া অস্তদেশ পানে
এইবার দিনু পাড়ি। নটনটী-রূপে
গ্রীষ্মদগ্ধ তাপশুষ্ক মারী-ধ্বংস-স্তূপে
নেচে নেচে গাই নবমন্ত্র সামগান
শ্যামল জীবনগাথা জাগরণতান!
এইবার গাহি নেচে নেচে,
রে জীবন-হারা, ওঠ বেঁচে!
রুদ্র কালের বহ্নি-রোষ
নিদাঘের দাহ গ্রীষ্ম-শোষ
নিবাতে এনেছি শান্তি-সোম,
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!
জেগে ওঠ ওরে মূর্ছাতুর!
হোক অশিব মৃত্যু দূর!
গাহে উদ্গাতা সজল ব্যোম,
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম॥
এসো মোর শ্যাম-সরসা
ঘনিমার হিঙুল-শোষা
বরষা প্রেম-হরষা
প্রিয়া মোর নিকষ-নীলা
শ্রাবণের কাজল গুলি
ওলো আয় রাঙিয়ে তুলি
সবুজের জীবন-তুলি,
মৃতে কর প্রাণ-রঙিলা॥
আমি ভাই পুবের হাওয়া
বাঁচনের নাচন-পাওয়া,
কারফায় কাজরি গাওয়া,
নটিনীর পা-ঝিনঝিন!
নাচি আর নাচনা শেখাই
পুরবের বাইজিকে ভাই,
ঘুমুরের তাল দিয়ে যাই –
এক দুই এক দুই তিন॥
বিল ঝিল তড়াগ পুকুর
পিয়ে নীর নীল কম্বুর
থইথই টইটম্বুর!
ধরা আজ পুষ্পবতী!
শুশুনির নিদ্রা শুষি
রূপসি ঘুম-উপোসি!
কদমের উদমো খুশি
দেখায় আজ শ্যাম যুবতি॥
হুরিরা দূর আকাশে
বরুণের গোলাব-পাশে
ধারা-জল ছিটিয়ে হাসে
বিজুলির ঝিলিমিলিতে!
অরুণ আর বরুণ রণে
মাতিল ঘোর স্বননে
আলো-ছায় গগন-বনে
‘শার্দূল বিক্রীড়িতে।’
(শার্দূল-বিক্রীড়িত ছন্দে)
উত্রাস ভীম
মেঘে কুচকাওয়াজ
চলিছে আজ,
সোন্মাদ সাগর
খায় রে দোল!
ইন্দ্রের রথ
বজ্রের কামান
টানে উজান
মেঘ-ঐরাবত
মদ-বিভোল।
যুদ্ধের রোল
বরুণের জাঁতায়
নিনাদে ঘোর,
বারীশ আর বাসব
বন্ধু আজ।
সূর্যের তেজ
দহে মেঘ-গরুড়
ধূম্র-চূড়,
রশ্মির ফলক
বিঁধিছে বাজ।
বিশ্রাম-হীন
যুঝে তেজ-তপন
দিক-বারণ
শির-মদ-ধারায়
ধরা মগন!
অম্বর-মাঝ
চলে আলো-ছায়ায়
নীরব রণ
শার্দূল শিকার
খেলে যেমন।
রৌদ্রের শর
খরতর প্রখর
ক্লান্ত শেষ,
দিবা দ্বিপ্রহর
নিশি-কাজল!
সোল্লাস ঘোর
ঘোষে বিজয়-বাজ
গরজি আজ
দোলে সিং-বি-
ক্রীড়ে দোল।
(সিংহ-বিক্রীড় ছন্দে)
নাচায় প্রাণ রণোন্মাদ- বিজয়-গান, গগনময় মহোৎসব।
রবির পথ অরুণ-যান কিরণ-পথ ডুবায় মেঘ- মহার্ণব।
মেঘের ছায় শীতল কায় ঘুমায় থির দিঘির জল অথই থই।
তৃষায় ক্ষীণ ‘ফটিক জল’ ‘ফটিক জল’ কাঁদায় দিল চাতক ওই।
মাঠের পর সোহাগ-ঢল জলদ-দ্রব ছলাৎছল ছলাৎছল
পাহাড়-গায় ঘুমায় ঘোর অসিত মেঘ- শিশুর দল অচঞ্চল।
বিলোল-চোখ হরিণ চায় মেঘের গায়, চমক খায় গগন-কোল,
নদীর-পার চখির ডাক ‘কোয়াককো’ বনের বায় খাওয়ায় টোল।
স্বয়ম্ভূর সতীর শোক- ধ্যানোম্মাদ- নিদাঘ-দাব তপের কাল
নিশেষ আজ! মহেশ্বর উমার গাল চুমার ঘায় রাঙায় লাল।
(অনঙ্গশেখর ছন্দে)
এবার আমার বিলাস শুরু অনঙ্গশেখরে।
পরশ-সুখে শ্যামার বুকে কদম্ব শিহরে।
কুসুমেষুর পরশ-কাতর নিতম্ব-মন্থরা
সিনান-শুচি স-যৌবনা রোমাঞ্চিত ধরা।
ঘন শ্রোণির, গুরু ঊরুর, দাড়িম-ফাটার ক্ষুধা
যাচে গো আজ পরুষ-পীড়ন পুরুষ-পরশ-সুধা।
শিথিল-নীবি বিধুর বালা শয়ন-ঘরে কাঁপে,
মদন-শেখর কুসুম-স্তবক উপাধানে চাপে।
আমার বুকের কামনা আজ কাঁদে নিখিল জুড়ি,
বনের হিয়ায় তিয়াস জিয়ায় প্রথম কদম-কুঁড়ি।
শাখীরা আজ শাখায় শাখা পাখায় পাখায় বাঁধা,
কুলায় রচে, মনে শোনে শাবক শিশুর কাঁদা।
তাপস-কঠিন উমার গালে চুমার পিয়াস জাগে,
বধূর বুকে মধুর আশা কোলে কুমার মাগে!
তরুণ চাহে করুণ চোখে উদাসী তার আঁখি,
শোনে, কোথায় কাঁদে ডাহুক ডাহুকের ডাকি!
এবার আমার পথের শুরু তেপান্তরের পথে,
দেখি হঠাৎ চরণ রাঙা মৃণাল-কাঁটার ক্ষতে।
ওগো আমার এখনও যে সকল পথই বাকি,
মৃণাল হেরি মনে পড়ে কাহার কমল-আঁখি!
প্রতিবেশিনী
আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে চলত নিতুই সকাল-সাঁঝে।
আর এ পথে চলবে না সে সেই ব্যথা হায় বক্ষে বাজে।
আমার দ্বারের কাছটিতে তার ফুটত লালী গালের টোলে,
টলত চরণ, চাউনি বিবশ কাঁপত নয়ন-পাতার কোলে –
কুঁড়ি যেমন প্রথম খোলো গো!
কেউ কখনও কইনি কথা,
কেবল নিবিড় নীরবতা
সুর বাজাত অনাহতা
গোপন মরম-বীণার মাঝে।
মূক পথের আজ বুক ফেটে যায় স্মরি তারই পায়ের পরশ
বুক-খসা তার আঁচর-চুমু,
রঙিন ধুলো পাংশু হল, ঘাস শুকাল যেচে বাচাল
জোড়-পায়েলার রুমঝুমু!
আজও আমার কাটবে গো দিন রোজই যেমন কাটত বেলা,
একলা বসে শূন্য ঘরে – তেমনি ঘাটে ভাসবে ভেলা –
অবহেলা হেলাফেলায় গো!
শুধু সে আর তেমন কর
মন রবে না নেশায় ভরে
আসার আশায় সে কার তরে
সজাগ হয়ে সকল কাজে।
ডুকরে কাঁদে মন-কপোতী –
‘কোথায় সাথির কূজন বাজে?
সে পা-র ভাষা কোথায় রাজে?’
প্রিয়ার রূপ
অধর নিসপিস
নধর কিসমিস
রাতুল তুলতুল কপোল;
ঝরল ফুল-কুল,
করল গুল ভুল
বাতুল বুলবুল চপল।
নাসায় তিলফুল
হাসায় বিলকুল,
নয়ান ছলছল উদাস,
দৃষ্টি চোর-চোর
মিষ্টি ঘোর-ঘোর,
বয়ান ঢলঢল হুতাশ।
অলক দুলদুল
পলক ঢুল ঢুল,
নোলক চুম খায় মুখেই,
সিঁদুর মুখটুক
হিঙুল টুকটুক,
দোলক ঘুম যায় বুকেই।
ললাট ঝলমল
মলাট মলমল
টিপটি টলটল সিঁথির,
ভুরুর কায় ক্ষীণ
শুরুর নাই চিন,
দীপটি জ্বলজ্বল দিঠির।
চিবুক টোল খায়,
কী সুখ-দোল তায়
হাসির ফাঁস দেয় – সাবাস।
মুখটি গোলগাল,
চুপটি বোলচাল
বাঁশির শ্বাস দেয় আভাস।
আনার লাল লাল
দানার তার গাল,
তিলের দাগ তায় ভোমর;
কপোল-কোল ছায়
চপল টোল, তায়
নীলের রাগ ভায় চুমোর॥
বাদল-দিনে
১
আদর-গর-গর
বাদর দর-দর
এ-তনু ডর-ডর
কাঁপিছে থর-থর।
নয়ন ঢল-ঢল
সজল ছল-ছল,
কাজল কালো জল
ঝরে লো ঝরঝর।
২
ব্যাকুল বন-রাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে,
সজনি! মন আজি গুমরে মনে মনে।
বিদরে হিয়া মম
বিদেশে প্রিয়তম,
এ জনু পাখি সম
বরিষা-জরজর।
৩
কাহার ও মেঘোপরি গমন গম-গম?
সখী রে মরি মরি, ভয়ে গা ছম-ছম।
গগনে ঘন ঘন
সঘনে শোনো-শোনো
ঝনন রণরণ –
সজনি ধরো ধরো।
৪
জলদ-দামা বাজে জলদে তালে তালে,
কাজরি-নাচা নাচে ময়ূর ডালে ডালে।
শ্যামল মুখ স্মরি
সখিয়া বুক মোরি
উঠিছে ব্যথা ভরি
আঁখিয়া ভরভর।
৫
বিজুরি হানে ছুরি চমকি রহি রহি
বিধুরা একা ঝুরি বেদনা কারে কহি।
সুরভি কেয়া-ফুলে
এ হৃদি বেয়াকুলে,
কাঁদিছে দুলে দুলে
বনানী মর-মর।
৬
নদীর কলকল, ঝাউয়ের ঝল-মল,
দামিনী জ্বলজ্বল, কামিনী টল-মল।
আজি লো বনে বনে
শুধানু জনে জনে,
কাঁদিল বায়ুসনে
তটিনী তরতর।
৭
আদুরি দাদুরি লো কহো লো কহো দেখি,
এমন বাদরি লো ডুবিয়া মরিব কি?
একাকী এলোকেশে,
কাঁদিব ভালোবেসে,
মরিব লেখা-শেষে,
সজনি সরো সরো।
বিজয়িনী
হে মোর রাণি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী
দিনে দিনে ক্লানি- আনে, হ’য়ে ওঠে ভারী,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।
ওগো জীবন-দেবী।
আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তৃণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে’,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।।
বিধুরা পথিকপ্রিয়া
আজ নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো।
পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায় চাওয়া ছলছল?
বলো সখী বলো বলো
মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে,
ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি দূরের পথিক গেছে চলে –
আবার ফিরে আসবে বলে গো?
স্বর শুনে কার চমকে ওঠ? আ-হা!
ও লো ও যে বিহগ-বেহাগ নির্ঝরিণীর কল-কল।
ও নয় লো তার পায়ের ভাষা, আ-হা,
শীতের শেষের ঝরা-পাতার বিদায় ধ্বনি ও,
কোন কালোরে কোন ভালোরে বাসলে ভালো, আ-হা!
খুঁজছ মেঘে পরদেশি কোন পলাতকার নয়ন-অমিয়?
চুমছ কারে? ও নয় তোমার চির-চেনার চপল হাসির আলো-ছায়া,
ও যে গুবাক-তরুর চিকন পাতায় বাদল-চাঁদের মেঘলা মায়া।
ওঠো পথিক-পূজারিনি উদাসিনী বালা!
সে যে সবুজ-দেশের অবুঝ পাখি কখন এসে যাচবে বাঁধন,
কে জানে ভাই, ঘরকে চলো।
ও কী? চোখে নামল আবার বাদল-ছায়া ঢলঢল?
চলো সখি ঘরকে চলো।
বিবাগিনী
করেছ পথের ভিখারিনি মোরে কে গো সুন্দর সন্ন্যাসী?
কোন বিবাগির মায়া-বনমাঝে বাজে ঘরছাড়া তব বাঁশি?
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
তব প্রেমরাঙা ভাঙা জোছনা
হেরো শিশির-অশ্রু-লোচনা,
ওই চলিয়াছে কাঁদি বরষার নদী গৈরিকরাঙা-বসনা।
ওগো প্রেম-মহাযোগী, তব প্রেম লাগি নিখিল বিবাগি পরবাসী!
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
মম একা ঘরে নাথ দেখেছিনু তোমা ক্ষীণ দীপালোকে হীন করি,
হেরি বাহির আলোকে অনন্তলোকে এ কী রূপ তব মরি মরি!
দিয়া বেদনার পরে বেদনা
নাথ একী এ বিপুল চেতনা
তুমি জাগালে আমার রোদনে, অন্ধে দেখালে বিশ্ব-দ্যোতনা।
ওগো নিষ্ঠুর মোর! অশুভ ও-রূপ তাই এত বাজে বুকে আসি।
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
বেদনা-অভিমান
ওরে আমার বুকের বেদনা!
ঝঞ্ঝা-কাতর নিশীথ রাতের কপোত সম রে
আকুল এমন কাঁদন কেঁদো না।
কখন সে কার ভুবনভরা ভালোবাসা হেলায় হারালি,
তাইতো রে আজ এড়িয়ে চলে সকল স্নেহে পথে দাঁড়ালি!
ভিজে ওঠে চোখের পাতা তোর,
একটি কথায় – অভিমানী মোর!
ডুকরে কাঁদিস বাঁধনহারা, ‘ওগো, আমায় বাঁধন বেঁধো না’।
বাঁধন গৃহের সইল না তোর,
তাই বলে কি মায়াও ঘরের ডাক দেবে না তোকে?
অভিমানী গৃহহারা রে!
চললে একা মরুর পথেও
সাঁঝের আকাশ মায়ের মতন ডাকবে নত চোখে,
ডাকবে বধূ সন্ধ্যাতারা যে!
জানি ওরে, এড়িয়ে যারে চলিস তারেই পেতে চলিস পথে।
জোর করে কেউ বাঁধে না তাই বুক ফুলিয়ে চলিস বিজয়রথে।
ওরে কঠিন! শিরীষকোমল তুই!
মর্মর তোর মর্মে ছাপা বেল কামিনী জুঁই!
বুকপোরা তোর ভালবাসা, মুখে মিছে বলিস ‘সেধো না’।
আমার বুকের বেদনা।
দৌলতপুর, কুমিল্লা
জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮
বেদনা-মণি
একটি শুধু বেদনা মানিক আমার মনের মণিকোঠায়
সেই তো আমার বিজন ঘরে দুঃখ রাতের আঁধার টুটায়।
সেই মানিকের রক্ত-আলো
ভুলাল মোর মন ভুলাল গো।
সেই মানিকের করুণ কিরণ আমার বুকে মুখে লুটায়।
আজ রিক্ত আমি কান্না হাসির দাবি দাওয়ার বাঁধন ছিঁড়ে
ওই বেদনা-মণির শিখার মায়াই রইল একা জীবন ঘিরে।
এ কালফণী অনেক খুঁজি
পেয়েছে ওই একটি পুঁজি গো!
আমার চোখের জলে ওই মণিদীপ আগুন হাসির ফিনিক ফোটায়।
ব্যথা-নিশীথ
এই নীরব নিশীথ রাতে
শুধু জল আসে আঁখিপাতে।
কেন কি কথা স্মরণে রাজে?
বুকে কার হতাদর বাজে?
কোন্ ক্রন্দন হিয়া-মাঝে
ওঠে গুমরি’ ব্যর্থতাতে
আর জল ভরে আঁখি-পাতে।।
মম বর্থ জীবন-বেদনা
এই নিশীথে লুকাতে নারি,
তাই গোপনে একাকী শয়নে
শুধু নয়নে উথলে বারি।
ছিল সেদিনো এমনি নিশা,
বুকে জেগেছিল শত তৃষা
তারি ব্যর্থ নিশাস মিশা
ওই শিথিল শেফালিকাতে
আর পূরবীতে বেদনাতে।।
মনের মানুষ
ফিরনু যেদিন দ্বারে দ্বারে কেউ কি এসেছিল?
মুখের পানে চেয়ে এমন কেউ কি হেসেছিল?
অনেক তো সে ছিল বাঁশি,
অনেক হাসি, অনেক ফাঁসি,
কই কেউ কি ডেকেছিল আমায়, কেউ কি যেচেছিল?
ওগো এমন করে নয়ন-জলে কেউ কি ভেসেছিল?
তোমরা যখন সবাই গেলে হেলায় ঠেলে পায়ে,
আমার সকল সুধাটুকুন পিয়ে,
সেই তো এসে বুকে করে তুলল আপন নায়ে
আচমকা কোন্ না-চাওয়া পথ দিয়ে।
আমার যত কলঙ্কে সে
হেসে বরণ করলে এসে
আহা বুক-জুড়ানো এমন ভালো কেউ কি বেসেছিল?
ওগো জানত কে যে মনের মানুষ সবার শেষে ছিল।
মরমি
কোন মরমির মরম ব্যথা আমার বুকে বেদনা হানে,
জানি গো, সেও জানেই জানে।
আমি কাঁদি তাইতে যে তার ডাগর চোখে অশ্রু আনে,
বুঝেছি তা প্রাণের টানে।
বাইরে বাঁধি মনকে যত
ততই বাড়ে মর্ম-ক্ষত,
মোর সে ক্ষত ব্যথার মতো
বাজে গিয়ে তারও প্রাণে
কে কয়ে যায় হিয়ার কানে।
উদাস বায়ু ধানের খেতে ঘনায় যখন সাঁঝের মায়া,
দুই জনারই নয়ন-পাতায় অমনি নামে কাজল-ছায়া!
দুইটি হিয়াই কেমন কেমন
বদ্ধ ভ্রমর পদ্মে যেমন,
হায়, অসহায় মূকের বেদন
বাজল শুধু সাঁঝের গানে,
পুবের বায়ুর হুতাশ তানে।
মানস-বধূ
যেমন ছাঁচি পানের কচি পাতা প্রজাপতির ডানার ছোঁয়ায়,
ঠোঁট দুটি তার কাঁপন-আকুল একটি চুমায় অমনি নোয়ায়।
জল-ছলছল উড়ু-উড়ু চঞ্চল তার আঁখির তারা,
কখন বুঝি দেবে ফাঁকি সুদূর পথিক-পাখির পারা,
নিবিড় নয়ন-পাতার কোলে,
গভীর ব্যথার ছায়া দোলে,
মলিন চাওয়া (ছাওয়া) যেন দূরের সে কোন্ সবুজ ধোঁয়ায়।
সিঁথির বীথির খসে-পড়া কপোল-ছাওয়া চপল অলক
পলক-হারা, সে মুখ চেয়ে নাচ ভুলেছে নাকের নোলক।
পাংশু তাহার চূর্ণ কেশে,
মুখ মুছে যায় সন্ধে এসে,
বিধুর অধর-সীধু যেন নিঙড়ে কাঁচা আঙুর চোয়ায়।
দিঘল শ্বাসের বাউল বাজে নাসার সে তার জোড়-বাঁশিতে,
পান্না-ক্ষরা কান্না যেন ঠোঁট-চাপা তার চোর হাসি সে।
ম্লান তার লাল গালের লালিম,
রোদ-পাকা আধ-ডাঁশা ডালিম,
গাগরি ব্যথার ডুবায় কে তার টোল খাওয়া গাল-চিবুক-কুয়ায়।
চায় যেন সে শরম-শাড়ির ঘোমটা চিরি পাতা ফুঁড়ি,
আধফোঁটা বউ মউল-বউল, বোলতা-ব্যাকুল বকুল কুঁড়ি
বোল-ভোলা তার কাঁকন চুড়ি
ক্ষীরের ভিতর হিরের ছুরি,
দু-চোখ-ভরা অশ্রু যেন পাকা পিয়াল শালের ঠোঙায়।
বুকের কাঁপন হুতাশ-ভরা, বাহুর বাঁধন কাঁদন-মাখা,
নিচোল বুকের কাঁচল আঁচল স্বপন-পারের পরির পাখা।
খেয়াপারের ভেসে-আসা
গীতির মতো পায়ের ভাষা,
চরণ-চুমায় শিউরে পুলক হিমভেজা দুধ-ঘাসের রোঁয়ায়।
সে যেন কোন্ দূরের মেয়ে আমার কবিমানস-বধূ;
বুকপোরা আর মুখভার তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু।
নিশীথ-রাতের স্বপন হেন,
পেয়েও তারে পাইনে যেন,
মিলন মোদের স্বপন-কূলে কাঁদনভরা চুমায় চুমায়।
নামহারা সেই আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোঁয়ায়।
মুক্তি-বার
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার।
অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।
দিনের পরে দিন গিয়েছে, হয়নি আমার ছুটি,
বুকের ভিতর মৌন-কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি।
আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া,
লাগল চোখে তোমার চাওয়া,
তাই তো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।
তোমার তরে বুকের তলায়
অনেক দিনের অনেক কথা জমা,
কানের কাছে মুখটি থুয়ে
গোপন সে সব কইব প্রিয়তমা।
এবার শুধু কথায়-গানে রাত্রি হবে ভোর,
শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর।
তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি,
মলিন মুখে ফুটবে হাসি,
হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি করুণ ছবি তার।
রৌদ্রদগ্ধের গান
এবার আমার জ্যোতির্গেহে তিমির প্রদীপ জ্বালো।
আনো অগ্নিবিহীন দীপ্তিশিখার তৃপ্তি অতল কালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
নয়ন আমার তামস-তন্দ্রালসে
ঢুলে পড়ুক ঘুমের সবুজ রসে,
রৌদ্র-কুহুর দীপক-পাখা পড়ুক টুটুক খসে,
আমার নিদাঘদাহে অমামেঘের নীল অমিয়া ঢালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
মেঘে ডুবাও সহস্রদল রবি-কমলদীপ,
ফুটাও আঁধার-কদম-ঘুমশাখে মোর স্বপন মণিনীপ।
নিখিলগহন-তিমির তমাল গাছে
কালো কালার উজল নয়ন নাচে,
আলো-রাধা যে কালোতে নিত্য মরণ-যাচে –
ওগো আনো আমার সেই যমুনার জলবিজুলির আলো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
দিনের আলো কাঁদে আমার রাতের তিমির লাগি
সেথায় আঁধার-বাসরঘরে তোমার সোহাগ আছে জাগি।
ম্লান করে দেয় আলোর দহন-জ্বালা
তোমার হাতের চাঁদ-প্রদীপের থালা,
শুকিয়ে ওঠে তোমার তারা-ফুলের গগন-ডালা।
ওগো অসিত আমার নিশীথ-নিতল শীতল কালোই ভালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
সমস্তিপুরের ট্রেন-পথে
ফাল্গুন ১৩৩০
[কার্তিক ১৩২৯]
লক্ষীছাড়া
আমি নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন।
শেষে সে-ই আমারে কাঁদায়, যারে করি আপনারই জন।
দূর হতে মোর বাঁশির সুরে
পথিক-বালার নয়ন ঝুরে
তার ব্যথায়-ভরাট ভালোবাসায় হৃদয় পুরে গো!
তারে যেমনি টানি পরান-পুটে
অমনি সে হায় বিষিয়ে উঠে!
তখন হারিয়ে তারে কেঁদে ফিরি সঙ্গীহারা পথটি আবার নিজন।
মুগ্ধা ওদের নেই কোনো দোষ, আমিও ওগো ধরা দিয়ে মরি,
প্রেম-পিয়াসি প্রণয়ভুখা শাশ্বত যে আমিই তৃপ্তিহারা,
ঘরবাসীদের প্রাণ যে কাঁদে পরবাসীদের পথের ব্যথা স্মরি
তাইতো তারা এই উপোসির ওষ্ঠে ধরে ক্ষীরের থালা,
শান্তিবারিধারা।
ঘরকে পথের বহ্নিঘাতে
দগ্ধ করি আমার সাথে,
লক্ষ্মী ঘরের পলায় উড়ে এই সে শনির দৃষ্টিপাতে গো!
জানি আমি লক্ষ্মীছাড়া
বারণ আমার উঠান মাড়া,
আমি তবু কেন সজল চোখে ঘরের পানে চাই?
নিজেই কি তা জানি আমি ভাই?
হায় পরকে কেন আপন করে বেদন পাওয়া, পথেই যাহার
কাটবে জীবন বিজন?
আর কেউ হবে না আপন যখন, সব হারিয়ে চলতে হবে
পথটি আমার নিজন।
আমি নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন।
শায়ক-বেঁধা পাখী
রে নীড়-হারা, কচি বুকে শায়ক-বেঁধা পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
কোথায় রে তোর কোথায় ব্যথা বাজে?
চোখের জলে অন্ধ আঁখি কিছুই দেখি না যে?
ওরে মাণিক! এ অভিমান আমায় নাহি সাজে-
তোর জুড়াই ব্যথা আমার ভাঙা বক্ষপুটে ঢাকি’।
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী,
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
বক্ষে বিঁধে বিষ মাখানো শর,
পথ-ভোলা রে! লুটিয়ে প’লি এ কা’র বুকের’ পর!
কে চিনালে পথ তোরে হায় এই দুখিনীর ঘর?
তোর ব্যথার শানি- লুকিয়ে আছে আমার ঘরে নাকি?
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
হায়, এ কোথায় শানি- খুঁজিস্ তোর?
ডাক্ছে দেয়া. হাঁকছে হাওয়া, কাঁপছে কুটীর মোর!
ঝঞ্ঝাবাতে নিবেছে দীপ, ভেঙেছে সব দোর,
দুলে দুঃখ রাতের অসীম রোদন বক্ষে থাকি’ থাকি’!
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
এমন দিনে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
মরণ যে বাপ বরণ করে তারে,
‘মা’ ‘মা’ ডেকে যে দাঁড়ায় এই শক্তিহীনার দ্বারে!
মাণিক আমি পেয়ে শুধু হারাই বারে বারে,
ওরে তাই তো ভয়ে বক্ষ কাঁপে কখন দিবি ফাঁকি!
ওরে আমার হারামণি! ওরে আমার পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
হারিয়ে পাওয়া ওরে আমার মাণিক!
দেখেই তোরে চিনেছি, আয়, বক্ষে ধরি খানিক!
বাণ-বেঁধা বুক দেখে তোরে কোলে কেহ না নিক,
ওরে হারার ভয়ে ফেলতে পারে চিরকালের মা কি?
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি।
এ যে রে তোর চির-চেনা স্নেহ,
তুই তো আমার ন’সরে অতিথ্ অতীত কালের কেহ,
বারে বারে নাম হারায়ে এসেছিস এই গেহ,
এই মায়ের বুকে থাক যাদু তোর য’দিন আছে বাকী!
প্রাণের আড়াল ক’রতে পারে সৃজন দিনের মা কি?
হারিয়ে যাওয়া? ওরে পাগল, সে তো চোখের ফাঁকি!
শেষের গান
আমার বিদায়-রথের চাকার ধ্বনি ওই গো এবার কানে আসে।
পুবের হাওয়া তাই কেঁদে যায় ঝাউয়ের বনে দিঘল শ্বাসে।
ব্যথায় বিবশ গুলঞ্চ ফুল
মালঞ্চে আজ তাই শোকাকুল,
মাটির মায়ের কোলের মায়া ওগো আমার প্রাণ উদাসে।
অঙ্গ আসে অলস হয়ে নেতিয়ে-পড়া অলস ঘুমে,
স্বপনপারের বিদেশিনীর হিম-ছোঁয়া যায় নয়ন চুমে।
হাতছানি দেয় অনাগতা,
আকাশ-ডোবা বিদায়-ব্যথা
লুটায় আমার ভুবন ভরি বাঁধন ছেঁড়ার কাঁদন-ত্রাসে।
মোর বেদনার কপূর্রবাস ভরপুর আজ দিগ্বলয়ে,
বনের আঁধার লুটিয়ে কাঁদে হরিণটি তার হারার ভয়ে।
হারিয়ে পাওয়া মানসী হায়
নয়নজলে শয়ন তিতায়,
ওগো, এ কোন্ জাদুর মায়ায় দু-চোখ আমার জলে ভাসে।
আজ আকাশ-সীমায় শব্দ শুনি অচিন পায়ের আসা-যাওয়ার,
তাই মনে হয় এই যেন শেষ আমার অনেক দাবি-দাওয়ার।
আজ কেহ নাই পথের সাথি,
সামনে শুধু নিবিড় রাতি,
আমায় দূরের বাঁশি ডাক দিয়েছে, রাখবে কে আর বাঁধন-পাশে।
কলিকাতা
শ্রাবণ ১৩২৮
সন্ধ্যাতারা
ঘোম্টা-পরা কাদের ঘরের বৌ তুমি ভাই সন্ধ্যাতারা?
তোমার চোখে দৃষ্টি জাগে হারানো কোন্ মুখের পারা।।
সাঁঝের প্রদীপ আঁচল ঝেঁপে
বঁধুর পথে চাইতে বেঁকে
চাউনিটি কার উঠছে কেঁপে
রোজ সাঁঝে ভাই এমনি ধারা।।
কারা হারানো বধূ তুমি অস-পথে মৌন মুখে
ঘনাও সাঁঝে ঘরের মায়া গৃহহীনের শূন্য বুকে।
এই যে নিতুই আসা-যাওয়া,
এমন কর”ণ মলিন চাওয়া,
কার তরে হায় আকাশ-বধু
তুমিও কি আজ প্রিয়-হারা।।
স্তব্ধ বাদল
ওই নীল-গগনের নয়ন-পাতায়
নামল কাজল-কালো মায়া।
বনের ফাঁকে চমকে বেড়ায়
তারই সজল আলোছায়া।
ওই তমাল তালের বুকের কাছে
ব্যথিত কে দাঁড়িয়ে আছে
দাঁড়িয়ে আছে।
ভেজা পাতায় ওই কাঁপে তার
আদুল ঢলঢল কায়া।
যার শীতল হাতের পুলক-ছোঁয়ায়
কদমকলি শিউরে ওঠে,
জুইকুঁড়ি সব নেতিয়ে পড়ে
কেয়াবধূর ঘোমটা টুটে।
আহা! আজ কেন তার চোখের ভাষা
বাদল-ছাওয়া ভাসা-ভাসা –
জলে-ভাসা?
দিগন্তরে ছড়িয়েছে সেই
নিতল আঁখির নীল আবছায়া।
ও কার ছায়া দোলে অতল কালো
শালপিয়ালের শ্যামলিমায়?
আমলকি-বন থামল ব্যথায়
থামল কাঁদন গগন-সীমায়।
আজ তার বেদনাই ভরেছে দিক,
ঘরছাড়া হায় এ কোন পথিক,
এ কোন পথিক?
এ কীস্তব্ধতারই আকাশ-জোড়া
অসীম রোদন-বেদন-ছায়া।
স্নেহ-ভীতু
ওরে এ কোন্ স্নেহ-সুরধুনী নামল আমার সাহারায়?
বক্ষে কাঁদার বান ডেকেছে, আজ হিয়া কূল না হারায়!
কণ্ঠে চেপে শুষ্ক তৃষা
মরুর সে পথ তপ্ত সিসা,
চলতে একা পাইনি দিশা ভাই;
বন্ধ নিশাস – একটু বাতাস!
এক ফোঁটা জল জহর-মিশা! –
মিথ্যা আশা, নাই সে নিশানাই!
হঠাৎ ও কার ছায়ার মায়া রে? –
যেন ডাক-নামে আজ গাল-ভরা ডাক ডাকছে কে ওই মা-হারায়!
লক্ষ যুগের বক্ষ-ছাপা তুহিন হয়ে যে ব্যথা আর কথা ছিল ঘুমা,
কে সে ব্যথায় বুলায় পরশ রে? –
ওরে গলায় তুহিন কাহার কিরণতপ্ত সোহাগ-চুমা?
ওরে ও ভূত, লক্ষ্মীছাড়া,
হতভাগা, বাঁধনহারা।
কোথায় ছুটিস! একটু দাঁড়া, হায়!
ওই তো তোরে ডাকচে স্নেহ,
হাতছানি দেয় ওই তো গেহ,
কাঁদিস কেন পাগল-পারা তায়?
এত ডুকরে কিসের তিক্ত কাঁদন তোর?
অভিমানি! মুখ ফেরা দেখ যা পেয়েচিস তাও হারায়!
হায়, বুঝবে কে যে স্নেহের ছোঁয়ায় আমার বাণী রা হারায়।
দেওঘর
পৌষ ১৩২৭
হার-মানা-হার
তোরা কোথা হতে কেমনে এসে
মণি-মালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি।
আমার পথিক-জীবন এমন করে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।
আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে
তারা হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে,
তোরা কেমন করে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে
ওই কচি বাহুর রেশমি ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে!
তোরা চলতে গেলে পায়ে জড়াস,
‘না’ ‘না’ বলে ঘাড়টি নড়াস,
কেন ঘর-ছাড়াকে এমন করে
ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি।
ওরে চোখে তোদের জল আসে না–
চমকে ওঠে আকাশ তোদের
চোখের মুখের চপল হাসিতে।
ওই হাসিই তো মোর ফাঁসি হল,
ওকে ছিঁড়তে গেলে বুকে লাগে,
কাতর কাঁদন ছাপা যে ও হাসির রাশিতে!
আমি চাইলে বিদায় বলিস, ‘উঁহু,
ছাড়ব নাকো মোরা’
ওই একটু মুখের ছোট্ট মানাই এড়িয়ে যেতে নারি,
কত দেশ-বিদেশের কান্নাহাসির
বাঁধনছেঁড়ার দাগ যে বুকে পোরা,
তোরা বসলি রে সেই বুক জুড়ে আজ,
চিরজয়ীর রথটি নিলি কাড়ি।
ওরে দরদিরা! তোদের দরদ
শীতের বুকে আনলে শরৎ,
তোরা ঈষৎ-ছোঁয়ায় পাথরকে আজ
কাতর করে অশ্রুভরা ব্যথায় ভরালি।
দৌলতপুর, কুমিল্লা
বৈশাখ ১৩২৮
হারামণি
এমন করে অঙ্গনে মোর ডাক দিলি কে স্নেহের কাঙালি!
কে রে ও তুই কে রে?
আহা ব্যথার সুরে রে,
এমন চেনা স্বরে রে,
আমার ভাঙা ঘরের শূন্যতারই বুকের পরে রে।
এ কোন পাগল স্নেহ-সুরধুনীর আগল ভাঙালি?
কোন্ জননির দুলাল রে তুই, কোন্ অভাগির হারামণি,
চোখ-ভরা তোর কাজল চোখে রে
আহা ছলছল কাঁদন চাওয়ার সজল ছায়া কালো মায়া
সারাখনই উছলে যেন পিছল ননি রে!
মুখভরা তোর ঝরনাহাসি
শিউলি সম রাশি রাশি
আমার মলিন ঘরের বুকে মুখে লুটায় আসি রে!
বুক-জোড়া তোর ক্ষুদ্ধ স্নেহ দ্বারে দ্বারে কর হেনে যে যায়
কেউ কি তারে ডাক দিল না? ডাকল যারা তাদের কেন
দলে এলি পায়?
কেন আমার ঘরের দ্বারে এসেই আমার পানে চেয়ে এমন
থমকে দাঁড়ালি?
এমন চমকে আমায় চমক লাগালি?
এই কি রে তোর চেনা গৃহ, এই কিরে তোর চাওয়া স্নেহ হায়!
তাই কি আমার দুখের কুটির হাসির গানের রঙে রাঙালি?
হে মোর স্নেহের কাঙালি।
এ সুর যেন বড়োই চেনা, এ স্বর যেন আমার বাছার,
কখন সে যে ঘুমের ঘোরে হারিয়েছিনু হয় না মনে রে!
না চিনেই আজ তোকে চিনি, আমারই সেই বুকের মানিক,
পথ ভুলে তুই পালিয়ে ছিলি সে কোন ক্ষণে সে কোন বনে রে!
দুষ্টু ওরে, চপল ওরে, অভিমানী শিশু!
মনে কি তোর পড়ে না তার কিছু?
সেই অবধি জাদুমণি কত শত জনম ধরে
দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে রে,
আমি মা-হারা সে কতই ছেলের কতই মেয়ের
মা হয়ে বাপ খুঁজেছি তোরে!
দেখা দিলি আজকে ভোরে রে!
উঠছে বুকে হাহা ধ্বনি
আয় বুকে মোর হারামণি,
আমি কত জনম দেখিনি যে ওই মু-খানি রে!
পেটে-ধরা নাই বা হলি, চোখে ধরার মায়াও নহে এ,
তোকে পেতেই জন্ম জন্ম এমন করে বিশ্ব-মায়ের
ফাঁদ পেতেছি যে!
আচমকা আজ ধরা দিয়ে মরা-মায়ের ভরা-স্নেহে হঠাৎ জাগালি।
গৃহহারা বাছা আমার রে!
চিনলি কি তুই হারা-মায়ে চিনলি কি তুই আজ?
আজকে আমার অঙ্গনে তোর পরাজয়ের বিজয়-নিশান
তাই কি টাঙালি?
মোর স্নেহের কাঙালি।
দৌলতপুর, কুমিল্লা
জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮